#নক্ষত্র_বন্দনা
#পর্ব_২৩
#লেখায়_জারিন
১২৮.
ড্রয়িংরুমের লম্বা সোফাটার হাতলে কোশন ঠিকিয়ে সোজা করে পা মেলিয়ে দিয়ে হেলান দিয়ে বসে আছে নক্ষত্র। কোলের উপর রাখা ল্যাপটপে অনবরত আঙুল চলছে তার। পাশের সেন্টার টেবিলে ছড়িয়ে আছে দু তিনটে ফাইল। চোখের সামনে সেটে থাকা চতুষ্কোণ আকৃতির চশমাটায় জ্বলজ্বল করছে ল্যাপটপের স্ক্রিনের আলো। বেশ মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে সে। হঠাৎ কফির কড়া গন্ধ নাকে আসতেই মনোযোগে বিঘ্ন ঘটলো তার। উৎস খুঁজে পাশে তাকাতেই দেখতে পেল ইরিন দাঁড়িয়ে আছে। হাতের ট্রেতে ধোঁয়া উঠা গরম কফি আর তার পাশেই ছোট একটা চিনির বয়াম।
লম্বা ঝরঝরে খোলা চুল..কিছুটা অগোছালো। লম্বা হাতাওয়ালা ঢিলেঢালা হালকা নীল সাদা সালোয়ার কামিজ পড়নে। নীল ওড়নাটা গলা থেকে কাঁধের উপর বেয়ে আড়াআড়িভাবে ঝুলে আছে। ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে ইরিনের ছোটমোটো শুকনা মুখখানা দেখলে এই মূহুর্তে যে কোন পুরুষের প্রেমে পড়ে যাওয়ার দশা হবে। বয়স বাড়লেও শরীরের গড়নে এখনো ২৩/২৪ এর যুবতী লাগে ইরিনকে। বিবাহিত বলেও মনে হয় না দেখলে। অথচ সে নক্ষত্রেরই দ্বিতীয় সন্তানের মা।
বিয়ের পর পর মাঝে মধ্যে দিনের বেলা বাড়িতে সুতি শাড়ি পড়ার অনুমতি পেলেও রাতে কখনোই তাকে শাড়ি পড়ে ঘুমাতে দিত না নক্ষত্র। নওরিন গর্ভে আসার পর থেকে তো সেটা একেবারেই নিষিদ্ধ হয়ে যায় ইরিনের জন্য। যদি হঠাৎ কখনো শাড়িতে পা আটকে যায়! গরমে কোন সমস্যা হয়! তাই ঘরে কেবল ঢিলেঢালা সুতি সালোয়ার কামিজ আর ম্যাক্সি পড়া হতো ইরিনের। বাইরে গেলে মাঝেমধ্যে শখ করে পড়া হতো শাড়ি। কিন্তু, ওয়াসিফের দ্বারা ঘটা দূর্ঘটার পর থেকে ইরিনের জন্য শাড়ি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে দেয় নক্ষত্র। শাড়িভর্তি আলামারিতে তালা পড়ে।
পুতুলের জন্মের সময় তো একদম কড়া নজরে রেখেছিল নক্ষত্র তাকে। আজকাল অফিসে গেলে অবশ্য শাড়িতে দেখা যায় ইরিনকে। সাজগোজের ধরণে তখন কিছুটা বিবাহিতা নারী লাগে। এছাড়া সালোয়ার কামিজে তার বয়স সত্যিই আন্দাজ করা কিছুটা মুশকিলই বটে।
সামনের দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখলো নক্ষত্র। রাত একটা বেজে পাঁচ মিনিট। ইরিন আর পুতুলকে রেখে ঘর থেকে বেরিয়েছিল যখন রাত প্রায় ১১ টার কাছাকাছি তখন। এতসময় পরেও কফি হাতে ইরিনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাকই হলো নক্ষত্র। তাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইরিন ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো, ‘ধরুন…আপনার কফি। চিনি দেইনি….কতটা খাবেন মিশিয়ে নিয়েন।’
‘দেড় চামচ চিনি দাও।’ আদেশের স্বরে কথাটা বলে ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ রাখলো নক্ষত্র। ইরিন তার গলার স্বর শুনে পুরো ব্যাক্কল বনে গেল। কিন্তু কিছু বললো না।কিঞ্চিৎ বিরক্তি নিয়েই দেড় চামচ চিনি মিশিয়ে দিল। কফির মগটা নক্ষত্রের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘নিন…মিষ্টি হয়েছে কিনা দেখুন। ‘
ইরিনকে এই সময় এই রূপে দেখে নক্ষত্রের মনে ইতোমধ্যে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। এক বছরের কিছুটা বেশি সময় তারা একসাথে থাকে না। ঘুমন্ত মুখের আদলে তার পরীর নিষ্পাপ আদুরে মুখখানাও দেখা হয়নি বহু..বহুদিন। ঘুমন্ত ইরিনের মুখখানা তার ভেতরে ভালোবাসার উত্তাল ঝড় তুলে দিতে সক্ষম ছিল বরাবরই। তবে কখনো তা কামনায় রূপ নেয়নি। এক অদ্ভুত শান্তির যোগান দেয় এই রূপ নক্ষত্রের মনে। অথচ এই শান্তিটুকুও কতকাল কাছে পাওয়া হয় না তার।
ইরিনের ভুলটুকু তার শান্তির সবটুকু কেড়ে নিয়েছে।সকল অনুভূতি ও বৈধ্য অধিকার নিয়েও শান্তিটুকু কাছে টেনে নিতে পারে না নক্ষত্র। অভিমান এক অদৃশ্য অভেদ্য স্বচ্ছ কাঁচের দেয়ালের মত তাদের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে আছে।যেটা ভেদ করেও একে অপরের মুখোমুখি হওয়া যায়, কথার শব্দ শুনতে যায় , শরীর ছোঁয়া যায়…কিন্তু অনুভূতি সে কাঁচের সূক্ষতা ভেদ করে একে অন্যকে স্পর্শ করে না।
১২৯.
নক্ষত্র নিজেকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ করে হাত বাড়িয়ে নিল কফির মগটা। ঠোঁটের কাছে নিয়েও সেটা ফিরিয়ে আনলো। ইরিন মগ দিয়েই চলে যাচ্ছিল। পেছন থেকে নক্ষত্রের কথায় থমকে দাঁড়ালো।
‘ভালো আছো, পুতুলের আম্মু?’
হঠাৎ এই মানুষটার থেকে এমন প্রশ্নে হাত-পা অবশ হয়ে এলো ইরিনের। এভাবে শেষ কবে তাকে এ কথা জিজ্ঞেস করেছিল মানুষটা? মনে করা দুষ্কর। বুকের ভেতর অচিন এক যন্ত্রণা খুঁচাখুঁচি শুরু করে দিয়েছে। চোখ জ্বালা করছে ভীষণ। শ্বাস ভারী হয়ে দমবন্ধ লাগছে খুব। ইরিন বড় করে একটা শ্বাস নিল। ঝরঝরে গলায় বললো, ‘আলহামদুলিল্লাহ। ‘
‘তাহলে মনোযোগ কোথায় তোমার?’
‘মানে?’ পেছন ঘুরে অবাক হয়ে বললো ইরিন।’
‘টেস্ট ইট।’ কফির মগটা ইরিনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো নক্ষত্র।
ইরিন ভ্রু কুচকে ফেললো নক্ষত্রের এমন কথায়। বিচলিত স্বরে বললো, ‘কি সমস্যা?”
‘খেয়ে দেখো।’ কফির মগটাকে উদ্দেশ্য করে বললো।
ইরিন বিরক্ত হয়ে মগটা হাতে নিয়ে তাতে চুমুক দিল একটা। চোখ মুখ কুচকে গেল নিমিষেই। বিরক্তিমিশেল গলায় বললো, ‘ইশ! এত তেঁতো কফি আপনি ক্যাম্নে খান পুতুলের বাবাই? কি বিচ্ছিরি!’
‘এটাই স্ট্রং কফি। কিন্তু, তুমি চিনি বেশি দিয়ে ফেলেছো।’ নির্বিকার গলায় বললো নক্ষত্র।
‘কিহ! এই তেঁতো কফিতে মিষ্টির ছিটাফোঁটাও নাই। আর আপনার চিনি বেশি মনে হচ্ছে?’ তেঁতানো গলায় বললো ইরিন।
‘তুমি হয় তো ঘুম চোখে দেড় চামচের জায়গায় দু চামচ চিনি দিয়েছো। তাই বেশি লাগছে।’ ল্যাপটপে আঙুল চালাতে চালাতে বললো নক্ষত্র। কথা শেষ করে আড়চোখে ইরিনকে দেখলো একনজর। কনফিউজড হওয়া মুখ নিয়ে চিন্তিত ভংগিতে দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে আছে কফি মগটার দিকে। তারপরও নিজের পক্ষ টেনে বললো, ‘একদমই না। আমি দেড় চামচ চিনিই দিয়েছি। ‘
‘তাহলে কি আমি মিথ্যা বলছি, পুতুলের আম্মু?
ইরিন এবার সত্যিই বিপাকে পড়ে গেল। সে জানেই নক্ষত্র মাঝেমধ্যে মজা করলেও কখনো সিরিয়াস ব্যাপার নিয়ে মিথ্যা বলার মানুষ না। সেকেন্ড কয়েক ভাবলো সে কিছু একটা। তারপর নক্ষত্রকে বললো, ‘আচ্ছা, স্যরি। ঘুম চোখে সত্যিই খেয়াল করিনি বোধয়। আমি আরেক মগ বানিয়ে দিচ্ছি।’
‘না…থাক। খাবার নষ্ট করা পছন্দ নয় আমার। জানো তুমি এটা। দাও এটাই। আই উইল এডজাস্ট। ‘
ইরিন আর কথা বাড়ালো না এই নিয়ে। চুপচাপ কফির মগটা ফেরত দিয়ে দিল নক্ষত্রকে। নক্ষত্র ওটা হাতে নিয়ে বললো, ‘ঘুম পাচ্ছিল তো এত রাতে কফি কে করতে বলেছিল তোমাকে?’
‘আপনার তো ঘুম হবে না আজ। রাত জেগে কাজ করবেন। কফি লাগে এসময় আপনার।তাই জন্য…’ কিঞ্চিৎ চোরা গলায় বললো ইরিন। নক্ষত্রের অভ্যাসগুলো যে আজও সে মনে রেখেছো এটা বুঝে নক্ষত্র আবার কি না কি ভাবে এই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে সে।
‘ঘুমাও গিয়ে যাও। ‘ কড়া গলায় বললো নক্ষত্র।
ইরিনের ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল এমন গলার স্বরে। গত ৫ টা বছর ধরে নক্ষত্র তাকে নিজের কোন ব্যাপারে জড়ায় না। তার খেয়াল রেখে কিছু করাতেও কড়া নিষেধাজ্ঞা ইরিনের। কেবল পুতুলের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার হলে তারা দুজন মিলে নেয়।
ইরিন আর দাঁড়ালো না। চুপচাপ ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিল। নক্ষত্র বুঝলো তার মন খারাপ হয়েছে। কিন্তু, সেটা নিয়ে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না সে।
মুচকি হেসে ইরিনের চুমুক দেওয়া জায়গাটায় ঠোঁট ছুঁইয়ে পরম তৃপ্তিতে চুমুক দিল কফিতে। চিনি ঠিকই ছিল। কিন্তু, মিষ্টির স্বাদটা এবার হয়েছে ঠিকঠাকভাবে।
১৩০.
বিকেল থেকে বৃষ্টি হওয়ায় আজ বাইরের পরিবেশ বেশ ঠান্ডা। ঝিরিঝিরি শীতল হাওয়ায় মাতোয়ারা এই গোমট শহরের গোটা প্রকৃতি। রাত প্রায় ২ টা। ইরিন দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। ভেতর ঘরে পুতুল ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু ইরিনের ঘুম ধুয়ে মুছে গেছে অভিমানের জলে। নক্ষত্রের ওমন কড়া গলার স্বরে আবারও অভিমান জেগে উঠেছিল তার। বাঁধ মানেনি মনের জমা কষ্টগুলো।
তিক্ত কিছু অতীত জুড়ে উত্তাল সমুদ্রের ঢেউয়ের মতই ফুলে ফেপে আছড়ে পড়েছে চোখের কার্ণিশে। ইরিন ভাবনায় ডুবে যায় অতীতের সেই দিনগুলোতে যেখানে এক বিছানায়…এক ছাদের তলায় থেকেও নক্ষত্র তাকে নিজের জীবন থেকে পৃথক করে দিয়েছিল। স্ত্রী হয়েও সম্পর্ক না হারিয়েও হারিয়েছিল নিজের মর্যাদা আর নক্ষত্রের প্রতি ব্যক্তিগত অধিকার। নক্ষত্র তাকে ভালোবাসা ছেড়ে দিয়ে কেবল দায়িত্বের খাতায় জায়গা দেয়। তবুও, আজও ইরিনের মনে প্রশ্ন জাগে, ‘নক্ষত্র কি সত্যিই তাকে ভালোবাসা ছেড়ে দিয়েছিল? ভালোবাসা কি সত্যিই এভাবে চাইলেই ছাড়া যায়? নাকি বিশ্বাসঘাতকের প্রতি রাগ ঘৃণা গিলে খেয়েছে সবটুকু ভালোবাসা?!’
১৩১.
সেই সব দিন গুলো ছিল ভীষণ কঠিন। হাসপাতালে ভর্তি করার পর থেকেই ইরিনকে বেশিরভাগ সময় কম পাওয়ারের ঘুমের ঔষধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হতো। কারণ ছিল দুটো। প্রথমত ইরিনের শারিরীক ক্ষত সারিয়ে তোলার জন্য প্রচুর বিশ্রামের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ইরিন ঘুমাতে পারতো না একদমই। নওরিনের জন্য কান্নাকাটি করতো প্রচুর। দেখা যেত হালকা ঘুম পেলেই হোটেল রুমের ঘটনাগুলো তার মস্তিষ্কে অগোছালোভাবে নাড়া দিত। ইরিন সেসব বুলি আউড়ে অস্থির হয়ে উঠতো। এমন কি মাঝে মধ্যে এতটাই উত্তেজিত হয়ে যেত যে নক্ষত্রকে কিংবা কোন পুরুষ ডাক্তার বা ওয়ার্ডবয়কে দেখলেও ওয়াসিফ ভেবে পাগলামি শুরু করতো। পালানোর জন্য ছুটাছুটি করতো। ওর হুশ জ্ঞান কিছুই কাজ করতো না। তখন তাকে ধরে বেঁধে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়ানো হতো।
নক্ষত্র প্রথমে মানসিকভাবে বেশ ভেঙে পড়েছিল ইরিনের এমন আচরণে। ইরিন যখন পাগলের মত চিৎকার করতো, ওয়াসিফকে বাঁধা দেওয়ার জন্য ঘুমের ঘোরেই হাতপা ছুঁড়ে দিত নক্ষত্র বুঝেছিল কতটা কষ্ট সহ্য করেছিল ইরিন সেসময়। ইরিনের প্রতি রাগ ঘৃণাকে ছাপিয়ে ওর জন্য কষ্টটা দ্বিগুণহারে জায়গা করে নেয় নক্ষত্রের মনে। প্রথম দু তিনদিন তেমনভাবে ওয়াসিফের নাম উচ্চারণ করতে না পারলেও যন্ত্রণায় ছটফট করতো সে। এরপর পুলিশের কাছে দেওয়া বয়ানে যখন ওয়াসিফের নাম প্রকাশ্যে আসে, নক্ষত্র প্রচন্ড আঘাত পায় মানসিকভাবে। নিজের প্রিয় ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভালোবাসার মানুষের এমন করুণ অবস্থার জন্য দায়ী হওয়ার অভিযোগ….চরম মানসিক আঘাতের পাওয়ার ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু, গত দিনগুলোতে ইরিনের ওমন আচরণ আর শায়লার সায় পেয়ে অবিশ্বাস করেনি সে ইরিনের কথা। মামলা করে ওয়াসিফের বিরুদ্ধে।
ইরিনের প্রতি এত যত্ন, এত শান্ত ব্যবহার মূলত এই জন্যই ছিল নক্ষত্রের তরফ থেকে। নিজের কষ্ট, রাগ, অভিমানের চাইতেও ইরিনের কষ্টটাকেই প্রাধান্য দিয়েছিল সে বেশি। সময়ের দাবিকে জায়গা দিয়েছিল নিজের অনুভূতির আগে।
নিবেদিত প্রাণের মত সেবা করেছিল প্যারালাইজড ইরিনের।
রোজ সকালের ব্রাশ থেকে শুরু করে গোসল খাওয়া সব কিছুই প্রায় সে একা হাতে করতো। অফিসের কাজগুলোও যথাসম্ভব বাড়িতে বসেই করতো।
কিন্তু ইরিন স্বাভাবিক হতে পারছিলনা। নক্ষত্রের সেবা, ধৈর্য্য তার প্রতি কোমল ব্যবহার আরও বেশি অপরাধবোধে জর্জরিত করে তোলে ইরিনকে। প্রচুর কান্নাকাটি করতো সে।একদিকে নিজের প্রথম সন্তান হারানোর শোক, যন্ত্রণা অন্যদিকে নিজের প্রতি ঘৃণা, অপরাধবোধ। ঘুম ঘোরে জেগে ওঠা সেই সব বিভৎস স্মৃতি।
নক্ষত্র তার সাথে কথা বলা কমিয়ে দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু ইরিন যখন কান্নাকাটি করতো তাকে ঠিকই বুকে নিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করতো। এ যেন ইরিনের অপরাধবোধ আরও শতগুণে বাড়িয়ে দিত। ঘৃণা হতো তার নিজের প্রতি আরও বেশি। তারওপর অদ্রিজা, নাফিজ শেখসহ নানান জনের নানান কূটুক্তি তো ছিলই।
বাপের বাড়ির তাচ্ছিল্যও কম সহ্য করেনি ইরিন। ভাইয়েরা সম্পর্ক রাখবে না বলে জানিয়ে দেয়।বোনেরাও শশুড়বাড়ির সম্মানের কথা চিন্তা করে ইরিনের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। আম্বিয়া খাতুন যতই রাগ, কূটুক্তি করুক, মেয়েকে একেবারে ছাড়তে পারেননি। মাঝেমধ্যে এসে দেখা করে যেতেন।।কিন্তু, ইরিনের ভাবীর চাপে পড়ে সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। রিতুকে নক্ষত্র আম্বিয়া খাতুনের কাছে পাঠিয়ে দেয়। যাতে ইরিনের এই অবস্থায় রিতুর মুখোমুখি না হতে হয় ইরিনকে। কিন্তু, অঘটন যখন ঘটার হয় তা ঘটেই ছাড়ে। নক্ষত্রের এত সতর্কতার পরেও ইরিনের সাথেও ঘটে গেল নতুন একটা অঘটন।
১৩২.
ইরিন গায়েব হওয়ার পর প্রায় দুইমাস ইরিনের সাথে রিতুর দেখা হয় না।নক্ষত্র রিতুকে এ বাড়িতে আনতে নিষেধ করেছে যতদিন না ইরিন সুস্থ হয়। কিন্তু রিতু অস্থির হয়ে গেছে ইরিনকে দেখবে বলে। না পারতে আম্বিয়া খাতুন রিতুকে নিয়ে এসেছেন শেখ ভিলায়। আজ নক্ষত্রও নেই বাড়িতে। অফিসের কাজে বাইরে গেছে।।ফিরতে রাত হবে। ইরিনকে শায়লার দায়িত্বে রেখে গেছে। সব কিছুই ঠিক ছিল, কিন্তু অবুঝ রিতুর কিছু কথা এক বিকেলেই পাল্টে দিল অনেক কিছুই।
রিতুকে ইরিনের কাছে বসিয়ে আম্বিয়া খাতুন গেছেন অযু করতে। আসরের নামাযের জন্য। ইরিন গল্প করছিল বোনের সাথে। জীবনে এই প্রথম এত সময় বোনের থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেছে সে। এমনকি রিতু নিজেও। তাই দুইবোন একসাথে হতেই এতদিনের না বলা কথা নিয়ে গল্পে মেতে উঠেছে।এরমধ্যেই রিতু বললো,
‘হ্যাঁ রে….ছোটোপা, তুই নাকি তোর বাবুটাকে মেরে ফেলছিস? নওরিন আর আসবে না আমার সাথে খেলতে?’ সাত বছর বয়সী রিতুর মুখে এমন কথা শুনে ভেতরটায় নতুন করে রক্তক্ষরণ হয় ইরিনের। পুরোনো যন্ত্রণায় যেন নতুন করে কেউ খুবলে দেয়।
‘তোকে এ কথা কে বলেছে রে বুড়ি?’ ইরিন জিজ্ঞেস করে।
‘বড়ভাবী বলছে। আজকে আম্মা আমাকে নিয়ে আসার সময় বড়ভাবী বলেছে তুই নাকি একটা রাক্ষসী। নিজের বাবুকে খেয়ে ফেলছিস। বাবু কি খাওয়া যায় রে ছোটোপা??আর তুই নাকি একটা বে…ব্যা…’
‘কি?’ বুঝতে না পেরে ব্যাথিত কন্ঠে প্রশ্ন করে ইরিন।
‘মনে পড়তেছে না তো। আমি তো জিজ্ঞেস করছিলাম এইটা কি। ভাবী বলছে…রাত্রেবেলা রাস্তায় যে মেয়েরা দাঁড়ায় থাকে তুই নাকি ওরকম। কি যেন বললো শব্দটা..ব্যাএএশ…ভুলে গেছি। ‘
অনেক চেষ্টা করেও মনে না করতে পেরে ব্যাথিত গলায় বললো ছোট্ট অবুঝ রিতু।
‘আচ্ছা আপা, তুই কি সত্যিই রাত্রিবেলায় রাস্তায় যাস? ভাইয়া তোকে বকা দেয় না? আমি তো সন্ধ্যায় আযান দিলে খেলতেও পারি না। আম্মা বাইরে থাকতে দেয় না। তাহলে তুই রাস্তায় যাস কিভাবে? এই জন্যই কি ভাইয়া তোর পা ভেঙে দিছে? তাই তুই হাঁটতে পারিস না?’
ইরিন পুরা চুপ। কি জবাব দিবে সে এই অবুঝ শিশুর প্রশ্নের?
ইরিনকে চুপ থাকতে দেখে রিতু আবারও বললো, ‘তুই জানিস ছোটোপা…ভাবী আম্মাকে বলছে আমাকে তোর সাথে না থাকতে দিতে। তাইলে নাকি আমিও তোর মত নোংরামি করবো। তুই কি নোংরামি করছিস রে ছোটোপা?ভাবী এমন ক্যান বলে? আমি আজকে খুব ঝগড়া করছি ভাবীর সাথে। তাই জন্য ভাবী আমাকে চড় মারছে। এই যে দেখ। -কাঁদো কাঁদো গলায় ইরিনকে নিজের গাল দেখিয়ে বললো রিতু।
ইরিন এতক্ষণে খেয়াল করলো রিতুর গালে লাল হয়ে আছে।কোমল ফর্সা গালে রক্ত জমাট বেঁধেছে বেশ কিছুটা। ইরিনের ভেতরটা পুরো দুমড়ে মুচড়ে গেল। তার জন্য তার বোনকেও অকারণ আঘাত পেতে হচ্ছে।
‘আম্মা কিছু বলে নাই ভাবীকে..তোকে যে মারলো?’ ইরিন কান্না জড়ানো গলায় প্রশ্ন করে।
‘বলছিল। বকা দিসে ভাবীকে। আমাকে বলছিল তোকে না বলতে। কিন্তু, তোকে সব কথা না বললে কি আমার ভালো লাগে বল? তুই জানিস ভাবী আম্মাকে কি বলছে?’
‘কি বলছে?’ কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করে ইরিন।
‘আম্মার নাকি গলায় দঁড়ি দেওয়া উচিৎ। তুই বল আপা আম্মা গলায় দঁড়ি দিবে ক্যান? দঁড়ি কি গলায় দেওয়ার জিনিস?’
ইরিন আর সহ্য করতে পারলো না। রিতুকে বুকে টেনে নিয়ে ডুকরে কেঁদে ফেললো। অবুঝ রিতু আকস্মিক এ ঘটনায় ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। সেও কান্নাজুড়ে দিল ইরিনের সাথে। আম্বিয়া, শায়লা কনক সবাই ছুটে আসে ইরিনের ঘরে। দুজনকে এভাবে কাঁদতে দেখে আম্বিয়া হতভম্ব স্বরে বলেন, ‘কি রে কি হইছে ইরিন? এভাবে কাঁদতেছিস কেন তোরা?’
রিতু কান্নার দমকে কিছু বলতেই পারলো না। ইরিনকে ধরে সমানে কেঁদে যাচ্ছে সে। ইরিন সবাইকে এভাবে নিজের ঘরে দেখে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেল।
কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, অনেকদিন পর রিতুকে কাছে পেয়ে কেঁদে ফেলেছে। আর তার কান্না দেখে ভয়ে রিতুও কেঁদে ফেলেছে। নাটকীয় শুনালেও মেনে নিল সবাই ইরিনের এমন কথা। সবাই জানেই ইরিন রিতু একে অন্যের প্রাণ বলতে গেলে। রিতুর জন্ম আম্বিয়ার গর্ভে হলেও তাকে গভীর আদর যত্নে বড় করেছে ইরিন। বিয়ের পরেও নক্ষত্রের কারণেই ইরিনকে রিতুর থেকে আলাদা হতে হয়নি। তাই এমন দূর্ঘটনার পর, এতকাল পরে বোনকে কাছে পেয়ে আবেগ প্রবণ হয়ে গেছে ইরিন।
আম্বিয়া রিতুকে নিয়ে চলে যেতে চাইলেও ইরিন দিল না। সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই ইরিন রিতুকে বুঝিয়ে বললো যেন এসব কথা অন্যকাউকে না বলে। রিতুর বয়স কম হলেও আদর স্নেহের জোরে সে ইরিন ও নক্ষত্র দুজনেরই ভীষণ বাধ্য। তাই একবাক্যেই ইরিনের কথা মেনে নেয় রিতু।
সন্ধ্যা বাড়ি ফিরে যাওয়ার আগে আম্বিয়া খাতুন দেখা করতে আসেন ইরিনের সাথে। ইরিন তাকে জড়িয়ে ধরেও অনেক কাঁদলো। আম্বিয়া খাতুন মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন পরম স্নেহে। নক্ষত্রের কাছে সবটাই শুনেছেন তিনি। প্রথমে ইরিনের প্রতি রাগ ঘৃণা হলেও সন্তান তো সেও। নক্ষত্রের বুঝিয়ে বলায় তিনি আর কোন খারাপ আচরণ করেননি ইরিনের সাথে। বিদায়ের আগে বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে তিনি বুঝালে মেয়েকে। যেন নক্ষত্রের কথা শুনে চলে। ভালো হয়ে থাকে। যা হয়েছে তা যেন দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যায়।
ইরিন কোন কথা বলিনি এসব নিয়ে। কেবল তার মত মেয়ের মা হতে হয়েছে বলে ক্ষমা চায় আম্বিয়া খাতুনের কাছে। তিনিও মেয়ের অপরাধ বোধের কথা ভেবে ব্যাথিত হন। পরম স্নেহে তাকে আদর করে দেন। এরপর, রিতুকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যান তিনি।
১৩৩.
জ্ঞান ফিরতেই প্রথমে নিজের সামনে নক্ষত্রকে বসা দেখলো ইরিন। উঠে বসার চেষ্টা করতেই শক্ত হাতে বেশ জোরালো এক চড় পড়লো ইরিনের গালে। এই প্রথমবারের মত নক্ষত্র ইরিনের গায়ে হাত তুললো। ঘরজুড়ে মানুষের নিঃশব্দ উপস্থিতি। কেউ কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না নক্ষত্রের এমন কাজের জন্য।
এতটা রাগ করতেও এই প্রথম দেখছে তারা নক্ষত্রকে। ইরিন কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না এ বিষয়ে। চুপচাপ বসে রইলো বিছানায়। শরীরে নিজ থেকে হালকা নড়াচড়ারও শক্তি পাচ্ছে না সে। একহাতে ক্যানোলা দিয়ে রক্ত দেওয়া হচ্ছে।ইরিন আর উঠার চেষ্টা করলো না। অসাড় শরীর নিয়ে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলো বিছানাতেই। দু চোখের কার্নিশ বেয়ে নিরবে নেমে এলো সিক্ত যন্ত্রণার ধারা।
ইরিনের জ্ঞান ফিরেছে দেখে আম্বিয়া, শায়লা, কনক বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। নক্ষত্র এবং ইরিনকে এই মূহুর্তে একলা ছাড়াই ভালো। অন্যায্য না হলেও আম্বিয়া খাতুন নক্ষত্রের এমন রাগ ও ইরিনকে চড় মারতে দেখে প্রথমে কিছুটা ঘাবড়ে যান। হাজার হোক মা তো তিনি। সন্তান যতই ভুল করুক এমন করুন অবস্থায় তার সাথে এমন আচরণ কখনোই কাম্য নয়।আম্বিয়া খাতুনের এমন বিচলিত অবস্থা দেখে শায়লা ভরসা দেন। নক্ষত্র এমন রাগ করলেও এতটা নিয়ন্ত্রণহীন সে নয় যে রাগে ইরিনের বা অন্যকারও কোন ক্ষতি করে দিবে। তাই আম্বিয়া খাতুনও আর আপত্তি করেননি।চলে আসেন ইরিনকে রেখে।
শুধু ইরিনের কথা ভেবে আফসোস হলো তার। মেয়েটা কি বোকামিটাই না করলো আবার। বোকামি না বলে আরেকটা ভুল বললেও বোধয় কম হবে। নক্ষত্রের এত সেবা, এত চেষ্টাকে বৃথা করে দিয়ে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল সে।
সন্ধ্যায় আম্বিয়া খাতুন বাড়ি যাওয়ার পথেই খবর পায় ইরিন হাতের শিরা কেটেছে। বেড সাইড টেবিলের উপর রাখা ফল কাটার ছুরি দিয়ে এ কাজ করেছে সে। শায়লা সন্ধ্যার নাস্তা দিতে এসে দেখেন ইরিন অচেতন হয়ে পড়ে আছে। বা’হাত থেকে ধীমিগতিতে রক্ত পড়ছে। মেঝেতেও বেশখানিকটা রক্ত। শয়লা পুরো দিশেহারা অবস্থায় নক্ষত্রকে ফোন করেন। নক্ষত্র মিটিং ফেলে ডাক্তার নিয়ে ছুটে আসে বাড়িতে।
এই নিয়েও নাফিজ শেখ ঝামেলা করেন।যে মেয়েটাকে বাবার স্নেহ দিয়ে নিজের মেয়ের মত আপন করে নিয়েছিলেন আজ সেই তার দুচোখের বিষ। ইরিনের জন্যই নাকি তার বোনের পরিবারের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে, অদ্রিজার বিয়ে ভেঙেছে আর নক্ষত্রও কাজে মনোযোগ দিচ্ছে না আগের মত। অফিস ফেলে দিন রাত ইরিনের সেবায় পড়ে থাকে। ইরিনের অচেতন অবস্থায় যখন নক্ষত্রর পাগলপ্রায় অবস্থা সেই সময়টাও তিনি চুপ থাকেননি। যা নয় তাই শুনিয়েছেন নক্ষত্রকে। সব মিলিয়ে নক্ষত্রও নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি।।বিক্ষিপ্ত মন, নাফিজ শেখের তিক্ত কথা সব মিলিয়ে রাগ ঝেড়েছে ইরিনের উপর।
সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে নক্ষত্র দরজা আটকে দেয়। ইরিনকে ঘরে রেখে নিজে ব্যালকোনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। আঙুলের ফাঁকে বিষাদ জ্বালায়। ঠোঁটের ভাঁজে কষ্ট পোড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে। মূহুর্ত কয়েক এভাবেই গড়ায়। কানে আসে গুমড়ে গুমড়ে কান্নার শব্দ। নক্ষত্র জানে এটা ইরিন। রাগ বাড়ে তার। যে মানুষটাকে এতটা ভালোবেসেছিল, বিশ্বাস করেছিল সে কি করলো! বিশ্বাসঘাতকতা।
প্রকৃতির শাস্তি ভোগ করতে গিয়ে নিজের সাথে সাথে নক্ষত্র এবং নিজেদের অনাগত ভবিষ্যৎ প্রাণটাকেও শেষ করে দিয়েছে সে। ভাগ্য তাকে সুযোগ দিয়েছিল। নক্ষত্র সব সহ্য করেও তাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টায় নিজেকে সবভাবে বিলিয়ে দিয়েছিল। আর সেই কিনা শেষে নিজ হাতেই নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিল? বারবার বলার পরেও হারিয়ে যেতে চেয়েছিল নক্ষত্রের জীবন থেকে। এতখানি দুঃসাহস! এটা নক্ষত্র কিছুতেই বরদাস্ত করবে না। রাগ অভিমান ক্ষোভ জড় হয়ে ভীষণভাবে চেপে ধরলো নক্ষত্রকে। জলন্ত সিগারেট পিষে যায় পায়ের তলায়। নক্ষত্র ঘরের দিকে পা বাড়ায়।
১৩৪.
‘কান্না থামাও ইরিন, কথা আছে তোমার সাথে।’ ইরিনের পায়ের কাছে বসতে বসতে বললো নক্ষত্র।
ইরিন কান্না থামানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। নিজেকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সে। নক্ষত্র এবার ধমকে উঠলো, ‘কান্না থামাবি? নাকি দুই চারটা থাপ্পড় আরও লাগবে তোর?’
ইরিন বুঝলো নক্ষত্র রেগে গেছে। তার মুখের ভাষা বদলে গেছে মানেই এখন সে বিন্দুমাত্র ছাড় দিবে না ইরিনকে। ইরিন ভয় পেল মনে মনে। কান্নাও থামছে না। কি একটা বেগতিক অবস্থা। নক্ষত্র এবার হেঁচকা টানে ইরিনকে উঠিয়ে বসালো। দুই বাহু চেপে ধরে রাগী গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘কি সমস্যা তোর? ক্যান করছিস এমন? জীবন এত সস্তা লাগে তোর? হ্যাঁ? এত সস্তা? নাকি আমাকে সস্তা লাগে তোর? বল! কি জন্য করছিস এই কাজ…বল!!!’
ইরিনের অন্তআত্মা কেঁপে উঠলো এমন ধমকে। ইরিন দিকবিদ্বগ ভুলে আঁছড়ে পড়লো নক্ষত্রের বুকে। দুর্বল হাতেই নিজের সমস্ত জোর খাটিয়ে খাঁমচে ধরলো নক্ষত্রের পিঠ। আরও জোরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো সে। নক্ষত্র কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো ইরিনের বিপরীতে। চুপচাপ বসে রইলো ওভাবেই। ইরিনকে ধরলো না পর্যন্ত।
কাঁদতে কাঁদতেই একসময় ইরিন বললো, ‘আমি খুব খারাপ, নওরিনের আব্বু। খুব খারাপ আমি। ঠিকই বলছে ভাবী, আমার আর রাস্তার মেয়েদের মধ্যে তো কোন তফাৎ নাই। আমি আপনার যোগ্য না। এই যে এত সব কিছু…এসবের যোগ্য না তো আমি। ঘেন্না লাগে আমার নিজেকে। বিচ্ছিরি লাগে। শ্বাস নিতেও কষ্ট লাগে খুব। আল্লাহর….আল্লাহর এই শাস্তি আমার সহ্য হইতেছে না। বেঁচে থাকার শক্তি নাই আমার আর। প্লিজ আমাকে মেরে ফেলুন। আমার আর সহ্য হইতেছে না এসব। ‘ কাঁদতে কাঁদতে হাঁপিয়ে উঠেছে ইরিন।ভীষণ দূর্বল ও ক্লান্ত সে। তাও বড় বড় শ্বাস টেনে বললো কথাগুলো। নক্ষত্র শুনলো সব চুপচাপ।
কিছু মূহুর্ত এভাবেই কাটলো তাদের। কাঁদতে কাঁদতে গলা স্বর বসে গেছে ইরিনের। নক্ষত্র গভীর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলগোছে চোখ মুছে নিল নিজের। হাতটা ইরিনের মাথায় রেখে অন্য হাত তার পিঠে রাখলো। তাকে শান্ত করতে আরেকটু গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে ক্লান্ত নিস্তেজ গলায় বললো, ‘এই জীবন শাস্তি লাগে তোমার….তাই মরে গিয়ে রেহায় পেতে চেয়েছো। কিন্তু আত্মহত্যার পরের যে শাস্তি সেটা থেকে কিভাবে রেহাই পেতে তুমি?’
ইরিন চুপ। ক্লান্ত হয়ে এখন নক্ষত্রের বুকে লেপ্টে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তাকে চুপ থাকতে দেখে হতাশ হলো নক্ষত্র। হতাশা জড়ানো গলায় বললো, ‘তুমি যেটা করেছো ইরিন…আমি জানি না এর শাস্তি আমি দিলে ঠিক কি বা কতখানি হতো সেটা তোমার জন্য। কিন্তু, যতটা পেয়েছো সেটা অনেক বেশি। তবুও আল্লাহ ভালো জানেন কেন কার কতটা প্রাপ্য। আল্লাহ চাইলে সেদিনই তুমি মরে যেতে পারতে। তোমাকে যে অবস্থায় পাওয়া গেছিল তাতে বেঁচে থাকা অসম্ভব ছিল প্রায়। তাও তুমি বেঁচে আছো। এই যে তোমার অনুতাপ, আত্মদহন এগুলোও তোমার শাস্তি ও শিক্ষা দুইটাই। তুমি এভাবে মরে গেলে একজীবন থেকে বেঁচে যেতে হয় তো, কিন্তু তোমার সাথে যে এটা করেছে তাকে বাঁচিয়ে যাচ্ছো কেন? আর আমি? আমাকে কি মানুষ মনে হয় না তোমার..এত কষ্ট কেন দাও?’
‘আমি তো খারাপ…খুব খারাপ। আপনার নখেরও যোগ্য না।তাহলে ছেড়ে দিচ্ছেন না কেন আমাকে? কেন আমাকে বয়ে বেড়াচ্ছে এভাবে? ‘
‘আল্লাহ তোমাকে আমার জন্য নির্ধারণ করেছেন। স্ত্রী হিসেবে তুমি আমার দায়িত্ব। তুমি খারাপ হও ভালো হও তুমি ততোদিন আমার দায়িত্ব যতদিন আমি স্বেচ্ছায় তোমাকে না ছাড়ি বা আল্লাহ আমাকে তার দরবারে ডেকে পাঠান। ‘
‘তাহলে কেন ছেড়ে দিচ্ছেন না আমাকে? আমি তো নষ্ট মেয়ে। আপনার জীবন নষ্ট করছি। ডিভোর্স দিয়ে দিন আমাকে।’
ডিভোর্সের কথা শুনে দমে যাওয়া রাগটা আবার উথলে উঠে নক্ষত্রের। কড়া গলায় জবাব দেয় সে।
‘তুই খারাপ…তোরে আমি একাই সহ্য করি না হয়।আমার একার জীবনই নষ্ট হোক। ডিভোর্স দিয়ে ছেড়ে দিলে যে অন্য কারও জীবন নষ্ট করবি না তার কি গ্যারান্টি! ‘
এত দুঃখের মাঝেও চূড়ান্ত কষ্ট পেল এবারে ইরিন। নক্ষত্র তাকে এতটা বাজে মেয়ে ভাবে? এত নিম্নমানের সে? এর চাইতে তো তার ভাবীর বলা রাস্তার মেয়ে অনেক ভালো ছিল। ওরা তো নিজেকে বিক্রি করে বেঁচে থাকে। আর ইরিন কিনা নিজেকে বিলিয়ে অন্যের জীবন নষ্টের কারণ হবে? এতটাও বাজে কথা নক্ষত্র বলতে পারলো তাকে?
থেমে আসা কান্না আবারও বাঁধ ভেঙে উপচে পড়লো তার। ভাঙা গলায় কিছুটা অস্পষ্ট স্বরেই বিড়বিড় করে বললো, ‘এর চাইতে তো আমার মরে যাওয়াই ভালো।’
বিড়বিড় করে বললেও কথাটা নক্ষত্রের কানে গেল ঠিকই। রাগ সীমানা ছাড়ালো তার। ইরিনকে বুকের উপর থেকে সরিয়ে বিছানা ধাক্কা মেরে ফেলে দিল সে। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে গেল বিছানা ছেড়ে। ঝাঁঝালো গলায় বললো, ‘ এতই সহজ! এই জীবন শাস্তি লাগে না তোর?? আই সোয়্যার ইরিন, যতদিন না আল্লাহ তোরে মুক্তি দিবে এই শাস্তির জন্য হইলেও আমি দায়িত্বে নিয়া তোরে বাঁচায় রাখবো।আমার যোগ্য তো না তুই। আজকে থেকে কেবল আমার দায়িত্ব হয়েই থাকবি তুই। নামমাত্র স্ত্রী। ‘
কথাশেষ করে এক মূহুর্তও দাঁড়ালো না নক্ষত্র।রাগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। ইরিন নিজের প্রতি বিতৃষ্ণায় ডুকরে কেঁদে উঠলো আবারও।
আহরে জীবন……আহা জীবন…
জলে ভাসা পদ্ম জীবন!
_ডুব
চলবে…