রংধনুর রঙ কালো পর্ব ৩৫

#রংধনুর_রঙ_কালো
৩৫.

রাতটা না ঘুমিয়েই কাটলো অরিনের। সকালে ঘুম ভাঙার পর সুমনাকে ইলহানের খুন করার বিষয়ে আবার জিজ্ঞেস করলে সে কোনো উত্তর দেয় না। চোরা চোখে পালিয়ে যায়। আসলে এই ব্যাপারটা অরিনের কাছে গোপন রাখার কথা ছিল। অর্ণভও এই কথা জানে। কিন্তু অরিনকে জানায়নি। সুমনা ঘুমের ঘোরে বলে ফেলেছে। ঘুমন্ত অবস্থায় তার হুশ-জ্ঞান ঠিক থাকে না। অরিন বিস্তারিত সত্যি জানার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছিল। সামনে যাকেই পাচ্ছে তাকেই জিজ্ঞেস করছে, ইলহান কেনো খুন করেছে? কাকে খুন করেছে? কিন্তু মানুষ অরিনের প্রশ্নের উত্তর দিতে নারাজ। যাকেই অরিন এই প্রশ্ন করছে সে-ই এড়িয়ে যাচ্ছে। অবশেষে দুইতলা থেকে একটা পিচ্চি মেয়ে এসে বলল,
” আন্টি, আপনাকে শ্যান আন্টি উপরে যেতে বলেছে।”
অরিন পিচ্চিটার কথামতো উপরে গেল। ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল শ্যানিন। তার চোখে চশমা, চুলে উপুড় করে হাত খোপায় বাধা। একটা ঢোলা টপ পড়ে আছে সে। অরিন নিজের পিঠ ভর্তি হাইলাইট করা চুল একপাশে এনে জিজ্ঞেস করল,” কেমন আছিস?”
শ্যানিন সরাসরি অরিনের দিকে তাকিয়ে বলল,” তুই কেমন আছিস?”
অরিনের ভেতর থেকে একটা অভিমানী বাতাস আছড়ে পড়ল,” কাল আমাকে দেখে মুখের উপর দরজা আটকে দিয়েছিলি। আর এখন জিজ্ঞেস করছিস কেমন আছি?”
শ্যানিন একহাতে অরিনকে কাছে এনে বলল,” কিছু মনে করিস না। আমার আসলে তখন কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। পরিবারের কি অবস্থা দেখছিসই তো। মন-মেজাজ কি ঠিক থাকার কথা? তুই আবার মনে করিস না যে তোর উপর রেগে আছি। আমরা কেউ তোর উপর রেগে নেই।”
” মা-ও আমার সাথে কথা বলেনি। সাদিকাকে পরিচয় করাতে নিয়েছিলাম। মা সাদিকাকে দেখেও কিচ্ছু বলল না জানিস? আমার খুব খারাপ লেগেছে।”
” মায়ের কথা আর বলিস না। মায়ের মাথা ঠিক নেই। আমার সাথে কত খারাপ ব্যবহার করে জানিস? ইদানীং তো মা পাগলই হয়ে গেছে। আমিও পাগল হয়ে যাবো মনে হয়। বাবা তো চলে গিয়ে বেঁচে গেল। একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। ভাইয়ার শেষ পরিণতি বাবাকে নিজচোখে দেখতে হবে না। বাবা এটা সহ্য করতে পারতো না রে! এজন্যই হয়তো মহান আল্লাহ বাবাকে আগে নিয়ে গেছেন।”
শ্যানিনের কণ্ঠে কান্নারচোট। অরিন শ্যানিনের মুখের কাছে ঝুঁকে প্রশ্ন করল,” এই শ্যানিন, বল না। ইলহান কি আসলেই খুন করেছে? এটা কি সত্যি?”
শ্যানিন ধীরে-ধীরে হ্যাঁবোধক মাথা নাড়ল। অরিন আবার কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। এরপর হঠাৎ ব্যগ্র হয়ে বলল,” ওর কি ফাসি হবে?”
” খুন করলে তো ফাসি হওয়াই উচিৎ। ”
” কিন্তু ও কাকে খুন করেছে? কেনো খুন করেছে? ও কি খুন করতে পারে?”
শ্যানিন অরিনের কাঁধে হাত রেখে বলল,” সে অনেক ঘটনা। আরেকদিন বলবো।”
” না এখনি বল!”
অরিনের অধৈর্য্য কণ্ঠ।
” প্লিজ!”
শ্যানিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” আচ্ছা, ভেতরে আয়।”

অরিনের কাছে ডিভোর্স পেপার পাওয়ার পর ইলহান বাংলাদেশে ফিরে এসেছিল। শ্যানিন তখনও কানাডায়। ভাইয়া আর অরিনের বিবাহ-বিচ্ছেদের ঘটনা শুনেই সে ইমারজেন্সীতে বাংলাদেশে চলে আসে। কারণ ইলহানের অবস্থা তখন খুবই খারাপ। সে কারো সাথে কথা বলতো না, নিজেকে পুরো ঘরবন্দী করে ফেলেছিল। আর অদ্ভুত ব্যাপার, রাত হলেই সে কারো সাথে কথা বলতো। মোবাইলে না, আয়নায় তাকিয়ে কথা বলতো। হয়তো দিনের বেলাতেও বলতো। কিন্তু রাতে সবকিছু নীরব থাকায় তার কথাগুলো স্পষ্ট শোনা যেতো। নুসাইবা অরিনের সাথে যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করলেন। কিন্তু অরিনের কোনো খোঁজ নেই। মেয়েটা পুরো লাপাত্তা। ইলহানের সাথে সে অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে আসেনি। ইলহানও অরিনের ব্যাপারে কিছু বলছে না। অরিনের মা-বাবাও মেয়েকে খুঁজতে খুঁজতে মরিয়া হয়ে যাচ্ছেন। তাদের সাথেও তখন অরিনের যোগাযোগ হয়নি। অবশেষে আমানত সাহেবের থেকে জানা গেল, অন্বয়-অরিন বিয়ে করে ফেলেছে। শুধু তাই না, অরিন এখন প্রেগন্যান্ট। সে অন্বয়ের বাচ্চার মা হবে। এইসব শুনে নুসাইবা ঘৃণায় আর রাগে শিউরে উঠলেন। শায়িখ সাহেব আমানত সাহেবের সাথে বন্ধুত্ব ছিন্ন করলেন। এতোবড় বিশ্বাসঘাতকতার জন্য অরিনকে তারা মন থেকে ঘৃণা করতে লাগলেন। অরিনের বাড়ি গিয়ে নুসাইবা ঝগড়া-বিবাদ শুরু করলেন। ওই মেয়েটার জন্যই আজকে তার ছেলেটার এই অবস্থা। কোন মা সহ্য করবে এই অনাচার? তারপর একদিন ইলহান নিজেই সবকিছু স্বীকার করল। সে অরিনের সাথে যত অন্যায় করেছে, মা-বাবা এবং বোনকে সব পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিল। কিছুই গোপন রাখল না। তার স্বীকারোক্তিতে একফোঁটা মিথ্যে ছিল না। সবই সত্যি বলেছিল সে। নিজের অপরাধের জন্য বাবা-মায়ের কাছে ক্ষমাও চেয়েছিল। ইলহানের পরিবার তাকে নির্দ্বিধায় ক্ষমা করে দিল। কারণ পরিস্থিতিটাই এতো করুণ ছিল যে তখন ওইসব ব্যাপার কিছুই মনে হচ্ছিল না। ইলহান যতটা কষ্ট পাচ্ছিল সেই তুলনায় তার পাপটাকেও ঠুনকো মনে হচ্ছিল। এর চেয়ে যদি অরিন ইলহানকে মেরে ফেলতো, তাও ভালো ছিল। এতোবড় শাস্তি সে ইলহানকে কিভাবে দিল? সবাই ইলহানকে ক্ষমা করল কিন্তু অরিন কেন ক্ষমা করতে পারল না? ইলহান তার ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়েছিল। সে অরিনের কাছে ক্ষমা চাইতেও গিয়েছিল। কিন্তু অরিন ক্ষমা করেনি। উল্টো সেদিন অন্বয়কে দিয়ে ইলহানকে বীভৎসভাবে মার খাওয়িয়ে আহত করেছিল। রাস্তার মানুষ যদি সময়মতো তাকে হসপিটালে না নিতো, তাহলে আজকে ইলহান মা-বাবার কাছে ফিরে আসতে পারতো না। তার মৃত্যুর খবর তার মা-বাবা জানতেও পারতো না। অথচ এই কথা কেউ জানলো না সেদিন অরিন নিজেই ইলহানকে হসপিটালে নিয়েছিল। আর হসপিটাল কর্তৃপক্ষকে এই কথা গোপন রাখতে বলা হয়েছিল। অন্বয় যখন ইলহানের কাছে অরিনের সাইন করে দেওয়া ডিভোর্স পেপার নিয়ে এসেছিল তখন বলেছিল, সে আর অরিন বিয়ে করবে। তারা দুজনই দুজনকে ভালোবাসে। আর অরিনই চায় অন্বয়কে বিয়ে করতে। এই কথা জানার পর ইলহান আর অরিনকে বিরক্ত করেনি। জীবনে তো সে অনেক কষ্ট দিয়েছে অরিনকে। এখন যদি অরিন অন্যকারো কাছে সুখ খুঁজতে যায় তাহলে ইলহানের বাঁধা দেওয়ার অধিকার নেই। এতোদিন অন্বয়কে ইলহান সহ্য করতে পারতো না কারণ তার বিশ্বাস ছিল, অরিন কখনও অন্বয়কে ভালোবাসেনি। সবকিছুর পরেও অরিন শুধু ইলহানকেই ভালোবাসে। কিন্তু সেদিন যখন ইলহান ক্ষমা চাইতে গেল আর অরিন অন্বয়কে পাঠালো ইলহানকে মারার জন্য, তখন সত্যি ইলহানের পরিচিত পৃথিবীটা পাল্টে গেছিল। এর কিছুদিন পরেই অরিন ডিভোর্স পেপার পাঠাল ইলহানের কাছে। তখন ইলহান পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে গেল যে অরিন আর তাকে ভালোবাসে না। সে চিরজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলেছে অরিনকে। অরিন- অন্বয়ের বিয়ের কথা শুনে ইলহানের জীবন অর্থহীন মনে হচ্ছিল। এরপর থেকেই তার অভিশপ্ত জীবনের সূচনা।

এ পর্যায়ে অরিন বলল,” তার মানে ইলহান সাদিকার আসল পরিচয় জানে না?”
শ্যানিন চোখের জল মুছে বলল,” উহুম।”
” তাহলে সে সাদিকাকে এতো আদর করছে কেনো? কালরাতে আমি যখন ঘুমিয়ে ছিলাম সাদিকাকে ঘর থেকে নিয়ে গেছিল জানিস? আজকেও সকাল থেকে সাদিকা ওর কাছে। ও কেনো অন্বয়ের মেয়েকে কোলে নিয়ে ঘুরছে? ”
” ইলহান ভাইয়ার কাছে সাদিকা তোর মেয়ে। এজন্যই হয়তো আদর করছে। তুই তো জানিস, ভাইয়ার মেয়ে বাচ্চার খুব শখ ছিল।”
অরিন ডানহাত মুখে ঠেকালো। সে ভাবতেই পারছে না তার বিরুদ্ধে এতোবড় মিথ্যে প্রচার করেছিল অন্বয়। কিন্তু অন্বয় এটা কেনো করল? এজন্যই তো সবাই তাকে এতো ঘৃণা করছে। তার বাবার মতো শ্বশুরও নিশ্চয়ই তার প্রতি এই ভুল ধারণা নিয়েই মারা গেছেন। ইশশ! শায়িখ সাহেবকে সত্যি কথাটা সে আর কোনোদিন জানাতে পারবে না।অরিনের খুব খারাপ লাগছে। এই পৃথিবীটা আসলে বিশ্বাসের অযোগ্য। কাউকে বিশ্বাস করে শান্তি নেই। সবাই বিশ্বাস ভাঙতে ওস্তাদ। অন্বয়ের প্রতি বিতৃষ্ণায় অরিনের বুক ভার হয়ে আসছিল। অরিন কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,” শ্যানিন, আমি কিন্তু অন্বয়সাহেবকে বিয়ে করিনি বিশ্বাস কর। সাদিকা অন্বয়ের মেয়ে না। ও তোর ভাইয়েরই মেয়ে।”
শ্যানিন বলল,” জানি আমি। কিন্তু এই কথা আমি মাত্র কয়েকদিন আগে জানতে পেরেছি। ভাইয়া আর মাকে এখনও জানানো হয়নি।”
” কেনো জানানো হয়নি? আমি এখনই জানাতে চাই।”
অরিন উঠতে নিচ্ছিল তখনি শ্যানিন ওর হাত চেপে ধরে বলল,
” প্লিজ অরিন, বোস। দোহাই লাগে ভাইয়াকে এইসব জানাবি না। আর তুইও ভাইয়ার সাথে কথা বলিস না প্লিজ। অনেক দেরি হয়ে গেছে এখন। ভাইয়ার হাতেও সময় নেই। কি দরকার পিছুটান তৈরী করার? এখন আফসোস ছাড়া তো আর কিছুই হবে না। ভাইয়া যদি এখন জানতে পারে, সাদিকা তারই মেয়ে আর তুইও বিয়ে করিসনি তাহলে কি তার মরতে ইচ্ছে করবে বল? তার তো আবার বাঁচতে ইচ্ছে করবে। আমি চাই না আমার ভাইয়ের নতুন করে বাঁচার ইচ্ছে জাগুক। কারণ এই এই ইচ্ছে পূরণ অসম্ভব। আর যে ইচ্ছে পূরণ করা অসম্ভব সেই ইচ্ছে জাগতে দেওয়াও উচিৎ না। ভাইয়া তো চাইলেও আর বাঁচতে পারবে না। তার মৃত্যুর মাত্র কিছু সময় বাকি! এই কিছুসময়ে আফসোসের বোঝা বাড়িয়ে তার মৃত্যুটাকে কঠিন করে তোলার কোনো মানে হয় না।”
শ্যানিন কথা বলতে বলতে ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠল। অরিন শ্যানিনের মাথাটা বুকে জড়িয়ে ধরল। মনে মনে অরিনের ভয়ংকর কষ্ট হচ্ছে! ভয়ংকর! অনেকক্ষণ পর অরিন ব্যাকুল কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
” ইলহান কেনো খুন করেছিল?”

চলবে

– Sidratul Muntaz

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here