প্রেম পায়রা ২ পর্ব ২+৩

#প্রেম_পায়রা (২)
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব__০২+৩

ঝাপসা চোখে তিথি দেখলো, ধবধবে শুভ্র রঙের পাজামা পাঞ্জাবি পরিহিত সম্পদ রুমে ঢুকেছে। মাথায় টোপর নেই। টোপর থাকার আশা সে করেনি। তাদের বিয়েটা তো স্বাভাবিক ভাবে হয়নি। সম্পদ দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে পেছন ঘুরলো। সঙ্গে সঙ্গে তিথি মাথা নিচু করে চোখ সরিয়ে নিল।

কয়েক মিনিট কেটে গেল। কিন্তু সম্পদের থেকে কোনো রূপ প্রতিক্রিয়া না পেয়ে তিথি ফের চোখ তুলে তাকালো। সম্পদ নিঃশব্দে রুমে হাঁটাহাঁটি করছে। একবার ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। হাতের ঘড়ি আর আংটি খুলে রাখলো। আবার হেঁটে ওয়ারড্রবের কাছে গিয়ে জামাকাপড় বের করলো। ভুলেও তার দিকে তাকাল না। নিঃশব্দে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।

তিথির ভেতরটা পুড়ছে। সম্পদ এতটা কোল্ড বিহেভ কেন করছে? এমন প্রতিক্রিয়া করছে যেন রুমে সে বাদে দ্বিতীয় কেউ নেই। এই জলজ্যান্ত মানুষটাকে চোখে পড়ছে না? কিছু একটা বলবে তো। বলা উচিত। অন্তত বকাঝকা করা উচিত। কেন আমার জীবনে এলে? আমার জীবন নষ্ট করলে? আমার সব শেষ করে দিলে? তুমি একটা নষ্টা মেয়ে ইত্যাদি বলা উচিত। তিথির চোখ দুটো আবার জলে ভরে উঠলো।

সম্পদ ওয়াশরুম থেকে বের হচ্ছে না। তিথি ভেতরে ভেতরে ভয় পেয়ে গেল। এতক্ষণ তো লাগার কথা নয়। ভেতরে গিয়ে কোনো অঘটন ঘটাচ্ছে না তো? যদি চিন্তায় হার্ট অ্যাটাক করে মারা যায়? অথবা হাত টাত ছুরি দিয়ে সে কেটে ফেলেনি তো? গলা শুকিয়ে এলো তার। দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। সিদ্ধান্ত নিল ডাক দিবে।

ওয়াশরুমের দরজায় কান পেতে সে ভেতরের শব্দ শোনার চেষ্টা করলো। কিন্তু পানি পড়ার কোনো শব্দ আসছে না। কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো তার। সরে এসে রুমের মাঝ বরাবর একবার দাঁড়াল। চিন্তিত হয়ে আবার ওযাশরুমের কাছে গেল। এক কান দরজার উপর রেখে মিশে দাঁড়ালো৷ আচমকা দরজার পাল্লা সরে যেতে সে হুড়মুড় করে সম্পদের বুকের উপর গিয়ে পড়লো।

সম্পদের কপাল কুঁচকে গেল। তিথি পড়ি কি মরি করে সরে এলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করলো। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের করতে পারলো না। সম্পদ তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,

‘কিছু করার চেষ্টা করছিলে?’

তিথি ভয়ে সিটিয়ে গেল। অস্ফুট স্বরে বলল,

‘না।’

‘তাহলে দরজায় কান পেতে কি করছিলে?

‘তেমন কিছু না। ওয়াশরুম ব্যবহার করতে হবে আমার। আপনি বের হচ্ছিলেন না। তাই ডাকতে নিয়েছিলাম।’

সম্পদ আর কিছু বলল না। তিথিকে পাশ কাটিয়ে রুমে ঢুকে গেল। তিথি সঙ্গে সঙ্গে ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা লাগাল। দরজাটা একটু বেশিই জোরে বন্ধ করেছিল সে। ঠাস করে শব্দ হলো তাতে। সম্পদ একবার ঘাড় ঘুড়িয়ে পেছনে তাকাল।

বুকের গহীন থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হলো তার। এতক্ষণ যাবত মাথায় পানি নেওয়ার পরেও ব্যথা কমছে না। মাথাব্যথা তার কোনো কালে ছিল না। কিন্তু আজ হঠাৎ করে প্রচন্ড ব্যথা করছে৷ মাত্রারিক্ত চিন্তার ফলে হয়তো। তিথি ফেরার আগেই চুপচাপ মেডিসিন খেয়ে নিল সে।

সে নিশ্চিত তিথি সহজে ওয়াশরুম থেকে বের হবে না। তার থেকে লুকিয়ে থাকার জন্যই সে ওয়াশরুমে বসে আছে। লম্বা করে শ্বাস নিল সম্পদ। তিথিকে বউয়ের সাজে কেমন লাগছে তা তার দেখা হয়নি। এখন অবধি সে তিথির মুখপানে তাকায়নি। ঘৃণায় নাকি অন্য কোনো কারণে তা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। শুধু তার পরণের লাল বেনারসি চোখে পড়েছে। এইটুকুই! অথচ এই বেনারসির সাজে সে পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র মনের একটা মেয়েকে আশা করেছিল। যার উপর শুধু তার অধিকার থাকবে, অক্সিজেনের মতো যার মাঝে শুধু সে বিরাজমান থাকবে। যার প্রতিটি কোষাভ্যন্তরে শুধু সম্পদের অস্তিত্ব থাকবে।

হাতের টাওয়াল ছুঁড়ে ফেলে দিল সে। তারপর ফুল বিছানো বিছানার দিকে এগিয়ে এলো। সম্পূর্ণ রুমে একবার নজর বুলাল। রুমের সাজসজ্জা তার গায়ে যেন আরো জ্বালা ধরিয়ে দিল। এতটা মহান তাকে কে হতে বলেছিল? দুদিনের পরিচিত একটা মেয়ের সম্মানের কথা ভেবে সে কেন নিজের জীবন নষ্ট করলো?

মুহূর্তে সমস্ত রুমের সাজসজ্জা নষ্ট করে ফেলল সম্পদ। ফুলগুলো টেনে হিঁচড়ে ছিঁড়ে ফেলল। মোমবাতি গুলো নিভিয়ে জুতো পায়ে দিয়ে নিভিয়ে ফেলল। খুব দ্রুত হাঁপিয়ে উঠলো। কিছুক্ষণ ফ্লোরে বসে বিশ্রাম নিল। অগোছালো রুমের দিকে তাকিয়ে আবার উঠলো সে। ঝাড়ু দিয়ে রুম কোনো রকমে পরিষ্কার করে ফেলল। ওয়াশরুমের দিকে চোখ পড়লো। তিথি এখনো বের হয়নি। হেলতে দুলতে সিগারেটের প্যাকেট হাতে চিকন বারান্দায় প্রবেশ করলো সে। ঠোঁটে সিগারেট গুঁজে তার ধোঁয়া ছাড়লো। মনের কোণে উঁকি দিল, আজ থেকে সিগারেট তার নিত্যসঙ্গী হলো।

কি অদ্ভুত মানুষের জীবন। স্বপ্নেও যেসব কিছু কখনো ভাবেনি, অথচ সেসব ঘটনা ঘটলো তার সাথে। মানবজীবন যেন আস্তো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কারখানা। একের পর এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে থাকে। তার আর তিথির গল্পটা কোন দিকে মোড় নিবে? এরকম একটা মেয়েকে কি করে সে সহ্য করবে? ট্রাউজারের পকেট থেকে ফোন বের করলো সম্পদ। সময় দেখলো। অনেক রাত হয়ে গেছে। মনটা বিষিয়ে উঠেছে তার। চারপাশের কোনো কিছুই সহ্য হচ্ছে না। তাকে ঢাকা ফিরতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব তাকে ঢাকা ফিরতে হবে।

তিথি ইতোমধ্যে কাপড় পাল্টে ফেলেছে। ভারী বেনারসির জায়গায় এখন শোভা পাচ্ছে পাতলা শাড়ি। এতক্ষণ যাবত ওয়াশরুমে বসে কান্না করছিল সে। এটা অন্তত বুঝে গেছে যে তার কান্নার দিন সবে শুরু হয়েছে। এখন থেকে তাকে প্রতি ক্ষণে ক্ষণে কাঁদতে হবে। মাঝরাত, অথ এখনো বিছানা খালি। সম্পদ ঘুমায়নি। চিন্তিত হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে অন্ধকার বারান্দায় ক্ষীণ আলো দেখলো। এগিয়ে যেতে বুঝতে পারলো সম্পদ সিগারেট টানছে৷ তীব্র মন খারাপ এসে গ্রাস করলো তাকে। ছোটবেলা থেকে সিগারেট তার ভীষণ অপছন্দের। মন খারাপ ভাব লুকিয়ে সে আরেকটু এগিয়ে গেল। সম্পদ এখনো তার উপস্থিতি ঠাওর করেনি৷ সে অন্ধকারের মধ্যে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। নিরবতা ভঙ্গ করে নরম গলায় বলল,

‘আপনি ঘুমাবেন না?’

সম্পদ চমকে উঠলো। আকস্মিক কন্ঠ শুনে এতটা ভড়কে গেল যে সিগারেটের জ্বলন্ত অংশে ঠোঁট পুড়ে গেল। সে সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরলো। ব্যথার আর্তনাদ করতে তিথি তার কাছে গেল। নিচু হয়ে তার দিকে ঝুঁকে বলল,

‘কি হয়েছে আপনার? দেখি?’

সম্পদ হাত ইশারা করে তাকে দূরে যেতে বলল। অস্ফুট স্বরে বলল,

‘তোমার কি কোনো কাজ নেই? প্রথম এবং শেষ বারের মতো বলে দিচ্ছি। ভূতের মতো যেখানে সেখানে উদয় হবে না।’

তিথি সোজা হয়ে দাঁড়ালো। একটু পিছিয়ে গিয়ে পূর্বের জায়গা দাঁড়াল। একবারের জন্য সম্পদের ঠোঁট পরখ করতে চেয়েছিল। অনেকখানি পুড়ে গেছে কি না। কিন্তু ধমক শুনে আর দেখার সাহস হলো না। মাথা নিচু করে শুধু বলল,

‘ঠোঁট পুড়ে গেছে আপনার? বরফ আনবো?’

সম্পদ উত্তর দিল না। ঠোঁট থেকে হাত সরিয়ে আবার সিগারেট ধরাল। তিথির দিকে একবারের জন্যও তাকাল না। নাক মুখ দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়লো। শান্ত গলায় বলল,

‘তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।’

‘অনেক রাত হয়েছে। একটুপর ভোরের আযান দিবে। আপনিও শুয়ে পড়ুন।’

‘তোমাকে আমি কেন জানি সহ্য করতে পারছি না। তোমার নামটাও মুখে আনতে গিয়ে শরীর গুলিয়ে উঠছে। চোখের সামনে শুধু একটা দৃশ্যই ভাসছে। কেউ একজন তোমার উপর …….’

সম্পদ তার কথা শেষ করলো না। তার অসম্পূর্ণ বাক্য বুঝতে তিথির বিন্দুমাত্র কষ্ট হলো না। চোখের কোণে আবার পানির অস্তিত্ব টের পেল। সম্পদ পুনরায় বলল,

‘দূরে, দূরে থাকো আমার থেকে। ভুলেও আমার চোখের সামনে পড়বে না।’

তিথি আর বিরক্ত করলো না। ধীরপায়ে বারান্দা থেকে সরে আসলো। কি করা উচিত তার এখন? তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। এক ঘরে থাকতে হবে এখন। কিন্তু একই ঘরে থাকতে গেলে সম্পদের চোখের আড়ালে থাকবে কি করে? তার কি এখন মরে যাওয়া উচিত? বুকের ক্ষতে আগুন ধরে গেল। কাঁদতে কাঁদতে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে গেছে। শরীরের ব্যথা এখনো কমেনি। কেমন জ্বর জ্বর অনুভব করছে। ঠিকমতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। সম্পদের তোয়াক্কা করলো না সে। বিছানা থেকে বালিশ আর কম্বল নিয়ে রুমের এক কর্ণারে গিয়ে বিছালো। রুমের লাইট বন্ধ করে সে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়লো।

৪.

শেষরাতের দিকে মেয়েলি স্বরের গোঙানির শব্দে সম্পদের কপাল কুঁচকে গেল। সবেমাত্র শুয়েছিল। মাথাটা এখনো ধপধপ করছে। কানের দু পাশের রগগুলো লাফাচ্ছে। তিন-চার ঘন্টা ঘুম না দিলে ঠিক হবে না। অথচ চোখ দুটোতে ঘুমেরা ধরা দেওয়ার আগেই শব্দটা কানে আসলো। কারো ইনিয়েবিনিয়ে কান্নার শব্দ। সে পাত্তা দিল না। দু হাতে কান ঢেকে ঘুমানোর চেষ্টা করলো।

বেশিক্ষণ নির্বিকার থাকতে পারলো না। গোঙানির শব্দ বেড়ে চলেছে। হুট করে তার মস্তিষ্ক সচল হলো। তিথি? তিথি কান্না করছে কেন? সে একলাফে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো। আবছা অন্ধকারে রুমের দক্ষিণ কর্ণারের দিকে তাকালো। তারপর দ্রুত উঠে গিয়ে রুমের লাইট অন করলো। তিথির কাছে ছুটে গেল সম্পদ। তার মনে রইলো না,কয়েক ঘন্টা আগে সে মেয়েটির মুখ দেখতে চায়নি।

তিথি গুমড়ে গুমড়ে কাঁদছে। কেমন ছটফট করছে। তার বন্ধ চোখের কার্নিশ বেয়ে জলের ধারা। চোখ মুখ ব্যথায় যেন নীল বর্ণ ধারণ করেছে। সম্পদ কাছে গিয়ে ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে ডাকলো,

‘তিথি? এই তিথি? তিথি?’

তিথি কোনো রেসপন্স করলো না। শরীর মুচড়ে সে কান্না করছে। ক্ষণে ক্ষণে ঠোঁট কামড়ে ধরছে। সম্পদ ভাবলো হয়তো কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছে। সে প্রথমবারের মতো কাঁপা কাঁপা হাতে তিথির কপাল স্পর্শ করলো। সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে উঠল সে। জ্বরে তিথির গা পুড়ে যাচ্ছে। তিথির দু কাঁধ ঝাঁকিয়ে সে আরো কয়েকবার ডাকলো। কিন্তু তিথি চোখ খুলল না। বড্ড অসহায় বোধ করলো সম্পদ। কেউ অসুস্থ হলে সেবা শ্রুশুষা করে অভ্যাস নেই তার। এতরাতে কি করবে এখন? কাউকে ডাক দিবে? কিন্তু সবাই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কাকে ডাক দিবে? তার ভাবনার মাঝে তিথির কান্নার শব্দ ভেসে এলো। বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো তার। আলগোছে তিথিকে কোলে তুলে নিল সে।

(চলবে)
#প্রেম_পায়রা (২)
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব____০৩

সম্পদের ভাবনার মাঝে তিথির কান্নার শব্দ কানে এলো। বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো তার।আলগোছে তিথিকে কোলে তুলে নিল। দু বার চিন্তা না করে তাকে বিছানার মাঝখানে শুইয়ে দিল। মাথার নিচে বালিশ ঠিকমতো দিয়ে কপালে হাত রাখলো। শরীরের তাপমাত্রা অনেক বেশি। গালে হাত ছোঁয়াতে তিথি এক ঝটকায় তার হাত ফেলে দিল। বিড়বিড় করে কিছু একটা বললো যা সম্পদের বোধগম্য হলো না। তিথির চোখের কোণ বেয়ে স্পষ্ট জলের ধারা। হাত পা কাঁপছে। সে ফ্লোর থেকে কম্বলটা উঠিয়ে এনে গায়ে জড়িয়ে দিল। তিথির কান্নার আওয়াজ আবার কানে আসতে তড়িঘড়ি করে উঠে গেল। রুমে থার্মোমিটার খুঁজলো। কোথাও খুঁজে পেল না।

তিথির জ্বর কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে৷ কিন্তু কি করে কি করবে? কিছুক্ষণ ইতিউতি করে সে এক টুকরো কাপড় ভিজিয়ে এনে কপালে চেপে ধরলো। তিথিকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল,

‘তিথি? তিথি! তোমার জ্বর এসেছে।’

তিথি এদিক ওদিক নড়াচড়া করলো শুধু। চোখ খুলল না। সম্পদ পুনরায় বলল,

‘ওয়াশরুমে যেতে পারবে? মাথায় পানি দিতে হবে।’

তিথি হাঁসফাঁস করতে করতে সম্পদের হাত সরিয়ে দিল। চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

‘না।’

সম্পদ কিছুটা সময়ের জন্য থমকে গেল। পরে মনে পড়লো, তিথি বোধ হয় তাকে ওই জানোয়ার ভেবেছে। সে কপাল থেকে ভেজা কাপড়ের টুকরো সরিয়ে তিথিকে টেনে বসিয়ে দিল। দু কাঁধ ঝাঁকিয়ে উঁচু স্বরে বলল,

‘তিথি, তোমার গায়ে অনেক জ্বর। মাথায় পানি দিতে হবে। বুঝতে পেরেছ? আমার সাথে ওয়াশরুমে চলো।’

তিথি ঘোলা চোখে সম্পদের দিকে এক নজর তাকালো। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। তার মধ্যে ওয়াশরুমে যাওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না৷ ঘোলা চোখ দুটো সে সম্পদের উপর থেকে সরিয়ে নিল। সম্পদ আর সময় ব্যয় করলো না। তিথিকে কোলে তুলে নিল। তিথি ছটফট করে দূর্বল হাত নেড়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। সম্পদ আরো শক্ত করে চেপে ধরলো। ওয়াশরুমে গিয়ে তাকে নামিয়ে দিল। রুম থেকে বসার টুল নিয়ে তিথিকে জোর করে বসিয়ে দিল। তারপর বালতিতে পানি নিয়ে মাথা নিচু করলো। পানি ঢালতেই ঠান্ডা স্পর্শ তিথি শিউরে উঠলো। বসা থেকে উঠতে নিতে সম্পদ বাঁধা দিল। তার পেটের কাছের টিশার্ট খামচে ধরে তিথি বলল,

‘শীত! শীত লাগছে আমার।’

সম্পদ কোনো প্রতিত্তর করলো না। এক হাতে ধরে রেখে নির্বিকারভাবে আরেক হাতে পানি ঢালতে লাগলো।

দীর্ঘক্ষণ পর ক্লান্ত হতে সে থামলো। তিথির চুল শুকনো টাওয়াল দিয়ে মুড়িয়ে দিয়ে সে ভেতরে নিয়ে এলো। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে গলা পর্যন্ত কম্বল দিয়ে ঢেকে দিল। দৌঁড়ে গিয়ে মেডিসিন বের করলো৷ এখন মেডিসিন খাওয়াতে হবে। তা না হলে জ্বর কমবে না। কাল বড় অনুষ্ঠান আছে। বাড়িতে প্রচুর মেহমান। এর মধ্যে নতুন বউ অসুস্থ হয়ে পড়লে সবাই কি না কি ভাববে!

গ্লাসে পানি ঢেলে মেডিসিন হাতে তিথির নিকট এলো। তিথিকে ডাকতে নিয়ে মনে পড়লো এখন অনেক রাত। সেই কখন না কখন পেটে কিছু পড়েছে। এখন খালি পেটে মেডিসিন খাওয়ানো ঠিক হবে না। কিছু একটা খাইয়ে নিতে হবে। হাতের গ্লাস বিছানায় নামিয়ে রেখে আবার দৌঁড় শুরু করলো সে।

চোরা চোখে চারপাশ পরখ করলো সম্পদ। তারপর দ্রুত পায়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। ড্রয়িং রুম মাড়িয়ে রান্নাঘরে যেতে হয়। ড্রয়িং রুমের ফ্লোরে অনেক মানুষ শুয়ে আছে। আবছা অন্ধকারে এদের কেউ একজন জেগে গেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। ভূত ভেবে নিশ্চিত হার্ট অ্যাটাক করবে। নিঃশব্দে হেঁটে সে রান্নাঘরে ঢুকলো।

কিছুক্ষণ পর প্লেটে কাঁটা ফলমূল নিয়ে ফিরলো সে। রুমের ছিটকিনি লাগিয়ে এগিয়ে এলো। বিছানার কাছে আসতেই কপাল কুঁচকে গেল। মৃদু ধমক দিয়ে বলে উঠলো,

‘তিথি!’

তিথি পূর্বের ন্যায় কোনো রেসপন্স করলো না। হাতের প্লেট নামিয়ে রেখে সে বিছানা চেক করলো। অনেকখানি ভিজে গেছে। সে আবার চেঁচিয়ে বলল,

‘এই মেয়ে। গ্লাসের পানি ঢেলে বিছানা ভিজালে কেন?’

খালি গ্লাসটা হাতে নিয়ে সম্পদের রাগটা তরতর করে বেড়ে গেল। এক টানে তিথিকে বিছানায় বসিয়ে দিল। কোলের উপর ফলের প্লেট দিয়ে বলল,

‘এটা খাও। তাড়াতাড়ি শেষ করো।’

তিথি চোখ মুখ কুঁচকে সম্পদের দিকে তাকালো। সম্পদ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

‘এভাবে তাকাচ্ছো কেন? চোখ দিয়ে খেয়ে ফেলবে? আমাকে নয়, ফলগুলো খেতে বলেছি আমি।’

তিথি মাথা নিচু করলো। বাধ্য মেয়ের মতো কয়েক টুকরো ফল তুলে খেল। প্লেট সরিয়ে রাখতে সম্পদ আর জোর করলো না৷ গ্লাসে পানি ঢেলে আনলো৷ তিথির হাতে ধরিয়ে দিয়ে ট্যাবলেট খুলে দিল। চুপচাপ খেয়ে নিল তিথি। সম্পদের আদেশের অপেক্ষা না করে কম্বল দিয়ে মুখ ঢেকে শুয়ে পড়লো। তিথি বিছানার ভেজা অংশে চলে এসেছে অনেকটা। সম্পদ ধমক দিয়ে বলল,

‘ডান দিকে সরে যাও। ভেজা জায়গা শুয়ে জ্বর আরো বাড়াও।’

তিথি নিঃশব্দে ডান দিকে সরে গেল। কম্বল দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে নিজেকে পেঁচিয়ে নিল। সম্পদ প্লেট, গ্লাস সরিয়ে রাখলো। এতক্ষণ ছুটোছুটি করে শরীরটা ক্লান্ত হয়ে গেছে। মাথা ব্যথার কথা এতক্ষণ ভুলে গিয়েছিল। সেটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। জগটা উঁচু করে ঢকঢক করে পানি খেল সে। ঘড়ির দিকে এক পলক তাকাল। ফজরের আযান দেওয়ার সময় হয়ে গেছে।

এক লাফে তিথির পাশেই শরীরটা বিছানায় মেলে দিল। কয়েক সেকেন্ড পর পিঠের নিচে ভেজা অনুভূত হতে সে মাথা ঘুরিয়ে তিথির দিকে তাকালো। বিস্মিত হয়ে আরেক লাফে উঠে পড়লো। মাথা চেপে ধরে বলল,

‘শিট! কোথায় ঘুমাব এখন আমি?’

কিন্তু ঘুমাতে হবে তো। মাথা ব্যথায় ফেটে যাচ্ছে। গলা ফাটিয়ে একটা চিৎকার দিতে গিয়েও থেমে গেল সে। কর্ণারের ফ্লোরে পড়ে থাকা বালিশ টা নিয়ে বিছানা পরখ করলো। লম্বা খাট! তিথির পায়ের নিচে অনেকখানি জায়গা। সে সেখানে ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নিল। তিথি ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো। তিথির পা দুটো টেনে সে কোণাকুণি করে দিল। তারপর বালিশটা ঠিকমতো রেখে তিথির পায়ের নিচে শুয়ে পড়লো। রুমে লাইট জ্বলছে। সম্পদ হাত কপালে আড়াআড়ি করে রেখে আলো থেকে নিজেকে আড়াল করলো। তারপর চোখ বন্ধ করলো।

__________

ভোরবেলা দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ সম্পদের কানে আগে পৌঁছাল। কপাল কুঁচকে গেল তার। চোখ থেকে ঘুম সরেনি এখনো। এত ভোরবেলা কে ডাকছে? যার ইচ্ছে সে ডাকুক। পাত্তা না দিয়ে সে আরো গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। বেশিক্ষণ চুপচাপ থাকতে পারলো না। দরজার ওপাশে কেউ ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছে। বিরক্তি নিয়ে সে চোখ খুলল। চোখ খুলতে এক জোড়া স্নিগ্ধ, কোমল পা নজরে এলো। ধবধবে ফর্সা পদযুগল। ডান পায়ের কনুই আঙুলে বড়সড় একটা কালো তিল। চোখ সরু করে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো সে পায়ের দিকে। সচকিত হতে মেজাজ বিগড়ে গেল তার। হুড়মুড় করে উঠতে নিতেই বাঁধা পড়লো। বুকের উপর তিথির পা জোড়া দেখে বিস্মিত হলো। বিড়বিড় করে বলল,

‘মেয়ে! তোমার সাহ তো কম নয়। এই সম্পদ জুহায়েরের বুকের উপর মেয়েরা মাথা রাখার সাহস পায় না, আর তুমি পা রাখো?’

এক ধাক্কায় পা দুটো সরিয়ে দিল সে। টিশার্ট টেনেটুনে তিথির মুখের দিকে এক পলক তাকালো। উল্টো পাল্টা হয়ে শুয়ে আছে। গলার চার ইঞ্চি নিচে তার তথাকথিত প্রেমিকের দেওয়া চিহ্ন জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। বুকের ভেতর পুড়ে উঠলো সম্পদের। কম্বল তুলে তিথির মুখ পর্যন্ত পেঁচিয়ে দিয়ে দরজা খুলল।

‘এতক্ষণ লাগে দরজা খুলতে? তিথি কোথায়?’

দরজার ওপাশে মারিয়া ভাবীর মুখটা দেখতে পেল সম্পদ। মারিয়া তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী। চাচাতো ভাই! তাদের জয়েনড ফ্যামিলি। তার বাবা আর এক চাচা সবাই একত্রে এক বাড়িতে থাকে। সবাই একক পরিবার। তার একমাত্র ছোট বোন, স্নেহা সেও এই বাড়িতে থাকে। তার চাচার ছোট ছেলের সাথে তার বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। সম্পদ হাই তুলে দরজা থেকে সরে দাঁড়াল। বলল,

‘ভেতরে আসো ভাবী।’

মারিয়া ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,

‘আত্মীয় স্বজন বাইরে অপেক্ষা করছে। বসার ঘরে কত মেহমান। তিথিকে উঠতে হবে এখন। রেডি হবে না? সবাই জিগ্যেস করছে, নতুন বউ কই? নতুন বউ কই?’

‘ভাবী তিথি অসুস্থ। প্রচন্ড উইক। উঠতে পারবে না।’

মারিয়া চমকে সম্পদের দিকে তাকালো। বিস্ফারিত কন্ঠে বলল,

‘সে কি! উঠতে পারবে না মানে? তুমি……’

সম্পদ যেন হঠাৎ বুঝতে পারলো। থতমত খেয়ে বলল,

‘আহা! আমি কিছু করিনি। ওর জ্বর এসেছে মাঝরাতের দিকে। বিশ্বাস না হলে তুমি নিজে পরখ করো।’

‘জ্বর এসেছে?’

‘হুঁ! মেডিসিন খাইয়ে দিয়েছি রাতেই।’

মারিয়া চিন্তিত হয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল। কম্বল সরিয়ে তিথির কপালে হাত রাখলো। ঘেমে একাকার। কপাল ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। সে সরে এসে বলল,

‘জ্বর তো নেই। কিন্তু গভীর ঘুমে।’

সম্পদ এক নজর দেখে বলল,

‘ওই দেখো! জ্বর কমেছে। সেজন্য ঘেমে গেছে।’

‘মাথার চুল ভেজা কেন?’

‘মাথায় পানি ঢেলেছি ভাবী। রাতের বেলা তাপমাত্রা এতটা বেড়ে গিয়েছিল যে আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আধ ঘন্টার মতো পানি ঢালা হয়েছে। রান্নাঘর থেকে ফল এনে খাইয়ে তারপর মেডিসিন দিয়েছি।’

‘অহ।’

মারিয়া উঠে দাঁড়ালো। হঠাৎ করে তার চোখ পড়লো সম্পদের ঠোঁটের উপর। মুচকি হাসলো সে। এতক্ষণ মনে যে ভয়টা ছিল সেটা কেটে গেল। ভেবেছিল, সম্পদ হয়তো তিথিকে মেনে নেয়নি। কিন্তু তার ধারণা ভুল। সে হাসতে হাসতে বলল,

‘তিথিকে ডেকে তুলো। তাড়াতাড়ি রেডি হতে হবে। কোনো ধকল যাবে না ওর উপর দিয়ে। সেজেগুজে শুধু বসার ঘরে বসে থাকবে। আমি আসছি।’

দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে মারিয়া চলে গেল। সম্পদ কপাল কুঁচকে নিজের ঠোঁটের উপর হাত রাখলো। মারিয়া ভাবী তার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে হাসলো কেন? দৌঁড়ে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো সে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল তার। নিচের ঠোঁটের মাঝামাঝি জায়গা জখম হয়েছে। এটা তো গতকাল রাতের সিগারেটের পুড়ে যাওয়া অংশ। কালচে হয়ে গেছে। দাঁত দিয়ে কামড়ে কালচে ভাব উঠানোর চেষ্টা করলো। সবাই কি না কি ভেবে বসবে!

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আয়নার সামনে থেকে সরে আসলো সে। কড়া গলায় ডাকলো,

‘তিথি? তিথি?’

তিথির কর্ণকূহরে তার ডাক পৌঁছাল না। এই মেয়ে এত ঘাড়ত্যাড়া কেন? এত কথা, এত ডাকাডাকি কিছুই কানে ঢুকছে না? যতই মেয়েটার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে না, ততই যেন বেশি করে বলতে হচ্ছে। সে আর ডাকাডাকির ভেতর গেল না। এগিয়ে গিয়ে তিথির বাহু চেপে ধরে এক টানে উঠে বসালো।

(চলবে….)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here