“তুমি কেন আগে আসোনি?”
৮.
মধ্যরাত। সিনথিয়া গায়ের কাথা সরিয়ে সায়ানের বাহুডোর থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো। খাট থেকে নেমে বারান্দায় এসে দাড়ালো। আকাশের দিকে তাকাতেই কান্নারা উপচে বেরুলো। কিছুতেই কান্না থামাতে পারছে না সিনথিয়া। সিনথিয়া হাটু গেড়ে মেঝেতে বসে পরলো। খুব কষ্ট লাগছে।
নিজেই নিজেকে বললো, ‘তুই তো জানিস শারিয়াহ বিধান তাহলে কিভাবে ওদের অত্যাচারের ভয়ে দীনের সাথে কম্প্রোমাইজ করে নিলি? তুই তো জানিস এর শাস্তি কি? সায়ান বা বাকিরা জানে না তাই তারা এমন করছে। আর তুই ভয় পেয়ে গেলি? আছিয়া রাদিআল্লাহু আনহুর কথা মনে নেই তোর? তাহলে কিভাবে এদের দুই একটা মার খেয়ে শরিয়াহ বিধান থেকে সরে সায়ানের সাথে তালে তাল মিলাচ্ছিস? এর জন্য ক্ষমা পাবি?’
সিনথিয়া কোলের উপর জামা খামছে ধরে। এতোদিন ধরে এইসব বিষয় ওকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিলো। শান্তি পাচ্ছিলো না। বেশ অনেকক্ষণ কান্নার পর সিনথিয়া নিজেকে সামলে নিলো। চোখ, মুখ মুছে নিলো। বেশ শান্ত ভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো আজকের পর থেকে দীনের সাথে, ঈমানের সাথে আর কোনো কম্প্রোমাইজ করবে না। এতে যদি ওকে মারতে মারতে মেরেও ফেলে তবুও না। সায়ান যতই হিংস্র আচরণ করুক তবুও আর কারো কথা শুনবে না।
সিনথিয়া রুমে এলো। সায়ানের পাশে শুয়ে পরেছে। সায়ানের দিকে তাকিয়ে দেখলো উপুর হয়ে শুয়ে আছে। মুখটা ওর দিকে ফিরানো। সিনথিয়া সেভাবে তাকিয়েই ভাবতে লাগলো। এই কয়েকদিনে অনেক কিছু বুঝেছে। আরশির করা অত্যাচারের অনেক কিছুই সায়ান জানে না। সিনথিয়াও কখনো এসব বিষয় সায়ানকে জানায়নি। সায়ান ঘুমের ঘোরেই সিনথিয়াকে নিজের কাছে নিয়ে নিলো। সিনথিয়া সায়ানের হাবভাব কিছুই বুঝতে পারে না। সায়ান আসলে কি চাইছে সিনথিয়া জানে না।
_________________________
একটা ব্লাক গাউন সিনথিয়ার দিকে বারিয়ে দিয়ে বললো,
— “যাও তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। আজকে ত…..।”
— “আমি আপনার সাথে এসব পার্টিতে আর যাবো না।”
সায়ান ব্লেজার পরছিলো। সিনথিয়ার কথায় থেমে গিয়ে ওর দিকে তাকালো। সিনথিয়াকে দেখে মনে হলো আবার আগের ফর্মে ফিরে এসেছে। সেই তেজি, সাহসি, বাঘিনী রুপ। যেটা বরাবরই সায়ানকে আকর্ষণ করে। সায়ান হাত ঘড়ি পরতে পরতে বললো,
— “হঠাৎ মত বদলালে কেনো?”
— “মত তো বদলেছিলাম আগে। ওসব ছাইপাস পার্টিতে যাওয়ার জন্য রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু আর নয়। আমি আর ওসব পার্টিতে যেতে চাইনা। এবার যদি আপ….।”
সায়ানের হঠাৎ আক্রমণে সিনথিয়া থেমে গেলো। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে সায়ানের দিকে। সায়ান মুচকি হেসে বললো,
— “অনেকদিন পর বেশ ইনজয় করেছি। এতোদিন মিস করছিলাম তোমার এই রুপটা।”
— “ছা..ছাড়ুন।”
— “ওকে যেতে হবে না তোমার।”
— “আবার কি নোংরা প্ল্যান বানাচ্ছেন আল্লাহই জানেন।”
— “কোনো কিছুই করছি না। তবে সামনে তোমার জন্য একটা বিগ সারপ্রাইজ আছে। যেটা পেলে তুমি অজ্ঞান হবে।”
— “মা..মানে? কিসের কথা বলছেন?”
— “ইটস সিক্রেট। সময় মতো পেয়ে যাবে।”
সিনথিয়া খানিকটা চমকে গেছে। কিছুটা ঘাবড়েছেও। সায়ান মুচকি হেসে সিনথিয়ার গাল টেনে দিয়ে বললো,
— “এতো চিন্তা করো না তো।”
— “(——)”
— “আচ্ছা ফাহিমটা কে? কি কাহিনি পাকিয়েছিলে আগে?”
সিনথিয়া তাচ্ছিল্য হেসে বললো,
— “সেদিন তো অনেক কিছুই বললেন আমার আর ফাহিম নামের কারো সাথে পরকিয়া চলছে। আপনি আমাকে ফাহিম নামের কারো সাথে দেখেছেন। এখন জিজ্ঞেস করছেন কেনো?”
— “আহা বলোই না।”
— “ছাড়ুন বলছি। ছাড়ুন। যত্তসব ন্যাকামি আপনার।” সিনথিয়া রেগে বললো।
সায়ান বেহায়ার মতো হাসছে। সায়ানের এই বেহায়ার মতো হাসি দেখলে সিনথিয়ার গা জ্বলে উঠে। সিনথিয়া নিজেকে ছাড়ানোর জন্য সায়ানকে ধাক্কা দিতে লাগলো। সায়ান ওর বলিষ্ঠ হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে রেখেছে সিনথিয়াকে। সিনথিয়ার ঘাড়ে ওর গালের খোচা দাড়িগুলো ঘষে বললো,
— “যতক্ষণ পর্যন্ত বলবে না ততক্ষণ ছাড়া পাবে না।”
— “উফ ছাড়ুন তো। আপনার এসব আদিখ্যেতা ভালো লাগে না। এমন আচরণ করছেন যেনো আমাকে ভালোবেসে উলটে ফেলছেন।”
— “হ্যাঁ বাসিতো। তবে তোমাকে নয়। তোমার এই বিউটিফুল ফিগারটাকে।”
সিনথিয়া দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
— “অসভ্য।”
সায়ান দাঁত কেলিয়ে হাসছে। সিনথিয়ার গায়ে আরো আগুন ধরে গেলো। এবার ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেছে। সায়ান আরো শক্ত করেই জাপটে ধরেছে। সিনথিয়া এবার ক্লান্ত হয়ে বললো,
— “কি চাই আপনার.. হুম? এমন করছেন কেনো?”
— “ফাহিমটা কে ছিলো? আর কাহিনি কি ছিলো সেটা বলো।”
সিনথিয়া মুখ ঘুড়িয়ে নিলো। সায়ান আবারো তাড়া দিয়ে বললো,
— “বলো৷ চুপ করে আছো কেনো? তোমার সাথে ফাহিমের ক্লোজনেস কি বেশিই ছিলো?”
— “চুপ করুন আপনি। ফাহিম নামের কারো সাথেই আমার কিছু ছিলো না। আমার জীবনের প্রথম পুরুষ আপনি ছিলেন সেটা হয়ত আপনি প্রথম রাতেই বুঝেছেন। এবার ছাড়ুন।”
— “তাহলে তোমার পরিবার যে বললো?”
— “আমার পরিবার তো অনেক কিছুই বলে। মিম ভাবিতো আপনাকে আমার সেইসব ছবিও দিয়েছিলো তার মানে কি আমি এই ধরনের ছবি তুলি?”
সায়ান সিনথিয়াকে ছেড়ে বেডে বসলো। সিনথিয়া বেরিয়ে যেতে চাইলে ওর হাত টেনে ধরে বললো,
— “আমাকে পুরো কাহিনি না বলে যেতে পারবে না। বলো।”
— “বললাম তো ফাহিম নামের কারো সাথেই আমার কিছু ছিলো না। সেদিন কারো বানানো জালে ফেসেছিলাম আমি। তাই চরিত্রে দাগ পরেছিলো আমার। এরচেয়ে বেশি কিছু না। যেমনটা ফেসেছি আপনার বানানো জালে। তারপর আবারো একবার চরিত্রে দাগ পরেছে আমার। হয়েছে আপনার? খুশি হয়েছেন সব শুনে?”
সিনথিয়া বারান্দায় চলে গেলো। সায়ানও বেরিয়ে গেলো। সায়ানকে যেতে দেখে সিনথিয়া একটু খুশি হলো কারণ ওকে এখন থেকে আর এসব জায়গায় যেতে হবে না।
_________________________
সিনথিয়ার হাতে বাজারের ব্যাগ, টাকা এবং বাজারের লিস্ট ধরিয়ে দিলো আরশি। বললো,
— “বাজারে যাও। আজকে থেকে তুমি বাজার করবে।”
— “আ..আমি?”
— “তো আর কে করবে? তোমার বাপে কি তোমার জন্য দশ, বারোটা বান্দী, দাসী পাঠাইছে যে ওরা আইসা তোমার কাজ করে দিবে? নিজের কাজ নিজেই করে নাও।”
— “আগে তো দারোয়ান চাচা বাজার করতেন। আজকে হঠাৎ..।”
— “ওরে কি তোমার বাপের বাড়ি থেইকা আইনা বিল দাও? আমি বিল দেই। তাই এখন আমিই মানা করে দিছি। তোমার যদি ওরে দিয়া বাজার আনাইতে মন চায় তাইলে নিজেরে গিয়া বিলাও ওর কাছে। তাইলে তোমার সব কাম কইরা দিবে। এমনিতে তো তোমার আবার নিজেরে বিলানোর শখ বেশি।”
অপমানে, লজ্জায় সিনথিয়ার চোখে পানি চলে এসেছে। হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো আরশির দিকে। এতোদিন তো এসব করতে বলেনি। তাহলে আজ হঠাৎ বাজারে পাঠাচ্ছে কেনো? আবার কোন ঝামেলায় ফেলতে চাচ্ছে এই মহিলা। সিনথিয়া রুমে এলো। বোরকা পরতেই ডুকরে কেঁদে উঠে। সেদিনের বিচারসভার পর থেকেই আরশি ওকে যখন তখন এসব বাজে কথা বলে খোটা দেয়।
.
বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে সিনথিয়া। একটা রিকশা খুজচ্ছে কিন্তু পাচ্ছে না। প্রচন্ড রোদের উত্তাপ আজ। গরমে ভেতরে একেবারে ভিজে গেছে। হাত দিয়েই নেকাবটা মুখের সাথে চেপে ধরলো। যাতে মুখের ঘাম মুছে যায়। সিনথিয়া বামপাশে ঘাড় ঘুড়াতেই দেখলো সেদিনের পার্টির ওই লোকটা দাঁড়িয়ে আছে ওর পাশে। সিনথিয়া ঘাবড়ে গেলো। পরক্ষণেই মনে হলো ও তো বোরকা পরে আছে হয়ত চিনবে না। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
রিকশা না পাওয়ায় হেটে এলো বাড়িতে। গেইট দিয়ে ঢুকার আগ মুহুর্তেই ওই লোকটা ওকে ডাক দিলো। সিনথিয়া অনেকটা চমকে পেছনে ফিরলো। লোকটা ওর দিকে এগিয়ে এসে বললো,
— “আমার থেকে নিজেকে আড়াল করে লাভ নেই সিনথি ডার্লিং। আমি তোমাকে চিনে ফেলেছি। নাউ টেল মি, এখন পার্টিতে আসো না কেনো? জানো তোমাকে ছাড়া একটুও ভালো লাগেনা আমার।”
ভয়ে সিনথিয়ার পা দুটো কাপছে। এই লোকটা তাহলে তখন ভেজাবিড়াল সেজে ওকে ফলো করছিলো? এখন যদি আরশি দেখে ফেলে তাহলে একটা ইস্যু পেয়ে যাবে ওকে বারবার অপদস্ত করার। এটার জন্য হয়ত আবার বিচার বসতে পারে। তারপর আবার ওর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। সিনথিয়া এসব ভেবে তাড়াতাড়ি গেইটে ঢুকতে চাইলে লোকটা ওর হাত চেপে ধরে। সিনথিয়া ভয়ে হাত থেকে বাজারের ব্যাগ ফেলে দিলো। আতঙ্কিত হয়ে বললো,
— “ছা..ছাড়ুন আমার হাত। অসভ্য লোক।”
— “তুমি যাই বলো আমি তোমাকে ছাড়ছি না। সায়ান তোমার জন্য পারফেক্ট না। তুমি ওকে ছেড়ে আমার কাছে চলে আসো। সিনথিয়া প্লিজ।”
সিনথিয়া রেগে গিয়ে চড় বসালো লোকটার গালে। লোকটা হতভম্ব হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। হয়ত এইটা আশা করেনি। সিনথিয়া তাড়াতাড়ি ব্যাগ উঠিয়ে ভেতরে চলে এলো। মনে মনে ভয় পাচ্ছে। এই বুঝি আরশি ওর উপর বাঘিনীর মতো ঝাপিয়ে পরবে। দেখে ফেলেছি কি? কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে আল্লাহর নাম নিয়ে বাড়িতে ঢুকলো। বাজারের ব্যাগ রান্নাঘরে রেখে ধীরেধীরে আরশির রুমের সামনে গেলো। বাহির থেকে দেখলো আরশি ঘুমিয়ে আছে। সিনথিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। যাক বেঁচে গেছে আরেকটা তামাশা হওয়া থেকে।
দুইদিন পার হয়েছে। সিনথিয়া অনেকটা চিন্তিত হয়ে আছে। বারবার শুধু দোয়া করছিলো ওই লোকটার বাজে নজর থেকে যেনো বেঁচে যায়। সায়ান অফিসে যাওয়ার পরপরই আরশি এসে ওর হাত টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললো,
— “মার্কেটে যাও। আমার জন্য একটা বডি লোশান, বডি ওয়াশ, আর একটা মোশচরাইজার নিয়ে আসবে যেটা আমি ইউজ করি।”
— “আ..আমি যাবো?”
— “তো কি তোর মায় যাবে? তাড়াতাড়ি যা।”
— “জ..জ্বী।”
— “শুন! সুপার মার্কেট যাবি। সেখান থেকেই আনবি। আমি ব্রান্ডেড ছাড়া ইউজ করি না।”
সিনথিয়া একটা কসমেটিকস এর দোকানে গেলো। ওদেরকে নাম বলতেই সবকিছু ওকে দেখালো। সিনথিয়া ভালো মতো দেখে কিনে নিলো। দোকান থেকে বেরিয়ে একটু সামনে যেতেই কেউ ওর হাত ধরে টান দিয়ে একটু নিরিবিলি জায়গায় নিয়ে এলো। সিনথিয়া ঘাবড়ে সামনে তাকালো। সেদিনের ছেলেটা। ভয় পাচ্ছে সিনথিয়া। এবার যদি সেদিনের থাপ্পড়ের জন্য কিছু করে বসে এই লোক? সিনথিয়া কিভাবে বাচাবে নিজেকে? উফ! এটা আবার কোন নতুন ঝামেলা তৈরি হলো? লোকটা ছ্যাচড়ার মতো লেগে আছে ওর পিছনে। অসৎ উদ্দেশ্যেই আছে লোকটার এটা তাকে দেখলেই বুঝা যায়।
লোকটা ওর হাত চেপে টান দিতেই অনেকটা কাছে এসে পরেছে সিনথিয়া। হাত মুচড়া মুচড়ি করছে ছাড়া পাওয়ার। লোকটা ওকে বললো,
— “তুমি আমাকে মারো, অপমান করো, যাই করো না কেনো আমি তোমাকে ছাড়ছি না। তোমার ওই পারফিউমের ঘ্রাণ আমি এখনো ভুলতে পারিনা। ওয়াইনেও এখন নেশা ধরেনা। যেই নেশা তুমি ধরিয়েছো। প্লিজ আমাকে ফিরিয়ে দিও না। সায়ান তোমার যোগ্য নয়।”
— “আপনি আর একটা কথাও বলবেন না উনাকে নিয়ে। উনি যেমনই হোক আমার স্বামী। আর আমি আমার স্বামী যথেষ্ট ভালোবাসি। তাই এসব বলে কোনো লাভ নেই। ছাড়ুন আমার হাত। যেতে দিন। নয়তো আমি চিৎকার করবো।”
— “করো। তাহলে আমিও বলবো বিবাহিত হয়েও আমার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছো। আমার টাকা উড়িয়েছো। আর এখন আমাকে ইগনোর করছো।”
উফ! আচ্ছা ঝামেলা তো। মনে মনে বললো সিনথিয়া। এদিকে ভয় পাচ্ছে খুব। মনে মনে শুধু দোয়া করছে এই বদলোকটার কবল থেকে যেনো বাঁচিয়ে দেয়। সিনথিয়া আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো। এখানে তেমন মানুষজন নেই। চিৎকার করেও লাভ নেই। দেরিও হচ্ছে। আরশি অবশ্যই ওকে এক্সট্রা সময়ের জন্য প্রশ্ন করবে। তখন কি বলবে? উত্তর দিতে না পারলে তো রটিয়ে দিবে ও বাইরে কারো সাথে দেখা করে।
সিনথিয়া লোকটার পেছনের দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়ে বললো,
— “সায়ান আপনি? আমি জানিতাম আপনি আসবেন।”
লোকটা ওর হাত ছেড়ে তাড়াতাড়ি পেছনে তাকালো। এই সুযোগে সিনথিয়া সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে আসলো। যাক বাঁচলো। মনে মনে অসংখ্য শুকরিয়া জানালো রবের দরবারে। তিনি যদি তৎক্ষনাৎ এই বুদ্ধিটা মাথা দিয়ে সাহায্য না করতেন তাহলে না জানি কি হতো আজ।
বাসায় ফিরে আরশিকে সব কিছু দিলো। আরশি বাঁকা চোখে তাকিয়ে বললো,
— “এতো দেরি হলো কেনো?”
— “আসলে জ..জ্যাম ছিলো রাস্তায়। আবার র..রিক্সাও পাচ্ছিলাম না।”
মিথ্যেটা বলতে কষ্ট হয়েছে ওর। কিন্তু কিছু করার ছিলো না। এসব কথা বললে উলটো দোষ ওর ঘাড়েই পরতো।
রাতে সায়ান আসলো বেশ তাড়াতাড়ি। ওকে পপর্কন ভেজে দিতে বললো। সিনথিয়া পপর্কন ওর সামনে রেখে চলে যাচ্ছিলো তখন সায়ান ডেকে বললো,
— “এই পাশে বসো। আসো মুভি দেখি।”
— “আপনি ভালো করেই জানেন আমি এসব পছন্দ করি না। এসব দেখি না। তারপরেও কেনো বলেন। আমি যতই আপনার সাথে সহজ হতে চাই আপনি সিচুয়েশনটা আমার জন্য আরো কঠিন করে তুলেন।”
— “ওকে কুল! এতো রাগার কি আছে।”
সিনথিয়া চলে গেলো। সায়ান ওর মতো করেই মুভি দেখতে লাগলো। রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে সায়ান রুমে এসে দেখলো সিনথিয়া খুব অস্থির হয়ে আছে। সায়ান চুপিচুপি এসে ওর কানের কাছে ভু করে আওয়াজ করলো। সিনথিয়া ভয়ে লাফিয়ে উঠে। সায়ান বেডে শুয়ে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। রাগ হলো সিনথিয়ার। অপর পাশে মুখ ঘুড়িয়ে শুয়ে পরলো। সায়ান জিজ্ঞেস করলো,
— “কিছু কি হয়েছে? চিন্তিত লাগছে তোমাকে।”
— “এমন ভাবে বলছেন যেনো আপনি কিছুই জানেন না।”
— “সবই জানি। তোমার থেকে শুনতে চাইছি শুধু। বলো।”
— “কিছু না।”
সায়ান ঘুমিয়ে পরলো। আজও সিনথিয়া ভুল করলো। ভেবেছিলো সায়ান সব জানে ওই লোকটার ব্যাপারে। তাই রেগে কিছু বললো না৷ আর এইটাই ওর সবথেকে বড় ভুল ছিলো।
________________________________
লোকটার উৎপাতের পরিমাণ দিনদিন বাড়তে লাগলো। সিনথিয়া অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। এবার সিদ্ধান্ত নিলো সায়ানকে বলবে এসব। আজ রাতেই বলবে এসব।
গোসলের সময় সিনথিয়া গায়ে পানি ঢেলে মাথায় শ্যাম্পু করতেই পানি বন্ধ হয়ে গেলো। সিনথিয়া হতভম্ব হলো। এখন কি করবে? এভাবে তো বসে থাকাও সম্ভব না। ভিজা গায়ে বের হবে কিভাবে? কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও যখন পানি আসলো না তখন সিনথিয়া ভিজা কাপড় নিয়েই বের হলো। একটা ওড়না গায়ে পেচিয়ে ছাদে গেলো চেক করতে।
ছাদে উঠেই ওর পা থেমে গেলো। ভয়ে পুরো শরীর থরথর করে কাপছে। লোকটা এখানেও চলে এসেছে। কিন্তু কিভাবে? গেইটে তো দারোয়ান আছেন। উনি তো অপরিচিত কাউকে ঢুকতে দেননা। তাহলে কিভাবে এলো।
লোকটা ওকে এতক্ষণ স্ক্যান করছিলো। এগিয়ে এসে সিনথিয়ার সামনে দাড়ালো। কয়েকটা ভেজা চুল সিনথিয়ার মুখে পরেছিলো। লোকটা সেসব সরিয়ে দিয়ে বললো,
— “তোমার এই রুপ আমার মনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে সিনথিয়া। এবার আমি তোমাকে ছাড়ছিই না।”
— “আ..আপ..আপনি ক..কি….!”
লোকটা হাসলো। সিনথিয়া এতো শখ খেলো যে কি করবে বুঝতে পারছে না। সায়ান, আরশি, ওর বাড়ির লোকজন এসব জানলে ওকে হয়ত এবার মেরেই ফেলবে। এসব ভাবতেই ওর চোখ থেকে পানি বেরিয়ে এলো। সরতে চাইলে লোকটার কাছ থেকে। তার আগেই বেয়াদব ছেলেটা ওর কোমড়ে হাত রেখে দিয়েছে। সিনথিয়া তড়িৎ গতিতে সরতে চেয়েছিলো। কিন্তু হলো না। হায়! যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়।
সায়ান এসে দাঁড়িয়েছে ছাদের দরজার সামনে। সায়ান বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। পেছনে আরশি, সালেহা বানু, ওর বড় ভাবি মিম। সিনথিয়া নিজের দিকে তাকালো। লোকটা এখনো ওর কোমড় ধরে রেখেছে। সিনথিয়ার নজর শুধু সায়ানের দিকে। সায়ানের চোখে মুখে বিষ্ময়। এমন একটা মুহুর্তে এসে দেখেছে ওরা যে, এখন ও হাজার বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না এই লোকটা ওকে ডিস্টার্ব করতো।
সিনথিয়া আরশির দিকে তাকাতেই দেখলো কেমন করে যেনো সবার অগোচরেই হাসছে। সিনথিয়া এবার বুঝলো এসব কার চাল। এইজন্য ওকে বাজারে, মার্কেটে পাঠিয়েছে। আর ও বোকাটা বুঝতেই পারলো না। সায়ান ওর হাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে গেলো। সিনথিয়া তাড়াতাড়ি গোসল সেরে কাপড় পরে বেরিয়ে এলো। সায়ান কিছু বলছে না। সিনথিয়াকে বের হতে দেখে সায়ান ওকে টেনে নিয়ে গাড়িতে বসালো। সিনথিয়া বুঝলো না কি হয়েছে।
গাড়ি এসে থামালো ওদের বাড়ির সামনে। সিনথিয়া বুঝে গেছে আজ ওর সাথে কি হবে। সায়ান ওকে টেনে হিচড়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলো। সোফায় ওর বাবা-মা, বড় ভাই বসা ছিলো। সায়ান সিনথিয়াকে ছুড়ে ফেললো ওদের সামনে। সিনথিয়ার বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
— “দিয়া গেলাম আপনাদের চরিত্রহীন মেয়েকে। এবার যা করার আপনারাই করুন।”
— “কি করেছে আবার?” আসমা বললো।
— “প্রমাণ পাঠিয়ে দেবো কি করেছে। বাকিটা ওর থেকে শুনে নেবেন।
সায়ান চলে গেলো। সিনথিয়া শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো সায়ানের চলে যাওয়াটা। খুব কষ্ট পেয়েছে সিনথিয়া। একবার জানতেও চাইলো না পুরো ঘটনা।
চলবে,,,
® ‘নুরুন নাহার’