#সমাপ্তির_পূর্ণতা
লেখনীতে: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-১০ (সমাপ্তির পূর্ণতা)
পুলিশ শিমুকে নিয়ে যাবার পরে, অদ্রি বিভানের কাছে যায়। বিভান তখন তার ভাইয়ের পাশে বসে আছে। অদ্রি যখন বিভানের সামনে এসে দাঁড়ায় তখন ইভান বিভানকে ইশারায় বলে উঠে যেতে। বিভান অদ্রিকে নিয়ে করিডোরের এক কোণে গিয়ে দাঁড়ায়।
–কেমন আছো বিভান?
অদ্রির প্রশ্নে বিভানের ইচ্ছা করছে চিৎকার করে বলতে, “ভাল নেই আমি অদ্রি। তোমাকে ছাড়া আমি একদম ভালো নেই। ” কিন্তু ওই যে নিজের অক্ষমতা! সেটার জন্য হলেও এখন সে অদ্রিকে ছাড়তে রাজি।
–কি হলো, কথার জবাব দিলে না?
–কি জবাব দেবো? দেখতেই পারছো, কেমন আছি।
–হুম। কোনো কিছু নিয়ে নিজেকে দোষারোপ করবে না। হতেও পারে, যা আমরা দেখছি তা চোখের ভুল!
বিভান মলিন চোখে তাকায় অদ্রির দিকে। অদ্রি বিভানের দিকে নমনীয় চোখে তাকিয়ে বলে,
–আমার সমাপ্তির পূর্ণতা তুমি। তুমি হিনা আমি অন্য কাউকে আমার জীবনে জড়াইনি এবং জড়াবো না। ঠিক তেমনি তোমার জীবনেও আমি ছাড়া অন্য কাউকে জড়াতে দেবো না।
বিভান জড়িয়ে নেয় তার প্রিয়তমাকে নিজের উষ্ণ আলিঙ্গনে।
সমাপ্তির পূর্ণতা
অদ্রি রহমান
_______________________________________________
এতোক্ষন পার্কে অদ্রির পাশে বসেই মিসেস রেহনুমা অদ্রির লিখা বইটা পড়ছিল। অদ্রিরা আমেরিকায় যেখানে এখন থাকে সেই বাড়ির পাশেই একটা খোলা পার্ক আছে। মিসেস রেহনুমা সেও বাংলাদেশি এবং এখন অদ্রির প্রতিবেশী। অদ্রীর লেখা বইটা পড়ে সে অদ্রিকে মুগ্ধতার সাথে বলে,
–মিসেস অদ্রি, আপনার লেখা বইটা সত্যিই অসাধারণ। বইটা পড়ে আমার একবারের জন্যও মনে হচ্ছিল না যে, আমি কোন গল্প পড়ছি! মনে হচ্ছিল বাস্তব কাহিনী আমি নিজের চোখের সামনে ঘটতে দেখছি। প্রতিটা চরিত্র এতটাই জীবন্ত!
অদ্রি মিসেস রেহনুমার দিকে মুচকি হাসি দিয়ে অদূরে তার স্বামী-সন্তানের দিকে নজর দেয়। কি সুন্দর খেলছে বাপ-মেয়ে মিলে। নিজের মেয়েটাকে দেখলে নিজেরি প্রতিচ্ছবি মনে হয়। বাবার মতো কিছুটা দেখতে হলেও স্বভাব-চরিত্র পেয়েছে পুরোটাই মায়ের মতো!
মিসেস রেহনুমা আবারো অদ্রিকে বলে,
–মিসেস অদ্রি! কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন থেকেই যায়।
অদ্রি বুঝতে পারে মিসেস রেহনুমা কি বলবে। তাই সে ভাবলেশহীন ভাবে বলে,
–এটাই তো যে, বিভানকে ওই ড্রাগের অ্যান্টিডোট দেওয়া হয়েছিল কিনা?
মিসেস রেহনুমা অবাক হয়ে মাথা হ্যাঁ বোধক দুলায়। এরপর কৌতূহলবশত বলে,
–আপনি কিভাবে বুঝলেন, আমি এটার কথাই বলবো?
অদ্রি রহস্য করে হাসে তারপর আকাশপানে নজর দেয়। আমেরিকার আকাশ এখন রক্তিম। রাতের দিকে ঠান্ডা পরবে। এখন যেহেতু পড়ন্ত বিকাল বেলা সূর্য পশ্চিমাকাশে ডুবায়মান হালকা শীত শীত লাগছে। মেয়েকে বিভান দৌড়ে ধরার চেষ্টা করছে হাতে তার পশমি বেবি সুয়েটার। চার বছর হলো সবে অদ্রি ও বিভানের মেয়ে অবনীর।
অদ্রি আকাশপানে দৃষ্টি স্থির রেখে বলে,
–গল্পটা অসম্পূর্ণ। গল্পের সমাপ্তিতে আমি ইচ্ছে করেই অসম্পূর্ণ রেখেছি যাতে বাকিটা পাঠক নিজের মতো বুঝে নেয়।
মিসেস রেহনুমা কিছু বুঝতে না পেরে বলে,
–তবে আমার তো মিলছে না!
অদ্রি হেসে মিসেস রেহনুমার দিকে ফিরে বলে,
–মিলালেই মিলে যাবে। আর হবে #সমাপ্তির_পূর্ণতা।
অদ্রি সেখান থেকে উঠে চলে যায় তার প্রিয়জনদের কাছে। হাতে তার নিজের লিখা “সমাপ্তির পূর্ণতা” বইটি। মিসেস রেহনুমাও চলে যায়।
অদ্রি যেতেই বিভান বলে,
–মিসেস রেহনুমা কি তোমার বইটা পড়ছিলেন?
অদ্রি বলে,
–এটা একান্ত আমার লিখা না বিভান! তুমিও এটার কিছু অংশ জুরে আছো। তোমার ডায়েরী থেকে তোমার অনুভূতি ও পর্যবেক্ষন নিয়ে আমি বইটা সম্পূর্ণ করতে পেরেছি।
বিভান আলতো হাসে এরপর বলে,
–আমার ডায়েরী থেকে নিয়েছ তবে মেলবন্ধনটা তুমি করেছ। আমি শুধু প্রতিদিনকার মতো ডায়েরী লিখে রাখতাম, কে কি করলো নিত্যদিন সেটা লিখে রাখতাম।
অদ্রি বিভানের বাহু জড়িয়ে তাদের মেয়ের দুষ্টামি দেখছে আর বলে,
–সমাপ্তির পূর্ণতা আমাদের দুজনের মেলবন্ধন। তাইতো আমাদের মেয়ের নাম “পূর্ণতা অবনী”।
একটু পর অদ্রি মেয়ের কাছে গিয়ে বলে,
–অবনী, মা আমার। ঠান্ডা পড়ছে মা। শীতের কাপড় টা পড়ে নাও বাবার কাছ থেকে।
অবনী মাথা দুলায়। মানে সে পড়বে না শীতের কাপড়টা। বিভান অদ্রির দিকে অসহায় চাহনি দিয়ে বলে,
–তোমার মেয়ে ঠিক তোমার মতো হয়েছে। নিজে যা ঠিক করবে সেটাই করবে।
অদ্রি বিভানের দিকে চেয়ে চোখে তাচ্ছিল্যতা এনে বলে,
–তাহলে তুমি কি চাচ্ছিলে! তোমাকে আমি ওই মেয়েটার হাতে ছেড়ে দিতাম?
বিভান তাড়াহুড়ো করে বলে,
–সেটা আমি কখন বললাম! তবে তুমি যেভাবে সবকিছু হ্যান্ডেল করেছ, ব্যাপারটা অনেক রিস্কি ছিল।
অদ্রি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
–শেষ পর্যন্ত সবকিছু জানার পর তুমি যে আমায় ভুল বুঝনি এটাই আমার কাছে অনেক। তোমাকে হারানোর ভয়ে আমি হিংস্র হতে পারি। অনেকটা তো সহ্য করলাম এরপরেই আমি ওই পদক্ষেপ নিয়েছিলাম।
বিভান অদ্রিকে একপাশ দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,
–এটা ঠিক যে ভাবি ও তার বোন মিলে মায়ের মাথায় এমন ভাবেই নষ্ট করেছিল যে মা তোমাকে বুঝতে পারছিল না। আমিও তো তোমার মুখ থেকে কথাটা শুনে প্রথমে আমার খুব রাগ হয়েছিলো তবে তোমার সুন্দরভাবে বোঝানোতে রাগটা কমিয়ে সব বুঝতে পেরেছিলাম।
হঠাৎ অদ্রি মজার ছলে বলে,
–জার্মানীতে গিয়ে যখন তোমাকে ড্রাগটার অ্যান্টিডোট দিয়েছিলাম তখন তোমাকে দেখে একজন ডাক্তার একটাই কথা বলেছিল,
” Is she really your wife! ”
মানে সে বিশ্বাস করতে পারছিলো না আমি তোমার বউ হয়ে তোমাকে ওই ড্রাগটা দিয়েছিলাম এবং অ্যান্টিডোট দিতেও নিয়ে এসেছিলাম। ওই ডাক্তারটা এই ড্রাগটার ঘোর বিরোধী।
বিভান বাঁকা চোখে তাকিয়ে আছে। অদ্রি দেখেও না দেখার মতো করে উদাসিন স্বরে বলে,
–জানো বিভান! সেদিন যখন মায়ের এক্সিডেন্টের কথা শুনে আমি হাসপাতালে আসি সেদিন আমি সত্যই ভাবতে পারিনি শিমু ও ভাবি মিলে এমনটা করবে মায়ের সাথে। আমার সেদিন মায়ের জন্য নিজেকে কিছুটা দোষী মনে হচ্ছিলো। আর রিমু ভাবি! সে নিজের শাস্তি এভাবে পাবে আমি ভাবতে পারিনি। একজন মায়ের কাছ থেকে তার সন্তান চলে যাবার কষ্ট কতটা হয় সেটা একজন সন্তান বিহীন মা বুঝতে পারে। মায়ের অবস্থাটা এতো ক্রিটিকাল ছিল আমি শুধু চাইছিলাম মা যেনো কোন অপূর্ণ ইচ্ছা নিয়ে পৃথিবী ত্যাগ না করে। মায়ের তো একটাই অপূর্ণ ইচ্ছা ছিল তোমার সন্তানের মুখ দেখা।
বিভান মলিন ভাবে বলে,
–হ্যাঁ, মায়ের ইচ্ছাটা পূরণ হয়েছিল তবে আমার মা তার বড় ছেলের চিন্তায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিল। ইভান ভাইয়া তো ভাবিকে সুস্থ হবার পরেই পুলিশ কাস্টডিতে দিয়ে আসে আর তাকে সেস্পেশাল রিকুয়েস্টের মাধ্যমে সর্বনিম্ন শাস্তি পাঁচ বছরের জেলেকে কমিয়ে আড়াই বছরে নামিয়ে আনে। শিমুকে সেই পুরো পাঁচ বছরের জেল খাটতে হয়েছে।
হঠাৎ মেয়ের ডাকে বিভান আবার নিজের মেয়ের পিছনে যায়। অদ্রি সেখানে দাঁড়িয়েই ভাবতে থাকে,
” বিভানের মা ছয় মাস প্যারালাইসড অবস্থায় ছিল। হাসপাতাল থেকে মা ও রিমু ভাবিকে রিলিজ দেওয়ার পরেই অদ্রি ও বিভান জার্মানির উদ্দেশ্যে যাওয়ার বন্দোবস্ত করতে থাকে। ড্রাগটা বিভানের শরীরে প্রবেশ করানো হয়েছে তখন নয় মাস। এই ড্রাগটার মেয়াদ দুই বছর। দুই বছরের মধ্যে অ্যান্টিডোট দিলে ব্যাক্তি মেয়াদ শেষ হলে আবারো আগের মতো সুস্থ হয়ে যাবে। হাতে যেহেতু আরো এগারো মাস সময় ছিলো তাই সমস্যা হয়নি। রিমু ভাবিকে পুলিশ কাস্টডিতে রেখে আসার পর ইভান ও রিহাব একা হয়ে পরে তাই বিভান ও অদ্রি মিলে ইভানকে রাজী করায় তারা দুই বাপ-ছেলেও জেনো ওদের তিনজনের সাথে আমেরিকা যায়। বিভানকে নিয়ে জার্মানি থেকে ফেরার পর তারা আমেরিকায় যাবে। আমেরিকায় গিয়ে মায়ের পরবর্তী চিকিৎসা হবে।
এরপর জার্মানি থেকে ফিরে তারা আমেরিকায় যায়। আমেরিকায় যাওয়ার এক বছরের মাথায় অদ্রি কনসিভ করে। বিভানের মাও অনেকটা সুস্থ হয়ে গেছে ততোদিনে। ছোট ছেলের জন্য বিভীনের মা অনেক খুশি থাকলেও চোখের সামনে সারাক্ষণ বড় ছেলেকে ওভাবে দেখতে ভালো লাগত না। ইভানের ছেলে রিহাব মায়ের জন্য কান্না করতো মাঝে মাঝে তবে অদ্রির মাতৃ সমতুল্য স্নেহে রিহাব নিজের মাকে অতটা মনে করতো না। ছয় বছরের বাচ্চাকে বুঝাতে একটু বেগ তো পেতে হয়েছিলো।
যথারীতি নয় মাস পর অদ্রির কোল আলো করে অবনী আসে। রিহাব তো অবনীকে পেয়ে আর কিছু লাগে না। রিহাব ততোদিনে সাত বছরের।
অবনীর বয়স যখন দুই মাস তখন বিভানের মা ঘুমের মধ্যেই স্ট্রোক করে মারা যায়। সেদিন ইভান, বিভান, অদ্রি, রিহাব ও অবনী সবাই শেষ বিদায় দেয় মানুষটাকে।
বিভানের মা মারা যাওয়ার তিন মাস পর রিমু জেল থেকে মুক্তি পায় এবং ইভান নিজে বাংলাদেশে গিয়ে রিমুকে ফ্লাইট কনফার্ম করে আমেরিকায় নিয়ে আসে। রিমু নিজের অন্যায় নিজের বাচ্চা হারানো ও নিজে অসমপূর্ণ হবার পর বুঝতে পেরেছিলো। রিমু এসে অদ্রির কাছে মাফ চায় এবং ধন্যবাদ জানায় তার অবর্তমানে তার ছেলেকে মায়ের স্নেহ আগলে রাখার জন্য।
অদ্রিও সেদিন মাফ করে দেয় রিমুকে কারণ অনেক তো হলো শাস্তি। ”
মেয়ের আদো আদো ডাকে হুশ ফেরে অদ্রির।
–মা! মা! আতকে (আজকে) রিআব (রিহাব) ভাইয়া এলো না কেনো?
অদ্রি মিষ্টি করে বলে,
–রিহাব ভাইয়ার তো কালকে পরিক্ষা “মা”।
অবনীর মুড খারাপ হয়ে যায়। বিভান অদ্রিকে বলে,
–তোমার মেয়ে এই পর্যন্ত “রিহাব ভাইয়া এলো না কেন? ” এই কথাটা কতবার যে বলেছে তার হিসাব নেই।
অদ্রি অবনীকে খুশি করার জন্য বলে,
–বাসায় গিয়ে ভাইয়াকে আচ্ছা মতো বকে দিবো। ঠিক আছে?
অবনী খুশিতে খিলখিল করে হেসে উঠে। মেয়ের এই সিন্গ্ধ হাসিতে প্রশান্তি বয় অদ্রি ও বিভানের হৃদয় জুড়ে। একেই বলে পরিপূর্ণ #সমাপ্তির_পূর্ণতা।
~~~~~~~~~~~~~~সমাপ্ত~~~~~~~~~~~~~
ধন্যবাদ সবাইকে। পর্বটা এলোমেলো হয়েছে জানি তাও বলবো, পুরো গল্পটা কেমন লাগলো জানাবেন।
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। কার্টেসি ছাড়া দয়া করে কপি করবেন না। রিচেক করা হয়নি।