#জলছবি
#পার্ট_২৮
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.
লেকের পানিতে পা ভিজিয়ে বসলো নোলক। এক পায়ের নূপুরখানা জলে ভিজে শব্দ হারালো। পানি থৈ থৈ করে কেঁপে উঠলো। গাছ থেকে শুকনো পাতা, ঝড়ে যাওয়া ফুল পড়লো সেই থৈ থৈ করা পানিতে।
মৃদু বাতাসে মাথা ওড়না খানিক সরে গিয়ে, আলগা চুল এসে পড়লো অভিযোগ মাখা স্নিগ্ধ চোখে। ইশান তখনও আসেনি।
সে আসলো আরো মিনিট দশেক পর। চুপটি করে নোলকের পাশে বসলো। নোলক ভাবান্তরহীন দৃষ্টিতে চাইলো।
ইশান সুন্দর করে হাসলো। মাড়ির কিনারের বাঁকা দাঁতটা ভেসে উঠলো। তবে এই হাসি, অন্য হাসি। তা অবশ্য বোঝার উপায় নেই। নোলক মুখ ফিরিয়ে নিলো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জিজ্ঞেস করলো,
“কখন এসেছো? বেশিক্ষণ অপেক্ষা করালাম, না?”
নোলক ভণিতা ছাড়াই বলে,
“উঁহু, বেশিক্ষণ হয়নি। কিন্তু আমি বিরক্ত হয়েছি।”
ইশান তপ্ত নিশ্বাঃস ফেললো। তারপর কন্ঠে প্রচুর দরদ মেখে প্রশ্ন ছুড়লো,
“একটা সত্যি কথা বলি?”
নোলক চাইলো কেবল। ইশান বলল,
“এই যে স্পষ্ট করে সত্যি কথা বলে ফেলো, এটা আমি খুব পছন্দ করি। আমরা অনেকেই মুখের উপর সত্যি কথা বলতে পারি না!” বলেই হাসলো। একটু থেমে জিজ্ঞেস করলো,
“কেমন আছো?”
নোলক ছোট্ট করে শুধু বলল,
“ভালো।”
ইশান আনমনে কিছু ভাবলো। নোলক ভাবনা এগোতে দিল না। বলে উঠল,
“কেন ডেকেছেন? কী বলতে চান?”
“অনেক কিছু! অনেক কিছু বলতে চাই অগ্নিশর্মা। শুনবে প্লিজ? কত কথা জমে আছে, সব কথা তোমায় দিতে চাই। নিবে প্লিজ?”
নোলক ইশানের মুখের দিকে তাকায়। এমন নির্লিপ্ত, অসহায় মুখের ইশানকে তার অপরিচিত লাগে। সারাক্ষণ ‘অগ্নিশর্মা অগ্নিশর্মা’ বলে অগ্নিকুন্ডলি হয়ে জ্বলে থাকা ছেলেটাকে ভারী অদ্ভুত লাগে। এ যেন অন্য ইশান!
মুখে কিছু না বলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চায় নোলক। ইশান চোখ সরিয়ে অন্যদিকে চায়। দু’হাতে নিজের হাঁটু আঁকড়ে ধরে পিঠ খানিকটা পিছনে হেলে দেয়। দখিনা বাতাস এসে লাগে চোখে, মুখে, মনে! বলে,
“তোমাকে একটা গল্প বলি? অনেক কথার ছোট একটা গল্প?”
নোলক সুধায়,
“গল্প?”
“হুম, গল্প। আদ্র’র গল্প, আমার গল্প, আমদের বন্ধুত্বের গল্প।”
নোলকের আর কথা আসে না। দুজনেই বেশ খানিকটা সময়জুড়ে আনমনা হয়ে থাকে। তেজহীন সূর্য এসে যখন চোখে লাগে, ঠিক তখন ইশান বলতে শুরু করে,
“তখন সম্ভবত সপ্তম শ্রেনীতে পড়ি আমি, আমরা। হোস্টেলে আমাদের দুজনের একই রুম কিন্তু ওকে আমি একদমই পছন্দ করি না। দুজনের স্বভাব ভিন্ন বলেই অপছন্দ করতে শুরু করি। অল্পবয়সে আদ্রর অমন মস্ত বড় ছেলেমানুষ হয়ে যাওয়াটাও অপছন্দের শক্তপোক্ত কারণ। কেমন গম্ভীর! সমবয়সী একটা ছেলে, রাগি স্যারদের মতো গম্ভীর হয়ে থাকে! কেমন অদ্ভুততুড়ে না?
আমার তখন অনেক বন্ধু। আদ্র’র কোনো বন্ধু নাই। সারাক্ষণ বই হাতে নিয়ে বসে থাকতো। স্কুল, হোস্টেলের রুম, রুমের টেবিল, বিছানা আর বিছানার পাশের খোলা জানালায়া ছাড়া ওর দুনিয়ায় আর কিছুই নেই যেন!
মাঝে-মধ্যে প্রচুর বিরক্ত লাগতো। এত পড়তে হবে কেন? এত পড়ে কি হবে? হলো অবশ্য অনেক কিছুই, স্যার ম্যামদের প্রিয় ছাত্র হয়ে উঠলো অল্প ক’দিনেই। পরপর মারাক্তক ভালো রেজাল্ট!
অন্যদিকে আমি, সন্ধ্যে হলে কিছুক্ষণ বই নিয়ে বসে থাকি, তারপর ঘুমিয়ে পড়ি। পড়াশোনা ভাল্লাগে না। ভাবি, অত পড়ে কি হবে? তার চাইতে বরং ঘুমাই! শুধু ঘুমালেও চলতো, ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও খেলি!
ছেলেটা রাত জেগে পড়ত। পড়াশোনা ছাড়া এই জগতে যেন তার কোনো ধ্যানধারণা নাই। তার দুটো চোখের কাজই যেন বইতে নিবদ্ধ রাখা। আমি তো মনেমনে মনের জ্বালা মিটিয়ে মিনিটে মিনিটে বলতাম, চোখ দুটো খুলে বইয়ে স্কচটেপ মেরে রাখ না বেটা! হা হা হা!
মাঝেসাঝে সেধে সেধে কথা বলতে গেলেও আদ্র ‘হু’ ‘হা’ অব্দি-ই সীমাবদ্ধ। আমার রাগ আরো বেরে যেত!
অন্যদের সাথে আমার খুব ভাব, কিন্তু ওরে দুই চোক্ষে সহ্য করতে পারি না।
একবার হলো কি? আমার জ্বর হলো। যেমন তেমন জ্বর না। মরা বাঁচা টাইপ জ্বর। সে রাতে আমার মনে হলো, আমি বোধহয় মারা যাচ্ছি। জ্বর হওয়ার কারন টানা তিন ঘন্টা বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলেছি ছাদে। যে ক’জন ভিজেছিলাম সবাই মারও খেয়েছি, হোস্টেলের নিষেধ অমান্য করে বৃষ্টিতে ভিজে ছাদে ফুটবল খেলায়। অমন মাইর তখন প্রায়শই খাই, তাই মাইর খাওয়াতে দুঃখ নাই। আসল যন্ত্রনা টের পেলাম রাতে।
জ্বরের তাপে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। কথা বের হয় না মুখ দিয়ে। ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ! কি যে কষ্ট! আদ্র তখনও সজাগ। ওর রাত জাগাটা আমার বিরক্তি ছিল, কিন্তু সেবার সেটাই সাংঘাতিক রকম কাজে লেগে গেল। আদ্র কাছে এসে কপালে হাত রাখলো। কেঁপে উঠে বলল, তোমার কি বেশি খারাপ লাগছে, ইশান? জ্বর এসেছে তো খুব!
কিছু বলতে পারলাম না আমি।
আমার কাঁপুনি দেখে ফ্যান অফ করে দিল, কাথা জড়িয়ে দিল গায়ে। ঝটপট করে জলপট্টিও দিল। এটুকুই মনে রইলো।
তারপর কি কি করলো আর জানি না। যখন জ্ঞান ফিরলো তখন নিজেকে হসপিটাল আবিষ্কার করলাম। দম বন্ধও লাগছিলো না, খারাপও লাগছিল না। তবে একটু ক্লান্ত লাগছিলো শুধু। মা-বাবা সবাই চলে এলো গ্রাম থেকে। জানতে পারলাম দুদিন যাবত হসপিটালে। মাঝের কিছুই মনে নেই আমার। পরে জেনেছি আদ্রই সবাইকে খবর দিয়েছে। হল সুপারকে মাঝরাতে জাগিয়ে পুরো হোস্টেল জাগিয়ে ফেললো। ভাবতে পারছ? যাকে শুরুতে অপছন্দ করলাম সে আমার কেমন কাজে লেগে গেল? কেমন করে আপন হয়ে আগলে নিলো?
মা-বাবার সাথে সেদিন আদ্রকেও দেখতে পেলাম বেডের পাশে। নিজের চোখের থেকেও মোটা ফ্রেমে চশমা পড়া ছেলেটা সেদিন থেকে আমার খুব কাছের হয়ে গেল। খুব প্রিয় হয়ে গেল। মা-বাবার পাশে একটা দায়িত্বশীল বন্ধু দেখতে পেলাম, একজন খুব আপন ভাই খুঁজে পেলাম। সেই যে পেলাম, আর হারালাম না। একদম শক্ত করে আঁকড়ে ধরলাম।
এক জ্বরে একদম সোজা হয়ে গেলাম। আদ্র আর আমি মিলে আমরা হয়ে গেলাম। বন্ধু, ভাই। ও যে একটা সম্পর্ক নিয়ে কতটা সেন্সেটিভ, তুমি জানো না অগ্নিশর্মা! তুমি জানলে অবাক হবা অগ্নিশর্মা! সেই যে আমার জ্বর হলো না? আদ্র ভয় পেল, এরপর আর কোনদিন বৃষ্টিতে ভিজতে দিল না আমাকে।
এরপর যতবার যত সমস্যায় পড়েছি কেমন করে যেন আমার সেই ছোট্ট বন্ধু, আমার সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। হাত কাটা, পা কাটা যা যা একবার ওর চোখে পড়েছে তা আর দ্বিতীয়বার হতে দিত না। ফুটবল খেলে পা কেটে রুমে আসতাম, ওর একটা ফার্স্টএইড বক্স ছিল। এখনও আছে। সবকিছুতে গোছালো সে, শুধু নিজের ব্যাপারে ছাড়া! ওইটুকু ছেলে তার ফার্স্টএইড বক্স থেকে কি কি বের করে সেবা যত্ন করে করে ঠিক করে দিত। কাউকে জানতে দিত না, স্যার জানলে মারবে যে! তবে সে নিজেই শাসিয়ে বলতো, পরেরবার এমন দেখলে পা কেটে দিব কিন্তু!
আমি হাসতাম! আদ্রর কড়া চাহনী! যেন ও-ই আমার গার্ডিয়ান! ওর সংস্পর্শে এসে অন্য আমি হয়ে গেলাম। পড়াশোনায় ভালো হয়ে গেলাম। অথচ এর আগে প্রতি পরিক্ষা ডাব্বা মারতাম, হা হা হা।
এরপর একদিন জানতে পারলাম ওর মা-বাবার ডিভোর্স হয়ে গেছে। আদ্র বলেনি কিন্তু। ওর ডায়রি পড়ে জেনেছি। আমার অভিভাবক হয়ে উঠা ছেলেটার অভিভাবক নড়বড়ে জেনে সেই প্রথম ভীষণ অবাক হলাম।
সম্পর্ক ভাঙনে ওর মারাক্তক ভীতি! ওর ধারনা, প্রিয় মানুষ অপ্রিয় হওয়ার চাইতে জীবনে কেউ প্রিয় হিসেবে না আসাই উত্তম। ও কিন্তু সেই ফর্মুলা ম্যানটেইন করেই চলত। যদি হারিয়ে যায় এর এই ‘যদি’ টাকেই কখনো সুযোগ দিতে চাইত না।
ছোট থেকে বড় হলাম আমরা। বন্ধু থেকে ভাই হলাম। কিন্তু আমার পর দ্বীপ ছাড়া আর কেউ খুব কাছে আসতে পারলো না ওর।
সবাইকে এড়িয়ে চলার এই যুক্তিটা ফিকে করতেই উঠে পড়ে লাগলাম আমি। ও বোধহয় খানিক আশ্বস্ত হলো শেষে এসে। জীবনে আরশিকে ঠাঁই দিল।
আফসোস! মেয়েটা ওর ভাবনা আরো বাস্তব করে চলে গেল। ওর এই হতাশার জন্যেও নিজেকে দায়ি মনে হয়!
আরশি যাওয়ার পর ভয় বেড়ে গেল আদ্রর, ওর ধারনা সত্য থেকে আরো সত্য হয়ে গেল। ভেবে বসলো, প্রিয় বলে কিছু হয় না, নিজে ছাড়া নিজের কাছে আর কিছু প্রিয় হতে পারে না, সব আসলে অপ্রিয়, ঠুনকো, ফাঁকা মায়া!”
অনবরত কথাগুলো বলে ইশান একটু থামল। ঢোক গিললো। গলার মাঝের উচু হারটা নড়ে উঠলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে বুক ভোরে শ্বাস নিল। একটা ঘাসফড়িঙ উড়ে এসে ইশানের কাঁধে বসলো।
নোলকের নতুন রোগটা মাথা চারা দিয়ে উঠে।গলা ধরে আসে, কান গরম হয়ে যায়, মাথা ধরে যায়। পানি থেকে ঝুপঝুপ আওয়াজে পা তুলে অন্যদিকে তাকায়। চোখ জ্বালা করে।
ইশান মাথা ঘুরিয়ে প্রথমে নোলকের দিকে তাকালো। কেমন যেন লাগলো তার! তারপর সেই ঘাসফড়িঙ এর দিকে তাকিয়ে আলতো করে, মায়া নিয়ে বলল,
“তুমি জানো না মেয়ে! তুমি এমন একজন মানুষের উপর অভিমান করছো, যার মনে এই পুরো পৃথীবি জুড়ে, পৃথীবির মানুষগুলোকে নিয়ে কত কত অভিমান, অভিযোগ আর রাগ!
তোমায় আদ্র ভয় পায় অগ্নিশর্মা! বহুদিন পর ওর মাঝে প্রিয় মানুষ হারানোর ফোবিয়া জেগে উঠেছে।
আর ওর এই ভয়টাকে আরো বেশি মজবুত করতেই এলো আদ্র’র এই রোগটা!
তুমি জানো? আদ্র যতটা দায়িত্বশীল বন্ধু, আমি ঠিক ততটাই দায়িত্বহীন বন্ধু।
সেই ছোট বেলা থেকে ওর কোনো সমস্যার সমাধান আমি হয়ে উঠতে পারলাম না! ওর কোনো অসুস্থতা আগে টের পেলাম না! একটা বন্ধু হিসেবে আমি খুব জঘন্য, খুব! পারফেক্ট বন্ধু হতে পারলাম না আজও। আজ কদিন ঘুমাতে গেলে মনে হয় আদ্র’র চোখ দুটো ড্যামেজ হওয়ার পেছনে ও যতটা কেয়ারলেস এর ভূমিকা রেখেছে তার থেকে বেশি ভূমিকা আমার। আমি তো জানতাম বলো? ও নিজেকে নিয়ে কত উদাসিন! ওর ঘন ঘন মাথা ব্যথা, চোখ ব্যথা! তবুও দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো এতদিন ডক্টর না দেখিয়ে চোখের চেইক-আপ না করিয়ে রেখে দিলাম। খুব দেরি করে ফেললাম অগ্নিশর্মা! খুব দেরি করে ফেললাম।”
শেষের কথাগুলো নোলক ঠিক বুঝতে পারলো না। ইশানের ঠিক মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কিসের দেরি? চোখ ড্যামেজ মানে? ক-কি হয়েছে তার? কি বলছেন?”
ইশান বলল,
“তুমি জানো না? কাল গেলে যে?”
নোলক অস্থির হয়ে বলল,
“আমি কী জানবো? আমি তো তার জন্য যাইনি! আমায় বলুন প্লিজ! তার কী হয়েছে?”
ইশান তপ্ত এক নিশ্বাঃস ফেললো। বুঝতে পারলো নোলক কিছুই জানে না! আর জানে না বলেই, অভিমানী কন্যাটি হয়ে আছে! নোলকের অস্থিরতাময় দৃষ্টিতে দৃষ্টিপাত করে বলে,
“আদ্রর গ্লুকোমা ধরা পড়েছে, অগ্নিশর্মা! গ্লুকোমা এমন একটা রোগ যার ফলে চোখের স্নায়ু ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং চোখের দৃষ্টি হ্রাস পায়। একসময় অন্ধত্ব বরণ করে নিতে হয়।
অগ্নিশর্মা? বললাম না? আদ্র যতটা অন্যদের নিয়ে কেয়ারফুল, ঠিক ততটাই নিজের ব্যাপারে কেয়ারলেস! ও কখনো নিজের সমস্যা কাউকে বলে না, বলতে চায় না। আর ওর এই উদাসিনতার কারণেই আমি জাস্ট ধারনাও করতে পারিনি নিজের এতটা ক্ষতি ছেলেটা করে ফেলেছে!
এই যে ওর এত ঘন ঘন মাথা ব্যাথা হতো, চোখ ব্যথা হতো, চোখে ঝাপসা দেখতে লাগলো এসব কিছুই কিন্তু আমায় বলেনি! ডক্টর দেখায় নি! আমি এতটা ফালতু বেস্ট ফ্রেন্ড যে, একটুখানি আঁচও করতে পারিনি কি সর্বনাশ হতে যাচ্ছে! মাঝে-মধ্যে দেখতাম মাথা আর চোখের যন্ত্রনায় আবোল-তাবোল বলছে। এমন ও সব সময়-ই করে। মাইগ্রেনের ব্যথা হলেই উল্টা-পাল্টা বলে। তাই জাস্ট মাইগ্রেনের ব্যথা হিসেবে ধরে রেখে হেলা করলাম।
যেহেতু ওর অতিরিক্ত মাইনাস পাওয়ার সেকারণে দুই একমাস পরপরই ‘আই ও পি’ মাপা হত।
কতদিন হয়ে গেল ওর আই ও পি মাপা হয়নি! এই গ্যাপটাও একটা কাল হয়ে দাঁড়াল!
সেদিন রাতে এত অসুস্থ হয়ে পড়লো ছেলেটা! হসপিটাল নিলাম। ডক্টর নানান চেইক-আপ করালেন। যেহেতু প্রবলেমটা বেশি চোখেই তাই অপটিকেল নার্ভ হেডের পরিক্ষা করালেন। তাদের সন্দেহ বাড়ল। অটোমেটেড পেরামেট্রি করান এবং তাদের সন্দেহ সঠিক হলো!
শেষে গোনিওস্কোপি করিয়ে জানান, আদ্রর ক্লোজড অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমা। যতক্ষণে ওর এই সমস্যা ধরা পড়লো ততক্ষনে অনেকখানি ড্যামেজ হয়ে গিয়েছে!
এই গ্লুকোমা নিরবে এত দ্রুত ক্ষতি করে ফেলে যে ধারনাও করা যায় না। এই রোগের এমন কোনো চিকিৎসা নেই যার ফলে পুনরায় দৃষ্টিশক্তি ফেরত পাওয়া যায়। আদ্র’র অনেক বেশি ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। ও এখন ক্লিয়ারলি কিছুই দেখতে পায়না। ডে বাই ডে আরো খারাপ হচ্ছে! আমি কিছুই করতে পারছি না। আগেও পানিনি এখনও পারছি না। হসপিটালে রেখেছি তাও এমনি! কোনো ফায়দা নেই।
বন্ধু হলাম ঠিক, কিন্তু সত্যিকারের বন্ধু হতে পারলাম কই? পৃথিবীতে অনুতাবোধের চাইতে ভয়াবহ যন্ত্রনা আর কিসে আছে, বলতে পার?
চারদিক থেকে সকল অনুতাপ এসে আমায় মেরে ফেলছে। ওর জন্য কিচ্ছুটি করতে না পারার যন্ত্রনায় আমি ক্রমশ মরা যাচ্ছি, অগ্নিশর্মা!
প্লিজ ওর উপর অভিমান করে থেকো না। ও যা বলে, তা সত্য না।
শোনো মেয়ে? ওর জীবনের যত সত্য, সব আমি চুরি করে ডায়রি পড়ে জেনেছি! ওর মাঝের তুমিটাকেও আমি ডায়রি পড়েই জেনেছি! ভাগ্যিস পুরোনো এই অভ্যাসটা আমি ত্যাগ করিনি! নয়তো এমন সত্যটা জানতাম-ই বা কী করে? হা হা হা! ওর কাছে ওর চোখের দ্যুতি তুমি। চোখ হারিয়ে অত দুঃখী নয়, যতটা ভয় ওর তোমায় হারানোয় হয়! ভালোবাসা, ভালোবাসা, ভালোবাসা! হায় ভালোবাসা!”
এইযে এতটা সময়? নোলক চুপটি করে শুনলো, কোনোরূপ বাক্যব্যয় ছাড়া! এবার? এবার তারে চুপ করিয়ে রাখে কে? মাথার ব্যথা, বুকের আর্তনাদ আর আটকাতে পারলো কই?
হাঁটুমুড়ে হাঁটুর উপর মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলো। তার মায়া, তার দরদ, তার টান সব যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো।
ইশান তাকায়। এই দরদে মাখামাখি মানবীটাকে দেখে তার শরীর কেঁপে উঠে। কি যন্ত্রনা, কি যন্ত্রনা! চোখ সরিয়ে নেয়।
ঘাস ফড়িং উড়ে গিয়ে জলের কোনের ঘাসে বসে। জলে জলে ঘুরে বেরিয়ে জলে রাঙা ছবি আঁকে। জলছবিটা না হলেও, কিছু একটা হলো তো?
পানির আলোয় পড়ন্ত সূর্যের রশ্মি, ঝলমলিয়ে কেঁপে উঠে যেমন করে? ইশানের দহন বাড়ে তেমন করে! মস্তিষ্কে বয়ে বেড়ায় এলোমেলো শব্দ।
“সত্য না, সত্য না!
মেয়ে তুমি সত্য না!
তুমি আমার স্বপ্নে দেখা,
মায়াবী এক কল্পনা!”
#জলছবি
#পার্ট_২৯
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.
ফয়সালের জ্ঞান ফিরলো সন্ধ্যার পরপর। সকলেই তখন হসপিটালে। মাঝখানে সবাই একবার ঘুরে আবার সন্ধ্যের আগে আগে হসপিটাল চলে আসে।
খানিক বাদেই ডাক্তার এসে বলল, “রোগীর জ্ঞান ফিরেছে। ধীরে সুস্থে সকলে দেখা করতে পারেন এখন। তবে হট্টগোল করা চলবে না।”
কুহিনূর বেগম, যে কিনা ছেলে অমন মুমূর্ষু অবস্থায় কাঁদলেন না, সে ছেলের জ্ঞান ফিরেছে শুনে হু হু করে কেঁদে ফেললেন। হাতের স্যালাইন সহ-ই তাকে ফয়সালের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো প্রথমে।
মায়ের আগমনে, মায়ের শরীরের গন্ধে ফয়সাল ক্লান্ত চোখ পিটপিট করে তাকালো। অসম্ভব সতেজ ও সুন্দর হাসলো। কোহিনূর বেগম মুখে কিচ্ছুটি বলল না। ফয়সালের গালে, চোখে মুখে পরম আদরে আত বুলাতে লাগল। তার চোখ আর গাল বেয়ে ঝুপঝুপ করে অশ্রুধারা বয়। এই অশ্রুতে দুঃখ শেষে নির্মল সুখ। দুঃখের পরের সুখগুলো এমনই হয়, সুন্দর ও কোমল!
দুর্বল ফয়সালের সকল দূর্বলতাই উবে গেল এক নিমিষে। মায়ের হাতের উপর নিজের ক্যানোলা লাগানো হাত রেখে আবেশে চোখ বন্ধ করে। অল্পকিছুক্ষন পর চোখ মেলে। মোলায়েম হাসি মুখে ডাকে, “আম্মা? কেমন আছো আম্মা?”
কোহিনূর বেগম তখনও কেঁদেই যাচ্ছিলেন। বরং তার কান্নার বেগ বেড়েছে বৈ কমেনি।
ফয়সাল বুঝতে পারলো মায়ের মন। স্বাভাবিক করতেই হেয়ালি করে, খুব ধীরেসুস্থে বলল,
“আল্লাহ্! আম্মা? তুমি এমন কাঁনতে পারো, জানতাম না তো! যাক এই উছিলায় দেখতে পারলাম।”
কোহিনূর বেগম কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
“তুই আমার লগে কথা কইবি না, বেদ্দপ! জীবনে কোনোদিন তোরা বাপ-পুতে আমার কথা শোনোস নাই।”
ফয়সাল বলে,
“এই আম্মা? দেখি দেখি? দেখি তো তোমার মুখখানা! দেখ, তোমার নাক কেমন লাল হয়ে গেছে! ইশশ! একদম বাচ্চা পুতুল লাগতেছে! আহারে আব্বায় যদি দেখতো এখন! নিশ্চিত আবার প্রেমে পইরা যাইতো! হা হা হা!”
মা ছেলের খুনশুটিগুলো বন্ধুরা সব দারুন উপভোগ করে। দূরে দাঁড়িয়েই মিটিমিটি হাসে তারা।
কোহিনূর বেগম অভিমানী মুখ করে বলে,
“ফাইজলামি করস? কর! যা মন চায় কর! আমারে নিয়া ভাব্বি ক্যা? তোর বাপেও ভাবে নাই, তুইও ভাবস না।”
ফয়সাল খুব দরদ নিয়ে বলে,
“ভাবি তো আম্মা। কে কইছে, ভাবি না?”
“একটুও ভাবস না। ভাবলে আমার কথা শুনতি। শুনস আমার কথা? তোর যদি কিছু হইয়া যাইতো, আমি কী নিয়া বাঁচতাম ক? ভাবছস একবারও সেই কথা? আমার কথা একবারও মনে আসে নাই তোর?”
ফয়সাল মায়ের হাতে চুমু দেয়। আঘাতের স্থানে অন্য হাত রেখে বলে,
“আসছে তো আম্মা। ওরা যখন এইখানটায় আঘাত করলো, দুনিয়াডা আন্ধার হইয়া গেল, তহন আমার চোখে কেবল তোমার মুখটাই ভাসছে আম্মা। কাইন্দো না আম্মা। তোমার কান্নামাখা মুখ, ছুরির আঘাতের চাইতেও বেশি জঘম করে আমারে। তুমি তো সাহসি আম্মাজান! এইটুকুতে এত ভেঙে পড়লা? কি অবস্থা করছো নিজের দেহো তো?”
কোহিনূর বেগম তখনও ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে ঠিক বাচ্চা মেয়েটির মতো কাঁদে। তার খুব সুখ সুখ লাগে!
কোহিনূর বেগমের শরীরও দূর্বল থাকায় তাকে তার কেবিনে নিয়ে যাওয়া হয়।
এরপর এক এক করে সবাই আসে। বিষাদে তলিয়ে থাকা মন নিয়েই নোলকও আসে। লেক থেকেই সে হসপিটালে আসে। ফয়সালের জন্যেও মন কেমন করছিল। ওর সাথে কথা না বলেও বাসায় যেতে পারছিলো না। নবনীকে আরমানের সাথে পাঠিয়ে দিয়েছে অবশ্য! নোলক ফয়সালের কাছে গিয়ে কিছুটা হুংকার দেয়ার মতো করে বলে,
“জাস্ট পুরোপুরি সুস্থ হয়ে নে, তারপর তোকে আবার মেরে হসপিটালে ভর্তি করাবো, অসভ্য! খুব জ্বালাস তুই!”
ফয়সাল হেসে ফেলে। হাসে সকলেই।
উপরে স্বাভাবিক দেখালেও নোলকের মনে শান্তি লাগেনা কিছুই। মেকি হেসে ফয়সালের কপালে হাত রেখে বলে,
“তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠ তো দোস্ত। তুই ছাড়া সব কেমন ফিকে লাগে। হাদারামগুলা মন ভালো করে দিতে জানে না। তুই ছাড়া চলবে না।”
বলেই আনমনা হয়ে যায়। ফয়সাল বলে,
“হুম, সুস্থ হয়ে আগে চিরুনি তল্লাশি চালাবো। তারপর দেখবো কোন বেটায় তোরে এমন ছ্যাঁকা খাইয়ে, নোলকরানী থেকে ছ্যাঁকারানী বানিয়ে দিয়েছে!”
নোলক ফয়সালের গালে আলতো থাপ্পড় মেরে বলে,”চুপ, ফাজিল।”
ফয়সাল হাসে।
সৃজন বলে,
“শালা তুই নোলকের আগে আমার হাতে মাইর খাবি। তোর লাইগা দুইটা সুন্দরী মাইয়া রাগ কইরা ব্লক মারছে, রিপ্লাই দিতে পারি নাই দেইখা। কেমনডা লাগে ক?”
ফয়সাল বলে,
“তাইলে তো সোয়াবের কাম করছি মনেহয়! মাইয়া দুইটারে তোর মতো দুই নাম্বারের হাত থেইকা বাঁচায়ে দিছি। বহত আচ্ছা কাম কার’দিয়া!”
সকলে হেসে উঠে।
নিষাদ বলে, “সব বাদ! নিশির সাথে যে আমার দুই দিনের প্রেম গায়েব হয়ে গেল, তার জন্য তুই কী শাস্তি ডিজার্ভ করিস তা বল?”
ফয়সাল বলে,
“বেশি কিছু না। জাস্ট দুইটা ট্রিট দিলেই হইবো।”
শ্রেয়া বলে,”তোর ট্রিট থেকে আমারেও একটু ভাগ দিস দোস্ত।”
সৃজন পিঞ্চ মেরে বলে,
“আইছে আরেক নাদানি। ‘খালি খাই খাই, সুযোগ পেলেই ভাগ চাই'”
শ্রেয়া নিচু স্বরে বলে,
“খুব পঁচা হয়েছে তোর শেষের ছন্দটা। তুই একটা ফেলটু কবি হবি, অভিশাপ দিলাম।”
সৃজন মুখ বাঁকিয়ে বলে,
“তোর মতো বলদনী আমার ছন্দের মর্ম বুঝবো না এইটাই স্বাভাবিক। আই ডোন্ট মাইন্ড। তার চাইতে বড় কথা বলদনীগো অভিশাপে ক্রিয়েটিভ মানুষেদের কিছু হয় নট। জনগণ’স? চিল্লায়ে বল, ঠিক কি-না?”
নিষাদ আর ফয়সাল বলে,”ঠিক, ঠিক।”
শ্রেয়া মুখ ফুলায়। নোলক বলে,”ফাজিল গুলা!”
দুই দিনকে সকলের কাছে দুই যুগ মনে হচ্ছিলো। সবশেষে সবার মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে। এ যে কি শান্তির, প্রকাশ করা দায়!
হঠাঠ-ই ফয়সাল জিজ্ঞেস করে,
“আমাদের পাপা’স প্রিন্সেস কই? তারে দেখি না ক্যান? সে কি সুযোগ পেয়ে আমারে ভুলেটুলে গেল নাকি?”
নিষাদ বলে,
“আরে না। ওর প্রিন্স ব্রো এসে নিয়ে গেছে। ফোন অফ মাইয়ার। উধাও হয়ে গেল ক্যান, বুঝলাম না!”
ফয়সাল আনমনা হয়ে কি যেন ভাবে।
সবার মাঝেও একজনের অনুপস্থিতিতে অস্থির লাগে। মনে হয় কতদিন দেখে না!
মনে মনে ক্ষিপ্ত হয়ে ভাবে, আলালের দুলালি! মরার পিরিত! আল্লাহ্ রক্ষা করো এই মরন থেকে! কেন এলি না, লুবু? আ’ম মিসিং ইউ!
.
ইশান আদ্রকে ধরে হসপিটাল থেকে বাহিরে আনে। আদ্র ইশানের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
“ধরে রেখেছিস কেন? আমি একা হাঁটতে পারি না বলেছি? দেখি ছাড়!” বলে ইশানের হাত ছাড়িয়ে নেয়। ত্যাক্ত হয়ে বলে,
“এত বেশি আলো কেন চারদিকে? চোখে বিঁধছে খুব!”
অথচ বাহিরে কৃত্রিম আলো। রাতের এটুকু আলো সইতে পারছে না, এটাই ওর কথার প্রমাণ।
ইশান আবার এসে ধরে। আদ্র রেগে গিয়ে বলে,
“আমি একাই চলতে জানি ইশু। বারবার ধরছিস কেন? ছাড়।”
ইশান উল্টো রাগ দেখিয়ে বলে,
“বাচ্চাদের মতো অযথা জেদ দেখাবি না আদ্র। সব সময় তোর কথা শুনতে বাধ্য নই আমি। জাস্ট তোর অকারন খামখেয়ালির কারণে এই এত বড় ক্ষতিটা হয়েছে। এমন কেন করছিস তুই? বাচ্চা হয়ে গেছিস আদ্র।”
“যা হয়েছে ভালো হয়েছে। যা করছি বেশ করছি। তুই আমায় নিয়ে ভাবা বন্ধ কর, প্লিজ! আমাকে আমার মতো একা ছেড়ে দে।”
কথার জবাব দেয়ার সুযোগ পায়না ইশান।
বেখেয়ালে আদ্রর কাছ ছুঁয়ে একটা বাস যেতে লাগলে ইশান টেনে ছড়িয়ে ফেলে। বাহু ধরে চেঁচিয়ে বলে,
“কী হয়েছে কী আদ্র? মরতে চাস? এমন কেন করছিস?”
আদ্র চোখের চশমাটা খুলে ছুড়ে মারে রাস্তায়। গাড়ির নিচে পড়ে চশমাটা গুড়াগুড়া হয়ে যায়।
নিজের চুল টেনে ধরে অসহায়ের মতো চেঁচিয়ে বলে,
“উফফ! কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না ইশু, কিচ্ছু না। অসহ্য লাগছে দোস্ত, অসহ্য লাগছে। মারা যাচ্ছি আমি।”
ইশান হাতের ইশারায় গাড়ি থামায়। আদ্রকে ধরে গাড়িতে উঠায়। চোখের সামনে আদ্রর এই আর্তনাদ দেখেও কিছুই করতে পারছে না সে। কি যে অসহায় লাগে। এই মূহুর্তে নিজের চোখ দুটো গেলে দিতে ইচ্ছে করছে তার।
আদ্রর দু’হাত ধরে বলে, “কিচ্ছু হবে না দোস্ত, কিচ্ছু না। আমি আছি তো, আছি না? বেশি খারাপ লাগছে আদ্র?”
আদ্র মাথা আর চোখের দু’পাশ দু’হাতে চেপে রেখে চুপ করে থাকে। ইশান খুব করুন করে বলে,
“আই এম স্যরি দোস্ত! আই এম স্যরি। কিচ্ছু করতে পারছি না আমি, কিচ্ছু না!”
.
লুবনা রাত থেকে কিছু খায়নি। ফ্লোরেই হাঁটু মুড়ে বইসে রইলো দীর্ঘ সময়।
লুবনার মা সাহানারা একজন নিরীহ টাইপ মানুষ। স্বামী, ছেলে, মেয়ে সকলের রাগ সামলাতে সামলাতে জীবনের এতোটা সময় পার করে এসেছেন তিনি। সে মেয়েকে অনবরত ডাকছে, কিন্তু লুবনা তার ডাক শুনতে পেলে চূড়মূড় করে কিছু ভেঙে জেদ মেটাচ্ছে। ভাঙার মতো তেমন কিছু অবশিষ্টও নেই এখন আর।
এ খবর পেয়ে আমিনুল হক ছুটে আসেন। ছেলের হাতের প্রজেক্টর দায়ভার রেখে হন্তদন্ত হয়ে আসেন। এসেই প্রথমে সাহানারাকে ধমক দিয়ে বলেন,
“আমার মেয়েটা এতটা সময় না খেয়ে আছে, আর তুমি মা হয়ে মেয়েকে খাওয়াতে পারছো না? ইডিয়েট! আর আমাকেই বা এত দেরী করে জানিয়েছ কেন? যদি আমার মেয়েটা অসুস্থ হয়ে যায় না, সাহানা…!”
সাহানারা স্বামীর এহেন ব্যবহারের শেষে মিন মিন করে বলে,
“ফোন করেছিলাম আপনাকে। দেখননি হয়তো।”
আমিনুল হক কপট রাগ দেখি বললেন,
“এই দেখি সরো, সামনে থেকে সরো, আশ্চর্য!”
সাহানারা বেগম সরে দাঁড়ালেন। আমিনুল হক আদর দিয়ে ডাকলেন,
“মা? দরজা খোলো।”
ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ এলো না। তিনি আরো কয়েকবার ডেকেও যখন সারা পেলো না তখন রাগ আর আতংক নিয়ে সাহানারার দিকে তাকালো। তিনি কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন,
“দরজা ভেঙে ফেলুন না! একটু আগেও তো ভাংচুর করছিল!”
“তুমি চুপ থাকো, দায়িত্বজ্ঞানহীন মহিলা! একটা কথাও বলবে না এখন আর!”
সাহানারার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়ায়।
দশ মিনিটের মাথায় দরজা ভেঙে ফেলা হয়।
আমিনুল হক, সাহানারা এক ছুটে ভেতরে গিয়ে আঁৎকে উঠে।
পুরো রুম জুড়ে সব কিছু ভাঙাচূড়া, এলোমেলো। বিছানা চাদর, বালিশ সব নিচে পড়া। খাটের সাথে লাগোয়া হয়ে ফ্লোরে পড়ে আছে নিস্তেজ লুবনা।
.
মাঝরাতে অদ্ভুত আওয়াজে ঘুম ভাঙে নবনীর। চোখ না মেলেই হাত হাতরে নোলককে খোঁজে। না পেয়ে চোখ মেলে চায়। ড্রিম লাইটে স্পষ্ট দেখতে পায় নোলক নেই পাশে। বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুম চেইক করে, সেখানেও নেই।
গুনগুন আওয়াজটা তখনও স্পষ্ট। পাশের রুম থেকে আসছে। নবনী সংশয় নিয়ে সেদিকে যায়।
নোলকে দেখতে পায়। হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদে। নিশ্চুপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে সেখানেই।
সন্ধ্যায় দেখা আদ্রর সেই অসহায়ত্ব বারবার চোখে ভাসে নোলকের। এই মানুষটাকে এভাবে সে কোনদিন কল্পনাও করেনি! ভীষণ কষ্ট লাগে নোলকের, ভীষণ।
নবনী নোলককে ছুঁতেই কেঁপে উঠে। তড়িঘড়ি করে চোখ মুছে ফেলে। নবনীর কপালে ভাঁজ। খুব আদরের সহিত জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছে বোন? ফয়সাল তো সুস্থ হয়ে যাচ্ছে, কাঁদছিস কেন? কেউ কি কিছু বলেছে?”
নোলক বোনকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“কিছু হয়নি আপু। এমনি কাঁদিছি। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে, তাই।”
নবনী সবই জানে, ইশান তাকে সব বলেছে। আদ্র’র অসুস্থতাও শুনেছে আরমানের কাছে। বুঝতে পারে, নোলক জানতে পেরেই কষ্ট পাচ্ছে। নোলককে কাছে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“আয় চল ঘুমাবি। সকালে আদ্রর কাছে যাব।”
নোলক বলে,
“চোখে দেখতে না পাওয়া খুব অসহায়ত্বের, নারে আপু? আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তাকেই কেন এত অসহায় করে দিচ্ছেন আল্লাহ্!”
নবনী কিছুই বলতে পারে না। কী বলবে সে? এর উত্তর যে তারও জানা নাই!…….(চলবে)
(চলবে)