হৈমন্তীকা
১০.
নিস্তেজ পায়ে নিজ ফ্ল্যাটে এসে হাজির হলো হৈমন্তী। তাকে ফিরে আসতে দেখে অবাক হলেন আসরাফ সাহেব। জিজ্ঞেস করলেন,
— “কিরে মা, ফিরে এলি যে?”
— “ভালো লাগছে না বাবা। যাবো না।” নিষ্প্রভ স্বরে জবাব দিলো হৈমন্তী।
রাবেয়া ভ্রু কুঁচকালেন,
— “যাবি না মানে? এই না কি সুন্দর যাচ্ছিলি। আবার কি হলো?”
— “মাথা ব্যথা করছে মা। ঘুমাবো।”
— “ঘুমাবি মানে? আমার রাগ উঠাস না হৈমন্তী! চুপচাপ সবার কাছে যা।”
হৈমন্তী বিরস চোখে একপলক মায়ের দিকে তাকালো। অতঃপর কথা অমান্য করে চলে গেল নিজ রুমে। হালকা শব্দে লাগিয়ে দিলো দরজা। রাবেয়া রোষপূর্ণ চাহনি মেলে ধরলেন হৈমন্তীর যাওয়ার পথে। কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,
— “দেখেছো তোমার মেয়েকে? একটা কথাও শুনে না। একে নিয়ে যে আমি কি করি!”
আসরাফ সাহেব দিরুক্তি করে উঠলেন,
— “আহা! এত কথা বলো না তো! ওর হয়তো সত্যিই মাথা ব্যথা করছে। তুমি বরং এক কাজ করো। ফ্রিজ থেকে বরফ নিয়ে ঠান্ডা পানি খাও। মাথা ঠান্ডা হয়ে যাবে।”
_____
রুমে এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো হৈমন্তী। ঠোঁটে তার লাল রঙা লিপস্টিক। যাওয়ার সময় রাবেয়া জোড় করে লাগিয়ে দিয়েছিলেন। রুক্ষ শক্তিতে বাম হাতের উলটো পিঠে ঠোঁট মুছে নিলো সে। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁটের আশপাশ, হাতের তালু সল্প লালে আচ্ছাদিত হলো। হৈমন্তী সটান হয়ে শুয়ে নিষ্পলক চেয়ে রইলো সিলিংএর দিকে। চেয়ে রইলো প্রায় অনেক্ষণ। নির্জীব, অনুভূতি শূণ্য হয়ে। বুকের ভেতরটা কেমন ভারী হয়ে আসলো। আচ্ছা, সব দোষ কি সত্যিই তার? সবকিছুর জন্য শুধুমাত্র সে-ই কি দায়ী? হঠাৎ কান্না পেয়ে গেল হৈমন্তীর। নয়ন জোড়ায় অশ্রু খেলতে লাগলো। গাল বেয়ে গলা অব্দি ছুটতে লাগলো সেগুলো।
–
তখন শীতের মাস। চারিদিক কুয়াশায় আচ্ছন্ন। হৈমন্তীর স্পষ্ট মনে আছে তারিখটি। ১২ই ডিসেম্বর। এই দিনটিতেই অচেনা এই রংপুরের পাঁচ তলা বিশিষ্ট বিল্ডিংয়ে থাকতে এসেছিল হৈমন্তীর পরিবার। সেদিনই প্রথম সে তুষারকে দেখেছিল। উঠোনের এক কোণে, এক বেঞ্চে কপালে হাত রেখে শুয়ে আছে এক যুবক। হৈমন্তী একপলক সেদিকে তাকায়। পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে নেয় ধীর গতিতে।
হৈমন্তী প্রকৃতি প্রিয় মানুষ। বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতির নির্মল বাতাস উপভোগ করা যেন তার নিত্যদিনের অভ্যেস। প্রতিদিনকার মতো বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতি উপভোগ করার পাশাপাশি একটা জিনিস ভীষণ ভাবে প্রভাবিত করে তাকে। রোজ উঠোনের মধ্যিখানের এক বেঞ্চে একটা ছেলেকে বসে থাকতে দেখে সে। একদম চুপচাপ, মাথা নিচু করে, মলিন মুখে। ভার্সিটি যাওয়া আসার সময়ও ছেলেটির নিশ্চুপ অভিব্যক্তিতে ওভাবেই বসে থাকা বিশেষ ভাবে খেয়ালে আসে তার। ছেলেটির কি কোনো কাজ নেই? প্রতিদিন ওভাবে চুপচাপ বসে থাকে কেন? কৌতূহল জাগলেও হৈমন্তী কখনো আগ বারিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে যায় নি। কেমন জড়তা কাজ করতো ওর মাঝে। কেননা ছেলেটিকে দেখতে তার চেয়ে বড়ই মনে হতো হৈমন্তীর।
এভাবে বেশ কিছু দিন চলল। একদিন হেমন্ত থেকে জানতে পারলো, ছেলেটি তার চেয়ে ছোট। অনার্সে ভর্তি হয়েছে এবার। বাড়িওয়ালার একমাত্র ছেলে। মুহুর্তেই হৈমন্তীর সব জড়তা কেটে গেল। অজানা কৌতূহলগুলো গভীর ভাবে জেঁকে বসল মস্তিষ্কে। ছেলেটা তো তার ছোট ভাইয়ের মতোই। সে হিসেবে কথা তো বলাই যায়!
এরপর থেকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে হৈমন্তী সূক্ষ্ণ ভাবে পর্যবেক্ষণ করতো ছেলেটিকে। মাঝে মাঝে চোখাচোখি হলে তুষার ভ্রু কুঁচকে তীক্ষ্ণ চাহনিতে তাকিয়ে থাকতো কিছু সেকেন্ড। তারপর যখন দেখত, হৈমন্তী তার থেকে চোখ সরাচ্ছে না, তখন বিরক্ত সহিত চলে যেত সেখান থেকে। ছেলেটাকে জ্বালাতে হৈমন্তীর বেশ লাগত। সে ইচ্ছে করে আরও বেশি তাকিয়ে থাকতো তুষারের মুখপানে।
এরপর একদিন সাহস করে তুষারের কাছে যায় হৈমন্তী। তুষারের পাশে বসে কোনো ভণিতা ছাড়াই জিজ্ঞেস করে,
— “আপনার নাম কি?”
তুষার একপলক তাকায়। গম্ভীর স্বরে জবাব দেয়, “তুষার।”
— “ওহ্! আমার নাম হৈমন্তী।”
তুষার তখন আপন মনেই অস্পষ্ট কণ্ঠে আওড়ায়, “হৈমন্তীকা।”
যা শুনতে পেয়ে হেসে ফেলে হৈমন্তী। বলে,
— “আমার নাম হৈমন্তীকা না তো। হৈমন্তী। আর আমি কিন্তু আপনার চেয়ে অনেক বড়। তাই আমাকে আপু বলে ডাকবেন।”
প্রতিউত্তরে তুষার হ্যাঁ, না কিছুই বললো না। হৈমন্তী আবার জিজ্ঞেস করল,
— “আচ্ছা তুষার, আপনি সবসময় এভাবে চুপচাপ বসে থাকেন কেন? বিরক্ত হন না?”
এবারো নিশ্চুপ তুষার। তুষারের ব্যবহারে তেমন ভাবান্তর ঘটলো না হৈমন্তীর। সে ভেবেই রেখেছিল এমন কিছু ঘটবে। সুতরাং, হৈমন্তী তার মতোই বকবক করতে লাগলো।
মাসখানেক যেতেই তুষারের ব্যবহারে পরিবর্তন এলো। আগে শুধু হৈমন্তীই কথা বলতো। তুষার চুপচাপ বসে শুনতো শুধু। কোনো কথা বলতো না। মাথা নিচু করে রাখতো সবসময়। কিন্তু এখন সেও হৈমন্তীর সঙ্গে মন খুলে কথা বলে। হঠাৎ হঠাৎ গালে হাত রেখে নিমেষহীন চেয়ে রয় হৈমন্তীর মুখপানে। মাঝে মাঝে এমন সব আবেগমাখা কথা বলে, হৈমন্তী ভীষণ অস্বস্তিতে পরে যায়। তবে অত ঘাটায় না ব্যাপারগুলো। কিন্তু দিনে দিনে তুষারের আচরণ আরও পাগলাটে হতে শুরু করে। হৈমন্তীর প্রতি তীব্র অধিকার বোধ যেন তার মাঝে সর্বদা বিরাজমান। তাই তো হৈমন্তী সরে এসেছিল তুষারের থেকে। রুঢ় আচরণে নিজেকে শক্ত করে রেখেছিল। চড়ও তো মেরেছিল তুষারকে। তাহলে সে দোষী কিভাবে হলো? এক পর্যায়ে হৈমন্তীর মনে হলো, না! সব দোষ তারই। তুষারের সঙ্গে আগ বারিয়ে কথা বলাটাই ছিল তার দোষ, মারাত্বক ভুল। যার শাস্তি হিসেবে অন্যের কথা শুনতে হচ্ছে তাকে।
_____
রাতে বেশ দেড়ি করে ঘুমায় হৈমন্তী। ফলসরূপ সকালে উঠতে দেড়ি হয়ে যায় তার। ফজরের নামায কাজা হয়ে যায়। ঘুম থেকে উঠেই প্রথমে নামায আদায় করে সে। এরপর অলস পায়ে সোফায় গিয়ে বসে। আসরাফ সাহেব সেখানেই বসে বসে খবর দেখছিলেন। মেয়েকে নিজের পাশে বসতে দেখে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। স্নেহভরা স্বরে বললেন,
— “শরীর ঠিক আছে তো মা? মাথাব্যথা আছে এখনো?”
— “না বাবা।”
কথাটা বলে কিছুক্ষণ চুপ রইলো সে। হাসফাস করতে লাগলো। এরপর ক্ষীণ আওয়াজে বললো,
— “বাবা? এ বাসাটা আর ভালো লাগছে না আমার। অন্য বাসা দেখো।”
আসরাফ সাহেব অবাক হলেন,
— “কেন মা?”
রাবেয়া মাঝখান দিয়ে ফোড়ন কেটে উঠলেন,
— “কেন? বাসা পাল্টাবে কেন? কি সুন্দর ছাদে গাছ রাখার সুবিধা আছে এখানে। কি খোলামেলা! তার উপর প্রতিবেশীদেরও কি সুন্দর আচরণ।”
রাবেয়ার কথায় তাল মিলিয়ে আসরাফ সাহেবও বললেন,
— “হ্যাঁ, মা। তাছাড়া তোর ভার্সিটি, আমার অফিস আর হেমন্তর স্কুলও তো এখান থেকে কাছে। তাহলে অসুবিধেটা কোথায়?”
আসরাফ সাহেব এমন ভাবে বললেন, যে আর দিরুক্তি করতে পারলো না হৈমন্তী। গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মাত্র।
সেদিন আর ভার্সিটি যাওয়া হলো না তার। ঘর থেকেই বের হলো না। বিকেলের দিকে একটু ছাদে যেতেই ছাদের এককোণে তুষারকে দেখে থমকে গেল হৈমন্তী। তুষার তখনো দেখেনি তাকে। তড়িৎ গতিতে উলটো পায়ে আবার ফিরতে নিলেই, পেছন থেকে তুষার গমগমে স্বরে ডেকে উঠল,
— “দাঁড়ান, হৈমন্তীকা।”
____________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা