প্রেম পায়রা ২ পর্ব ১

O১.
‘বিয়ের আগের দিন পরপুরুষের দ্বারা ধর্ষণ হওয়া মেয়ের বিয়ে হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু মি. সম্পদ জুহায়ের? আমি গতকাল আমার প্রেমিকের হাতে রেপড হয়েছি! এটা জানার পর আপনি বিয়ে করবেন আমায়? নাকি আজকের বিয়েটা ভেঙে দিবেন?’

কথাটা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লো তিথি। ওড়নার ফাঁক দিয়ে বের হওয়া তার গলার নিচের আঁচড় গুলো প্রমাণ করে দিচ্ছে সে মিথ্যে বলছে না। সম্পদ যেন অথই সাগরে পড়লো। এতবড় সত্যিটা তো সে জানতে চায়নি। মাথাটা কেমন শূন্য শূন্য লাগছে। নিউরনগুলো জট পাকিয়ে যাচ্ছে যেন। তার দেড় হাত সামনে বসে থাকা মেয়েটি যেন মুহূর্তে তার ভেতর আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। বুকের ভেতর আগ্নেয়গিরির উত্তপ্ত লাভা টগবগ করে ফুটছে। সে কম্পিত কন্ঠে বলল,

‘কি বলছ তুমি? মাথা ঠিক আছে?’

‘আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই না? আমার নিজেরও বিশ্বাস করতে মন সায় দিচ্ছে না। কিন্তু এটাই ঘটেছে। ওই জানোয়ারটা আমার সব শেষ করে দিয়েছে।’

তিথি অঝোর ধারায় কাঁদছে। তার বুক চিঁড়ে বের হওয়া প্রতিটি শব্দ বুঝিয়ে দিচ্ছে তার কষ্ট। তার হাহাকার ভরা কান্নায় থমকে গেছে প্রকৃতি। সেই সাথে থমকে গেছে সম্পদ। তিথির ফোলা চোখ-মুখ, ঠোঁটের কোণের অস্পষ্ট দাগ, হাত-পায়ের আঁচড় আর বেহাল দশা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছে সব। মুহুর্তে মাথার চুল টেনে ধরলো সম্পদ। এটা কি হলো তার সাথে? আজ সন্ধ্যায় তিথির সাথে তার বিয়ে। গত সাতদিন হলো বিয়ের তোড়জোড় চলছে। গ্রামের চেয়ারম্যানের একমাত্র ছেলে সে। ধুমধাম করে বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল তার বাবার। দু-চার গ্রামের মানুষের খাওয়ার আয়োজন করা হচ্ছে আজ। সমস্ত গ্রামে সাজ সাজ রব। আর বিয়ের দিন ভোরবেলা কনে এসে বলছে সে রেপড হয়েছে!

সম্পদ উঠে দাঁড়ালো। তিথি এখনো মাথা নিচু করে কেঁদে যাচ্ছে। তিথি এই গ্রামেরই মেয়ে। কিন্তু তার সাথে পরিচয় ছিল না। ছোটবেলা থেকে সম্পদের পড়াশোনা, ক্যারিয়ার সব ঢাকায়। দেড় বছর হলো তার পড়াশোনা শেষ হয়েছে। এখন মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে ভালো চাকরি করছে। বিয়ের বয়স হয়ে গেছে তার। এবার ইদের ছুটিতে গ্রামে আসায় বাবা-মা জোরজবরদস্তি করছে বিয়ের জন্য। এর আগে বহুবার তার বিয়ের কথা উঠেছে এবং প্রতিবার সে নাকচ করে দিয়েছে। কিন্তু শহরে দেখাশোনা করার মানুষ নেই বলে এবার তার স্বাস্থ্য একটু বেশিই খারাপ হয়ে গেছে। সেজন্য বাবা-মা কিছুতেই ছাড়ছে না। তারা জিদ ধরেছে এবার বিয়ে করে বউ নিয়ে শহরে ফিরতে হবে তাকে। না হলে তাকে আর ঢাকা ফিরতে দিবে না।

অগত্যা একপ্রকার বাধ্য হয়ে সে বিয়েতে রাজি হয়েছিল। মেয়ে তার পরিবারের পছন্দের। বলতে দ্বিধা নেই, প্রথম বার দেখে তিথিকে তারও পছন্দ হয়েছিল। তিথি অত্যন্ত মিষ্টি একটা মেয়ে। তাকে অপছন্দ করবে এমন মানুষ এ ধরায় জন্ম নেয়নি। সব ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু আজ বিয়ের দিন ভোরবেলা তিথির মুখে এমন কথা শুনে মনে হচ্ছে বুকের ভেতর কেউ জ্বলন্ত বারুদ চেপে রেখেছে। সে ক্ষীণ স্বরে বলল,

‘তোমার প্রেমিক ছিল সেটা তো আগে বলোনি।’

কাঁদতে কাঁদতে তিথির গলা বসে গেছে। ওড়নায় ফোলা চোখ মুছে সে বলল,

”ওই জানোয়ারটা আমাদের পাশের গ্রামের। কলেজ যাওয়ার পথে পরিচয় হয়েছিল। আমি সবাইকে বলতে চেয়েছিলাম, যে এই বিয়েটা আমি করতে পারবো না। কিন্তু ও বারণ করেছিল। বলেছিল, ‘বিয়ের আগের দিন আমরা পালিয়ে যাব। তুমি বললে কেউ রাজি হবে না। এত ভালো ছেলে তোমার বাবা-মা হাত ছাড়া করবে না। জোর করে ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিবে।’ আমিও সেটা বিশ্বাস করেছিলাম। বুঝতে পেরেছিলাম না, জানোয়ারটা এভাবে আমার সর্বনাশ করবে। ওর কথামতো আমি গতকাল বিকেলে ওর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। কাপড়চোপড় না নিয়ে শুধু জমানো টাকা নিয়েছিলাম। একা পেয়ে হারামজাদা আমার আমার সর্বনাশ করে দিল। এতটা বিশ্বাস করেছিলাম ওকে! কেন এমন হলো আমার সাথে?’

তিথি মুখে ওড়না চেপে আবার কান্না শুরু করলো। সম্পদ তাকে কিছুটা সময় দিল। একটু ধাতস্থ হতে প্রশ্ন করলো,

‘এই ব্যাপারে আর কেউ জানে?’

‘না! প্রথম আপনাকে বলছি। কাল রাতে দরজা বন্ধ করে সারা রাত কেঁদেছি। ব্যথার ওষুধ খেয়ে তবেই একটু সুস্থ হয়েছি। ভোরবেলা ফোলা চোখমুখ দেখে কেউ সন্দেহ করেনি। সবাই ভেবেছে, বিয়ে হয়ে অন্যের ঘরে চলে যাব সেজন্য কান্না করেছি। চাদর গায়ে দিয়ে নিজেকে আড়ালে রেখেছিলাম এতক্ষণ। এখন একজনকে বলে শুধু আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি।’

সম্পদ কিছু বলল না। তারা বর্তমানে আছে তিথির বাড়ির পেছনের বাঁশঝাড়ের আড়ালে। তিথিই জরুরি তলব করেছে তার। তিথি ঝাপসা চোখে একবার সম্পদের দিকে তাকালো। বসে যাওয়া গলায় বলল,

‘আমার মতো জঘন্য মেয়ের কারো বউ হওয়ার যোগ্যতা নেই। বিয়ে করতে হবে না আমাকে। এখনো অনেক সময় আছে। আপনি বিয়েটা ভেঙে দিন। সবাইকে বলে দিন যে, এই নষ্ট চরিত্রের মেয়েকে আপনি বিয়ে করবেন না। নাকি আমি বলবো সবাইকে?’

সম্পদ খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। এই শেষ মুহূর্তে এসে কিছুতেই বিয়ে ভেঙে দেওয়া যাবে না। এতে তার বাবার নামডাক, এত পরিশ্রম করে কুঁড়ানো সম্মান সব ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। গতকাল রাতে তিনটে গরু জবাই করা হয়েছে। সবাই হৈ-হুল্লোড় করছে। এত মানুষের আনন্দ নিয়ে সে ছিনিমিনি খেলতে পারে না। তাছাড়া এই মেয়েটা! সে বিয়ে ভেঙে দিলে এই মেয়ের কি হবে? তার রেপড হওয়ার ঘটনা সবার কানে পৌঁছাবে। মিডিয়া আসবে, পেপার ছাপবে, রেপিস্ট পলাতক হবে, শেষমেশ গ্রামের মানুষের কানাঘুষা আর কটু কথায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাবে মেয়েটার। তখন সুইসাইড ছাড়া মেয়েটার দ্বিতীয় পথ খোলা থাকবে না।

এই মেয়েটারও তো দোষ নেই। একজনকে ভালোবেসেছিল শুধু। ভালোবাসা তো অপরাধ নয়। অপরাধ যদি কেউ করে থাকে সেটা ওই প্রেমিকরূপী জানোয়ারটা করেছে। মেয়েটার বিশ্বাস নিয়ে রঙ তামাশা করেছে। সে বিয়েতে রাজি না হলে একের পর এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যাবে। তাছাড়া তিথি যদি নিজেকে শেষ করে দেয়, সে কোনোদিন নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। তারচেয়ে সে না হয় একটু স্যাক্রিফাইজ করুক! এতে অনেক গুলো জীবন বেঁচে যাবে। তিথিকে বিয়ে করে শহরে নিয়ে গেলে সব ঝামেলা চুকে যাবে। তার আর তিথির মধ্যকার ব্যাপারটা ধীরে সুস্থে মিটমাট করে নেওয়া যাবে। হাতে একদম সময় সেই। সে তিথির দিকে তাকিয়ে বলল,

‘আমি এই বিয়েটা করছি তিথি। তোমায় দুশ্চরিত্রা পদবি থেকে রেহাই দেওয়ার জন্য হলেও বিয়েটা আমাকে করতে হবে। তোমার সম্মান বাঁচাতে হবে। তোমাকে বাঁচাতে হবে।’

‘আমাকে বাঁচাতে গিয়ে আপনি নিজের জীবন কেন নষ্ট করবেন?’

‘আমি কারো জীবনই নষ্ট করছি না। কয়েকমাস গেলে তোমাকে না হয় মুক্ত করে দিবো। আমিও মুক্ত হবো। কিন্তু আজ আমাদের বিয়েটা করতেই হবে। তৈরি থেকো।’

তিথিকে আর কিছু বলার সুযোগ দিল না সম্পদ। খুব দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে গেল। সম্পদ চলে যেতে তিথি দু হাতে মুখ ঢেকে পুনরায় কান্নায় ভেঙে পড়লো।

২.

সচরাচর বিয়েতে ছেলেরা দ্রুত কবুল বলে দেয়। কিন্তু কবুল বলার সময় সম্পদ অনেকখানি সময় নিল। মনের কোথাও উঁকি দিল, কবুল বলে কাকে সে নিজের স্ত্রী বলে মেনে নিচ্ছে? কাকে সে নিজের জীবনসঙ্গী করে কবুল করে নিচ্ছে? যার মনে অন্য পুরুষের বসবাস আর শরীরে অন্য পুরুষের ছোঁয়া? এমন একটা মেয়েকে কেন বিয়ে করবে সে? কিসে কমতি তার? শিক্ষা, আদর্শে, সৌন্দর্যে সবদিক থেকেই তো সে পার্ফেক্ট। ভার্সিটির সবচেয়ে সুন্দর, সবার চেয়ে মডার্ণ মেয়েটাও তার জন্য পাগল ছিল। সে পাত্তা দেয়নি। অথচ আজ এমন একটা মেয়েকে নিজের সহধর্মিণী বলে স্বীকৃতি দিবে?

পরমুহূর্তে বিবেকের কাছে হাজারো প্রশ্ন ধামাচাপা পড়লো। মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে! এখন আর পিছু ফেরবার অবকাশ নেই। সবদিক দিয়ে পিছু ফেরার রাস্তা বন্ধ। কানের কাছে বৃদ্ধ মাওলানা সাহেব বার বার কবুল বলতে বলছে। বুক চিঁড়ে বের হওয়া দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে সম্পদ কবুল বলে দিল। ক্ষণিকের জন্য তার মনে হলো, দূরে কোথাও কোনো একটা নিশাচর করুণ সুরে ডেকে যাচ্ছে। নিশাচরেরও কি তার মতো গোপন দুঃখ আছে? পরক্ষণে সে আর কোনো সুর শুনতে পেল না। নিশাচরের মতোই তার দুঃখগুলো মুখ লুকাল সবার আনন্দ ধ্বনিতে।

নির্বিঘ্নে মিটে গেল বিয়ের কাজ। বাজনা বাজলো, হৈ-হুল্লোড় হলো, গান বাজলো, নাচানাচি হলো। সবই হলো! শুধু বর-কনের মনের অবস্থা কেউ টের পেল না। হাজারো মানুষের আনন্দের নিচে ভাটা পড়ে রইলো দুজনের ক্ষত-বিক্ষত মন!

৩.

এক বুক হাহাকার নিয়ে তিথি বাসর ঘরে বসে রয়েছে। ফুলের গন্ধে ডুবে আছে রুমটা। বাহারি রঙের গোলাপ, মোমবাতি আর হরেক রকমের রেডিয়াম দিয়ে অনিন্দ্য সুন্দর আলোকসজ্জা রুমে। এই রুমে পা রাখলে যে কারো ভেতর স্বর্গীয় অনুভূতি হবে। কিন্তু তার হচ্ছে উল্টো। শরীর পুড়ে যাচ্ছে, নিজের বোকামির ফলে, নিজের ভুলের জন্য সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস হারিয়েছে সে। এক বদমাইশ, জানোয়ার, কাপুরুষের হাতে তার সতীত্ব নষ্ট হয়েছে। তাছাড়া আরো একটু সুন্দর মনের মানুষের জীবন সে নষ্ট করে দিল। এত কষ্ট সে কাকে দেখাবে?

এতক্ষণ সবার থেকে শরীরের দাগগুলো লুকিয়ে রাখতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তাকে। চাচাতো ভাবী তো তাকে সম্পদের নাম ধরে কত হাসি তামাশা করলো। তারা ধরেই নিয়েছে সম্পদ বিয়ের আগে তাকে অল্প-বিস্তর ছুঁয়েছে। সে তাদের ভুল ভাঙাতে পারেনি! নিজের শরীরের দিকে এক পলক চেয়ে ঘেন্নায় মুখ ফিরিয়ে নিল। নিজেই দুহাত খামচে, ঘঁষে জানোয়ারটার স্পর্শ মুছে ফেলার চেষ্টা করলো। তখনি দরজার ছিটকিনি লাগানোর শব্দ কানে এলো। ঝাপসা চোখে দেখলো, ধবধবে শুভ্র রঙের পাজামা পাঞ্জাবি পরিহিত সম্পদ রুমে ঢুকেছে।

(চলবে….)

#প্রেম_পায়রা (২)
#লেখনীতে: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#সূচনা_পর্ব: ০১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here