#সাত_সমুদ্রের_তিমির
পর্বঃ১৩
#সুমাইয়া_আফরিন
অনু দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল রাফাত ও একটা অচেনা ছেলে কেবিনে ঢুকেছে। অনু ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইল তাদের দিকে। কারন অনু ভেবেছিল রাফাতের মা আসবেন কেবিনে। কারন একজন মায়ের থেকে নিজের মেয়েকে কেউ বেশি কেয়ার করতে পারে না। আর এখন স্নেহার প্রচুর বেশি কেয়ার দরকার। অনু রাফাত আর আগুন্তুক লোকটাকে দেখে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
রাফাত আর ওই ছেলেটি অনুর সামনে রাখা দুইটি চেয়ারে বসে পড়ল। অনু ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে রইল দুইজনের দিকে। তারপর প্রেসক্রিপশনের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল,
‘প্রেশেন্টের মা আসলে খুব ভালো হতো।’
‘আসলে ভাবী না মানে ডক্টর শাশুরী মা আমার ছেলেকে নিয়ে খুব ব্যস্ত তো তাই আসেনি।’
অনু লেখা ছেড়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল।ইনিই প্রথম মানুষ যে অনুকে ভাবী বলে ডাকলো। অনু লোকটার কথার ধরন শুনে বুঝতে পারল যে লোকটা স্নেহার হাজবেন্ট। অনু ভ্রুটা উচু করে আবার নিচে নামিয়ে বলল,
‘আপনিই প্রেশেন্টের হাজবেন্ট?’
‘জ্বী। আর ও হচ্ছে রাফাত। রাফাত প্রেশেন্ট মানে আমার স্ত্রীর ব্রাদার।’
অনু লোকটার কথায় ভীষন বিরক্ত হলো। কিন্তু বিরক্তের থেকে অবাক হলো বেশি। অনু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল লোকটার দিকে।আনমনে ভাবতে থাকলো সে,
‘আজব তো, এমনভাবে পরিচয় দিচ্ছে যেন আমি জানি না রাফাত কে!ওনার কথা শুনে তো মনে হচ্ছে উনি জানেন না যে আমি রাফাতের স্ত্রী। কিন্তু যদি না জেনে থাকেন তাহলে ভাবী বললেন কেন?কিন্তু যদি জেনেই থাকতেন তাহলে পরিচয় দেবেন কেন?’
মাথায় হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে অনুর। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রয়েছে সে। ভাবনার দুনিয়ায় বাস করছে সে। হঠাৎ রাফাত গলা খাকারি দিয়ে বলল,
‘অনু? আমার বোনের জন্য এখন কি কি করা উচিত তাড়াতাড়ি বলো।’
রাফাতের কথায় অনুর হুশ ফেরে। অনু নিজের চোখের চশমাটি ঠিক করে স্নেহার ব্যাপারে উপদেশ দেওয়া শুরু করল। এক পর্যায়ে অনু বলে উঠল,
‘কোনো রকমের যেন ব্যালেন্স ডাইট না করে। সকল পুষ্টিকর খাবার তাকে খেতে হবে। আর দিকে দুটো করে ডিম খেতে হবে তাকে।’
অনুর সামনে বসে থাকা লোকটি চোখ বড় বড় করে বললেন,
‘কি বলছেন আপনি? আমার বউ ডিম খায় না। অন্য কিছু বলুন।’
অনু ভ্রু কুচকে বলল,
‘ What? আপনার মাথায় কি সমস্যা আছে? একজন মানুষের ডিম খাওয়া দরকার এখন আমি সেইটা কি করে বদলাবো? তার ডিম খাওয়া দরকার তাকে ডিম খাওয়াতেই হবে বুঝতে পেরেছেন’
লোকটার মাথায় অজানা চিন্তার রেখা ফুটে উঠল। অনু আর কোনো কথা না বাড়িয়ে রাফাত আর লোকটার দিকে প্রেসক্রিপশন এগিয়ে দিল। অনু একটি অবাক হয়েছে রাফাতের সারাক্ষন এমন চুপ থাকায়। লোকটা প্রেসক্রিপশন নিয়ে উঠে দাড়ালো। সাথে সাথে রাফাতও বসা থেকে উঠে দাড়ালো।
লোকটা দরজার কাছে গিয়ে আবার ফিরে এসে অনুকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘আপনি গাইনালোজি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন?’
‘পড়াশোনা আমি সবকিছু নিয়েই করেছি। আর ডিগ্রি পেয়েছি গাইনালজি নিয়ে।’
লোকটা ”ওওও”বলে চলে গেল। অনুর কেন জানি লোকটাকে একটা পাগল মনে হলো। অদ্ভুত ধরনের প্রশ্ন করে। অনু আর কিছু না ভেবে নিজের ব্যাগ গোছাতে লাগল এবং নিজেকে তৈরি করতে লাগল বাসায় যাওয়ার জন্য।
কেবিন থেকে বের হয়েই রিয়াদ রাফাতের হাত চেপে ধরল। তারপর শয়তানি হাসি দিয়ে বলল,
‘কি ব্যাপার শালাবাবু, ভাবীর সামনে গিয়ে তো একেবারে চুপ হয়ে গেলে।’
রাফাতের দিক থেকে কোনো প্রতিউত্তর পাওয়া গেল না। রাফাত আপন মনে হেটে চলেছে করিডর দিয়ে। রিয়াদ কথার সাথে আরো ঝাল মশলা মাখিয়ে বলল,
‘কি রে, কি হয়েছে তোর? আচ্ছা আমি একটা জিনিস বুঝলাম না তুই মেয়েটার নাম জানলি কীভাবে? তুই কি মেয়েটার সাথে কথা বলেছিস?কবে কথা বললি? আমাকে তো বললি না?’
রাফাত রিয়াদের কথায় বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ওই মেয়েটাই অনু মানে যার সাথে আমার সাত বছর আগে বিয়ে হয়েছিল।’
কথাটা শুনেই রিয়াদ খুকখুক করে কেশে উঠল। কাশি যেন থামতেই চাইছে না তার। রাফাত পানি যোগাড় করে রিয়াদের সামিনে তুলে ধরল।রিয়াদ ঢক ঢক করে বোতলের অর্ধেক পানি শেষ করে দিল। তারপর রাফাতের দিকে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল,
‘কি বললি তুই?’
‘তুই যা শুনেছিস।’
‘মানে আমি যাকে উড বি ভাবী ভাবছিলাম সে জেনুইনলি আমার ভাবী?’
রাফাত হুম বলে হনহন করে স্নেহার কেবিনের দিকে ছুটে গেল।রিয়াদ এখনো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে রাফাতের যাওয়ার পানে।
রিয়াদ আর রাফাত ছোট বেলার বন্ধু সাথে সাথে বেস্ট ফ্রেন্ডও তারা। রিয়াদকে কাকলি সরকার অনেক পছন্দ করতেন তাই রিয়াদের সাথেই নিজের মেজো মেয়ে স্নেহার বিয়ে দেন তিনি। রাফাত রিয়াদের সাথে সবকিছু শেয়ার করে তাই অনুকে ভালোবাসার ব্যাপারটাও শেয়ার করেছিল সে। রাফাত আর রিয়াদের পক্ষে কোনোদিন সম্ভব হয়নি অনুর সাথে কথা বলার তাই অনুর সমন্দ্ধে কিছুই জানে না তারা।
যার জন্য আজকে রিয়াদ অনুর পরিচয় জেনে অবাক হয়েছে। তখন অনুকে ভাবী বলার কারন রাফাত অনুকে ভালোবাসতো এবং বিয়ে করার ইচ্ছাও ছিল তার। যার জন্য অনুকে আগে থেকে ভাবী বলা শুরু করে দিয়েছিল রিয়াদ। অভ্যাসগত হওয়ায় ভুলবশত ভাবী বলে ফেলে সে।
রিয়াদ আকাশ থেকে পড়েছে রাফাতের কথায়। রিয়াদ নিজেকে সামলিয়ে ওষুধ কিনতে চলে গেল।
অনু রেডি হয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেল। কিছুদুর যেতেই পেছন থেকে চেনা কন্ঠস্বর ভেসে আসলো তার কানে। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখল রাফাত দাঁড়িয়ে আছে। অনু এতক্ষন খেয়াল করেনি যে আজকে রাফাতকে অপরুপ সুদর্শন লাগছে। একদম হালকা গোলাপি রঙের ব্লেজার আর ব্যাক কালারের গ্যাবার্ডিন প্যান্ট পড়েছে সে।
অনু পেছন ফিরে তাকাতেই রাফাতের ঠোটের কোণে হাসি ফুটে উঠেছে। কারন রাফাত ভেবেছিল অনু রাফাতের আহ্বানকে উপেক্ষা করে চলে যাবে। রাফাত একটু তাড়াতাড়ি অনুর কাছে চলে আসলো। অনু জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে রাফাতের দিকে। রাফাত হাস্যজ্জল চেহারায় বলল,
‘আমি কি তোমাকে একটু এগিয়ে দিতে পারি?আসলে কিছু কথা ছিল।’
অনু রাফাতের কথায় একটু খুশি হলো। কারন অনুও চাইছিল রাফাতের সাথে কথা বলতে। কিন্তু কি করে বলবে সেইটাই বুঝতে পারছিল না সে। অনু নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘হুমম,পারেন। আমারো কিছু কথা আছে আপনার সাথে।’
রাফাত অনুর কথায় ভীষন খুশি হলো। অনু আর রাফাত একসাথে রাস্তায় হাঁটা শুরু করল।নিস্তব্দ্ধ রাস্তায় দুইজন হেঁটে চলেছে আপন গতিতে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় সম্পূর্ন দেখা যাচ্ছে দুইজনের মুখটা। কিন্তু কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না। কথা বলছে না। অদ্ভুত সংকোচ আর জড়তা কাজ করছে তাদের মধ্যে। সাত বছর হয়েছে বিয়ের কিন্তু আজও তারা নবদম্পতিদের মতো আচরন করছে।
সব সংকোচ আর জড়তা কাটিয়ে রাফাত অনুর দিকে নেশাভরা দৃষ্টিতে তাকালো। শান্ত গলায় বলে উঠল,
#সাত_সমুদ্রের_তিমির
পর্বঃ১৪
#সুমাইয়া_আফরিন
সব সংকোচ আর জড়তা কাটিয়ে রাফাত নেশাভরা দৃষ্টিতে অনুর দিকে তাকালো। শান্ত গলায় বলে উঠল,
‘অনু তুমি কিছু কথা বলতে চেয়েছিলে।’
অনু ভ্রু কুচকে রাফাতের দিকে দৃষ্টপাত করল। জিহবা দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে প্রতিউত্তরে বলল,
‘আপনিও তো কিছু বলতে চেয়েছিলেন?’
‘হুম বাট, লেডিস ফার্স্ট।’
অনু একটা মুচকি হাসি দিল। রাফাত অন্র হাসি দেখে যেন একটু সস্তি পেল। রাফাত কখনো কোনো মেয়ের সাথে কথা বলতে গেলে ঘাবড়ায় না কিন্তু এই একজন মেয়ে যাকে দেখলেই প্রচুর নারভাস হয়ে যায় সে। রাফাত দীর্ঘ অপেক্ষায় আছে অনুর মিষ্টি কন্ঠস্বরের ভাবান্তর কথাগুলোর জন্য। অবশেষে রাফাতের প্রতিক্ষার অবসান ঘটিয়ে অনু বলে উঠল,
‘আমি যদি আপনাকে বলি……..
অনু থেমে গেল। রাফাত ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে তার দিকে। অনুকে এক অজানা ভয় আকড়ে ধরছে। কীভাবে বলবে কথাটি বুঝতে পারছে না সে। প্রচন্ড সংকোচ বোধ হচ্ছে তার। রাফাত কৌতুহলি কন্ঠে বলল,
‘তুমি আমাকে কি বলবে?তাড়াতাড়ি বলো।’
অনু আর চুপ করে থাকল না। অনু রাফাতের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আমি যদি বলি আমি আপনার বাবাকে শাস্তি দিতে চাই এবং শাস্তি দিতে আপনার সাহায্য চাই তাহলে কি আপনি আমাকে সাহায্য করবেন?’
অনুর এমন প্রশ্নে রাফাত অনেকটা চমকে গেল।বজ্রচক্ষুতে তাকিয়ে রইল অনুর জিজ্ঞাসু মুখস্রির দিকে। রাফাতের মনটা বিষন্নতায় ভরে উঠল। বুঝতে পারছে না যে সে কি উত্তর দেবে অনুকে।অনুকে হারনোর অদ্ভুত ভয় বিরাজ করতে লাগল তার হৃদয়ে। রাফাত অনুকে সবকিছু কীভাবে বোঝাবে তা সে জানে না। বুঝতে পারছে না সত্যি ঘটনা কি করে জানাবে তাকে।
অনু রাফাতের স্তব্দ্ধ থাকায় তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়। অনু যা ভেবেছিল তাই হয়েছে। রাফাত তার বাবার বিরুদ্ধে কখনোই যাবে না। তার মতে রাফাত চায় না তার বাবার শাস্তি হোক।অনু রাফাতের ভাবনায় ডোবা দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে বলল,
‘It’s okey Rafat.বুঝতে পেরেছি। তোমার পক্ষে সম্ভব না।’
রাফাত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি রাস্তায় নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। অনু খেয়াল করল রাফাতের চোখ লাল হয়ে গেছে। অনু আর কথা বাড়াতে না চেয়ে হাঁটা ধরল নিজের গন্তব্যের দিকে। আচমকা পেছন থেকে ”অনু” বলে কেউ ডাক দিল।অনু বিষ্মিত দৃষ্টিতে পেছন ঘুরে তাকালো। রাফাত মাথা উচু করে অনুকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘অনু তুমি এখন আমার বাবাকে শাস্তি দিতে চাচ্ছো রাইট?’
‘হুমম।’
‘তুমি শাস্তি দিতে চাইলেও পারবে না। বিকজ যে ক্যামেরা দিয়ে রেকর্ডিং করা হয়েছে তা অনেক পুরোনো। সতেরো বছর পুরোনো ক্যামেরা আর কতই বা ভালো হবে। আর বাবা এত পাওয়ারফুল ম্যান যে এই প্রমান নষ্ট করতে তার দুই মিনিটও লাগবে না। পুলিশের হাতে যদি কেস যায় বাবা খুব সহজেই বেরিয়ে আসবে। তাই অনেক বড় একটা কেস হতে হবে যা সিয়াইডি বা র্যাব বা আর্মির হাতে যেতে বাধ্য হবে। নয়তো কোনোভাবেই বাবাকে শাস্তি দেওয়া যাবে না।’
‘আপনি কি বলতে চাইছেন? আপনার বাবা যত বড়ই পাওয়ারফুল মানুষ হোক না কেন শাস্তি তাকে পেতেই হবে। কেউ আটকাতে পারবে না।’
‘ইয়েস অনু আমি আগ্রি ইট বাট ট্রাই টু আন্ডারস্যান্ড।’
অনু এবার প্রচন্ড রেগে গেছে রাফাতের কথায়। নিজের রাগকে কন্ট্রোল করতে না পেরে রাফাতের উপর রাগান্বিত হয়ে বলল,
‘কি বুঝবো আমি?কি বোঝার আছে এখানে?একটা কথা কান খুলে শুনে নিন, আপনি আপনার বাবাকে বাচানোর প্রানপণ চেষ্টা করবেন তা আমি জানি কিন্তু আমিও প্রানপন চেষ্টা করব আপনার বাবাকে শাস্তি দেওয়ার।’
রাফাতের চোখ রক্তবর্ণ ধারন করেছে। রাগে মাথার রগগুলো ফুটে উঠেছে তার। অনুর দিকে নিজের রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠল,
‘ওহ অনু শাট আপ। আর কতো ভুল বুঝবে তুমি আমাকে? আমি চাই আমার বাবা শাস্তি হোক। কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি হোক আমার বাবার। বাট এখন যদি তুমি কেস করো বাবার উপর তাহলে বাব খুব সহজে পার পেয়ে যাবে। তুমি কি ভাবছো বাবা এই সতেরো বছরে আর কোনো ক্রাইম করেনি। অনু আমি আমার বাবার বিষয়ে এই দুইবছর বিজনেস সামলাতে গিয়ে এমন সব ক্রাইমের কথা জেনেছি যা প্রতি মুহূর্তে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে আমাকে। সেই ক্রাইমগুলোর প্রমান আমি তখনই আনতে পারবো যখন ঢাকার পুরো বিজনেস আমি সামলাবো। আর ঠিক তখনই কেস ফাইল করতে হবে। তার আগে যদি করো তুমি যেখানে আছো তার থেকে অনেক গভীরে চলে যাবে। যেখান থেকে আর কখনো বের হতে পারবে না তুমি।’
রাফাতের কথায় অনু থমকে গেছে। কি বলছে এসব রাফাত। সত্যি বলছে নাকি মিথ্যা?রাফাতের প্রত্যেকটা কথা অনুর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। অনু নির্বিঘ্নভাবে জিজ্ঞাসা করল,
‘কোন ক্রাইমের কথা জানতে পেরেছেন আপনি?’
রাফাত অনুর পেছনে তাকিয়ে আমার চোখ সরিয়ে নিল। অনু রাফাতের তাকানো দেখে পেছন ফিরে দেখল একজন অদ্ভুত চেহারার মানুষ হেঁটে যাচ্ছে। তার নজর অনেকটা রাফাত আর অনুর দিকে। অনু বিষয়টাকে গুরুত্ব না দিয়ে বলল,
‘কি হলো বলুন?’
রাফাত অনুর অনেকটা কাছে চলে আসলো। অনুর কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল সে। অনু রাফাতের এহেন কান্ডে ভীষন অবাক হয়ে গেল। অনুর নিশ্বাস ঘন হতে থাকল। রাফাতের হাত অনুর কোমড়ে বিচরণ করছে। রাফাত অনুর এত কাছে আসায় অজানা অসস্তি বিরাজ করতে থাকল অনুর হৃদয়ে। রাফাত আস্তে আস্তে তার মুখটা অনুর মুখের কাছে নিয়ে এলো। অনু নিজের মুখটা দূরে সরাতে থাকল রাফাতের থেকে। রাফাতের কোমড়ে জড়িয়ে ধরা হাত যেন আরো শক্ত হয়ে গেছে। রাফাত নিজের ঠোটযুগল অনুর কর্নকুহরের কাছে নিয়ে বলল,
‘যেদিন তুমি আমাকে নিজের হাজবেন্ট হিসেবে মেনে নিতে পারবে,আমাকে,ভালোবাসবে, আমাকে আপন করে নিতে পারবে সেইদিনই সবটা জানতে পারবে তুমি।’
হঠাৎ এক বাইকার যেতে যেতে অনু আর রাফাতকে বলে উঠল,
‘ও রোমিও বাড়ি গিয়ে প্রেম করো।’
কথাটায় অনু মারাত্নক লজ্জা পেল। কিন্তু রাফাতের কোনো হেলদোল নেই। রাফাত মুচকি হাসি দিয়ে নিজের ঠোট যুগল সরিয়ে নিল অনুর কর্নকুহরের থেকে।নিজের থেকে আস্তে করে অনুকে ছেড়ে দিল রাফাত। অনু নির্বিকার ভাবে তাকিয়ে রয়েছে রাফাতের দিকে। অনু রাফাতের কথাগুলো শুনে অবাকের শেষ পর্যায়ে পৌছে গেছে। আকাশ ভেঙে পড়লেও হয়তো অনু এতটা অবাক হতো না যতটা রাফাতের কথায় হয়েছে সে।
অনু ভেবেছিল রাফাত হয়তো কোনোদিনও তাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে মেনে নেবে না। রাফাত তার মায়ের জন্য অনেক পজেসিভ। যেহেতু রাফাতের মা তাকে পছন্দ করে না সেহেতু রাফাতও পছন্দ করবে না এটাই ছিল অনু ধারনা। রাফাত যে তার মায়ের মতো রুপ না দেখে গুন দেখে মানুষকে পছন্দ করে এটা অনু জানতো। রাফাত যে একজন মানুষের মানুষিকতা ও মনের সৌন্দর্য দেখে মানুষকে ভালোবাসে এটাও অনু জানতো। এই সততার জন্যেই অনু রাফাতকে ভালোবেসে ছিল।
কিন্তু তার প্রত্যেকটা বিশ্বাস রাফাত ওই চার লাইনের মাধ্যমে ভেঙে দিয়েছিল রাফাত।যার কারনে অনু বিশ্বাস করতে চাইছে না রাফাতকে। এটা যে রাফাতের কোনো ছলনা নয় তা অনু বিশ্বাস করতে পারছে না। কিন্তু আজ অনুর ভীষন ইচ্ছা করছে রাফাতকে বিশ্বাস করতে। রাফাতের চোখে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে তার বেদনাগুলো।একজন মানুষ কীভাবে এতটা সুন্দর অভিনয় করতে পারে।
রাফাত আর কোনো কথা বাড়িয়ে উলটো দিকে হাটা শুরু করল। অনু নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে রাফাতের যাওয়ার পানে।অনুর হৃদয়ে বেসামাল ঝড় বয়ে যচ্ছে। বারবার শুকনো ঢক গিলছে সে।
রাফাত কিছুদুর গিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখল অনু এখনো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। পরম মায়ায় তাকিয়ে আছে তার দিকে। রাফাত মুখে হাসি ফুটিয়ে অস্ফুট বেদনার সুরে বলে উঠল,
‘অনু তুমি যদি সেইদিন আমার নাম্বারটা ব্লকলিস্টে না রাখতে আজ হয়তো আমি আর তুমি এই রাস্তায় ভালোবাসার ছবি এঁকে কাটাতাম। যদি তুমি একবার ওই ব্লক করা নাম্বারটার মেসেজগুলো দেখতে তাহলে হয়তো আমি আর তুমি আজ একসাথে আমদের বোনের জন্য চিন্তা করতাম। কিন্তু আফসোস, তুমি কখনো আমার ব্লক করা নাম্বারটা দেখনি।’
অনু খেয়াল করল রাফাতের চোখটা ছলছল করে উঠেছে। দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি হয়তো টুপ করে পড়ে যাবে চোখের নোনা অস্রুজল। অনুর ভেতরটা দুমরে মুচরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। অনু ব্যাকুল হয়ে উঠল রাফাতের মেসেজগুলো পড়ার জন্য। গলায় অদ্ভুত কান্নার ভর অনুভব করতে পারছে সে। অনু জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিতে থাকলো। আর কোনোদিকে না তাকিয়ে পেছনে ঘুরে নিজের বাসার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো সে।
অনু আশেপাশে তাকিয়ে দেখল ওই লোকটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। নিজের পাশে তাকাতেই চমকে উঠল সে। লোকটা রাস্তার ইলেকট্রিক পিলারের পেছনে দাঁড়িয়ে রাফাতের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। অনুর ভীষন খটকা লাগল এই বিষয়টিতে। এই লোকটা কে? আর রাফাতকে নজরে নজরে রাখছেই বা কেন?
অনু মাথায় হাজারো প্রশ্ন নিয়ে হাঁটতে লাগল। বাড়িতে পৌছাতেই মিমি জিজ্ঞাসা করল,
‘কি রে? তোর ডিউটি শেষ আরো দেড় ঘন্টা আগে। তুই এতক্ষন কোথায় ছিলি?’
অনু মিমির কথার কোনো প্রতিউত্তর দিল না। মাথায় হাজারো টেনশন চলছে তার। রাফাত কি মেসেজ দিয়েছিল তা দেখার জন্য প্রতিনিয়ত বুক কাপছে অনুর। ইতিমধ্যে মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে গেছে তার। অনু যখন অতিরিক্ত চাপ নিয়ে নেয় তখনই এই সমস্যা দেখা দেয় তার। অনুর মনে বারবার এই প্রশ্নটিই জেগে উঠছে যে ওই লোকটা কে ছিল?
এভাবেই চিন্তা করতে করতে অনু কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে তা সে নিজেও জানে না। সকাকের আলো ফুটতেই অনু তার মামার বাসায় যাওয়ার জন্য রেডি হওয়া শুরু করে। ইরা অনুকে এমন হন্তদন্ত হয়ে বের হওয়া দেখে প্রশ্ন ছুড়ে মারে তার দিকে,
‘অনু আজকে তো শুক্রবার আর তোর তো আজকে ডিউটি নেই তাহলে কথায় যাচ্ছিস তুই?’
অনু ব্যাস্ত কন্ঠে ইরাকে বলল,
‘কাজ আছে রে।’
লারা ভ্রু কুচকে অনুর দিকে তাকিয়ে রইল। নিজের কৌতুহল মেটাতে অনুকে জিজ্ঞাসা করল,
‘কি কাজ? তুই রাতেও খাস নি আর এখনও না খেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিস।কি হয়েছে বলবি তো?
অনু লারাকে জানালো ফিরে এসে সবটা খুলে বলবে সে। অনু লারার স্কুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল তার মামার বাড়ির উদ্দেশ্যে। অনুর চোখ দুটো শুধু সেই মেসেজগুলো দেখার জন্য কাতরাচ্ছে।
চলবে,
(