ভালোবাসার রংবদল পর্ব ১

“তোর মা মারা যায়নি যখন তুই এক বছরের বাচ্চা ছিলি তখনই তোর মা তোর বাবাকে আর তোকে রেখে অন্য লোকের সাথে বিয়ে করে চলে গেছে।”

নিজের মায়ের নামে এমন কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছি আমি। মনে হচ্ছে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পরেছে। পুরো দুনিয়া যেন অন্ধকার হয়ে গেছে। টলমলে চোখে আমি দিদুমনির দিকে তাকিয়ে কাঁপাকাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম-

—”দিদুমণি তুমি এসব কি বলছো?”

দিদুমনি শক্ত গলায় বললেন-

—”যা বলছি একদম সত্যি কথাই বলছি শুভ্রা। তাই আর কখনো তোর মায়ের কথা আমার কাছে জানতে চাওয়ার চেষ্টা করিস না শুভ্রা।”

দিদুমনির কথা গুলো শুনে আমার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পরছে। আমি তো শুধু আমার মৃত মায়ের কথাই জানতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এমন কথা জানতে পারবো সেটা আমার ধারণার বাহিরে ছিল। হঠাৎ আব্বু ড্রয়িং রুমে এসে এসব শুনে দিদুমনির কাছে গিয়ে রাগী কন্ঠে বললেন-

—”ফুপি তোমাকে আমি বার বার বলেছি আমার শুভ্রতাকে এসব আজে বাজে কথা না বলতে।”

দিদুমনি আব্বুর দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললেন-

—”শোন শুভ ও যেমন তোর মেয়ে হয় আমারও কিন্তু নাতনি হয়। আমি শুভ্রাকে কম ভালোবাসি না নিজ হাতে মানুষ করেছি ওকে। কিন্তু কতদিন এভাবে ওকে মিথ্যার আশ্রয়ে রাখবি!! মেয়েটা প্রতিদিন ওর মায়ের গল্প শুনতে চায় আমার কাছে। আমিই বা কতদিন মিথ্যা বলে যাবো!! এবার শুভ্রা বড় হয়েছে ওর সব সত্যি জানা দরকার।”

আব্বু কিছু বলছে না চুপ করে আছে তার মানে এসব কথা সত্যি!! আমি নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনছি আর নিরবে চোখের পানি ফেলছি। আব্বু আমার দিকে তাকাতেই আমি ছুটে নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলাম। এতোদিন জানতাম আমার মা নেই মারা গেছে আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে কিন্তু আজ জানলাম উনি আমাকে ফেলে রেখেই চলে গেছে। এই ভয়ংকর সত্যিটা যেন মা হারানো চেয়েও বেশি কষ্ট দিচ্ছে। কোনো ভাবেই নিজেকে সামলিয়ে শান্ত করতে পারছি না সারাদিন দরজা লাগিয়ে কান্নাকাটি করে সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে পরলাম। আব্বু কিছু বলেনি উনি বুঝতে পেরেছে এখন তার শুভ্রতার একা কিছুটা সময় থাকা দরকার।

———————

রাতে দিদুমনি আর আব্বুর অনেক ডাকাডাকির পর আমি দরজা খুলে দিলাম। আব্বু ভিতরে এসে লাইট জ্বালিয়ে আমার দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি বুঝতে পারছি আব্বু এখন আমাকে এভাবে দেখে খুব কষ্ট পাচ্ছে। আব্বু কখনো আমাকে কান্না করতে দেয়নি। ছোট থেকে আমাকে খুব যত্নে আগলে রেখেছেন। আর আজ তার মেয়ে এভাবে কান্নাকাটি করেছে সারাদিন নিশ্চয়ই এটা আব্বুর জন্য খুব কষ্টের। আব্বু এগিয়ে এসে আমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো-

—”এইজন্যই তোকে এসব জানাতে চাইনি আমি। দেখতো নিজের কি হাল করেছিস কান্নাকাটি করে। সারাদিন তো কিছুই খেলি না একদিনেই কতটা শুকিয়ে গেছিস।”

আমি কিছু বলছি না চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছি। আব্বু আবারও বলে উঠলো-

—”আচ্ছা শুভ্রতা একটা ডিল করলে কেমন হয় বলতো!!”

আব্বুর কথা শুনে আমি তার দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকালাম। আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আব্বু বললেন-

—”তুই যদি এখন সুন্দর মতো ফ্রেশ হয়ে আমার সাথে বসে ডিনার করিস তাহলে আমি তোকে সব বলবো তুই যা যা জানতে চাস সব।”

আমি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আব্বুকে বললাম-

—”সত্যি বলছো তো!!”

—”একদম সত্যি তিন সত্যি। যা এখন ফ্রেশ হয়ে আয় আমি খাবার তোর রুমেই নিয়ে আসছি।”

এই কথা বলেই আব্বু চলে গেলেন। আর আমি কিছুটা খুশি হয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম।

(আমি কায়ানাত হোসাইন শুভ্রতা। আর আমার আব্বু সাফাদ হোসাইন শুভ। ছোট থেকে আব্বুর আদরেই বড় হয়েছি। উনি কখনো আমাকে মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি। বলতে গেলে একজন মায়ের থেকেও বেশি ভালোবেসে আগলে রেখেছেন আমাকে। পরিবার বলতে শুধু আমি,আব্বু আর দিদুমনি। দিদুমনিও আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে।)

ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলাম আব্বু খাবার নিয়ে বসে আছে। আমি আব্বুর পাশে গিয়ে বসতেই আব্বু আমার মুখে খাবার তুলে দিলো। ছোট থেকেই আমি নিজের হাতে কম আব্বুর হাতেই খাবার বেশি খেয়েছি। আব্বু খুব যত্ন করে আমাকে খাইয়ে নিজেও খেলে নিলেন। খাওয়া শেষ করে আমাকে নিয়ে বারান্দার দোলনার বসিয়ে দিলেন। আব্বু আমার পাশে বসে আমাকে বললেন-

—”বল কি জানতে চাস আমি উত্তর দেওয়ার জন্য রেডি।”

আমি আব্বুর দিকে তাকিয়ে গোমড়া মুখে বললাম-

—”শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব বলবে সত্যি সত্যি কথা বলবে। মিথ্যা বললে কিন্তু আমি আর কথা বলবো না তোমার সাথে।”

আব্বু একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললেন-

—”তোর মা আর আমি ভার্সিটি লাইফ থেকেই প্রেম করে তারপর বিয়ে করেছি। আমাদের বিবাহিত জীবন খুব ভালোই চলছিল। কিন্তু একটা সময় আমার ব্যবসায় অনেক লস হয়। অভাবের দিনে এটা ওটা নিয়ে ঝামেলা হতোই তোর আম্মুর সাথে। তোর আম্মু ছিল খুব সৌখিন মানুষ হঠাৎ এমন অভাবে হয়তো তার মানিয়ে চলতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো। এর মধ্যেই তোর আম্মুর প্রেগ্ন্যাসির কথা জানতে পারলাম। খুব খুশি হয়েছিলাম আমরা। তোর আম্মুও কিছুটা মানিয়ে নিয়েছিলো। তোর জন্মের পর আমি মনে মনে ভেবে নিয়েছিলাম যতই কষ্ট হোক নিজের অবস্থানটা ঠিক করবো। আমার মেয়েকে আমি অভাবের মুখোমুখি হতে দিবো না। আর এই কারনেই আমি সারাদিন রাত ব্যবসার কাজে খুব ব্যস্ত থাকতাম।”

আব্বু থেমে গেলেন কথা গুলো বলে। আমি আব্বুর কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছি চুপ করে। আব্বু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও বলা শুরু করলেন-

—”হঠাৎ একদিন তোর আম্মু বললো ও আমার কাছে ডিভোর্স চায়। কারন জানতে চাইলে বললে ও আমার সাথে থাকতে চায় না। অনেক বুঝিয়েছি কিন্তু কোনো লাভ হয়নি তাই শেষমেশ ডিভোর্স দিয়ে দিলাম। একটা ব্যপারে খুব অবাক হয়েছিলাম কারন তোর মা তোকে সাথে করে নিয়ে যাওয়ার কথা একবারও বলেনি আর বললেও আমি তোকে দিতাম না। ডিভোর্স কিছুদিন পার হতেই শুনলাম তোর নানা তোর আম্মু এক বড়লোকের সাথে বিয়ে দিয়েছে। তারপর আর কিছু জানার চেষ্টা করিনি ওর বিষয়ে। ফুপি একাই ছিলো তাই উনি আমাদের কাছে এসে পরে তোর দেখাশোনা করার জন্য। এতো ছোট বাচ্চা তো আমি একা আর সামলাতে পারবো। একটা বছর খুব কঠোর পরিশ্রম করে ব্যবসাটা আগের থেকেও ভালো পজিশনে নিয়ে এসেছিলাম। তুই আমার জন্য সৌভাগ্য হয়ে এসেছিলি তাই প্রথমেই তোর জন্য এই বাড়িটা কিনেছি আর নাম দিয়েছি “শুভ্রা কায়ানাত”। এখন আমার একমাত্র সম্বল হলি তুই শুভ্রা। আমি কখনও চাইনি তুই জানিস যে তোর মা তোকে রেখেই চলে গেছে। এটা মেনে নেওয়া একটা সন্তানের জন্য খুব কষ্টের হতো তাই তোকে বলেছি তোর মা তোকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে। আমাকে মাফ করে দিস শুভ্রা আমি তোকে মিথ্যা কথা বলেছি এতো বছর।”

শেষের কথা গুলো আব্বু অপরাধীর মতো বললেন। আমি আব্বুকে জড়িয়ে ধরে বললাম-

—”জানো বাবা আমার মা নেই বলে এতোদিন যতটুকু কষ্ট ছিল আজ তা-ও নেই। তোমার মতো এত ভালো একটা আব্বু আছে আমার তাই আমার আর কোনো কষ্ট নেই। তোমার শুভ্রা তোমাকে কখনো ছেড়ে যাবে না।”

আব্বু হাসি দিয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আমি আব্বুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম-

—”আচ্ছা আব্বু তোমরা তো ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলে তারপর কেন এমন নিষ্ঠুর পরিনতি হলো?”

আব্বু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার চুল গুলো ঠিক করতে করতে বললেন-

—”কারন ভালোবাসা রঙ বদলায়। কখনো কখনো ভালোবাসা ফিকে হয়ে ধূসর রঙের হয়ে যায় আবার কখনো ভালোবাসা রংধনুর মতো রঙিন হয়ে ওঠে।”

আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম আসলেই কি ভালোবাসা রঙ বদলায়!!!

চলবে…..

#ভালোবাসার_রংবদল
#পর্বঃ১
#Saiyara_Hossain_Kayanat

()

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here