প্রেম পায়রা ২ পর্ব ১৪

#প্রেম_পায়রা (২)
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব____১৪

ল্যাপটপ টেবিলে রেখে একটানে সম্পদের মুখের উপর থেকে ব্লাঙ্কেট সরিয়ে ফেলল তিথি। সম্পদ হাত মুঠ করে ফেলল। বন্ধ চোখ জোড়া খুলল না। দম বন্ধ করে মরার মতো পড়ে রইলো। এই মুহূর্তে তিথির চোখের দিকে তাকানোর মতো দুঃসাহসিক কাজ সে করতে পারবে না। তিথি সম্পদের বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘মি. প্রোপার্টি! উঠে পড়ুন বলছি!’

ধপ করে চোখ খুলল সম্পদ। বিস্ময় ভরা দৃষ্টি আবদ্ধ হলো তিথির নিষ্প্রাণ চোখে। তার দৃষ্টির গভীরতা ক্রমেই অতল স্পর্শ করলো। এক্ষুণি তিথি তাকে কি বলে ডাকলো? মি. প্রোপার্টি? সে বিস্ময়াভূত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘মাত্র কি বলে ডাকলে আমায়? প্রোপার্টি? প্রোপার্টি টাইপের কিছু?’

‘এইতো চোখ খুলেছেন। এবার বাধ্য ছেলের মতো এভাবে কিছুক্ষণ থাকুন। আমি খাবার নিয়ে আসছি।’

তিথি অতিশয় স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে রুমের বাইরে চলে গেল। এদিকে ঝড় তুলে দিয়ে গেল সম্পদের বুকে। বুকের ঘরটাতে প্রণয়ের সাজ সাজ রব পড়ে গেল। তিথির সাথে কাটানো মুহূর্ত গুলো একে একে স্মৃতিপটে ভেসে উঠলো। উপলব্ধি করলো, এই মেয়েটির প্রতি অনুভূত হওয়া অনুভূতি গুলো ইতোমধ্যে আকাশ ছুঁয়েছে। সে প্রচন্ড রকম নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে মেয়েটির উপর। এতদিন যে অনুভূতির সুতো পিছু টেনে ধরেছিল সেগুলো আজ উন্মুক্ত করে দিল। যতদূর যায়, যাক! তিথি নামক রহস্যময়ী নারী অবধি পৌঁছাক তারা। তার মনের কিনার স্পর্শ করুক!

মুখে বিস্তৃত হাসি ফুটে উঠলো সম্পদের। তিথি যেন না চাইতেও তাকে অনেক বড় একটা অধিকার দিয়ে গেল। এতদিন সে তিথির উপর কোনো অধিকার দেখায়নি। নিজের মনের কথা শোনেনি। সত্যি বলতে সে তিথির উপর কোনো প্রকার জোর করতে চায়নি। মেয়েটার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে তাকে ডমিনেট করার মতো মন মানসিকতা তার কোনো কালে ছিল না। কিন্তু আজ তিথি তাকে তার ব্যক্তিগত নামে আখ্যায়িত করে অদৃশ্য এক অধিকার দিয়ে গেল যেন। তার মনের কোণে নতুন করে আশার আলো জেগে উঠলো। তিথিকে কাছে পাওয়ার আশা, পাশে পাওয়ার আশা, বুকের খাঁচায় বন্দী করার আশা! তিথির সত্তাকে নিজের সত্তার মাঝে মিশিয়ে ফেলার সুতীব্র আশা।

দুই হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে তিথি ভেতরে ঢুকলো। টেবিলের উপর রেখে আবার বের হয়ে গেল। এক-দেড় মিনিটের মধ্যে আরো খাবার নিয়ে ঢুকলো। পুরোটা সময় সম্পদ এক ধ্যানে তিথির দিকে চেয়ে রইলো। এতদিন তিথির অগোচরে লুকিয়ে ঝুঁকিয়ে তাকে দেখে যেতো। চোখে চোখ পড়লে লজ্জায় কুঁকড়ে যেতো। কিন্তু আজ তার লজ্জা লাগছে না। বেহায়ার মতো শুধু তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছে করছে। মন বলছে, তিথি দেখুক। তার দিকে কেউ কতটা মায়া নিয়ে তাকিয়ে আছে। তার দিকে কেউ কতটা আবেগ, ভালোবাসা নিয়ে তাকিয়ে আছে।

তিথির সম্পদের ভাবনার দিকে নজর নেই। ইশারায় তাকে উঠে বসতে বলল। সম্পদ নিজে থেকে উঠে খাটে হেলান দিয়ে বসলো। খাবারের প্লেটটা তিথি তার দিকে বাড়িয়ে দিল। শ্বাস ফেলে বলল,

‘খেয়ে নিন!’

সম্পদ সঙ্গে সঙ্গে নিজের দু হাত লুকিয়ে ফেলল। তিথির উপর থেকে নজর সরালো না। চিপসানো স্বরে বলল,

‘আমি হাত দিয়ে খেতে পারবো না। খাইয়ে দাও তুমি!’

‘সে কি? কেন খেতে পারবেন না?’

‘অহেতুক প্রশ্ন করবে না তো। খাইয়ে দিতে বলেছি খাইয়ে দাও।’

তিথি বিস্ময় নিয়ে সম্পদের মুখোভঙ্গি পরখ করার চেষ্টা করলো। কিন্তু বেশ স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। সাথে কিছুটা বিরক্তও! সে আর বাড়াবাড়ির মধ্যে গেল না। সম্পদের পাশে বসে পড়লো। ছোট্ট করে ভাতের লোকমা সম্পদের মুখ তুলে দিল।

খাওয়ানোর পুরোটা সময় সম্পদ নিষ্পলকভাবে তিথির দিকে চেয়ে রইলো। তিথি প্রচন্ড ভড়কে গেছে। প্রতিবার মুখে খাবার তুলে দেওয়ার সময় সম্পদ কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। আড়চোখে দু একবার সে গভীর চাহনি দেখে গলা শুকিয়ে আসার উপক্রম হলো তার। খাবারের প্লেট সরিয়ে রেখে সে পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিল। পানির গ্লাসে চুমুক দিয়েও সম্পদ তার মুখের উপর থেকে দৃষ্টি সরালো না। তিথি আর ধৈর্য ধরে চুপচাপ থাকতে পারলো না। শুকনো ঢোক গিলে বলল,

‘কি হয়েছে আপনার?’

‘কিছু হয়েছে আমার? আমি কেন বুঝতে পারছি না?’

সম্পদের উত্তরে তিথি আরো ভড়কে গেল। মুখটা চুপসে বাচ্চাদের মতো হলো। তাড়াহুড়ো করে উঠে মেডিসিনের বক্স নিয়ে এলো। কাঁপা কাঁপা হাতে প্রেসক্রিপশন চেক করলো। রাতের মেডিসিন গুলো আলাদা করে বলল,

‘এগুলো খান।’

সম্পদ বাধ্যের মতো খেয়ে নিল। তিথি দ্রুত মেডিসিন গুলো বক্সে ভরে ফেলল। বক্স হাতে নিয়ে এগিয়ে যেতে ওড়নায় টান পড়লো। মুহূর্তে পা থেমে গেল তার। বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো। সম্পদ ওড়না টেনে ধরলো কেন? পরমুহূর্তে মনে পড়লো হয়তো সেদিনের মতো ভুলবশত। অস্বস্তি নিয়ে পেছন ঘুরে তাকাতে চোখ দুটো বড় বড় হয়ে এলো। সম্পদ সত্যি সত্যি তার ওড়নার নিচের অংশ মুঠোয় পুড়ে আছে। হাতের মেডিসিনের বক্সটা টেবিলের উপর ছুঁড়ে রাখলো সে। সম্পদের ধরে রাখা ওড়নার বাকি অংশে টান মেরে বলল,

‘কি করছেন? পাগল হয়ে গেছেন আপনি? ওড়না ছাড়ুন।’

‘ছাড়বো না!’

‘কি?’

তিথির কপাল কুঁচকে গেল। প্রথমদিকে সম্পদের কাজে ভয় পেয়ে গেলেও এখন বিরক্ত হলো। সম্পদের উপর অন্তত এতটুকু বিশ্বাস আছে যে মানুষটা তার কোনো ক্ষতি করবে না। ভ্রু জোড়া কুঁচকে সমস্ত শক্তি দিয়ে ওড়নায় টান দিল সে। কিন্তু সম্পদের থেকে ছাড়াতে সক্ষম হলো না। এবারে কঠোর গলায় বলল,

‘আমি আপনাকে খাবার খাওয়ালাম। অ্যালকোহল জাতীয় কিছু তো খাওয়াইনি। তাহলে মাতালদের মতো আচরণ করছেন কেন?’

‘তুমি মি. প্রোপার্টি ডাকলে কেন? এখন আমি সত্যি সত্যি মাতাল হয়ে গেছি।’

সম্পদের অস্পষ্ট সুর তিথির বোধগম্য হলো না। হতাশ সুরে বলল,

‘আমায় যেতে দিন এবার। বাড়তি খাবার, প্লেট সব গুছিয়ে রাখতে হবে।’

‘তুমি রাতের খাবার খেয়েছ না?’

‘হুঁ। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পরেই খেয়েছি৷ আপনার মতো গভীর রাতে খাওয়ার অভ্যাস নেই আমার।’

‘ভেরি গুড!’

বলে সে ওড়না ধরে দিল একটান। ওড়না সমেৎ তিথি বিছানার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো। সম্পদ তাকে জোর করে পাশে বসিয়ে দিয়ে বলল,

‘প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে তিথি। ঘুম আসবে না কিছুতেই। বিকেলের মতো মাথার চুল টেনে দাও তো!’

তিথির কৌতূহল মাখা দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সম্পদ শুয়ে পড়লো। বাম হাতে চেপে রাখা তিথির ওড়নার অংশটা ছাড়লো না। তিথির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘কি হলো? মাথার চুল টেনে দাও।’

‘দিচ্ছি। আপনি বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকবেন না। চোখ বন্ধ করুন।’

‘চোখ বন্ধ করছি। কিন্তু রাগের বশে কাটা জায়গা ব্যথা দিয়ো না আবার।’

মুচকি হেসে সম্পদ চোখ বন্ধ করলো। তিথি দাঁত কিড়মিড় করে কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে চেয়ে রইলো। ডান হাতটা দিয়ে সম্পদের কপালের ব্যান্ডেজ স্পর্শ করতে খপ করে সম্পদ হাত ধরে ফেলল। বন্ধ চোখে বলল,

‘উঁহু। নো চালাকি! আমি ব্যথা পেলে কিন্তু তোমায় তার চেয়ে দ্বিগুণ ব্যথা দিব।’

তিথি আর সাহস পেল না। সম্পদের থেকে হাতটা ছাড়িয়ে মাথার চুল স্পর্শ করলো। বুকের গহীনে উৎপন্ন হওয়া দীর্ঘশ্বাস গুলো একের পর এক চাপা দিয়ে গেল। অন্যমনস্ক হতে সম্পদের বিষণ্ণ সুন্দর কন্ঠ কানে এলো। মানুষটা স্পষ্ট অথচ ক্ষীণ কন্ঠে বিষণ্ণতা ঢেলে বলছে,

‘বাড়াই তৃষ্ণার হাত, ফিরে আসে শূন্যতাকে ছুঁয়ে-
তুমি নেই, নিষ্প্রদীপ মহড়ায় জ্বলে থাকে একা
পাথরের মতো ঠাণ্ডা একজোড়া মানবিক চোখ,
তৃষ্ণার্ত শরীর জুড়ে জেগে থাকে ব্যথিত রোদন।

নরম আলোর চাঁদ ম’রে যায় অঘ্রানের রাতে,
বেঁচে থাকে ভালোবাসা,নক্ষত্রের আলোকিত স্মৃতি।
তোমার শূন্যতা ঘিরে দীর্ঘশ্বাস,বেদনার ঘ্রাণ,
তোমার না থাকা জুড়ে থাকে সহস্র শ্মশান!’

-রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্

সম্পদের মুখের দিকে ব্যথিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো তিথি। মনের পর্দায় সবুজের চেহারা ভেসে উঠলো। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো। সে বুঝতে পারছে সম্পদ একটু একটু করে তার ভেতরে লুকিয়ে রাখা অন্ধকারের অপচ্ছায়া টেনে বের করতে চাচ্ছে। তাকে অতীতের কড়াল গ্রাস থেকে মুক্ত করতে চাচ্ছে। তার অন্ধকার কুঠুরী জোসনা দিয়ে আলোকিত করার চেষ্টা করছে৷ টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া নিষ্প্রাণ মানুষটার দেহে নতুন প্রাণ সঞ্চার করতে চাচ্ছে। কিন্তু কেন করছে সেটা বুঝতে পারছে না। লম্বা করে শ্বাস নিয়ে কান্না রোধ করলো সে। কাজটা এত সহজ নয়। তার ভেতরে কিছুই নেই। ধ্বংসস্তূপ ব্যতীত! সম্পদের ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে সে বিড়বিড় করে বলল,

‘কিছু অন্ধকার জোসনা দিয়ে কেন? তাজা রোদ্দুর দিয়েও আলোকিত করা যায় না। আপনিও পারবেন না!’

কিয়ৎক্ষণ সময় কেটে গেল। সম্পদের ভারী নিঃশ্বাস তিথি টের পেল। ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে মাথার চুল থেকে হাত সরিয়ে আনলো। উঠার জন্য সম্পদের মুঠো থেকে ওড়না ছাড়াতে গিয়ে চমকে গেল। এখনো শক্ত করে মুঠোয় চেপে ধরে আছে সম্পদ। সে বিস্ফারিত কন্ঠে বলল,

‘আপনি এখনো ঘুমাননি?’

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here