তুমি কেন আগে আসোনি পর্ব ৯+১০

“”তুমি কেন আগে আসোনি?”

৯.
ভোরের স্নিগ্ধ বাতাস সিনথিয়ার চোখে মুখে এসে বারি খেলো। ওর রুমের জানালাটা খোলাই ছিলো। বাতাসের ঝাপটায় হালকা শীত লাগলো সিনথিয়ার। জানালার দিকে ফিরে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। আজকের আকাশটা খুব সুন্দর লাগছে। সিনথিয়ার খুব ভালো লাগলো আকাশটা দেখে। সিনথিয়ার সবসময় ইচ্ছে ছিলো প্রিয় মানুষটার সাথে মেঘের দেশে যাবে। ইচ্ছেমতো ঘেম ছুবে ও। আর ওর প্রিয় মানুষটা মুগ্ধ হয়ে ওর মুখের অভিব্যক্তি দেখবে। সিনথিয়া চোখ বুজলো। চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পরলো এক ফোটা নোনাজল।

আস্তে করে উঠে বসলো। শরীরে খুব ব্যাথা। দাড়ানোর শক্তি নেই বললেই চলে। বালিশটা লম্বা করে পেছনে রেখে তাতে হেলান দিয়ে বসলো। একসপ্তাহ হয়ে গেছে অথচ সায়ান একবারও ওর খোজ নেয়নি। কেমন আছে একবারও জানতে চাইলো না। সিনথিয়ার খুব কষ্ট হলো। এখনও হচ্ছে। ওর কাছে ফোন নেই যা দিয়ে একটু ফোন করে কথা বলবে সায়ানের সাথে। সিনথিয়া সামনের দিকে একমনে তাকিয়ে রইলো।

সেদিন সায়ান ওকে রেখে চলে যাওয়ার পর ওর বড় ভাই হামিদ ভীষণ ক্ষেপে গিয়েছিলো। অনবরত চড় বসিয়েছে ওর গালে। অথচ ওর মুখ থেকে কিছুই শুনলো না ওরা কেউ। আঘাত করার পরিমাণ আরো বেশি হলো যখন মিম বাসায় এসেছিলো। হামিদ মিমকে বারবার জিজ্ঞেস করছিলো কি হয়েছে। কিন্তু সে মুখে কুলুপ এঁটে বসে ছিলো। আসমা ঝাড়ি দিতেই মিম বললো,

— “ওকে জিজ্ঞেস করুন এমন নোংরা স্বভাব কোথায় পেয়েছে এই মেয়ে? বাড়িতে পর্যন্ত নিয়ে এসেছিলো। নিজের চোখে দেখেছি ওদের দুজনকে একসাথে ছাদে। ছিহ!”
— “কি দেখেছো ক্লিয়ার করে বলো।”

মিম মোবাইল থেকে কি যেনো দেখালো। সিনথিয়া চড় খেয়েই অসার হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। মাথাটা ভো ভো করছিলো। মোবাইলে এসব দেখে আসমা সিনথিয়ার দিকে এগিয়ে এলো। ক্লান্ত চোখে মায়ের দিকে তাকালো সিনথিয়া। আসমা আচমকাই হাটু দিয়ে ওর তলপেটে এবং তার থেকে একটু নিচে স্পর্শকাতর স্থানে মেরেছে। সিনথিয়া ‘আল্লাহ’ বলে চিৎকার করে উঠলো। মেঝেতে পরে গেছে। নিঃশ্বাস যেনো আটকে গেছে বুকের ভেতরে। হা করে নিঃশ্বাস নেয়ার চেষ্টা করলো।

মিম আরো কি কি যেনো বললো সবাইকে। সেসব সিনথিয়ার কর্ণগোচর হলো না। চোখে ঝাপসা দেখছিলো সব। এরমাঝেই ওর বড় ভাই টেনে হিচড়ে রুমের ভেতরে নিয়ে গেলো। বড় ভাইয়ের সাথে ওর বাবাও উপস্থিত হয়েছে। অন্যরা সবাই বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো। ভেতরে আসতে চেয়েছে কিন্তু পারলো না। দরজা বন্ধ করে দিলো। রুমের ভেতরের সেই মর্মান্তিক নির্যাতন সিনথিয়া ছাড়া কেউই জানে না।

ও ছোট থেকেই দেখেছে বাবা-ভাইরা ওকে কেমন যেনো এড়িয়ে চলতো। নিজের শখ, আহ্লাদ কোনোদিন পূরণ করতে পারেনি। সবসময় প্রয়োজনীয় জিনিস ব্যতীত বারতি জিনিস পায়নি। এমনটা হওয়ার কারণ বুঝতো না সিনথিয়া। ক্লাস নাইনে পড়া কালীন একদিন সিনথিয়া ওর বাবা-মায়ের রুমে গিয়ে বললো,

— “বাব স্কুলে পাঁচমাসের বেতন একসাথে নিবে সেসব ক্লিয়া করতে বলেছে আগামীকাল।”
— “ঠিকাছে টাকা দিয়ে দিবো।”
— “হু…।”

সিনথিয়া বেরিয়ে এলো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একবার বাবার দিকে তাকালো। নিউজপেপারে ব্যস্ত হয়ে গেছে আবার ওর বাবা। মায়ের দিকে তাকালো। নিজের রুপচর্চা নিয়ে ব্যস্ত। সিনথিয়ার খুব ইচ্ছে করে বাবা-মায়ের সাথে একটু সময় কাটাতে কিন্তু ওরা কেনো যেনো ওকে তেমন একটা পছন্দ করেনা।
সিনথিয়া চলেই আসছিলো ভেতরের কথা শুনে পা থেমে গেলো।

— “ওর জন্য এতো খরচ করতে ভালো লাগেনা। আস্ত একটা ঝামেলা এই মেয়ে। কোন কুলক্ষণে যে এই মেয়ে জন্ম নিলো।”
আসমা বললো,
— “তোমারই তো দোষ। কিছু হবে না হবে না বলে ফূর্তি করেছিলে তার ফলই তো এই আপদটা। কতবার বলেছি প্রটেকশন ইউজ করতে। নাহ! উনার তাতে……।”
— “আরে আমি কি বুঝতে পেরেছি নাকি, এর কারণে এইটা জন্ম নিবে।”
— “নিয়েছে যখন পালতে তো হবেই। তোমাকে তো বলেছিলাম কোনো অনাথ আশ্রমে দিয়ে আসতে। তুমিই দিলে না। দরদ একেবারে উতলিয়ে পরছিলো। এখন বিরক্ত হচ্ছো কেন?”
— “ধুর ভুল করেছি তখন। এখন দেখলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। ক্লাস টেন পাস করুক। তারপর ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে বিদায় করবো।”

সিনথিয়া রুমে চলে এসেছে। আর শুনার ক্ষমতা হয়নি ওর। সিনথিয়া ভিষণ কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু কাদলো না। বোবার মতো দাঁড়িয়ে রইলো বারান্দায়। নিজেকে খুব ফেলনা মনে হচ্ছে।

সিনথিয়ার উপর এমনিতেই সবাই বিরক্ত ছিলো। যখন দীনে ফিরলো। শারিয়াহ মেনে চলতে লাগলো তখন থেকে আরো চোখের বিষ হয়ে গেলো সবার। তাইতো এতো মারধর করলেও কারো মায়া হয়না ওর প্রতি।

অতীতের কথা ভেবে সিনথিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সিনথিয়া এতোদিন একটুও বুঝতে পারেনি আরশিদের প্ল্যান। এবার বুঝেছে। কতটা সূক্ষ্ম প্ল্যান ছিলো ওদের। যত যাই হতো সায়ান বা আরশি কেউ ওর গায়ে তুলেনি। ওরা কৌশলে এ বাড়ির মানুষ দিয়েই ওকে মার খাইয়েছে। যাতে ওদেরকে অপবাদ দেয়া না যায়। মানষিক টর্চার করেছে প্রতিদিন যাতে সিনথিয়া ওদের প্ল্যান ধরতে না পারে। সারাদিন কাজে ব্যস্ত রেখেছিলো। বলতেই হবে ওরা খুব সূক্ষ্মদর্শী।

দরজা খটখট আওয়াজ করে খুলে গেলো। সিনথিয়া দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো ওর মা এসেছে। সিনথিয়া আবার আগের ন্যায় বসে রইলো। আসমা ওর সামনে একটা প্যাকেট রেখে খ্যাটখ্যাট করে বললো,

— “তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে সায়ান এসেছে তোর মতো দুশ্চরিত্রাকে নিতে।”
— “সায়ান…? এতোদিন পর হ..হঠাৎ?”
— “যাবি নাকি এখানেই বসে থাকবি?”

সিনথিয়া বেডের কিনারা ধরে আস্তে আস্তে উঠে দাড়ালো। আসমা ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

— “এখন ঢং বেড়ে গেছে তোর তাইনা? সায়ানকে না দেখালে তো তোকে ওই ঘরে নিবে না। এইজন্য নোখরা করছিস।”

সিনথিয়ার চোখে বিন্দু বিন্দু অশ্রুকণা জমে উঠলো। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ওর মায়ের দিকে। ওর মা তো দেখেছে সেদিন ওর কি হাল করেছিলো ওর বাবা-ভাই। তিনদিন পর্যন্ত বিছানা থেকে উঠতে পারেনি। এপাশ-ওপাশও করতে পারেনি। সব নিজের চোখে দেখেও এসব বলছে? সিনথিয়া কিছু বললো না ওর মাকে। ওয়াশরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নিলো। বেডের উপর পরে থাকা ব্যাগটা নিয়ে খুলে দেখলো। কালো রঙের সিম্পল একটা আবায়া। সিনথিয়া সেটা গায়ে জড়িয়ে নিকাব বেধে বেরিয়ে এলো।

সায়ান ওকে দেখে উঠে দাঁড়ায়। সিনথিয়া একবার তাকিয়েছিলো সায়ানের দিকে। তারপর আর তাকায়নি। অভিমান হয়েছে ভিষণ। নিজের অভিমানের কথা জেনে মনে মনে হাসলো সিনথিয়া। ও জানে এসবের কোনো দাম নেই সায়ানের কাছে। তারপরেও একটু আশা করা যদি সায়ান ওর অভিমান ভাঙায়। সায়ানের সামনে যথেষ্ট স্বাভাবিক ভাবে হাটলো। কষ্ট হয়েছে খুব। তবুও নিজেকে দুর্বল প্রমাণ করতে চায়নি ও।

গাড়িতে উঠে বসতেই সায়ান গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চালাতে শুরু করলো। একটা কথাও বলেনি এখন পর্যন্ত সায়ান। এতে সিনথিয়া আরো কষ্ট পেলো। একটাবার কেউ ওর মুখ থেকে শুনতে চাইলো না সত্তিটা কি। সবাই নিজের মতো করে যা নয় তাই বলে যাচ্ছে ওকে। সবার মন্তব্যের যাতাকলে ওকে পিষে ফেলছে।

গাড়ি এসে থামলো বিশাল বিল্ডিংয়ের সামনে। সিনথিয়া একটু চিন্তায় পরলো। সায়ান ওকে ও-বাড়ি না নিয়ে এখানে ফ্ল্যাটে কেন আনলো? সায়ান গাড়ি থেকে নেমে হাটতে শুরু করেছে। সিনথিয়াও গেলো পেছন পেছন। লিফট এসে নবম ফ্লোরে থামলো। ফ্ল্যাটে ঢুকতেই সিনথিয়ার আগের সেসব ঘটনা মনে পরে গেলো। এখন কেনো যেনো মনে হচ্ছে সায়ান ওকে জেদের বসে বিয়ে করেছে।

— “ভালো আছো সিনথিয়া?”

সায়ানের কণ্ঠে শুনে সিনথিয়া সেদিকে তাকালো। সায়ান সোফায় বসেছে। দুইহাত ছড়িয়ে এমনভাবে বসেছে যেনো ও কোনো রাজা। সিনথিয়া আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সায়ান উঠে এসে সিনথিয়ার বরাবর দাঁড়িয়ে বললো,

— “কথা বের হচ্ছে না? হবে কি করে? তোমার সব অহংকার ভেঙে যে গুড়িয়ে গেছে।”
— “অহংকার?” মিনমিনে স্বরে বললো সিনথিয়া।
— “হ্যাঁ অহংকার। এই অহংকারের কারণেই তো আমার মাকে যা নয় তাই বলেছিলে সেই প্রথমদিন। তাইনা?”
— “আমিতো কখনো অহংকার করিনি। কিসব বলছেন আপনি?”
— “ওহ! বুঝবে কি করে। আসলে যে অহংকার করে সে নিজেকে অনেক কিছু মনে করে তো তাই বুঝতে পারেনা। যেমন তুমি বুঝতে পারছো না।”
— “আপনি ভুল বুঝচ্ছেন আমাকে।”

সায়ান সিনথিয়ার দুই বাহু চেপে ধরে। যখমের জায়গায় চাপ পরতেই ব্যাথায় কুকড়ে উঠে সিনথিয়া। সায়ান হুংকার দিয়ে বললো,

— “ভুল! কোনটা ভুল? আমার মাকে স্বামীর ভাত খেতে না পারা বলাটা ভুল? তোমাকে আমরা দেখতে গেছিলাম আর তুমি যা নয় তাই বলে অপমান করলে এগুলো ভুল?”
— “ছাড়ুন আমাকে। লাগছে আমার। সেটার জন্য আপনারা আমাকে যথেষ্ট শাস্তি দিয়েছেন। এখন এসবের মানে কি?”
— “ইয়েস শাস্তি তো তুমি পেয়েছোই। আরো বাকি আছে।”
— “আরো? আমার অপরাধ?”
— “মনে আছে আমাকে এই ফ্ল্যাটে দাঁড়িয়ে থাপ্পড় মেরেছিলে? তারপর কি যেনো বলেছিলে? বেশি উত্তেজনা থাকলে নিষিদ্ধ পল্লীতে কেনো যাইনা। রাইট?”
— “(—–)”
— “এইযে তোমার সাথে এতোকিছু ঘটেছে এসব কেনো ঘটেছে জানো?”

সিনথিয়া প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সায়ানের দিকে। সায়ান বাকা হেসে বললো,

— “সেদিনের থাপ্পড়ের জবাব ছিলো এসব। আসলে আমি কারো ঋণ রাখি না বুঝলে।”

সিনথিয়ার চারপাশে সব যেনো থেমে গেলো। বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো একেবারেই। অবিশ্বাস্য চোখে সায়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো,

— “প্র..প্রতিশোধ নিতে…।”
— “ইয়েস। প্রতিশোধ নিতেই তোমার মতো মেয়েকে বিয়ে করা। তোমাকে আমার রক্ষিতা বানাতেই এসব করা। এন্ড আই ডিড ইট।”
— “আ..আমি আপ..আপনার রক্ষিতা?”

সায়ান সিনথিয়ার গাল চেয়ে ধরে বললো,

— “তুই কি নিজেকে অনেক ইমপোর্টেন্ট ভাবতি নাকি? মনে নেই তোর প্রথমদিন তোকে বাড়িতে সবার সাথে কি বলে পরিচয় করিয়েছি। কখনো বলেছি তুই আমার স্ত্রী?”
— “সায়ান কিসব বলছেন আপনি?”
— “বুঝতে পারছিস না কি বলছি আমি? বাংলাতেই বলেছি।”
— “সামান্য একটা থাপ্পড়ের জন্য আমার সাথে এরকম একটা নোংরা খেলা খেললেন আপনি?”
সিনথিয়ার গাল আরেকটু চেপে ধরে বললো,
— “সামান্য থাপ্পড়? এটা তোর কাছে সামান্য আমার কাছে নয়। সায়ান খানকে থাপ্পড় মারিস কোন সাহসে..হুম?”

সিনথিয়ার ডাগর চোখদুটোর কানায় কানায় নোনাপানিতে ভরে উঠলো। সায়ানের এই রুপটা হজম হচ্ছে না ওর। সিনথিয়া সায়ানের হাত ধরে বললো,

— “আপনি আমার সাথে মজা করছেন তাইনা?”
— “তোকে আমি এতোটাও শাস্তি দিতে চাইনি। কিন্তু তোর এই অহংকার, দেমাগ, দেমাগভরা কথাবার্তায় তোর শাস্তি বেড়েছে। কি যেনো বলেছিলি আমি চরিত্রহীন। এখন বল সবাই কাকে চরিত্রহীন বলছে? তোকে। হাহা…। বেচারি।”
— “তারমানে ওসব আপনি.. আপনার প্ল্যান ছিলো?
— ” অফকোর্স আমার।”
— “সায়ান আমি আপনার স্ত্রী হই। নিজের স্ত্রীর সাথে এরকম কিভাবে করতে পারলেন আপনি?”
— “স্ত্রী মাই ফুট। তুই আমার রক্ষিতা ছাড়া কিছুই না। এতোদিনেও বুঝিসনি তোকে কেনো শুধু রাতেই আমার কাছে আনতাম। রক্ষিতা ছিলি তাই সেরকম ব্যবহার পেয়েছিস।”
— “সায়ান..!”
— “আর কি যেনো বলেছিলি? আমার মায়ের চরিত্র ঠিক নেই। সেই একই পেট থেকে আমার জন্ম। এখন বল কেমন লাগছে নিজের সর্বাঙ্গে কলঙ্কের দাগ লাগিয়ে ঘুড়তে?”

সিনথিয়া কিছুই বলতে পারলো না। শুধু তাকিয়ে রইলো সায়ানের দিকে। সায়ান ওর হাতে কয়েকটা নোট ধরিয়ে দিয়ে টেনে ফ্ল্যাট থেকে বের করে দিলো। ফ্ল্যাট লক করে ওর দিকে ফিরে বললো,

— “তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসিস। নিজেকে বিক্রি করতে আবার কোথাও চলে যাস না।”
সায়ান চলে গিয়ে আবার ফিরে এসে বললো,
— “আমার বাড়িতেই ফিরিস। আসলে কয়েকদিন ধরেই একটু ভিন্ন কিছু টেস্ট করতে ইচ্ছে করছিলো তাই তোকে ডাকা।”

সায়ান চলে গেলো। সিনথিয়া ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। কিছু বুঝতে পারছে না। আসলে ওর মনে যে তোলপাড় চলছে তাতে ওর মাথায় কিছুই ঢুকছে না। একটা থাপ্পড়ের জন্য আজ ওকে কোথায় নামিয়ে আনলো সায়ান। এতোটা ঘৃণা? এতো ক্ষোভ ওর প্রতি? এইজন্য আরশি এতোটা অতাচার করেছে ওর উপর? সেদিনের কথাগুলোকে জের ধরে এমন করেছে? ওরাও তো ওকে কম শোনায় নি। কই সিনথিয়া তো প্রতিশোধ নিতে চায়নি। এতো অপমানের পরেও সব ভুলে সায়ানের সংসার করতে চেয়েছিলো।

হাটতে হাটতে পৌছে গেলো বাড়িতে। বাড়িতে ঢুকতেই আরশি কটাক্ষ করে বললো,

— “তোর তো আরো আগে আসার কথা। দেরি হলো কেন? নাকি নতুন নাগড় ছুটিয়েছিস? কাকে পেলি? নতুন টা কি আগের থেকেও…..।”

সিনথিয়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। সায়ান এসেই ওর বামহাতের বাহু চেপে ধরলো। ওর জখম বামহাতেই বেশি। আর সায়ান ওকে এই হাতেই বেশি চাপ দিচ্ছে। ওকে ঝাকি দিয়ে সায়ান বললো,

— “এতো দেরি করেছিস কেন? তোকে টাকা দিয়েছি কিসের জন্য? তাড়াতাড়ি ফিরে এলি না কেন? এতো বেয়াদব কেন তুই? যেদিকে যাস সেদিকেই জুটিয়ে ফেলিস। তোকে আমি….।”

সিনথিয়ার হাত টান দিতেই সায়ানের দেয়া টাকা সায়ানের হাত চলে গেলো। সায়ান টাকা গুলোর দিকে একবার তাকিয়ে সিনথিয়ার দিকে তাকালো। ওর কোনো হেলদোল নেই। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আরশি চলে গেলো রুমে। সায়ান ওকে টেনে রুমে নিয়ে গেলো। রুমের লাইট অফ। ড্রিম লাইট জ্বলছে। সায়ান বাধাকপির মতো করে একটা একটা আবরণ সরিয়ে নিচ্ছে সিনথিয়া থেকে। মেতে উঠলো ওর হিংস্র নেশায়।

_________________________________
হালকা আওয়াজে সায়ানের ঘুম ভেঙে গেলো। চোখ মেলতেই অনেক আলো এসে চোখে ভিড়লো। একবার চোখ বন্ধ করে আবার খুলে ফেললো। প্রথমেই চোখ গেলো আলমারির দিকে। সেখানে সিনথিয়াকে দেখলো। একমনে কাজ করছে। এই একসপ্তাহে ঘরটাকে ডাস্টবিন বানিয়ে ফেলেছে মা ছেলে দুজন। বিনে পয়সার বান্দিতো আছেই তাই কোনো চিন্তা নেই ওদের।

শার্ট ভাজ করতে গিয়ে হাত থেকে পরে গেলো। সেটা তুলে আবার ভাজ করতে লাগলো সিনথিয়া। কাজ করার কারণে ওর গায়ের ওড়না কাধের একপাশে পরে আছে। যার কারণে সায়ানের কাছে বেশকিছু জিনিস দৃষ্টিগোচর হলো। আরেকটু ভালো করে তাকালো সিনথিয়ার দিকে।

ঠোঁটের এককোণে ফুলে কালচে হয়ে আছে। দুই গালেই অসংখ্য থাপ্পড়ের দাগ। ডানচোখের নিচেও কালো কুচকুচে হয়ে আছে। ঘাড়ে, গলায় হাতে অসংখ্য জখমের দাগ। সায়ান উঠে বসে। গভীর চোখে তাকিয়ে আছে সিনথিয়ার দিকে। সায়ানের ধারণার বাইরে ছিলো এসব। ও ভেবেছে ওই ঘটনার জন্য হয়ত সামান্য চড়, থাপ্পড় দিবে ওর পরিবার। কিন্তু এভাবে মারধর করবে সেটা জানা ছিলো না।

সিনথিয়া আলমারির কাজ শেষ করে পেছন ফিরতেই দেখলো সায়ান বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সিনথিয়া নজর সরিয়ে নিলো। বিছানার কাছে এসে গুছিয়ে নিলো বিছানাটা। সায়ানের বুকসেল্ফের দিকে গেলো এবার। ধুলো জমে ভরে আছে। এখন যদি এসবে ধুলো দেখে তাহলে আরশি ওকে ছেড়ে কথা বলবে না। ক্লান্ত হাতে কাজ করে চলছে সিনথিয়া। সায়ান এরমধ্যেই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো। সিনথিয়ার দিকে তাকালো আবার। কেমন যেনো বিধ্বস্ত লাগছে ওকে।

সায়ানকে বেরিয়ে আসতে দেখে কাবার্ড থেকে ওর শার্ট, প্যান্ট, টাই, ব্লেজার, কোট বের করে বিছানায় রাখলো। স্টাডি টেবিল থেকে ওর প্রয়োজনীয় ফাইল সব গুছিয়ে রাখলো কাপড়ের পাশেই। মোবাইল, ওয়ালেট, ঘড়ি সব রেখে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো সিনথিয়া।

ডাইনিং-এ নাস্তা সাজিয়ে রাখলো মা-ছেলে দুজনের জন্য। রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেলো সিনথিয়া। এক সপ্তাহে রান্নাঘরের অবস্থা খারাপ করে ফেলেছে। সেগুলো পরিষ্কার করতে শুরু করেছে সিনথিয়া। এরমধ্যেই ডাইনিং থেকে আরশির চিৎকার শুনা গেলো। সিনথিয়া সেদিকে এগিয়ে গেলো। আরশি বেশ ক্ষেপে গেছে। সায়ান চুপ করে বসে আছে।

— “রান্নার সময় কোন নাগড়ের কথা চিন্তা করতাছিলা তুমি? রুটি এমন পুইরা গেলো কেমনে? তুমার বাপের বাড়ি থেইক্কা আসে এসব খাওন? সারাদিন তো হাড়িয়ে হাড়িয়ে গিলো। নিজের সময় সব ঠিক আর আমগোরে এমুন পোড়া, নষ্ট খাওন দেও। ভালোই ধুন্ধরবাজি জানো দেখতাছি।” সালেহা বানু বললো।

সিনথিয়ার কোনো হেলদোল নেই। বোবার মতো মেঝের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরশি বললো,

— “এই তুমি এসব খাবার কি মনে করে বানিয়েছো? যত্তসব থার্ডক্লাশ খাবার। আসলে আমিই ভুলে গেছিলাম। তোমার স্ট্যাটাস যেমন খাবারের আয়োজনটাও তেমনই তো হবে।”
— “মম আমি যাচ্ছি। লেইট হচ্ছে আমার।”
— “ওকে বাই।”
— “বাই মম।”

সায়ান দরজার কাছে গিয়ে পেছন ফিরে সিনথিয়ার দিকে তাকালো। একদম রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে যেনো প্রাণ নেই। ব্যাটারি পরিচালিত মানবীর মতো লাগছে।

আরশি এবং সালেহা বানু আরো কিছুক্ষণ বকাঝকা করে খাবারগুলো মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিলো। ওরা চলে যেতেই সিনথিয়া সেসব ভাঙা প্লেট উঠিয়ে সব পরিষ্কার করে নিলো। ডাইনিং পরিষ্কার করে নিলো। রান্নাঘরের কাজে লেগে পরলো। এরফাকে সবার জন্য আলাদা আলাদা আইটেমের লাঞ্চ বানিয়ে নিলো। রান্নাঘরের কাজ শেষ হলো বিকেলের দিকে।

একটার দিকে সায়ান এসেছিলো আজ লাঞ্চ করতে। সবাইকে লাঞ্চের জন্য সব গুছিয়ে দিয়ে ডাইনিং-এর একপাশে দাঁড়িয়ে রইলো ওয়েটারের মতো। খাওয়া-দাওয়া শেষে সবার যার যার রুমে চলে গেলো। সিনথিয়া আবারো কাজে লেগে পরেছিলো। রান্নাঘর থেকে বের হয়ে লিডিংরুম, সিড়ি, প্রতিটা রুম পরিষ্কার করে ধুয়ে মুছে আবার রাতের খাবারের আয়োজন করলো। রাতে আবার সবার জন্য আলাদা পদের তরকারি রান্না করেছে। সবার খাওয়া-দাওয়া শেষে এদিকে সব গুছিয়ে সিনথিয়া রুমে এলো। রাত এগোরাটা বাজতে চললো।

জামা-কাপড় নিয়ে গোসলে চলে গেলো। এশার সালাত পড়ে নিলো। কাজের ফাকে ফাকে দুপুরের আর বিকেলের সালাত সবার অগোচরে আদায় করে নিয়েছিলো সিনথিয়া। এশারের সালাত শেষ হতেই ক্লান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দিলো। মুহুর্তেই চোখে ঘুম নেমে এলো।

.
মুখে ঠান্ডা পানির ঝাপটায় ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো সিনথিয়া। কাচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় পুরো শরীর থরথর করে কাপছে। সায়ানের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিলো। সায়ানের চাহনি দেখে বুঝলো এখন ওর কি চাই। সিনথিয়া বাধা দিলো না। সবকিছুই নিরবে মেনে নিলো।

এভাবেই দিন পার হতে লাগলো সিনথিয়ার। কারো কোনো কথায় প্রতিক্রিয়া দেখায় না এখন। একেবারেই না। সারাদিন রোবটের মতো বিরতিহীন কাজ করে যায়। সিনথিয়ার এমন নির্লিপ্ততাও যেনো আরশির সহ্য হলো না। তাই সায়ান আসলেই কান পরা দিতে থাকে। এতসব শুনে সায়ান ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে সিনথিয়ার প্রতি। পান থেকে চুন খসলেই অকথ্য ভাষায় গালাগাল শুরু করে সায়ান। এতোকিছুর পরেও এপাশে নিরব। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।

যত যাই হোক সায়ান কখনোই সিনথিয়ার সাথে গালাগাল করে কথা বলেনি। এবারই প্রথম। সায়ানের এই রুপটা দেখে সিনথিয়া আরো রোবটের মতো আচরণ করতে শুরু করেছে। আরশি সবসময় এসব নিয়ে গজগজ করতেই থাকে। এভাবেই পার হয়ে গেলো সিনথিয়ার বিবাহিত জীবনের দেড় বছর৷

ইদানীং শুনছে সায়ান নাকি কানাডা যাবে। তাও দুই বছরের জন্য। এটা শুনে সিনথিয়ার ভেতরের আরো ভাঙন ধরলো। ওর কেনো যেনো খুব আবদার নিয়ে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো, ‘সায়ান আপনি যাবেন না। এখানে থাকুন। আমাকে বকুন, মারুন, আপনার যত ক্ষোভ আছে আমার উপরে মিটিয়ে নিন। তবুও যাবেন না।’ কিন্তু বলতে পারেনি। মনের কথা মনেই রয়ে গেলো। সায়ানের যাওয়ার কথা শুনে সিনথিয়ার শরীরটাও খারাপ করতে শুরু করেছে৷ তবে এই কথা কাউকে জানালো না।

— “রেডি হয়ে নাও।”
সিনথিয়া ফিরে তাকালো। প্রশ্নসূচক চাহনিতে সায়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। সায়ান আবার বললো,
— “রেডি হও। ব্যাগ গুছাও তাড়াতাড়ি। যাও।”
— “কে…কেনো?”
— “তোমাকে তোমার বাড়িতে দিয়ে আসবো।”

সিনথিয়ার বুকটা ধক করে উঠলো। কোনোরকমে বললো,

— “কে..কেনো? আমি কি ক..কোনো ভুল করেছি আবার? আমাকে বলুন। সব ঠিক করে নেবো।”
— “বেশি কথা বলো তুমি। কয়েকদিনের জন্য যাবে। এখন রেডি হও।”

শেষের কথাটা শুনে সিনথিয়া একটু শান্ত হলো। ব্যাগ গুছিয়ে নিলো। বোরকা পরে রেডি হয়ে সায়ানের সাথে বেরিয়ে গেলো। সায়ান ওকে এ-বাড়িতে রেখে গেলো। সবাইকে বললো কয়েকদিন থাকবে। সায়ান বেরিয়ে গেলো। সিনথিয়াও এলো পেছন পেছন। হাত ধরলো সায়ানের। সায়ান ঘুরে তাকালে সিনথিয়া বললো,

— “আমি জানি এরমধ্যেই আপনি কানাডা চলে যাবেন। হয়ত আর দেখা হবে না আমাদের। সায়ান আমাকে আপনার নাম্বারটা দিবেন? আপনার ইমু আইডি, নাম্বারটা দিবেন প্লিজ? ওখানে গেলে হয়ত আপনি ব্যস্ত হয়ে যাবেন। সময় পাবেন না। আমিই মাঝে মাঝে ফোন দেবো আপনাকে। প্লিজ সায়ান।”

সিনথিয়ার চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু অশ্রুকণা চিকচিক করে উঠলো। এই লোকটাকে একদম সহ্য হতো না আগে। আর এখন তার হাজার অপমানেও ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। মায়ায় পরে গেছে এই হৃদয়হীন লোকটার। সায়ান ওকে নিজের নাম্বার দিলো। সিনথিয়া নিজের হাতেই লিখে নিলো নাম্বারটা। চলে যেতে চেয়ে পেছন ফিরে সায়ানের দিকে তাকালো। সায়ানও তাকিয়ে ছিলো। সিনথিয়া ঝট করেই জড়িয়ে ধরলো সায়ানকে। খুব শক্ত করেই ধরলো। সিনথিয়ার কেনো যেনো খুব কষ্ট হচ্ছিলো। পায়ের আঙুলের উপর ভর করে সায়ানের মুখের দিকে এগিয়ে গেলো। অনেকটা সময় পর সরে এলো। আরেকবার জড়িয়ে ধরলো সায়ানকে। তারপর ধীরেধীরে সরে এলো সায়ানের কাছ থেকে৷ সিনথিয়া ততক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো যতক্ষণ সায়ানের গাড়িটা দেখা গেছে। চোখের আড়াল হতেই চোখ থেকে এক ফোটা নোনাজল গড়িয়ে পরলো। সিনথিয়া চোখ বন্ধ করে বললো,

— “আমার কেনো যেনো মনে হচ্ছে এটাই আমাদের শেষ দেখা, শেষ আলিঙ্গন ছিলো সায়ান।”

___________________________
হাতে প্র‍্যাগনেন্সি কিট নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সিনথিয়া। চোখে-মুখে খুশি উপচে পরছে। দ্রুত মোবাইল হাতে নিলো। ডাটা অন করেই সায়ানকে ভিডিও কল দিলো। দুইবার রিং হয়ে কেটে যাওয়ার পর তিনবারের সময় রিসিভ হলো। সায়ানকে দেখে বেশ বিরক্ত মনে হচ্ছে। সিনথিয়া সেসব পাত্তা দিলো না। খুশি হয়ে বললো,

— “সায়ান আপনার জন্য একটা খুশির খবর আছে।”
সায়ান চমকালো। সন্দিহান কণ্ঠে বললো,
— “কি?”
সিনথিয়া দ্বিগুণ খুশি নিয়ে বললো,
— ” আপনি বাবা হতে যাচ্ছেন সায়ান। আমাদের ছোট্ট একটা বাবু আসবে দুনিয়ায়। আপনাকে বাবা আর আমাকে মা বলে ডাকবে। আপনি কবে আসবে দেশে?”

সায়ান কিছু না বলেই ফোন কেটে দিলো। সিনথিয়া যতটা খুশি হয়েছিলো তারচেয়ে বেশি কষ্ট পেলো। প্র‍্যাগনেন্সি কিট আর মোবাইল হাতে নিয়ে থম মেরে বসে রইলো। কিছুক্ষণ পর আবার ফোন বেজে উঠলো। সিনথিয়া খুশি হলো। ভেবেছে সায়ান কল করেছে। কিন্তু হতাশ হলো। সায়ান নয় আরশি ফোন দিয়েছে। ফোন রিসিভ করে হ্যালো বলেই সিনথিয়া থমকে গেলো। আরশি বললো,

— “সারাবছর আমার ছেলেরে ইগনোর করছিস। এখন পিরিত মারাস? এই তুই কারে জিগাইয়া আপদ পেটে আনছিস? জিগাইছিস কেউরে? তোর প্ল্যান বুঝি না মনে করছিস? যেই দেখলি সায়ান কানাডা গেছে অমনি লেবাস পাল্টাই ফেলছিস। পোয়াতি হইয়া আমার ছেলের কাছে এখন ভিড়তে চাস। হাত করতে চাস। ব্যা** মা**….। আবার যদি সায়ানরে ফোন দিয়া এসব কস তো দেখিস আমি কি করি।”

আরশি ফোন কেটে দিয়েছে। সিনথিয়া একই জায়গায় এখনো দাঁড়িয়ে আছে। চোখ থেকে পানি ফোটায় ফোটায় গড়িয়ে পরছে। ধপ করে বিছানায় বসে পরলো। আরো গুটিশুটি মেরে বিছানার কোণে চলে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে হিচকি উঠে গেছে। মনে মনে বললো, ‘আল্লাহ আমি আর পারছি না সইতে। এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিন আমায়। আমি পার পারছি না।’

.
একসপ্তাহ পেরিয়েছে। সিনথিয়া এখনো কাউকে জানায়নি ও প্র‍্যাগনেন্ট। রাতে সবাই খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পরেছে। সিনথিয়াও শুয়েছে। প্রতিদিনের মতো আজও নিরবে কাঁদতে লাগলো। একপর্যায়ে ঘুমিয়ে গেছে।

ফোনের ভাইব্রেশনে সিনথিয়ার ঘুম ভেঙে গেছে। উঠে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো সায়ান ফোন করেছে। ঘড়ির দিকে তাকালো। রাত তিনটা। সিনথিয়া খুশি হয়ে রিসিভ করলো। সায়ান সিনথিয়াকে কিছু বলতে না দিয়ে নিজেই বললো,

— “তোমার পরিবারের সবাই এখন কি করছে?”
— “সবাই তো ঘুমাচ্ছে।”
— “সবাইকে ডেকে তুলো। বলো আমি কথা বলতে চাইছি। সবাই উঠলে ফোন দিবে আমায়।”
— “জ্বী।”

সিনথিয়া কিছুই বুঝলো না। রুম থেকে বেরিয়ে সবাইকে ডাকলো। ওর বড় ভাই হামিদ ল্যাপটপ রাখলো সবার সামনে। সায়ানকে ফোন করেছে। সিনথিয়া সবার পেছনে সোফার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। ল্যাপটপের স্ক্রিনে সায়ানকে দেখা যাচ্ছে। সায়ানের পাশে হুজুরের মতো কাউকে দেখা যাচ্ছে। সিনথিয়া বুঝলো না হুজুর কেনো।

তবে সিনথিয়া খুব খুশি। ভাবছে সায়ান এখন সবাইকে জানাবে সিনথিয়ার প্র‍্যাগনেন্সির কথা। তারপর বলবে সবাই যেনো ওর খুব খেয়াল রাখে। আমি খুব জলদি ফিরবো সিনথু এবং আমার বাবুর কাছে। সিনথিয়ার ঠোঁটে হাসি। মুখে খুশির ঝলক। সিনথিয়ার পুরো ভাবনাকে মিথ্যে প্রমাণিত করে সায়ান বললো,

— “আমার পক্ষে আর সম্পর্ক রাখা সম্ভব নয় সিনথিয়ার সাথে। তাই আজ এই মুহুর্তেই আপনাদের সামনে আমি ওকে তালাক দিচ্ছি। হুজুর সব নিয়ম আমাকে বলে দিয়েছেন।…. এক তালাক…দুই তাল……।”

আর কোনোকিছুই সিনথিয়ার কর্ণগোচর হলো না। ওর পায়ের নিচে দুলতে শুরু করেছে। চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলো। ঘরের সবার দিকে তাকিয়ে দেখলো সবাই কেমন ঘুড়ে পরে যাচ্ছে। উলটে পালটে যাচ্ছে। তারপর সব বন্ধ হয়ে গেলো। আর কিছু মনে নেই সিনথিয়ার।

.
পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাতেই নিজের পাশে সাদা এপ্রোন পরিহিত একজন মহিলাকে দেখলো। আশেপাশে ভালো করে তাকাতেই বুঝলো ও হসপিটালে। ডাক্তার নিজেই বললো,

— “পেশেন্ট এখন একদম ঠিক আছে।”
— “ঠিক থাকলেই হলো।” ঝামটা মেরে বললো আসমা।

কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো। সিনথিয়া ওভাবেই পরে রইলো। কিছু একটা মনে হতেই মাথা তুলে ডাক্তারকে বললো,

— “ডাক্তার আমার বেবি?”
— “সরি ডিয়ার! ইউ হেভ এ মিচকের‍্যাজ।”

~ চলবে,,,,,,
® ‘নুরুন নাহার’তুমি কেন আগে আসোনি?”

১০.
দুই সপ্তাহ পর আজ হসপিটাল থেকে ফিরলো সিনথিয়া। অনেক ক্লান্ত আর বিধ্বস্ত অবস্থায়। ওর বাসায় এখনো জানে না সিনথিয়ার প্র‍্যাগনেন্সির কথা। ওকে হসপিটালে এডমিট করেই সবাই চলে গেছিলো। দিনে একবার এসে দেখে গেছে শুধু। বারতি কোনো খোজ নেয়নি। তাই ডাক্তার ওর পরিবারকে ওর হেলথ কনন্ডিশান জানাতে পারেনি। আজ আসার সময় ডাক্তারই এসব বলেছে ওকে। প্রথমে খারাপ লেগেছিলো। পরে মানিয়ে নিয়েছে।

সোফায় বসেই শরীরের ভার ছেড়ে দিয়েছে। শরীরের অবস্থার সাথে মনের অবস্থাও খুব খারাপ। আসমা এসেই গজগজ শুরু করেছে। সিনথিয়াকে নিরলস দেখে আরো রেগে গেছে। চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,

— “লুইচ্চা মা** কোথাকার। ছোকছুকানি স্বভাবের জন্য জামাইর ভাত খেতে পারলি না। তারপরেও দেমাগ কমে না তোর?”
— “কি দেমাগ দেখিয়েছি মা?” অসহায় কণ্ঠে বললো সিনথিয়া।
— “জানিস না তুই? তোর এসব দেমাগের কারণেই সায়ান তোকে ছেড়েছে। ব্যাশ্যা মা**। বাইরে বাইরে ব্যাশ্যাগিরি করতে ভালো লাগে তোর। জামাইর লগে নোখড়া মারাস৷”
— “মা। আমার কোনো দোষ ছিলো না। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি সংসার টিকিয়ে রাখতে…।”
— “তোর হে** করছিস মা**।”

সিনথিয়া চোখ বন্ধ করে নিলো। ধীরস্থির কণ্ঠে বললো,
— “এভাবে গালাগাল করো না মা।”
— “কি করবি তুই হ্যাঁ? একশবার গালি দিবো। তোর কারণে আজকে আমার পরিবারের দিকে আঙুল তুলবে সবাই। চরিত্রের দোষের কারণে জামাইর ভাত খেতে পারলি না। কি বলেছিলি তুই যার কারণে সায়ান সরাসরি ডিভোর্স দিলো তোকে?”
— “কিছুই বলিনি মা।”

সিনথিয়ার এমন নির্লিপ্ততা দেখে আসমা ওকে টেনে তুলে দাড় করিয়ে গালে চড় বসিয়ে দিলো। সিনথিয়ার মেঝ ভাবি রিহা এসে টেনে সরিয়ে আনলো সিনথিয়াকে। আসমাকে বললো,

— “কি শুরু করেছেন মা আপনি? মাত্রই এলেন। এখনই এসবের কি দরকার ছিলো?”
— “এই মেয়ের জন্য এখন কি একটা অবস্থায় পরেছি আমরা সেটা বুঝতে পারছো? ইচ্ছে তো করছে গলা টিপে মেরে ফেলি আপদটাকে।”

রিহা সিনথিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— “এই সিনথিয়া তুমি তোমার রুমে যাও।”

সিনথিয়া কোনোরকমে উঠে নিজের রুমে এলো। দরজা বন্ধ করে দরজার সাথে ঘেঁষে দাড়ালো। হাতটা পেটে চলে গেছে। ঢুকরে কেঁদে উঠে সিনথিয়া। খুব কষ্ট হচ্ছে। যখন বাবুটা পেটে এসেছিলো ওকেই একমাত্র আপন মনে হয়েছিলো। খুব আপন। মনে হয়েছিলো ওর বাবুটা ওকে বুঝবে। কিন্তু বাবুটাও ওকে ছেড়ে চলে গেছে। একা করে দিয়ে চলে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে সিনথিয়া মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে পরে। চলতে থাকা ফ্যানের দিকে পলকহীন তাকিয়ে আছে।

.
অফিসিয়াল ভাবে আজকে সিনথিয়ার ডিভোর্স সম্পূর্ণ হলো। একটু আগেই লয়ার এসে কাগজে সাইন করিয়ে নিয়ে গেছে। সিনথিয়া এখন নিজের রুমের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সন্ধ্যা নামবে নামবে এমন সময় আকাশটা দেখতে খুব ভালো লাগে। আনমনা হয়ে আকাশটাই দেখতে লাগলো। কত কি না করেছে এই সংসার টিকাতে। কত কাঠখড় পোড়ালো। তারপরেও টিকেনি। সিনথিয়া নিজের সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে। ওদের কটুকথা, অপমান, অবহেলা সব সয়ে নিয়েছিলো। সারাদিন বান্দীর মতো খেটেছে। নিজের ব্যক্তিত্ব পর্যন্ত বিসর্জন দিলো তারপরেও হলো না।

সিনথিয়া নিজের ইদ্দত পালনকালীন সময় পার করছে নিজের রুমেই। এটা ওর মায়ের সহ্য হচ্ছে না। কেনো ঘরে ঢুকে থাকবে, কেনো এমন ঘরবন্দী হয়ে থাকবে এটাই ওর মায়ের কথা। হিসহিস করে সকাল থেকেই সিনথিয়াকে বকছে। এখন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,

— “বান্দীর ঝি রুম থেকে বাহির হো। তোর এই গর্তে ঢুকার স্বভাবের কারণেই সায়ান তোকে ছেড়েছে। ব্যাশ্যা কোথাকার। স্বামীর সাথে নোখড়া করে গর্তে ঢুকে থাকোস। আর বাইরের ব্যাডার লগে ডলাডলি করস। ওই শুয়োরের বাচ্চা বাহির হো।”

সিনথিয়া বেডের এককোনায় গুটিসুটি মেরে বসে আছে। এসব খোটা শুনতে একদম ভালো লাগে না। ডিভোর্স হয়েছে আজ দুইমাস। একটাদিনও শান্তি পেলো না এই বাড়িতে। দুইহাতে নিজের কান চেপে ধরে ফুপিয়ে কাঁদছে। সিনথিয়ার মনে হচ্ছে সায়ানদের থেকে ওর বাড়ির মানুষগুলোই ওকে বেশি ঘৃণা করে। একটাবার ওর অবস্থা জিজ্ঞেস করলো না। জানতেও চাইলো না কোনোকিছু। শুধু ওকেই দোষারোপ করে চলেছে। ওর বাবা তো বলেই দিয়েছে ওর মুখ আর দেখবে না। ভাইরা তো আগে থেকেই অবহেলা করতো। এখন আরো বেশি করে।

আছরের আযান পরতেই সিনথিয়া ওযু করে সালাতে দাড়ালো। সিজদায় যেতেই একেবারেই মুষরে পরেছে। এতোকিছু আর সহ্য হচ্ছে না।

সালাত শেষ হতেই উঠে দাঁড়ায়। জায়নামাজ ভাজ করে রেখে জানালার সামনে দাড়ালো। এখন একটু শান্তি লাগছে। আসলে সালাতেই অনেক শান্তি আছে। এটা যদি সব মানুষ বুঝতো তাহলে তারা প্রতিবার সিজদায় লুটিয়ে পরতো। ওর জানালা বরাবর অনেকটা দূরে একটা পুকুর আছে। পুকুরের অপাশে বস্তি। পুকুরের পাশ ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণচূড়া ফুলের গাছ। প্রায় সময় এই গাছটার দিকে তাকিয়ে সিনথিয়া কষ্টের সময়গুলো পার করে দেয়। সিনথিয়া অনেককিছু চিন্তা করছে। কিভাবে নিজেকে ব্যস্ত রাখা যায়।

টেবিলের উপর নিজের বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখলো। ওর অর্ধেক করা এসাইনমেন্ট এখনো টেবিলে পরে আছে। সিনথিয়া একটা বই নিয়ে বিছানায় বসলো। অনেক পিছিয়ে গেছে। এখন পড়তে চাইলে আবার অনার্স প্রথম বর্ষ থেকেই শুরু করতে হবে। ড্রয়ার হাতিয়ে ওর ব্যবহৃত পুরানো বাটনসেট মোবাইল বের করলো। মোবাইলটা দেড় বছর ধরে ব্যবহার করা হয়না। ধুলো জমেছে অনেক। ফু দিয়ে সব ধুলো সরিয়ে কিছুক্ষণ ওভাবেই বসে রইলো। সিনথিয়া নিজেই নিজেকে বলে উঠলো,

— “এভাবেই ফু দিয়ে সায়ানের সব স্মৃতি, সব অতীত মুছে দিতে চাই। আল্লাহ আপনি আমাকে সাহায্য করুন। আপনার সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয়।”

মোবাইলটা অনেক ঘেটেঘুটে ওর বান্ধুবি সাইমার নাম্বার পেলো। এই মেয়েটা পড়ালেখায় অনেক ভালো। ওর কাছ থেকেই কিছু জেনে নেয়া যাবে। ফোন দিলো সিনথিয়া। শেষবার টাকা রিচার্জ করেছিলো দেড় বছর আগে। এখন কল যাবে কিনা বুঝতে পারছে না। নানান কথা চিন্তাভাবনা করতেই ওপাশ থেকে মেয়েলি স্বরে কেউ ‘হ্যালো’ বলে উঠলো। সিনথিয়া অনেকটা চমকে উঠেছে। ও ভেবেছিলো কল যাবে না। অপাশ থেকে ‘হ্যালো’ ‘হ্যালো’ বলেই চলেছে। সিনথিয়া নিজেকে সামলে বললো,

— “আসসালামু আলাইকুম। সাইমা আমি সিনথিয়া বলছি।”
— “সিনথিয়া তুই? এতোদিন পর? না না দিন নয়। পুরো দেড় বছর পর। কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি? আমি অনেক চেষ্টা করেছি তোর খোজা নেয়ার। কিন্তু পাইনি। কি হয়েছিলো তোর?”
— “ব..বিয়ে হয়ে গেছিলো তাই।”
— “ওহ! তাই বলে যোগাযোগ রাখবি না? আচ্ছা এখন বল কেমন আছিস? দুলাভাই কেমন আছে?”
— “আস..আসলে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে।”

ওপাশ থেকে অনেকসময় নিরব রইলো। সিনথিয়াও চুপ করে রইলো। নিরবতা কাটিয়ে সাইমা বললো,

— “পড়ালেখা শুরু কর সিনথু। বোঝা হোস না কারো।”

সিনথিয়া ঢুঁকরে কেঁদে উঠে। এই একটা মেয়েই ওকে বোঝে। সেই স্কুল জীবন থেকেই সাইমার সাথে বন্ধুত্ব। সাইমা শান্তনা দিয়ে বললো,

— “কাঁদিস না। নিজেকে শক্ত করে। তুই খুব দুর্বল এবং বোকা সিনথু।”
— “আমি..আমি চাই আবার সব শুরু করতে নতুন করে। কিন্তু বাসা থেকে আমাকে কোনোরকম সাহায্য করবে না।”
— “তুই চিন্তা করিস না। এই মাসে আমার কাছে তিনিটা টিউশন অফার এসেছে। আমি আজই মানা করে দিতাম কারণ সময় পাচ্ছিলাম না। ভাগ্যিস তুই ফোন করেছিলি। আর চিন্তা করিস না পেমেন্ট নিয়ে।ওরা তোকে অনেক ভালো বেতন দিবে।”
— “শুকরিয়া দোস্ত।”
— “তবে আরো কিছুদিন সময় পর শুরু করতে হবে। কারণ এখন তো মাসের মাঝামাঝিতে আছিস। আগামী মাসের পরের মাস থেকে পড়াতে পারবি।”
— “আলহামদুলিল্লাহ। ঠিকাছে। এদিকে আমার ইদ্দতও শেষ হয়ে যাবে।”
— “ওকে দোস্ত রাখছি।”
— “ঠিকাছে। আসসালামু আলাইকুম।”
— “ভালো থাকিস। ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”

সিনথিয়ার এখন খুভ ভালো লাগছে। বইটা নিয়ে অনেকক্ষণ পড়েছে। অনেক কিছু ভুলে গেছে। আবার কিছু বিষয় আবছা মনে আছে। বইটা নিজের পাশে রেখে শুয়ে রইলো। তারপর উঠে ওর ছোটখাটো বুকসেল্ফের কাছে গেলো। সেল্ফের প্রথম তাকেই ওর আকীদার বই, ইসলামী শারিয়াহর বই, ফিকহের বই পরে আছে। এই বইগুলো কিনায় কত অপমান সইতে হয়েছে নিজের বাড়িতে। কত জঙ্গি, ভূত নাম উপাধি পেয়েছিলো। কিন্তু সেসবের একেবারেই পরোয়া করেনি সিনথিয়া। বইগুলোতে ধুলো জমেছে মোটা আস্তরণে। সব বই সেল্ফ থেকে নামালো সিনথিয়া। সেল্ফটা পরিষ্কার করে বইগুলো সব মুছে পরিষ্কার করে আবার সাজিয়ে রাখলো সেল্ফে। টেবিলও পরিষ্কার করে নিলো।

রুমটার দিকে ভালো করে চোখ বুলালো। অনেক ময়লা হয়ে আছে। এতোদিন নিজের মনের অবস্থা খুব বিধ্বস্ত ছিলো তাই কোনোদিকেই নজর দেয়নি। মাগরিবের সালাতের পর অল্প সময় থাকে এশারের। তাই আর রুম পরুষ্কারের কাজে গেলো না। আকীদার একটা বই নিয়েই বিছানায় গড়িয়ে পরলো।

পরিবারের সবাই সবসময়ই ওকে দূরে দূরে রেখেছে। যার কারণে এই রুমটাতেই নিজের একটা আলাদা জগত বানিয়ে নিয়েছিলো সিনথিয়া। অল্প কিছু পাতা পড়ে বইটা রেখে দিলো। এশারের ওয়াক্ত হয়ে গেছে। সালাত শেষেই লেগে পরলো ঘর পরিষ্কার করার কাজে। সব ধুয়ে মুছে খুব ক্লান্ত হয়ে পরেছে। খাওয়া আর হলো না। ওভাবেই ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পরলো।

____________________________
আজ সিনথিয়া ভার্সিটি যাবে আবার। ইদ্দত শেষ হয়েছে দশদিন হলো। বোরকা পরে রেডি হয়ে নিলো। নিজেকে আয়নায় দেখে মনে হলো এটা সেই দেড় বছর আগের সিনথিয়া। যার জীবনে কখনো সায়ান নামের কেউ আসেনি। কিন্তু বাবুটার কথা মনে হতেই হাতটা পেটে চলে গেলো। নিরবে অনেকক্ষণ কেদেছে। তারপর নিজেকে শক্ত করে নিলো। কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। বের হওয়ার সময় আসমা হুঙ্কার দিয়ে বললো,

— “কোথায় যাচ্ছিস?”
— “অনেক তো হলো মা। এবার নিজেকে নিয়ে একটু ভাবতে চাই। পড়ালেখাটা আবার শুরু করতে চাই।”
— “কলেজের নাম দিয়া ফষ্টিনষ্টি করতে বাইরে যাচ্ছসি। বুঝি না ভেবেছিস?”
— “তোমাদের যা বুঝার বুঝে নাও। তবে এবার আর আমাকে দমিয়ে রাখতে পারবে না। অনেক করেছো তোমরা। আর আমিও মেনে নিয়েছি। আর নয়।”

সিনথিয়া চলে যাচ্ছিলো। মিম ওকে ডেকে বললো,

— “এতো যে তেজ দেখাচ্ছো এসবের খরচ চালাবে কি করে? নাকি নতুন লোকটা সব দিবে?”
— “আসলে ভাবি একটা বিষয় জানো। যে এককালে নাগড়ের টাকায় চলেছে সেই সবাইকে এরকম মনে করে।”

মিম দাঁতে দাঁত চেপে সিনথিয়ার দিকে তাকালো। সিনথিয়া হেসে বললো,

— “বাই দ্যা ওয়ে, আমি কিন্তু তোমাকে মিন করিনি.. হুম? প্রতিশোধ নিতে আবার নতুন ফাঁদ পেতো না।”
— “কিসের প্রতিশোধের কথা বলছো তুমি?”
— “আমার থেকে তুমিই ভালো জানো। আর শুনো, যে আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট। অবশ্য এই কথাটা তোমাদের কাছে যদিও ডালভাত। তবে আমার কাছে কথাটার মূল্য অনেক।”
— “বেশ কথা বলতে শিখেছো দেখছি।”
— “আমার হয়ে তো কেউ বলবে না। তাই নিজেরটা নিজেকেই বলতে হবে। চিন্তা করো না তোমার স্বামী থেকে টাকা চাইবো না। টিউশন পেয়েছি। আশা করি আল্লাহ এই অল্প টাকাতেই আমার প্রয়োজন মিটিয়ে দেবেন ইংশাআল্লাহ।”

সিনথিয়া বেরিয়ে গেলো। দাড়ালো না। রিকশা নিয়ে পৌছে গেলো কলেজে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কালই শুনেছিলো সায়ান নাকি আবার বিয়ে করেছে এবং বউটা দেখতে পুতুলের মতো। এসব শুনে সিনথিয়া কতক্ষণ থমকে বসে ছিলো। অজান্তেই চোখ কোণ থেকে জলও গড়িয়েছিলো। সারারাত চোখে ঘুম আসেনি। যতই হোক লোকটার প্রতি মায়া জন্মে ছিলো। সেইজন্যই খারাপ লেগেছে। সকালেই নিজেকে কঠিন করে নিয়েছে। আর কোনো পিছুটান নয়। সব শেষ। এবার নিজেকে নিয়েই চলতে হবে।

কলেজ, টিউশন তারপর বাসায় ফিরে পড়ালেখা করা। এভাবেই সিনথিয়ার দিন যেতে লাগলো। এরমধ্যে অনেক উড়ো খবর পেয়েছিলো সায়ানকে নিয়ে। সিনথিয়া সেসব বিষয় পাশ কাটিয়ে গেছে। আরশিও নাকি এসেছিলো ওদের বাসায়। ওর বাবা প্রথমে ঢুকতে দিতে চায়নি ঘরে। নিজের মেয়ের সাথে এমন করেছে তাই হয়ত একটু খারাপ লেগেছিলো। কিন্তু যখনই আরশি কেঁদে কেটে ভাইয়ের কাছে ক্ষমা চাইলো ওমনি ভাইও গলে গিয়ে বাসায় এনে ঢুকালো। এসব কথা রিহাই সিনথিয়াকে শুনিয়ে শুনিয়ে মোবাইলে কাউকে বলেছে। সিনথিয়ার এসবে কিছু যায় আসেনা এখন আর। নিজের মতো করেই আছে।

.
খুব ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরলো সিনথিয়া। লিডিংরুমে আসতেই শোরগোল শোনা গেলো। সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দেখলো অনেকে বসে আছে। তারমধ্যে আরশিকেও দেখলো। সিনথিয়া চলে আসছিলো। মিমই ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

— “সিনথিয়া এতোসময় কোথায় ছিলে?”
— “ভাবি তুমি জানো আমি কোথায় ছিলাম। তাই আপাতত তোমাকে উত্তর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করছি না। তবুও যদি তোমার উত্তরের প্রয়োজন হয় তাহলে তোমার যেই চামচা আমার পিছনে লাগিয়েছো তার থেকে জেনে নিও।”
— “কিসব বলছো এসব সিনথিয়া? আমি তোমার পেছনে?”
— “ভাবি প্লিজ স্টপ দিস ননসেন্স। এখন আমার এসব মেলোড্রামা লাগছে।”

এরমধ্যে একটা মেয়ে বললো,

— “আচ্ছা তুমি যে এভাবে প্যাকেট হয়ে আছো গরম লাগে না?”
— “কিজানি। হয়ত লাগে না৷ আমার কিন্তু সিনথিয়াকে এলিয়েন বেশি মনে হয়।” রিহার বান্ধুবি বললো।

এইকথায় সবাই হাসলো। সিনথিয়া নিকাব উঠিয়ে একটা দম নিলো। মুখ ফুলিয়ে নিঃশ্বাস বের করে দিলো। তারপর হাসি হাসি মুখে বললো,

— “আসলে কি হয়েছে জানো। আমরা যারা এরকম প্যাকেট হয়ে ঘুরি তারা সবাই সারা বছর প্রচন্ড জ্বরে আক্রান্ত থাকে। তাই এরকম বস্তায় ঢুকে চলাফেরা করি। আর আমাদের গায়ের তাপে আশেপাশের সবাই ঝলসে নিজেদের কাপড় খুলে নেয়।”
— “কাপড় খুলে নেয় মানে?”
— “এই যে, আমি এখানে দাঁড়িয়েছি দেখে সবাই উত্তাপে কাপড় খুলে নগ্ন হতে শুরু করেছে। দেখো আশেপাশে তাকিয়ে।”

মেয়েটা সত্যিই আশেপাশে তাকালো। এদিকে বাকি সবাই কটমট চোখে সিনথিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। কারণ সবাই ওয়েস্ট্রান ড্রেস পরে আছে। সিনথিয়া মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললো,

— “আমার মনে হচ্ছে তুমিই একটু বেশিই আমার গায়ের গরমে পুড়ে যাচ্ছো।”

সিনথিয়া মুচকি হাসলো। মেয়েটা এবার বুঝলো সিনথিয়া আসলে কি বুঝিয়েছে। অপমানিত বোধ করলো। মেয়েটা হাটুর উপরে উঠানো কালো স্লিভলেশ ফ্রক পরেছে। সিনথিয়া চিনে না মেয়েটাকে। তাই আর কথা বাড়াতে চাইলো না। এরমধ্যেই রিহা বলে উঠলো,

— “শুনো সিনথিয়া, মনের পর্দাই হচ্ছে বড় পর্দা। আমা…।”
— “আয়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়া!”

রিহা লাফিয়ে উঠে সরে গেলো। কান হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রেগে বললো,

— “সিনথিয়া এসব কি ধরনের বাচ্চামি। তুমি আমার কানের সামনে এতো জোরে চেচালে কেনো?”

সিনথিয়া ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে নখ খুটতে খুটতে বললো,

— “তুমিই তো বললে মনের পর্দা বড় পর্দা। তাহলে মনের পর্দা দিয়েই শুনবে। কানের পর্দার কি দরকার?”
— “ইউ জঙ্গি…।”

সিনথিয়া ওর ব্যাগ থেকে বলের মতো গোল একটা কাগজ নিয়ে রিহার দিকে ছুড়ে মেরে বললো,

— “ভাবি বোম। এখনি তোমাকে ব্লাস্ট করে দিবে।”

রিহা আবারও লাফিয়ে উঠে সরে গেলো। বাকি সবাই-ও একটু চেচিয়ে উঠে নিজেদের জায়গা থেকে সরে গেলো। নিজের অপ্রয়োজনীয় কাগজ সিনথিয়া এরকম বল বানিয়ে সবসময় ব্যাগে রাখে। কারণ কখনো কখনো টিস্যু পায়না। তখন এসব কাগজ দিয়ে চালিয়ে দেয়। সিনথিয়া হাসতে হাসতে পেট চেপে ধরে নিজের রুমে চলে এসেছে। এতোটা বিনোদন আগে কখনো পায়নি।

চলবে,,,,
® ‘নুরুন নাহার’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here