“তুমি কেন আগে আসোনি?”
১১.
কলেজ, টিউশন, পড়ালেখা এসবের চাপে একেবারে হাপিয়ে উঠেছে সিনথিয়া। আজ একটু ফ্রি সময় পেয়েছে। টিউশন গুলো আজ বন্ধ। তাই ভাবলো কলেজ থেকে বাসায় ফিরে যাবতীয় কাজ শেষ করে একটু ঘুমাবে। বিকেলে একটু ছাদে হাটাহাটি করবে। এতে যদি একটু মাইন্ড ফ্রেস হয় আরকি।
কলেজ থেকে তাড়াতাড়িই বাসায় ফিরলো সিনথিয়া। রিকশায় বসেই এসব চিন্তা ভাবনা করছিলো। আজকে একটু খুশি লাগছে কারণ আজ একটা ছোট চারা গাছ কিনেছে। এটা বেলীফুলের গাছ। গাছটা ওর রুমের বারান্দায় লাগাবে। ফুল ফুটলে ঘ্রাণ ছড়িয়ে পরবে রুমে। এসব ভেবেই কিনা।
রিকশাভাড়া মিটিয়ে দিয়ে গেইটের ভেতরে ঢুকলো। ওদের বাসাটা পাঁচতালা। বাড়ির সামনে অনেকটা জায়গা আছে গাড়ি পার্কিং করার। ওরা তিনতালায় থাকে। বাকি সব ফ্লোর ভাড়া দিয়ে রেখেছে। তিনতালায় পৌছে নিজেদের ঘরের দরজার সামনে দাড়াতেই দেখলো দরজা খোলা। সিনথিয়া এসব ঘাটলো না। কারণ দরজা সবসময় এরকম খোলা থাকে। সিনথিয়া ভেতরে ঢুকে সামনে এগোতেই থেমে গেলো।
একটা শীতল শিহরণ বয়ে গেলো সর্বাঙ্গ জুড়ে। আশেপাশে তাকিয়ে আবার সামনে তাকালো। প্রায় একবছর পর দেখছে সায়ানকে। সায়ানও ওকে দেখে থেমে গেছে। সিনথিয়া নিজেকে সামলে নিলো। বর্তমান পরিস্থিতিতে ফিরে এলো। সবকিছু মনে পরতেই সায়ানকে পাশ কাটিয়ে চলে এলো রুমে। রুমে এসে দেখলো ওর দুই ভাবি কাউকে ঘিরে বসে আছে। সিনথিয়া রুমে প্রবেশ করে কাধ থেকে ব্যাগ রাখলো। নিকাব খুললো। কেমন যেনো একটা ফিলিংস কাজ করছে। সবকিছু স্থির মনে হচ্ছে। সিনথিয়ার বড় ভাবি ওকে বললো,
— “দেখো সিনথিয়া তোমার রুমে কে এসেছে?”
— “(——)”
— “সায়ানের বউ এসেছে।”
সিনথিয়া এবারো থমকালো। বিবাহিত জীবনে লোকটা একটুও শান্তি দেয়নি। বিয়ের পরেও শান্তি দিচ্ছে না। চাইছে কি এই লোকটা? কখনো নিজের মাকে এখানে আসতে বলবে। আবার কখনো নিজে বউকেসহ নিয়ে টপকাবে। লজ্জাসরম বলতে কিছু নেই নাকি? নির্লজ্জ লোক একটা। সিনথিয়া ঘুড়ে দাড়ালো। সায়ানের বউয়ের দিকে তাকিয়ে আরেকদফা থমকে গেলো।
পিউর লাল রঙের শাড়ি পরেছে মেয়েটা। ফর্সা গায়ে খুব মানিয়েছে। মনে হচ্ছে এই রঙটা সায়ানের বউয়ের জন্যই তৈরি হয়েছে। ঠোঁটে কড়া লাল লিপস্টিক। স্লিভলেস ব্লাউজ পরেছে। সত্যিই অপূর্ব লাগছে। একটা জীবন্ত পুতুল মনে হচ্ছে। সিনথিয়ার নিজেকে একেবারেই নগণ্য মনে হলো মেয়েটাকে দেখে। সিনথিয়া ধীরে ধীরে চোখ নামিয়ে নিলো মেয়েটার উপর থেকে। রিহা এগিয়ে এসে বললো,
— “আসো সিনথিয়া তোমাকে পরিচয় করিয়ে দেই অপ্সরার সাথে।”
অপ্সরা! সত্যিই মেয়েটা দেখতে অপ্সরীদের মতো। নামের সাথে চেহারা এবং গড়নের বেশ মিল আছে। অপ্সরা সিনথিয়ার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। এখনো তাকিয়ে আছে। সিনথিয়া যেমন থমকেছে অপ্সরাকে দেখে ঠিক তেমনই অপ্সরাও থমকেছে সিনথিয়াকে দেখে। অপ্সরার ধ্যান ভাঙলো মিমের ডাকে। বললো,
— “অপ্সরা এই হলো আমাদের সিনথিয়া। এতক্ষণ তোমাকে ওর কথাই বলছিলাম।” সিনথিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, “জানো সিনথু, অপ্সরা আর সায়ানের দীর্ঘ পাঁচ বছরের সম্পর্ক ছিলো। সেই ভালোবাসা এবার পরিণতি পেলো।”
সিনথিয়ার এবার বেশ মেজাজ গরম হলো। ইচ্ছে করেই এই দুই নারী ওর কাটা গায়ে নুনের ছিটা দিচ্ছে। এতো ঘাটানোর কি আছে ওকে? সারাদিন খোটা দিয়ে মন ভরে না এখন আবার এই মেয়েকে সামনে এনে ওকে আরো গুড়িয়ে দিতে চাইছে। সিনথিয়া বিরক্তি নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। অপ্সরা বললো,
— “তুমিও বেশ সুন্দর।”
সিনথিয়া তাকালো মেয়েটার দিকে। আবার নজর ফিরিয়ে নিলো। মনটা এখন একদম বিষিয়ে গেছে। ভালো লাগছে না কিছু। সিনথিয়াকে আরেকটু দহনে দগ্ধ করতে রিহা বললো,
— “আরে কি যে বলো না অপ্সরা। কোথায় তুমি আর কোথায় সিনথিয়া। তোমার দিকে একবার কারো চোখ পরলে চোখ ফেরানো দায়। আর সিনথিয়া তো কালো। ময়লা রঙের। এতে আর সুন্দর কি!”
সিনথিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ইচ্ছে করেই ক্ষেপাচ্ছে ওকে এরা এটা বেশ ভালোই বুঝলো। তবুও সেদিকে মন দিলো না। একটা চিনচিন ব্যাথা কাজ করছে বুকের বা পাশে। হয়ত কিছুটা মায়া এখনো রয়ে গেছে সেই পাষাণ হৃদয় ধারণকারী লোকটার প্রতি। অপ্সরা হাওয়ায় মাছি তাড়ানোর মতো করে হাত নেড়ে বললো,
— “গায়ের রঙে কি আসে যায়। মনটাই তো আসল। এম আই রাইট সিনথিয়া?”
মুখ ফুলিয়ে একটা ছোট শ্বাস ছেড়ে সিনথিয়া বললো,
— “এসব কথা উপন্যাস বা গল্পে মানায়। বাস্তবে সবাই উপরের রঙটাই দেখে। মনের খবর কয়জনই বা রাখে?”
— “হুম ঠিক বলেছো। তবে আমি বিশ্বাস করি এখনো এরকম মানুষ আছে। যারা উপরের চামড়া থেকে মনটাকে প্রাধান্য দেয়। যদিও তাদের সাক্ষাত পাওয়া মানে অন্ধকারে তীর ছোড়ার মতো।”
— “(—–)”
— “তোমার ঘন পল্লব বিশিষ্ট আঁখি যখন ধীরে ধীরে নামিয়ে নিয়েছিলে এক ঝাক স্নিগ্ধতায় ছেয়ে ছিলো মুহুর্তটা। আমি সিউর সত্যিকারের কোনো প্রেমিক পুরুষ এতেই তোমার প্রেমে পরবে।”
সিনথিয়া তাচ্ছিল্য হাসলো। অপ্সরার সামনে থেকে সরে ধীরে ধীরে বোরকা খুলে নিলো। গায়ে ওড়না জড়িয়ে নিয়ে বললো,
— “নিশ্চয়ই কোনো উপন্যাসের কপি করা লাইন ছিলো এটা।”
অপ্সরা হেসে ফেললো। বললো,
— “ওয়েল। লাইন তো ছিলো উপন্যাসের। তবে আমার দেখা সত্যিকার উপন্যাসের নায়িকা তুমি। এখন শুধু নায়কের এন্ট্রি বাকি।”
— “বাই দা ওয়ে, আমি আপনাকে এর আগে কোথাও দেখেছি মনে হচ্ছে।”
সিনথিয়া বিষয়টা এড়িয়ে গেলো। এই বিষয়ে কথা বলতে মোটেও ভালো লাগছে না। অপ্সরাও হয়ত বুঝেছে। তাই আর সেদিকে গেলো না। অপ্সরা বললো,
— “আমার মনে হচ্ছে তুমিই একটু বেশিই আমার গায়ের গরমে পুড়ে যাচ্ছো। রিমেম্বার?”
— “ওহ আই সি, তুমিই সেই। আসলে সেদিন একরকম লেগেছিলো এখন শাড়িতে অন্যরকম লাগছে।”
— “বেশি বাজে লাগছে আজ?”
— “উহু! স্নিগ্ধ লাগছে। সেদিন বাজে লেগেছিলো। খুব বেশিই।”
অপ্সরা হেসে বললো,
— “আমাদের কথোপকথনে কেউ বুঝতেই পারবে না তুমি আমার এক্স সতীন ছিলে।”
সিনথিয়াও হালকা হেসে ফেললো। আসলে মেয়েটাকে যতটা অহংকারী ভেবেছিলে মেয়েটা ততটা নয়। নাহলে এভাবে হেসে হেসে কেউ নিজের স্বামীর প্রাক্তন স্ত্রীর সাথে কথা বলে কি? সিনথিয়ার একটু খারাপ লাগলো। আরশি আর সায়ান যদি এই মেয়েটার সাথে সেসব ব্যবহার করে যা ও পেয়েছিলো তাহলে কিভাবে মানিয়ে নিবে এই মেয়ে। দেখে তো মনে হচ্ছে বাবা-মায়ের ননীর পুতুল ছিলো। পরক্ষণেই ভাবলো সায়ানের ভালোবাসার মানুষ। দীর্ঘ পাঁচ বছরের সম্পর্ক তাদের। নিশ্চয়ই কষ্টে রাখবে না। অপ্সরা একটু ইতস্তত করে বললো,
— “সরি!”
— “সরি? ফর হোয়াট?”
— “সেদিনের মন্তব্যের জন্য। আসলে আমি বাসায় যাওয়ার পর বুঝতে পেরেছি এরকম মন্তব্য করাটা ঠিক হয়নি। গিল্টি ফিল হচ্ছিলো। তাই আজ এসেছি সরি বলতে।”
— “এইজন্যই আগমন?”
— “বলতে পারো সেটাই। আসলে আমি মনে শান্তি পাচ্ছিলাম না। তাই আজ…।”
সিনথিয়া হাসলো। বললো,
— “ইটস ওকে। আমি কিছুই মনে রাখিনি।”
ওদের কথার শুরুতেই সিনথিয়ার দুই ভাবি চলে গেছিলো রুম থেকে। অপ্সরা এবং সিনথিয়া একাই রুমে কথা বলছিলো। কথার এক পর্যায়ে অপ্সরা বললো,
— “তোমার সম্পর্কে যতটা শুনেছি এখন মনে হচ্ছে সব মিথ্যে। তোমার কথার ধরনে এরকম কিছুই মনে হচ্ছে না আমার।”
সিনথিয়া কিছু বললো না। চুপ করেই রইলো। নিজের জন্য কোনো সাফাই গাইতে মন একটুও সায় দিলো না। যার যা মন চায় বলুক ওর নামে। তাতে কিছুই যায় আসেনা। অপ্সরার এইমাত্র কথায় বেশ অবাক হলো। সম্পূর্ণ উলটো কথাই শুনিয়েছে আরশি। তবে উপরে উপরে স্বাভাবিক রইলো। অপ্সরা বললো,
— “শুনেছি তুমিই সায়ানকে ভয় দেখিয়েছে বিয়ে করেছিলে? বিয়ের পর বিভিন্ন পুরুষের সাথে…।”
অপ্সরা বলতে পারলো না। সিনথিয়া গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সেখানে উপস্থিত হলো সিনথিয়ার মা এবং আরশি। আসমা বেশ তেতেই বললো,
— “তা আবার বলতে। স্বামীর লগে নোখড়া করছে পুরোটা বছর। আর ডলাডলি করতে গেছে পরপুরুষের সাথে। কয়জনের লগে করছে হিসাব নাই। তাইতো মুখ লুকাইয়া চলে। মনে করছে বুঝি না কিছু।”
আরশি আড়চোখে তাকালো সিনথিয়ার দিকে। সিনথিয়া ভাবেলশহীন ভাবে বসে আছে। যেনো এদের এতো কথায় কিছু যায় আসেনা ওর। আরশি টিটকারি করে বললো,
— “হু! সেইজন্যই তো জামাইর ভাত খাইতে পারলো না।”
সিনথিয়ার ভেতরটা নাড়া দিয়ে উঠলো। সিনথিয়া জানে আরশি ওকে ওর কথাই ফেরত দিয়েছে। তবুও চুপ করে রইলো। বাসায় এসে একটু রেস্ট নিবে ভেবেছিলো। কিন্তু সেটা আর হলো না। ক্ষতবিক্ষত হৃদয়টা আরো ক্ষতবিক্ষত করে দিলো তাদের কথার দ্বারা। ওদের কথার প্রতিউত্তর করলো না। মাঝে মাঝে সব কথার উত্তর দিতে হয়না। রবের উপর ছেড়ে দিতে হয়। উত্তরটা না হয় তিনিই দিয়ে দেবেন এদের। জানালার বাইরের আকাশপানে তাকিয়ে রইলো। মধ্য বয়স্ক মহিলা দুজন আরো কথা শুনিয়েছে সিনথিয়াকে। তারপর চলে গেলো। অপ্সরা যাওয়ার আগে সিনথিয়ার মলিন মুখের দিকে তাকালো। ওর কেনো যেনো বিশ্বাস হলো না এদের কথা।
“তুমি কেন আগে আসোনি?”
১২.
অতশি এবং তার মা সাবিনা আজ তাদের এক আত্মীয়ের বাসায় এসেছে। উদ্দেশ্য পাত্রী দেখা। ভাইয়ের জন্য পাত্রী দেখতে এসেছে। আত্মীয়টা তাদের দূরসম্পর্কের মামি হয়। মামির বাসার পাশে একটা মেয়ে আছে এটা তাদেরকে মামীই জানিয়েছে৷ দেখতে খুব সুন্দর এবং পরহেজগার নাকি। অতশীরা এখন সেখানেই বসে আছে। সাবিহা নিজের ছেলেকে আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ছেলেটা এতোই গোয়ার যে আসতে একদম রাজি হয়নি। কতবার রিকুয়েষ্ট করেছে কিন্তু কানেই তুললো না।
কি এক ছাইপাশ মেয়ের জন্য এখনো দেবদাস হয়ে বসে আছে। সাবিনার একমাত্র ছেলে জাভেদ। ছেলেটাকে এরকম দেখতে মোটেও ভালো লাগে না। বছর তিনেক আগে তারই অফিসের এক এমপ্লয়িকে বিয়ে করেছিলো। প্রেমের বিয়ে ছিলো তাদের৷ জাভেদ এতোটাই ওই মেয়ের প্রেমে মত্ত ছিলো যে মেয়েটার চাল একটুও বুঝতে পারেনি। দেড় বছর সংসার করার পর যখন সব সম্পত্তি নিজের নামে করে নিয়েছিলো তারপর পাখি উড়ে গেছে অন্য খাঁচায়। অথচ এদিকে তার ছেলেটা তরপাচ্ছে ওই ছলনাময়ীর জন্য। নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে একেবারে। পুরানো চিন্তাভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো সাবিনা।
পাত্রীকে দেখে বেশ ভালোই লাগলো। মেয়েটা বেশ সুন্দর। কিন্তু তারপরেও মা মেয়ের কেনো যেনো মন ভরলো না। কিছু একটা নেই নেই লাগছে এই মেয়ের মধ্যে। অতশি নিজের খছখছানি ভাব দূর করতে জিজ্ঞেস করলো,
— “কিসে পড়ো তুমি?”
— “আমি এইবার অনার্স থার্ড ইয়ারে।”
— “ওহ আচ্ছা। বেশ ভালো। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ঠিকঠাক পড়া হয়?”
— “হ্যাঁ হ্যাঁ। আমার মেয়ে বেশ নামাজী।” পাশ থেকে মেয়েটার মা বললো।
অতশি এবং সাবিনা হাসলো। অতশি বললো,
— “ওহ তোমার নামটাই তো জানা হয়নি। তোমার নাম কি?”
— “নয়নতারা। নাইস নেম না? আমার ভার্সিটির সব ছেলেরা এই নামেই ফিদা।”
— “মা। ওরা শুধু তোর নাম জানতে চেয়েছে।” নয়নতারার মা বললো।
অতশির এবার মনের খোচখোচানি ভাব দূর হলো। এবার বুঝলো এই মেয়ে কতটুকু পরহেজগার। আশেপাশে তাকালো। তাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন আছে। যেখানে গায়েরে মাহরাম বেশি। মেয়েটা খুব সেজেছে। ঠোঁটে কড়া লাল লিপস্টিক। অতশি এবার বললো,
— “তুমি তো দীন মানো। তাহলে এতোগুলো গায়েরে মাহরামের সামনে এভাবে সেজেগুজে বসে আছো। এটা পর্দার খিলাফ হচ্ছে না?”
— “আরে ওরা তো আমার কাজিন ব্রাদার। তাই ওদের সামনে কিসের পর্দা।”
অতশি তার মায়ের হাত চেপে ধরলো। সাবিনা নিজেও আর চাইছেন না এখানে থাকতে। চলে আসবে এমন সময় পাত্রী নিজেই বললো,
— “আপনারা তো আমায় দেখলেন। আমি তো পাত্রকে দেখতে পারিনি। পাত্রের ছবি নেই? বা পাত্র কি এখানে আসবে না?”
— “না। জাভেদ আসবে না৷ তাই আমরাই এসেছি। ছবি আছে। তোমাকে দেখাচ্ছি। একটু ওয়েট করো।”
অতশি মোবাইল থেকে তার ভাইয়ের ছবি বের করলো। মেয়েটার সামনে ধরতেই মেয়েটা খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগলো। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠেছে। যার অর্থ জাভেদকে নয়নতারার বেশ পছন্দ হয়েছে। নয়নতারা আনমনেই বললো,
— “নাম যেনো কি?”
— “জাভেদ বিন ইউসুফ।” অতশি বললো।
— “জাভেদ! জাভেদ!
অতশি মোবাইল নিয়ে নিলো। মেয়েটার হাবভাব একদম পছন্দ হয়নি। গায়ের রঙটাই সুন্দর। কিন্তু চলাফেরায় মাধুর্য নেই। অতশি ওর মায়ের হাত ধরে বেরিয়ে এলো। মামীর বাসায় বসে বোরকা খুললো মা, মেয়ে দুইজন। সাবিনা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
— ” তোর কেমন লাগলো মেয়েকে? আমার একটুও ভালো লাগে নি।”
— “আমারও ভালো লাগেনি মা। আমাদের এরকম চঞ্চল মেয়ে দিয়ে হবে না। জাভেদের সাথে একদমই মানাবে না। আমাদের দরকার সংসারী মেয়ে। যে নিজের সবটুকু দিয়েই আগলে রাখবে। বাদ দাও এই মেয়েকে। শেষে দেখলে না কেমন লুচ্চা মহিলার মতো করলো। দেখেই মেজাজ খারাপ হয়েছে আমার।”
— “এখন এমন সংসারী মেয়ে কই পাবো বল?”
— “আল্লাহ আমার ভাইয়ের জন্য উত্তম কাউকেই রেখেছেন। তাইতো এতো মেয়ে দেখার পরেও একটাও পছন্দ হলো না। তুমি চিন্তা করো না। আমরা ঠিক পেয়ে যাবো।”
___________________________
সিনথিয়ার আজ একটু ক্লান্ত লাগায় স্টুডেন্ট-এর বাসায় বসে রইলো। মেয়েটা এবার ক্লাস নাইনে পড়ে। খুব চঞ্চল আর দুষ্টু। এখন সিনথিয়ার সামনে বসে কথার ঝুড়ি খুলেছে। সিনথিয়াও শুনতে লাগলো। ওর তো গল্প করার সঙ্গী নেই। তাই এই চঞ্চল মেয়েটার কথাগুলো শুনছে আর মনে মনে হাসছে।
এরমধ্যেই স্টুডেন্ট-এর মা নাস্তার প্লেট নিয়ে এলো। নাস্তার প্লেট টেবিলে রেখে বললো,
— “সিনথিয়া আজ কি একটু বেশিই খারাপ লাগছে নাকি? তোমার কাছে এতক্ষণ আসতে চাইছিলাম। কিন্তু এদিকে আমার ভাইয়ের বউ আর মেয়ে এসেছে তাদের ছেলের জন্য পাত্রী দেখতে তাই আসতে পারিনি।”
— “না আন্টি সমস্যা নেই।”
— “পাশের বাসায়ই দেখেছে মেয়েকে। পছন্দ হয়নি হয়তো। মেয়ে খুব বেশি চঞ্চল। আমার ভাগ্নের জন্য একজন সংসারী মেয়ের প্রয়োজন বুঝলে। এই পর্যন্ত বিশটারও বেশি পাত্রী দেখেছে। কিন্তু মনমতো পাচ্ছে না।”
— “ওহ!”
সিনথিয়া বারবার এড়িয়ে যেতে চাইছে ব্যাপারটা। কেনো যেনো ওর ভালো লাগছে না এসব নিয়ে কথা বলতে। বিয়ে, সংসার এসবের প্রতি তিক্ততা চলে এসেছে। তাই হয়তো বিরক্ত বোধ করছে। আন্টি৷ হঠাৎ করেই বললো,
— “আচ্ছা সিনথিয়া তোমার কি বিয়ে হয়েছে?”
সিনথিয়া এবার বেশ অস্বস্তিতে পরে গেলো। এতক্ষণ এই ভয়টাই পাচ্ছিলো। ও চায়না নিজের অতীত কাউকে বলতে। দেড় বছর পার হয়েছে ওর ডিভোর্সি জীবনের। সবার কত কটু কথা শুনতে হয়েছে। কত অপমানিত হয়েছে। সেসব থেকে মুক্তি চায় সিনথিয়া। অথচ আজ আবার বলতে হবে ও ডিভোর্সি। স্টুডেন্ট-এর মা আবার জিজ্ঞেস করলো,
— “তোমার বিয়ে হয়নি?”
— “আন্টি আমার ডিভোর্সি।”
কণ্ঠনালি কেঁপে উঠেছিলো সিনথিয়ার এই কঠিন সত্যটা বলতে। আন্টিও একটু থম মেরে গেছে। কারণ সিনথিয়াকে তার খুব ভালো লাগে। গত দুই বছর ধরে চিনেন তিনি মেয়েটাকে। কখনো উদ্ভট কিছু পাননি সিনথিয়ার মাঝে৷ যদি নিজের কোনো ছেলে থাকতো তাহলে সিনথিয়াকে ছেলের বউ করে নিয়ে আসতো। এমনটা তিনি মনে মনে প্রায় ভাবেন। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা উনাকে শুধু একটামাত্র মেয়েই দিয়েছেন। তিনি কিছু না বলেই উঠে গেলেন। সিনথিয়া গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এতোদিন যেই সম্মান এখানে পেতো সেটা হয়ত এখন আর পাবেনা। স্টুডেন্টকে আগামীকালের পড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। এখন বাসায় যাবে৷ বাসার কথাটা মনে হতেই একরাশ তিক্ততা এসে ভীর করে মনে।
খেতে, বসতে সব জায়গায় এখনো ওকে কথা শুনায়। এইতো কিছুদিন আগে শুনেছে সায়ানের একটা বাবু হয়েছে। খবরটা শুনেই একেবারে নিস্তেজ হয়ে গেছিলো সিনথিয়া। বুকের বা পাশে চিনচিন ব্যাথা করেছিলো। সবকিছু থেমে গেছিলো ওর। খুব কষ্ট হয়েছিলো। হাতটা অজান্তেই নিজের পেটে চলে গেছিলো। খুব কাদতে ইচ্ছে হয়েছিলো কিন্তু কেনো যেনো চোখ থেকে পানি বের হয়নি। তবে ভেতরটা ভেঙে গুড়িয়ে গেছিলো। এরপরের দিনই বাসায় সায়ান এবং তার বউ এসেছিলো তাদের সদ্য জন্ম নেয়া বাবুটাকে নিয়ে। দূর থেকে দেখেছিলো ওদেরকে সিনথিয়া। খুব সুখী লাগছিলো ওদের। রুমে এসে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে৷ কারণ ও জানে একটু পরেই সায়ানের বউ এবং বাচ্চাকে নিয়ে ওর দুই ভাবি উপস্থিত হতো রুমে। ইচ্ছে করেই কষ্ট দিতে চায় ওরা।
সিনথিয়া গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো আবার। ওর ভেতরের আর্তনাদ, কষ্ট, হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কাউকে দেখাতে চায়না। না বলতে বা বুঝাতে চায়। সবকিছু নিজের ভেতরে চেপে রাখে। আর গভীর রাতে রবের দরবারে উপস্থিত হয়ে সবকিছু খুলে বলে৷ তখন একটু শান্তি পায় সিনথিয়া। নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো কারো সালামের আওয়াজ শুনে। সালাম দিয়ে সেই ব্যক্তির দিকে ফিরতেই থমকে গেলো। অপরপাশের ব্যক্তিটি ওকে দেখে বিষ্মিত হয়ে বললো,
— “সিনথিয়া তুমি এখানে? তুমিই সেই মেয়ে যার কথা মামী এই মুহুর্তে বললো আমাকে। What a coincidence! আমি মনে মনে তোমার কথাই ভাবছিলাম।”
সিনথিয়া থতমত খেলো। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না৷ আমতা-আমতা করতে লাগলো। এভাবে অতশির সামনে পরবে ভাবতে পারেনি। খুব লজ্জা লাগছে। ওর ডিভোর্স হয়ে গেছে এটা নিশ্চয়ই জেনে গেছে এতোক্ষণে। কি ভাববে ওকে নিয়ে এখন? নিজের উপর রাগ হচ্ছে। কেন যে আগে আগে চলে গেলো না৷ তাহলে উনাদের সামনে পরতে হতো না।
অতশি ওর হাত ধরে টেনে বিছানায় বসালো। পাশেই সাবিনা এবং অতশির মামী আইরিন। আইরিন বেশ অবাক হয়ে বললো,
— “অতশি তুই সিনথিয়াকে কিভাবে চিনিস?”
— ” সে অনেক কথা মামী। সবই জানতে পারবে।”
— “মাহিরা তুমি রুমে যাও।” আইরিন মেয়ে উদ্দেশ্য করে বললো।
— “একটু থাকি না মা। সিনথু আপুর সাথে কিভাবে অতশি আপুর পরিচয় সেটা একটু শুনি।”
— “বড়দের মাঝে থাকতে নেই। যাও।”
— “আমি এখন ক্লাস নাইনে পড়ি। আমিও বড় হয়েছি।”
আইরিন রেগে কিছু বলবে তার আগেই সিনথিয়া এবং অতশি উনার হাত ধরে ফেললেন৷ মাহিরাকে কাছে টেনে অতশি বললো,
— “বাহ! বনুটা তো অনেক বড় হয়ে গেছে। বিয়ে দিয়ে দিতে হবে তাইনা? বলো পাত্র দেখবো?”
— “অতশি আপু! আমি মাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।”
— “আচ্ছা বনুটা এখন তুমি একটু অন্যরুমে যাও। আমরা বড়রা একটু কথা বলবো।”
— “হুহ..যাচ্ছি যাচ্ছি।”
ভেঙিয়ে চলে গেলো মাহিরা। সিনথিয়া হাসলো। মেয়েটাকে খুব বাচ্চা বাচ্চা লাগে। যখন গাল ফুলায় তখন আরো কিউট লাগে। মাহিরা যেতেই অতশি এবার সিনথিয়াকে বললো,
— “সিনথিয়া সায়ানের সাথে তোমার ডিভোর্স হয়ে গেছে?”
— “হু..!”
— “কবে?”
— “হয়েছে দু বছর আগে।”
— “কি বলছো এসব? কেনো ডিভোর্স দিলো?”
— “বাদ দিন এসব। আপনার ভাইয়ের জন্য নাকি মেয়ে দেখছেন আন্টির থেকেই শুনলাম।”
— “কথা ঘুড়াবে না। খুলে বলো কি হয়েছে।”
— “জানি না আপু আমার দোষটা কি। আর কেনোই বা আমাকে ডিভোর্স দিয়েছে সায়ান। এখনো আমি কোনো যথাযথ কারণ খুজে পাইনি।”
— “এখন সায়ান কি করে?”
— “বিয়ে করেছে। বউটা একদম পুতুলের মতো দেখতে। একটা বাবুও হয়েছে৷ খুব সুখে আছে এখন।”
সিনথিয়ার কণ্ঠনালি কেঁপে উঠলো। চোখ দুটিতে চিকচিক করে উঠলো পানিতে। অতশির খুব খারাপ লাগলো। হুট করেই বুকে জড়িয়ে নিলো সিনথিয়াকে। খুব ভরসার জায়গা মনে হলো সিনথিয়ার। কেঁদে ফেললো। উপস্থিত সবাই-ই থমকে গেছে। সেই একদিনের ঘটনা দেখেই অতশি বুঝেছিলো সিনথিয়া ভালো থাকবে না এখানে। আজ সেটাই সত্যি হলো। অতশি বুঝেছে মেয়েটার সাথে কি কি হয়েছে। কতটা জুলুম করেছে তারা নিরীহ মেয়েটার উপর।
অনেকটা সময় পর সিনথিয়া থামলো। একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বললো,
— “জাযাকাল্লাহ আপু আমাকে শান্তনা দেয়ার জন্য। আমি যাই। ভালো থাকবেন।”
— “সিনথিয়া তোমাকে কিছু বলতে চাই।”
— “হু..।” মাথা নিচু করে রইলো সিনথিয়া।
— “আমরা গত দুই বছর ধরেই আমার ভাইয়ের জন্য মেয়ে খুজচ্ছি। কিন্তু পাইনি। এখন মনে হচ্ছে পেয়ে গেছি। সিনথিয়া আমার মনে হচ্ছে তুমি তোমার বাবার বাড়িতেও ভালো নেই। তাই বলছি এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাও।”
— “আপু আমি হাত জোর করে ক্ষমা চাইছি আপনার কাছে। আমার পক্ষে আর সম্ভব নয় নতুন করে সংসার করার। সেই সাহস, শক্তি নেই আমার মাঝে। আর না কোনো ইচ্ছে আছে কারো বউ হওয়ার৷ তাই বলবো আপনি আপনার ভাইয়ের জন্য অন্য কোনো মেয়ে দেখুন।”
সিনথিয়া বেরিয়ে যেতে নিলেই অতশি হতাশ হয়ে বলল,
— “আরেকবার ভেবে দেখো সিনথিয়া।”
সিনথিয়া দাড়ালো না। বেরিয়ে এলো মাহিরাদের বাড়ি থেকে। অতশি তার মায়ের দিকে তাকালো। আইরিন অতশির পাশে বসে বললো,
— “কি হয়েছে অতশি? আর তুই কিভাবে চিনিস মেয়েটাকে?”
অতশি সব খুলে বললো। সাবিনা অতশির পাশে বসে বললো,
— “আরশি এমন? কই আগে তো এরকম কিছু শুনিনি। এতোটা প্যাচ ওর ভেতরে?”
— “বাহির থেকে কি আর মানুষের ভেতরটা বুঝা যায় মা?”
— “মেয়েটা এতো কষ্ট পেয়েছে? অথচ সবার সামনে কতটা স্বাভাবিক থাকে।” আইরিন বললো।
— “এটাই তো ওর গুণ৷ কাউকে নিজের কোনো ব্যাথা দেখাতে চায়না। সেদিন ওকে এতোকথা শুনালো সবাই৷ ওর ভাই চড় মারলো তারপরেও কোনো রা করেনি। তখনই মুগ্ধ হয়েছিলাম আমি।”
— “অতু তুই একটু চেষ্টা করে দেখ মেয়েটাকে রাজি করাতে পারিস নাকি। আমার খুব ভালো লেগেছে মেয়েটাকে। কতটা মায়াবী মুখ। কথাবার্তার ধরনও কত সুন্দর।” সাবিনা বললো।
— “হু দেখি।”
___________________________
এক মাস পেরিয়েছে। আজও অতশি এসেছিলো সিনথিয়ার কাছে। সিনথিয়া একই কথা বললো। সে রাজি নয়। অতশি হতাশ হলো। সিনথিয়া আজ বাসায় ফিরেই অবাক হলো। আজ নাকি তাকে পাত্র দেখতে এসেছে। পছন্দ হলেই আকদ করিয়ে ফেলবে৷ সব শুনে সিনথিয়া হতভম্ব হয়ে গেলো। এতদিন ধরে কিছুটা গুঞ্জন শুনেছে এসবের। কিন্তু পাত্তা দেয়নি। কথাটা যে সত্যি হবে ভাবতে পারেনি।
সাজিয়ে গুজিয়ে বসানো হলো পাত্রের সামনে। সিনথিয়া এক পলক দেখে আরো হতভম্ব হলো। ওর মায়ের দিকে তাকালো। তারা কতটা সহজ হয়ে বসে আছে। সিনথিয়া বুঝলো ও এ বাড়ির বোঝা হয়ে গেছে তাই বাবার বয়সি লোকের সাথে বিয়ে দিতে চাইছে। কান্নাটা কোনোরকমে গলায় আটকে রাখলো।
সবাই জানালো তাদের সিনথিয়াকে পছন্দ হয়েছে। এবার নিরবে কেঁদে ফেললো সিনথিয়া। আবারও বলির বকরা হতে হবে ওকে। পাত্রপক্ষ নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করে জানালো ওদের কি একটা সমস্যার জন্য আকদ আজ করবে না। আগামী ফ্রাইডে হবে। সবাই খুব খুশি হলো। সিনথিয়া নিজের রুমে এসে ঢুকরে কেঁদে উঠলো। বিয়ে নামক সম্পর্কে আর জড়াতে চায়না সিনথিয়া। তবুও সবাই মিলে ওকে সেই সম্পর্কে বাঁধতে চাইছে। এরমধ্যেই অতশির ফোন এলো। সিনথিয়া রিসিভ করবে না ভেবে করে ফেললো। অতশি বললো,
— “সিনথিয়া আমি জানি তুমি আমাকে একই উত্তর দিবে। তবুও আশা নিয়ে ফোন দিয়েছি…।”
অতশি থেমে গেলো। সিনথিয়ার ফুপানোর আওয়াজ কানে আসতেই বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— “এই সিনথিয়া তুমি কাঁদছো কেনো? কিছু হয়েছি কি? বাসায় কিছু হয়েছে?”
— “(—–)”
— “সিনথিয়া কিছু তো বলো।”
— “আ..আমার আ..জ বি..য়ে ছিলো আপু।”
— “কিহ..! সিনথিয়া কিসব বলছো তুমি? কার সাথে? আগে বলোনি কেনো?”
— “আমি জানতাম না। আমার অগোচরেই ঠিক করেছিলো বাবার বয়সি একজনের সাথে। আপু আমি আর পারছি না এদের এতো জুলুম সইতে। আমি ক্লান্ত হয়ে পরেছি।”
অতশি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এই ভয়টাই পাচ্ছিলো অতশি। সিনথিয়া খুবই নরম মনের। কখন চেপে ধরে কারো কাছে গছিয়ে দেয় সেটা নিয়ে এতোদিন টেনশনে ছিলো। তাই এতোদিন ধরে রিকুয়েষ্ট করেছে যাতে রাজি হয়ে যায়। অতশি কিছু বলার মতো পেলো না। না সিনথিয়া কিছু পেলো বলার। তাই নিরবে ফোন কেটে দিলো। সিনথিয়া খুব বেশিই ভেঙে পরেছে এই বিয়ে নিয়ে। তাই সারারাত কেঁদেছে। মধ্যরাতে রবের দরবারে সিজদায় পরে ভিষণ কেঁদেছে৷
.
আজ শুক্রবার। সিনথিয়ার বিয়ের দিন। এবার কোনোরকমেই সিনথিয়া ট্রায় করেনি বিয়ে ভাঙার। নিজের তাকদির মেনে নিয়েছে। যা হবার হবে। সব রবের উপর ছেড়ে দিয়েছে৷ বউ সেজে চুপচাপ বসে আছে নিজের রুমে। এখন শুধু বর আসার অপেক্ষা। বিয়ের নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেছে কিন্তু বর এলো না। অপেক্ষা করতে করতে সিনথিয়া ঘুমিয়ে গেছে। ঘুম ভাঙলো কারো কান্নার শব্দে। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। শরীর কাপছে। আচমকা হওয়ায় বুক ধড়ফড় করছে। কি হয়েছে জানতে ছুটে বাইরে এলো। বর পক্ষের কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে। সিনথিয়া বুঝলো না এরা কাঁদছে কেনো? সিনথিয়া এগিয়ে গেলো তাদের দিকে। সিনথিয়াকে দেখে ওদের পক্ষের একটা মেয়ে বললো,
— “তোমার জন্য সব হয়েছে। অপয়া, অলক্ষী কোথাকার৷ বিয়ে ঠিক হতে না হতেই সব বিপদ যেনো আমাদের ঘাড়ে চেপে বসেছে।”
সিনথিয়া বেক্কলের মতো তাকিয়ে রইলো। কিসের কি বলছে বুঝতেই পারছে না৷ মেয়েটা হিসহিসিয়ে বললো,
— “তোমার মতো অপয়া, কালনাগিনীর সাথে গত রবিবার বিয়ে হয়েছে আর আজই আমার ভাই মারা গেছে। এতোটা কুলক্ষী মেয়ে আমি আর দুটো দেখিনি।”
সিনথিয়া অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলো। মানে ওর পাত্র বুইড়া ব্যাডা মরে গেছে? সিনথিয়া হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না৷ কাউকে কিছু না বলে রুমে চলে এসেছে। সিজদায় পরে শুকরিয়া জানালো মহান রবের৷
.
আজ ফুরফুরা মেজাজে এলো টিউশনে। বিয়ে ভেঙেছে তাই খুব খুশি সিনথিয়া। মহল্লায় রটে গেছে সিনথিয়ার বিয়ের দিনই পাত্র মরে যাওয়ার ঘটনা৷ সবাই তাকে অপয়া, অলক্ষী বলেই চিনে এখন। এতে সিনথিয়াই খুশি। এবার আর বিয়ের জন্য কেউ আসবে না। এরমধ্যেই অতশি এসে উপস্থিত হলো রুমে। সিনথিয়ার পাশে বসে বললো,
— “পুরো কাহিনি বলো।”
সিনথিয়া হাসতে হাসতে বলল,
— “আমার বুইড়া বর মরে গেছে কাল। তাই বিয়ে হয়নি। পারায় রটে গেছে আমার এই ঘটনা। এবার আর কোনো বিয়ের প্রস্তাব আসবে না।”
— “খুশি হলাম। এবার তোমাকে আর বলির বকরা হতে হয়নি। কিন্তু সিনথিয়া এভাবে আর কতদিন চলবে বলতে পারো? তুমি অভিভাবক বিহীন এই সমাজে টিকে থাকতে পারবে? বাবা-মায়ের কথা বলো না। কারণ তুমি জানো তারা তোমাকে কেমন করে দেখছে। তাই আবারও বলছি একবার ভেবে দেখো এই প্রস্তাবটা। তোমার জন্য মন্দ হবে না।”
সিনথিয়া চুপ রইলো। কোনো কথা বললো না। হয়ত ও নিজেই বুঝেছে এভাবে বেশিদিন টিকতে পারবে না। কারো না কারো গলায় ঝুলিয়ে দেবে ওকে৷ অতশি এবার সিনথিয়ার হাত ধরে বললো,
— “তোমার দীন নিয়ে আমাদের বাড়িতে খুব ভালোভাবে বাঁচতে পারবে সিনথিয়া। আমার ভাই নিজেই হা..হাফেজ। তোমার কষ্ট হবে না আশা করি।”
সিনথিয়া অবাক হয়ে তাকালো। কিন্তু চুপচাপই রইলো। অতশি কাতর চোখে সিনথিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। যদি রাজি হয়ে যায় এই আশায়।
________________________
লাল রঙের শাড়িতে আবারও বউ সেজেছে সিনথিয়া। আয়নায় তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর নজর সরিয়ে নিলো। শেষ পর্যন্ত রাজি হতে হয়েছে অতশির ভাইয়ের জন্য। পরিবার বাধ্য করেছে। সিনথিয়া নিজের সিদ্ধান্তেই অটল ছিলো। কিন্তু কিভাবে যেনো এই ব্যাপারটা বাসায় জেনে গেছে। তারপর চেপে ধরে আজ বসিয়ে দিলো বিয়ের পিড়িতে।
সিনথিয়ার ভাবনার মাঝে অতশি রুমে এলো। হাতে একটা কালো বোরকা। সিনথিয়া দিকে বাড়িয়ে দিলো মুচকি হেসে। সিনথিয়া এক পলক অতশির দিকে তাকিয়ে বোরকা নিয়ে গায়ে জড়িয়ে নিলো। লোকটাকে এখনো পর্যন্ত দেখেনি। জানে না তার হবু বরটা কেমন। কালো নাকি ফর্সা। ইচ্ছে হয়নি।
সব নিয়ম কানুন মেনে বিয়ে হয়ে গেলো সিনথিয়ার। আবারও গায়ে বিবাহিত ট্যাগ লেগে গেলো। বিদায়ের সময় যখন সিনিথিয়ার হাত তার সদ্য বিবাহিত বরের হাতে তুলে দেয়ার জন্য একসাথে চেপে ধরেছিলো সিনথিয়া পুরো শরীর শিরশির করে উঠলো। এই প্রথম লোকটাকে দেখলো। তাও হাতটা। ফর্সা লোমশযুক্ত হাত। যা দেখে সিনথিয়ার মনে এক শীতল ঢেউ খেলে গেলো।
গাড়িতে যখন লোকটার পাশে বসলো মিহি আতরের গন্ধ নাকে লেগেছিলো। তাতেই সিনথিয়ার যেনো অন্যরকম লাগলো। লোকটার গাম্ভীর্যতায় যেনো তার ব্যক্তিত্ত্ব ফুটে উঠতে চাইছে। সিনথিয়া গাড়ির সিটে মাথা হেলিয়ে দিলো। মিহি আতরের ঘ্রাণ এখনো নাকে লাগছে। একটা ঘোরের মধ্যেই চলে গিয়ে চোখ বুজে নিলো।
চলবে,,,
® ‘নুরুন নাহার’
[সুন্দর কিছু মন্তব্য চাই আজ সবার থেকে।]
চলবে,,,
® ‘নুরুন নাহার’