#মেঘ_পরশে_বর্ষণ
মোর্শেদা হোসেন রুবি
১||
” প্রস্তাবটাতে তুমি রাজী হয়া যাও বৌমা। আমি আজ বর্ষণরে আইতে কইছি। ” আস্তে করে কথাটা বলে শসা কাটায় মনোযোগ বাড়িয়ে দিলেন কোহিনুর বেগম।
স্কুলের খাতা দেখছিল মেঘা। কিছুদিন আগেই টেস্ট পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। খাতাগুলো তাড়াতাড়ি দেখে শেষ করতে না পারলে পরে অনেক দেরী হয়ে যাবে। এর মধ্যে বড় ভাইয়ার সপরিবারে খুলনা চলে যাচ্ছে কাল। পোস্টিং হয়েছে খুলনায়। সে উপলক্ষে গত কয়েকদিন ধরেই গোছগাছ চলছে। স্কুলের ফাঁকে ফাঁকে যতদুর সম্ভব মেঘা সময় দিয়েছে ভাবিকে। তার নিজেরও কিছু কেনাকাটা ছিল সেগুলো মেঘাকে সাথে নিয়েই করেছে। এত কাজের ভীড়ে ভাইঝিটার জন্য দুই রকম নকশী পিঠা করেছে মেঘা। বয়ামে ভরে ভাবির ব্যাগে ভরে দিয়েছে। গতকালও চলে আসার সময় ভাবি ওর হাত ধরে কাঁদছিলেন। বলছিলেন, ” জীবনটা কী এভাবেই পার করবি মেঘা ? কতই বা বয়স হয়েছে তোর। এ বয়সে তো অনেকের বিয়েও হয় না আর তুই কী না বৈধব্যের বেশ আঁকড়ে ধরেছিস। মেঘা জবাব দেয়নি। ম্লান হেসে ভাবির হাত ছাড়িয়ে চলে এসেছে। আর এই মুহূর্তে আম্মার মুখে ঐ কথা। যা শুনবে বলে আশা করেনি মেঘা। কথাটা ওকে ভাবিয়ে তুলেছে। কী বলবে ভেবে না পেয়ে নিরব রইল সে। একবার আরশকে দেখল। অকাতরে ঘুমাচ্ছে তার বাচ্চাটা। ওর ঘুমানোর ভঙ্গিটা একদম পরশের মত। হাসলে চিবুকে যে খাঁজটা পড়ে সেটাও। আরশকে দেখলে কারো বলে দেবার দরকার নেই ও পরশের ছেলে। হয়ত সেকারণেই ওর দাদী ওর জন্য এত পাগলপারা।
জানালার ধারে বসেছে মেঘা। এখানটায় বসলেই বাইরে চোখ চলে যায় আনমনে। বড় রাস্তার পুরোটা দেখা যায় এখান থেকে। চোখ কুঁচকে আকাশটা দেখলো মেঘা। ঈষাণ কোণে মেঘের ঘনঘটা। শেষতক বৃষ্টি হবে কি না কে জানে। রাস্তার পারের কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে তাকাল। ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে গাছের ওপর আর নিচটা। সবুজের সমারোহে লালের উৎসব। লাল সবুজের এমন চমৎকার মিতালী সচরাচর চোখে পড়েনা। মেঘার প্রিয় দৃশ্য এটা। কিন্তু বড় অসময়ের ভালোলাগা। যেদিন প্রথম এ বাড়ীতে এসেছিল সেদিনও গাছটা দেখেছিল। সে সময় তখন এত ফুল ছিলনা গাছটাতে। অথচ তখন পরশ ছিল পাশে। রাতভর ওর মুখেই শুনেছে ওদের বিয়ের উপাখ্যান। মেঘার সাথে পরশের বিয়ের দিনটাও এমনই ছিল। ঘনঘোর বরষা। যে বর্ষার সাথে মেঘার আজন্ম মিতালী। মেঘের পরশেই তো বর্ষা নামে। আনমনে কলম সরিয়ে রেখে স্মৃতিবিলাসীতায় ডুব দিল মেঘা। পরশের কণ্ঠ এখনও কানে বাজে। দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে ওঠে অতীতের দৃশ্যগুলো। ঠিক সেই ফুলশয্যার রাতে যেভাবে পরশ বলেছিল। মেঘার মনে হয় সেসব দৃশ্য সে নিজের চোখে দেখছে।
======
পরশের আকদের সময় নির্ধারিত হল বেলা দশটার দিকে। রাতে মেঘাদের অনুষ্ঠান। ঝামেলা এড়াতেই আকদ পর্ব সকালে সেরে নেয়া। কোহিনূর বেগম উচ্চস্বরে কাঁদছেন। ছেলে বিদায়ের কান্না। এটাকে প্রথাগত কান্না বললেও বাড়িয়ে বলা হবেনা। শোনা যায়, পরশের বাবার বিয়ের রাতে ওর দাদী নাকি একটা পানি ভর্তি গামলায় চুলের আগা ডুবিয়ে কেঁদেছিলেন। এটা হল ছেলেকে চিরতরে পর করে দেবার শোক। কারণ ছেলে বিয়ের পর বউয়ের হয়ে যায়। সে দুঃখেই এই শোকবিলাপ। ফলে রীতি মেনে পরশের বিয়েতে তার মা কাঁদবে এটাই স্বাভাবিক।
পরশ পাংশুমুখে মায়ের হাত ধরে চুপচাপ বসে আছে। এদিকে কোহিনুর বেগম বিলাপ জুড়েছেন। রীতিমত গীতিকাব্যে। তাঁকে সুর করে বলতে শোনা গেল, “ঐ আমার সোনার চান। আইজকা তরে বাইন্ধা দিলাম বউয়ের আঁচলে…..টাইপের কান্না। ঘরভর্তি মানুষ। পরশ নিজেও কিছুটা বিব্রত কিন্তু মায়ের সেন্টিমেন্টে আঘাত করতে চায়না সে।
ঘরের একপাশে দারুণ সাজে সুসজ্জিত তিন ভাবি দই চিড়া হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছে কখন কোহিনুর বেগমের কান্না থামবে। তার কান্না পর্ব শেষ হলেই পালাক্রমে দইচিড়া খাওয়ানো শুরু হবে । এটাই নাকি বিয়ের নিয়ম। যদিও আজ পর্যন্ত নিয়ম প্রণেতাদের টিকির দেখা পাওয়া যায়নি। পেলে পরশ তাকে ধরে অবশ্যই জিজ্ঞেস করত, ‘ এসব করে কী হয় রে ভাই ? ”
কোহিনুরের প্রলম্বিত সুরের কান্নায় সবার আগে বিরক্তি প্রকাশ করল তার বড় ছেলের বউ সুরমা। বউ হিসেবে এ বাড়ী সবার আগে সে’ই এসেছে। স্বাভাবিক ভাবেই তার দাপট অন্য দুই বউয়ের তুলনায় বেশী। এমনিতে সে মেয়ে হিসেবেও কম মুখরা নয়। তার এই ঠোঁটকাটা স্বভাবের কারণে স্বয়ং কোহিনুর বেগমও তাকে ভয় পান। যদিও এক জীবনে তার নিজের চাপার ধারের জন্য বিখ্যাত ছিলেন তিনি। এখন সেই বয়সও নেই সেই দাপটও নেই।
সুরমা যারপরনাই বিরক্ত হয়ে বলে উঠল, ” কান্না থামান তো আম্মা। আমাদের দেরী হয়ে যাইতেছে। আর এত কান্নাকাটি কিসের। শখ করে চাকরীজীবি বউ ঘরে আনতেসেন। শিক্ষিত বউমা এসে আপনার ঘর রোশনাই করবে। আপনার খেদমত করবে। আজ তো আপনার খুশির দিন। কান্নাকাটি কী কারণে।”
সুরমার খোঁচা মারা মন্তব্যে কোহিনুর বেগম বাস্তবিকই কান্না থামিয়ে দিলেন। দ্রুত শোয়া থেকে উঠে বসলেন তিনি। তার চোখে এখন পরিত্যক্ত জলের রেখা। এই অবস্থাতেই তিনি হাঁচড়ে পাঁচড়ে বিছানা ছেড়ে নেমে শোকেস ঘেটে সুরমার কৌটা খুঁজে বের করলেন। সেটা সামান্য ঝাঁকিয়ে পরশের চোখে পরিয়ে দিয়ে ওর কপালে চুমু দিয়ে বললেন, ” যাও বাবা। বিসমিল্লাহ বইলা বাইর হও।”
সুরমা লাগানোর সময় উথলে ওঠা কান্নার ঢেউটাকে কোনরকমে গিলে ফেললেন কোহিনুর। বউমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ” অরে তোমরা দই চিড়া খাওয়ায়া দাও।”
সাথে সাথেই আজ্ঞা প্রতিপালিত হল। তিন ভাবি পালাক্রমে পরশকে চামচে করে দইচিড়া খাইয়ে দিল। সেজ ভাবি দই চিড়ার সাথে সাথে ফ্রি তে একটা ঠোনাও মেরে দিল পরশের গালে, ” কত্ত বড় হা করেন। বউ আসার আগেই এত বড় নোলা কেন।”
মনে মনে বিরক্তি চেপে রুমালে মুখ মুছল পরশ। বিরক্ত লাগলেও কিছু করার নেই। নিজের আজন্ম লালিত ব্যক্তিত্ব খানা আজ নানাভাবে হীনতার স্বীকার হতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। কিন্তু চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই। বিয়ে বাড়ীর এসব আজব রীতিনীতির চক্করে পড়ে স্রেফ সঙ টাইপের কিছু মনে হচ্ছে নিজেকে । তারপরেও চুপ করে মেনে নেয়া। ভাবিদেরও সেভাবে কিছু বলা যাচ্ছেনা। পরশের বিয়ে ঠিক হবার পরপরই তিনজন একসাথে জোটবেঁধে পরশকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, ” শোনেন, পরশ ভাই। আপনি হলেন আমাদের এক লওতা দেওয়ারজি। কাজেই আমরা মনের সাধ মিটিয়ে এবার বিয়ের সমস্ত রুসুম পালন করব। আপনি প্যান প্যান করতে পারবেন না। আপনাকে কিন্তু আমাদের সব রকমের আব্দার মেনে নিতে হবে। ”
পরশ কোনরকম তর্কে যায়নি। মুচকি হেসে দীর্ঘশ্বাস গোপন করে ভাবিদের আব্দার নামের অত্যাচারগুলো মেনে নিয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে গতকাল ওর গায়ে হলুদ ছিল। আর গতকালের হলুদ দেয়া নিয়ে নাকানি চুবানি খাওয়ানোর গল্পটা নাহয় উহ্যই থাক। তবে সেজ ভাবি মহুয়া আবার এককাঠি বেশী সরেস। সে তার রসিকতার চুড়ান্ত করেছে গতকাল। প্রতিটা রসিকতায় ছিল অশ্লীলতার মিশেল। সব শুনেও কিছু বলার উপায় ছিল না। এদেরকে নিয়েই সমাজে চলতে হবে তার। কিছু করার নেই।
তবে এটা সত্যি , পরশের অবিবাহিত জীবনে ভাবিদের অবদান কিছুমাত্র কম নয়। বিশেষ করে সেজ ভাবির অবদানটা একটু বেশীই। একই বাড়ীতে থাকলেও বড় দুই ভাবি সংসার বড় হবার কারণে তারা আলাদা সংসার পেতেছিলেন। কারণ তাদের ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে। তাদের পক্ষে দশজনের একজন হয়ে থাকার উপায় নেই। প্রাইভেসী বলে কিছু থাকেনা। তাই বলে তারা বাড়ী ছেড়েও যান নি। বাবার এত বড় বাড়ী থাকতে বাইরে ভাড়া দিয়ে থাকাটা মুর্খতা ভেবেই তারা ঘাপটি মেরে এই পুরোনো বাড়িতেই দিন গুজরান করে চলেছেন। বড় দুজনেই নিজেদের মত দুটো করে রুম বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছেন। পরশের সেজভাই আর আম্মা দুই রুম ভাগাভাগি করে থাকেন। পরশের রুম বরাবরই আলাদা। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত বলে তাকে গোড়া থেকেই আলাদা রুম করে দেয়া হয়েছে। বিয়ে উপলক্ষে সেই রুমের ভেতর একটা এটাচ বাথরুম কেবল বানিয়ে নিতে হয়েছে । পরশের ঘর লাগোয়া ড্রইংরুমটা পরশ আর সেজভাই কমনলি ব্যবহার করবে বলে ঠিক হয়েছে। তবে পুরো বাড়ীতে রান্নাঘর একটাই। রান্নাঘরটা বেশ বড়সড় বলে সবার একটা করে মিটসেফ রাখার সুযোগ আছে এখানে। ব্যক্তিগত ভাবে দুই ভাইয়েরই ঘরে ইলেকট্রিক চুলা আছে কিন্তু ইলেকট্রিসিটি খরচ বাঁচানোর জন্য তার ব্যবহার প্রায় হয়না বললেই চলে। তিন বউ এখানেই ঠেলাঠেলি করে রাঁধে। এখন পর্যন্ত সব এভাবেই চলছে। পরশের বিয়ের পর কী হবে সে নিয়ে এখনও তেমন আলোচনা ওঠেনি। পরশ অবশ্য এ নিয়ে মনে মনে খানিক চিন্তিত।
মেঘা শিক্ষিত মেয়ে। তার উপর চাকুরীজীবি। সে পারবে তো তার অশিক্ষিত মা আর অর্ধশিক্ষিত ভাবিদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে। ঝগড়া বাঁধিয়ে দেবে না তো। এক অজানা অস্বস্তি রয়েই গেছে পরশের মনে। দুজনের ভালবাসাবাসির দিনগুলিতে বাড়ীর এসব অসঙ্গতি তুলে ধরতে চেয়েছিল পরশ। কিন্তু মেঘার আগ্রহের অভাবে আলোচনা গতি পায়নি। তার মতে, যখন বউ হয়ে যাব তখন দেখা যাবে। আমি মেয়ে হিসেবে যথেষ্ট মিশুক। তোমার চিন্তার কোন কারণ নেই। তাছাড়া সারাদিন তো অফিসেই থাকব। দিনের বাকি কয়েক ঘন্টা সময় কাটানো কোন সমস্যা না। তুমি আমার পাশে থাকলেই চলবে।” এই ছিল মেঘার ভাষ্য। ফলে আর কথা এগোত না। মেঘার কাছে পরশই যেন পুরো পৃথিবী। সেই মেঘাকে আজ নিজের পৃথিবী রাজ্যের রানী করে ঘরে আনতে যাচ্ছে পরশ। অনির্বচনীয় একটা অনুভূতি বারবার গ্রাস করছে পরশকে।
কোনোরকম ঝামেলা ছাড়াই বিয়েটা হয়ে গেল। পরশের বাবা নেই তাই ভাইয়েরাই সব। তারা হাসিমুখেই সমস্ত কাজ সমাধা করল। যদিও পরশের আড়ালে তারা মেঘার বড় ভাই আর বাবাকে নানাভাবে অপমান করতে ছাড়েনি। কিন্তু মেঘার বাবা সেটা সযত্নে চেপে গেছেন। পরশ বা তার মেয়ের কান পর্যন্ত পৌঁছুতে দেন নি। মেঘার বাবা তার ছেলেকেও হাতজোড় করে থামিয়ে দিয়েছেন। মনের কষ্ট মনে চেপে মেয়ে বিদায় দিয়েছেন তিনি। নতুন আত্মীয়দের সাথে ঝামেলা বাড়াতে চাননি।
মেঘা আসার পর সবকিছু অন্যরকম হয়ে গেল পরশের। ভাবিদের উদ্দেশ্য প্রণোদিত টিটকারী আর খোঁচা আজকাল ওর গায়েই লাগেনা। পারলে হাসতে হাসতে নিজেও দুটো শুনিয়ে দেয়। ভাবিরা বলতে শুরু করেন, ” পরশ ভাই আগে ছিল বোকা এখন হইসে বুদ্ধিমান।”
-” বুদ্ধিদাতা জুটসে যে একখান। ” সেজভাবি পাশ থেকে টিপ্পনী কাটে।
পরশ জবাব দেয়না। বরং মেঘার নির্মেঘ দিনের রৌদ্রালোকিত হাসি পরশের মনের মেঘ পুরোপুরিই কাটিয়ে দেয়। যদিও মনের মধ্যে কাঁটার মত বিঁধে ভাবিদের ঠাট্টা নামক খোঁচা গুলো। এরা মেঘাদের বাড়ী থেকে দেয়া প্রতিটা জিনিস নিয়ে নাক সিঁটকায়। যেন কিছু বলা চাই কিন্তু মেঘা বরাবরের মতই নির্বিকার। পরশ ভাবছিল, এভাবে কতদিন তারা এক বাড়িতে টিকতে পারবে। মেঘা যতই বদান্যতা দেখাক। নিশ্চিত দুদিনেই হাঁপিয়ে উঠবে সে। কিন্তু তেমনটা হয়নি। কোনরকম বিতন্ডা ছাড়াই পরশ তার প্রথম বিবাহ বার্ষিকী পার করল সফলতার সাথে। তবে সফলতা আকাশ ছুঁলো যেদিন জানতে পারল সে বাবা হতে চলেছে। চোখের আনন্দাশ্রু সেদিন পদ্মা মেঘনার মোহনার চেয়ে কোন অংশে কম ছিলনা। সবাইকে মিষ্টি মুখ করাল পরশ। এ নিয়েও একদফা মুখরোচক ঠাট্টা চলল। পরশ গা করল না। ওর কেবলি মনে হতে লাগল, মেঘা সত্যিই বড় ভাল মেয়ে। এদের সাথে কেমন করে যে দিনগুলো কাটিয়ে দিচ্ছে আল্লাহই জানেন। কোন নালিশই পরশের কান পর্যন্ত আসতে দেয় না মেয়েটা। এমনকি তার চির মুখরা মা পর্যন্ত আজকাল আড়ালে আবডালে মেঘার প্রশংসা করেন যেটা তার নীতিবিরুদ্ধ। তার মতে, বউ ঝি’দের প্রশংসা করে তাদের নাকি মাথায় উঠাতে নেই। এমনটিই তার নীতি। বড় তিনটা নাকি তার ভুলেই মাথায় উঠেছে। সেই আম্মা আজকাল তার হিসাবের খাতা নিয়ে গোপনে মেঘার সাথে বৈঠক করেন। বাড়ীর সবাই ঘুমিয়ে পড়লে তিনি তার ব্লাউজের ভেতর হিসাবের খাতা লুকিয়ে পরশের ঘরে আসেন। উদ্দেশ্য বড় দুই ছেলের খরচের খতিয়ান বের করা। তিনি মূর্খ মানুষ। বাড়ী ভাড়ার টাকা পয়সা সব তাদের হাতে। ইচ্ছেমত খরচ করে উল্টাপাল্টা ভাউচার বানায়। মেঘার কারণে সেসব আজকাল ধরতে পারছেন তিনি। তবে অবশ্যই মেঘার নাম বলেন না। অন্যভাবে সমাধান করেন। বড় নাতিকে ডেকে মিটার দেখান। তারপর ইউনিট প্রতি গড় হিসাবে টোটাল বের করে নাতির মাধ্যমেই বড় ছেলেকে ধরেন, ” কী রে কামাইল্লা। বিল আইসে সাড়ে তিন হাজার ট্যাকার। তুই আমার থেকা বিলের কথা বইলা পাঁচ হাজার নিলি ক্যান? ”
-” আরো খরচ আছে না। বারেবারে নিব নাকি ? ”
-” যখন যা খরচ হয় চায়া নিবি। এহন বাকি টাকা দে।” বড় ছেলে তখন আমতা আমতা করে বাকী পনেরশ টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হয়।
পরশ বোঝে মেঘার সততা তার মায়ের আত্মতৃপ্তির প্রধান কারণ। মেঘার নিরলস ধৈর্য আর সৎ পরামর্শের কারণে আজকাল কোহিনুর বেগমের টাকা পয়সা নয় ছয় হওয়া থেকে বেঁচে যাচ্ছে এই খুশিতেই তিনি আটখানা। কিন্তু পরশের মন বলে অন্য কথা। এতে করে ভাইয়া ভাবিদের সন্দেহের তীর মেঘার দিকেই যাচ্ছে। কেবল পরশের ভয়ে সেভাবে কিছু বলার সাহস পায়না। তারপরেও কথা থেকে যায়। মায়ের এখন বয়স হয়েছে। বাবা মারা যাবার পর থেকে সংসার অর্ধেকের বেশীই তিনি বড় দুই ভাইয়ের হাতে দিয়ে ফেলেছেন। সেজভাই আক্ষরিক অর্থেই ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা। বড় দুই ভাইয়ের তাবেদারী করে টু পাইস কামায়। তার ব্যবসা তো চিরকালই মন্দা। ফলে তিন বউয়ের জোটকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। তারপরেও মায়ের মধ্যে এক ধরণের আত্মতৃপ্তি কাজ করে। তিনি নিজেকে সর্বেসর্বা ভেবে তৃপ্তি পান। বেচারীর এই ভাবনায়ও ফাটল ধরল একদিন।
অফিসের ঈদ বোনাস পেয়েই সেবার মেঘা শাড়ী জুতা কিনে আনল শ্বাশুড়ীর জন্য। অনাকাঙ্খিত ভাবে উপহার পেয়ে কোহিনুর বেগমর ফোকলা দাঁতেও শাওয়াল মাসের ঈদের চাঁদের মত হাসি ফুটে উঠেছিল। মাথা নেড়ে কেবল জানাতেই যাচ্ছিলেন শাড়ী আর জুতার পছন্দের খবর। ঠিক তখনই বড় বউমার চিল চিৎকার শুরু হলো, ” কী ব্যপার আম্মা ? আজ যে বড় বত্রিশ দাঁত বের করে হাসছেন ? আমার বাপের বাড়ী থেকেও তো এরকম চওড়া পাড়ের শাড়ী দিয়েছিল আপনাকে। কই, সেদিন তো শাড়ীটা পছন্দ না বলে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আমার বাবা কত কষ্ট করে লোক দিয়ে ইন্ডিয়া থেকে শাড়িটা আনিয়েছিলেন। তখন তো আপনি কত কাহিনী করেছিলেন। না, জরিপাড়ের কাপড় আমি পরিনা।” সুরমা শ্বাশুড়ীর স্বর নকল করে বলতে লাগল।
আর এখন ? এখন কী ? আর এই জুতাও তো রবাবের। এইটা তো পিওর লেদার না। কী রে মেজ ? গেলবার যে মেজ ভাই ভুল করে রবারের জুতা আনল তখন আম্মা কী করেছিল মনে আছে ? জুতাটা নিয়ে বুয়ার মেয়েকে দিয়ে দিসিল। আর এখন ছোট বউমার কাপড় জুতা পেয়ে আম্মা তো এমন ভাব করছে যেন সাত জনমে কেউ তাকে কাপড় কিনে দেয়নি।”
কোহিনুর বেগম বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইলেন। সুরমা তবু ছাড়ল না। সে আগের মতই গজগজ করে বলতে লাগল, ” ঠিক আছে। আপনি এসব নিলে নেন। আমাদের কোন সমস্যা নাই। খালি জবাব দেন যে আমাদের গুলো কেন নেন নাই। আমরা কী আপনার শত্রু ? ” শেষ পর্যন্ত মেঘাকেই ঘাট মানতে হল। সে স্বীকার করল যে না জেনে জিনিসগুলো কেনা তার উচিত হয় নাই।
পরশ বাড়ী ছিল না। রাতে বাড়ী ফেরার পর জামা জুতাগুলো টেবিলের উপর পরে থাকতে দেখে বলল, ” কী ব্যপার। এগুলো এখনও দাওনি ? এই শরীর নিয়ে তিন মার্কেট ঘুরে অস্থির হয়ে এসব কিনলে আর এখনও দিলেনা ? ”
-” দেব তো। ” আরক্ত মুখে বলল মেঘা। ” কাপড়টা তো চওড়া পারের। এটা বদলে একটা চিকন পারের শাড়ী আনতে হবে আর জুতাটা আনতে হবে লেদারের। ”
-” আম্মা কিছু বলেছে নাকি এটা নিয়ে ? ” পরশ মেঘার মুখে কিছু খোঁজার চেষ্টা করল। কিন্তু বরাবরের মত এবারও ব্যর্থ মনোরথ হতে হল ওকে। মন বলছে কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু এই মেয়ে এমন যে বোম মারলেও বাড়ীর ঘটে যাওয়া কথাগুলো বলবে না। এতে নাকি গীবত হয়। আজব এক মেয়ে কপালে জুটেছে তার।
এর কিছুদিন পরেই ঘটল আরেক ঘটনা। কোহিনুরের নির্দেশেই পরিচিত এক মিস্ত্রী এসে রান্নাঘরে এগজষ্ট ফ্যান লাগিয়ে দিয়ে গেল। সুরমা মহুয়া আর মেজবউ তৃণা থমথমে মুখে পুরো ব্যপারটা দেখলেও তাৎক্ষণিকভাবে কিছু বলল না। বরং কোহিনুর নিজেই কৈফিয়তের সুরে বললেন, ” বুঝলা বড় বৌমা। মেঘাটা তো দোজবরে। রান্না করার সময় বেচারীরে যেভাবে ঘামতে দেখলাম তাতে ঠান্ডা না লাগায় ফালায়। তাই ফ্যান একটা লাগায়াই নিলাম। এটা আমাগো সবারই কাজে আসব। কী কও ? ”
সুরমা কোন জবাব দিলনা একথার। সে ভাল করেই জানে মেঘা এখন নয় মাসের গর্ভবতী। আজকাল সে ম্যাটারনিটি লিভে বাড়ীতেই থাকছে। ফলে রান্নাবান্না সহ নিজের বিভিন্ন প্রয়োজনে তাকে বারবারই রান্নাঘরে যেতে হচ্ছে। আর খুব স্বাভাবিক ভাবেই সে ঘেমে নেয়ে বেরোচ্ছে। তাই দেখে শ্বাশুড়ী আম্মার দরদ যে একেবারে উথলে পড়ছে সেটাও তার অজানা নয়। প্রচন্ড রাগ হলেও সুরমা রাতের অপেক্ষা করতে লাগল।
রাতে সবাই বাড়ি ফিরলে মিটিং বসল। পরশকেও ডাকা হল সেই মিটিং এ। পরশের ইচ্ছে ছিলনা সারাদিন পর এসব ঝামেলায় বসতে কিন্তু উপায় কী। মামলার প্রধান আসামীই যখন আম্মা আর দুই নম্বর আসামী তার স্ত্রী মেঘা। সেক্ষেত্রে তার উপর সমনজারী হলে তো যেতে হবেই। তাছাড়া আজকাল বাড়ীর ছোট বড় সব রকমের সিদ্ধান্ত বড় ভাইয়ার মাধ্যমেই আসে। আম্মা যতই চিৎকার চেঁচামেচি করেন না কেন তাকে যে বিশেষ গোণায় ধরা হয়না এটা আম্মাও বোঝেন। তবু লুপ্ত ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখা আর কী। আম্মা এখন নামেই এ বাড়ীর কর্ত্রী। আসল কর্তা এখন বড় ভাইয়া আর তার উপদেষ্টা মেজভাই। কাজেই কর্তার ইচ্ছাতেই কর্ম। পরশকে বসতে হল। তার পেছনে বসল মেঘা। বেচারীর চেহারায় স্পষ্ট উদ্বেগ।
বিচারের সভাপতি হিসেবে পরশের বড় ভাই কামাল তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শুরু করল অনেকটা প্রশ্ন করার ভঙ্গিতে।
” তোমরা কী সবাই জানো যে, আম্মা আজকে রান্নাঘরে এগজস্ট ফ্যান লাগাইছে ? ”
-” হ্যাঁ, জানি। জানব না কেন ? ” মেজবৌ জবাব দিলে বড় ভাসুর কামাল হাত দেখিয়ে তাকে থামাল। বলল, ” আম্মা ফ্যান লাগাইছে সেটা সমস্যা না। সমস্যা হল, এক পরিবারে দুই রকম নীতি পোষণ করা। ” বলেই কামাল সরাসরি কোহিনুর বেগমকে চার্জ করল।
-” আম্মা, আপনারে আমি জিজ্ঞেস করি। আপনার তিন বউ তো এই চুলাতেই রান্না করে করে তাদের সংসার জীবন পার করল তাই না ? তখন তো আব্বাও বেঁচে ছিল আর আপনার গাঁটের জোরও বেশ ভালই ছিল। কই তখন তো কোনদিন আপনারে দেখিনাই এগজস্ট ফ্যান লাগাইতে ? তাহলে আজকে আপনারে আব্বার পেনশনের টাকা দিয়া ছোট বৌমার জন্য ফ্যান লাগানোর বুদ্ধি কে দিল একটু শুনি ! ”
বড় ছেলে আর তার তেড়িয়া বউকে বাস্তবিকই ভয় করেন কোহিনুর। কারণ তাদের জিহ্বার ধার যেমন সুতীক্ষ তেমনই বউজামাই দুটোই বেয়াদবের হদ্দ। কোহিনুর বুঝতে পারছেন এরা সহজে এটা ছাড়বে না তাই তিনি আগপিছ না ভেবেই তড়িঘড়ি করে বলে বসলেন।
-” আরে, এই ট্যাকা তো আমারে পরইশ্যা দিছে।” বলেই সংকীর্ণ হয়ে গেলেন কোহিনুর। পুরো রুম জুড়ে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে। পরশ বোকার মত মায়ের দিকে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করতে লাগল। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল সে। কারণ এ মুহূর্তে মায়ের কথার প্রতিবাদ করা মানে তাকে সবার সামনে অপদস্থ করা। বাধ্য হয়েই তাকে চেপে যেতে হল। মেঘাও অজান্তেই ওর শার্টের কোণ টেনে ধরেছে। অর্থাৎ সেও চায়না মা’কে আরেকদফা নাকানি চুবানি খাওয়ানো হোক ভাইয়া ভাবিদের হাতে। এরা আজ তুলোধূনো করে ছাড়বে মা’কে ।
পরশকে নিরব দেখে মেজ ভাই বলে উঠল, ” কী রে, তুই কি এগজস্ট ফ্যান লাগানোর আগে ভাইয়ার অনুমতি নিয়েছিলি। নাকি বাড়ীর মধ্যে তুইই হেডম হয়ে গেছিস। যে কোন সিদ্ধান্ত একাই নেস। ”
পরশ এবার আর মিনমিন করার প্রয়োজন মনে করল না। শান্ত অথচ স্পষ্টস্বরে বলে উঠল, ” আমার বউয়ের ভাল মন্দ দেখার অধিকার আমার আছে। আর আমার বউয়ের জন্য কিছু করতে হলে আমি বড়জোর আম্মার সাথে পরামর্শ করব। সারাবাড়ির সঙ্গে পরামর্শ করব না। বাড়ি কারো একার না। আমার কারো অনুমতির প্রয়োজন নেই। ”
-” বাব্বাহ্, আজ এক বছরেই যে বউয়ের ভালমন্দ বুঝতে শিখে গেছিস ? এতদিন তবে আমাদের বউরা রাঁধল বাড়ল কিভাবে ? কই, আমরা তো কোনদিন আব্বার উপরে কথা বলিনাই।”
-” বলো নাই কারণ তোমরা আব্বার টাকায় নিজেদের সংসার চালাইসো কিন্তু আমি সংসার চালাই নিজের টাকায়। আমি কাউকে জমা খরচ দেব না।” এ পর্যন্ত বলতেই তুমুল হুলুস্থুল বেঁধে গেল ড্রইংরুমে।
সেজভাবি চেঁচাতে শুরু করলেন, ” ভালই তো পরশ ভাই। এক বছরেই বউ এতকথা শিখিয়ে দিল আপনাকে ? শোনেন, আমাদের স্বামীরা আব্বার টাকায় যেমন চলেছে তেমন আমরাও এই ঘরে বাঁদি খেটে মরেছি। আপনার বউ এর মত চেয়ার টেবিলে বসে বসে সংসার করিনি। আর আজ যে বড় বউ বউ করছেন। নিজের মায়ের জন্যেও তো এগজস্ট ফ্যান লাগান নি কোনদিন। না কি মায়ের ঘামটা আপনার চোখে পড়েনি ? ”
বরাবরের মত কোহিনুর বেগম এবারও কাঁদতে শুরু করলেন। পরশের অসহ্য বোধ হল একপর্যায়ে। সে মেঘার হাত ধরে টেনে ঘরে এনে বলল, ” এ্যাই কাপড় গোছাও তো। থাকব না আর এখানে। আর এক মুহূর্ত না। যে বাড়িতে এত পলিটিক্স হয়, সেখানে কেউ স্বস্তিতে বাঁচতে পারে না।”
-” হুট করে কোথায় যাব ? ” মেঘাও কাঁদছে। সামান্য একটা ব্যপার যে এতদুর গড়াবে সে ভাবেনি। তাহলে আম্মাকে সে অবশ্যই নিষেধ করত।
-” আপাতত সরাসরি তোমাদের বাড়ীতে উঠব। তারপর এ মাসে একটা ঘর ঠিক করে সেখানে গিয়ে উঠব। তবু আর এক মুহূর্ত এ বাড়ীতে না।” বলতে বলতেই মা’কে দেখে থেমে গেল পরশ। মেঘাও সচকিত হল। কোহিনুর বেগম কেঁদে ফেললেন,
-” আমারে একলা ফালাইয়া তুই চইলা যাবি বাবা ? সব দোষ তো আমার। ফ্যানটা তো আমিই লাগাইসিলাম। মেঘায় সারাদিন এসিতে থাকে। ও পাকের ঘরে ঢুকলে ওর কাপড় চোপড় সব ভিজা যায়। এমনে তো অর ঠান্ডা লাগব। এর জন্যই আমি…!”
-” সবই বুঝলাম মা। কিন্তু যে কাজ তুমি তাদের জন্য করোনাই সেটা মেঘার জন্য করার কী দরকার ছিল বলো তো। তোমার তিন ছেলের হিংসা তো আকাশ ছোঁয়া। এদের সাথে এক বাড়ীতে থাকা কতটা যে কঠিন তা তো তুমি দেখছই। এক কাজ করো, তুমিও নাহয় চল আমার সাথে। সমস্যা কী ! ”
-” না রে বাবা। আমি আমার স্বামীর ভিটা ছাইড়া কোনখানে যামুনা। আমার আরো তিন ঘরের নাতি নাতনী আছে। সবাইরে ফালাইয়া আমি কেমনে যাই বাবা। তুই আমারে এতবড় বিপদে ফেলাইসনা বাপ। আমারে ফালায়া যাইসনা। আমার ছোট নাতিটারে আমার কাছ থেকা সরায়া নিস না। ও তো এখনও দুনিয়াতেই আসে নাই। ও দুনিয়াতে আসনের আগেই আমারে পর করিস না বাবা। ” মায়ের কান্না দেখে অবশেষে পরশকে থামতেই হল।
এরপর থেকে কমপ্রোমাইজ নামের শব্দটা হয়ে গেল পরশ আর মেঘার নিত্যসাথী। এভাবে দিনগুলি একেবারে মন্দ কাটছিল না। এরই মধ্যে ওদের সকল দুঃখ ক্লেশ ভুলিয়ে দিতেই যেন আগমন ঘটল এক নবজাতকের। মেঘা নিজেই ওর ছেলের নাম রাখল। পরশের ছেলে আরশ। কোহিনুরের ভালোবাসার ঝুলিতে আরেকটা নাম। অখন্ড অবসর ভেঙ্গে ব্যস্ততা নতুন করে ঘিরে ধরল কোহিনুর বেগমকে। আজকাল আরশকে নিয়েই তার দিন কাটে।
এরই মধ্যে হঠাৎ এক দুর্ঘটনা ঘটে গেল। অফিসে বসেই বাবার মৃত্যু সংবাদ পেল মেঘা। মনটা ভয়ংকর রকমের খারাপ হয়ে গেল ওর। মাথার উপর যাওবা একজন ছিল সেও আজ চলে গেল। দ্রুত ছুটি নিয়ে বেরুল অফিস থেকে। পরশের নম্বরে ফোন দিল তাকে জানানোর জন্য। কিন্তু ওর লাইন বিজি দেখাচ্ছে। সংবাদটা পরশকে জানানো দরকার। সেল ফোনে ওকে না পেয়ে সরাসরি ওর অফিসে জানিয়ে দিল সংবাদটা। তারপরই বাসার উদ্দেশ্য রওনা দিল মেঘা। তখনও জানত না মাথার উপর ছাদের পাশাপাশি ওর পায়ের নিচে মাটিটাও আজ সরে যাবে। যখন পরশের একসিডেন্টের খবর এল তখনও মেঘা অনবরত পরশের ফোনে ট্রাই করেই যাচ্ছে। পরে যখন ওকে জানানো হল দ্রুত রাস্তা পার হতে গিয়ে পরশ গাড়ীচাপা পড়েছে তখন মেঘা পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে গেল। যেন চলৎশক্তি রহিত হয়ে গেল তার । কোহিনুর বেগম ভেবে পেলেন না আদরের ছোট বৌমাকে কিভাবে সামলাবেন।
দিনগুলি এখনও মনে করতে পারে মেঘা। শ্বাসকষ্টের রুগীদের মত দম বন্ধ করা একটা জীবন। মনে হত কোথায় গেলে একটু বুক ভরে শ্বাস নিতে পারা যাবে। তারপর একটা সময় স্বল্পমাত্রার অক্সিজেনেই বাঁচতে শিখে গেছে। আসলে জীবন কারো জন্য থেমে থাকেনা। মেঘার জন্যেও থাকেনি। পরশ নেই আর এই সত্যিটাকে মেনে নিয়েই জীবনের দ্বিতীয় পর্বে পা রাখতে হয়েছিল মেঘাকে। যদিও দ্বিতীয় পর্বের শুরুটা খুব একটা সুন্দর আর সম্মানজনক হয়নি। তারপরেও কোহিনূর বেগমের জরাজীর্ণ হাতের আড়াল নধর স্বাস্থ্যবতী মেঘাকে প্রানপণে আগলে রাখতে চেষ্টা করছিল।
জাগতিক প্রয়োজন কখনও ছুটি নেয়না। মেঘার বেলায়ও নেয়নি। প্রয়োজনের কাছে হার মেনে শেষপর্যন্ত ছুটিকেই ছুটি দিতে হয়েছিলো মেঘার। ফের অফিস যেতে শুরু করল সে। আরশকে নিয়ে সামান্য একটু ভয় ছিল। সেই ভয় দুর করে দিলেন কোহিনুর বেগম। ফলে ছেলেকে তারই মত আরেকজন মমতাময়ীর কোলে তুলে দিতে পেরে মেঘাও স্বস্তি নিয়ে অফিস যেতে পারছিল। আরশকে নিয়ে আর কোন চিন্তাই করতে হয় না ওর। কোহিনুর বেগমের জানপ্রাণ সবটাই এখন আরশের জন্য। এ নিয়ে বাকি বউদের টীকা টিপ্পনী কানেই তোলেন না তিনি। যদিও তাদের দিনের অধিকাংশ সময়ই কাটে নিজেদের সন্তানদের সাথে আরশের আদরের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে। তবে স্বস্তি বেশিদিন মিতালী ধরে রাখতে পারল না মেঘার সাথে। আজকাল স্বস্তির সাথে নতুন শত্রুতা শুরু হয়েছে।
অফিস থেকে ফিরে এক বালতি কাপড় ধুতে হয়েছে মেঘাকে। ছুটা বুয়াটা গত দু’দিন ধরেই কাজে আসছেনা। এদিকে কাপড় জমে গেছে একগাদা। ফলে মেঘাকেই এগুলো ধোবার উদ্যোগ নিতে হল। কাপড়গুলো ধুয়ে ছাদে নিয়ে নিজেই মেলে দিয়ে এল। ভেজা কাপড়ে ঘরে ঢুকতে গিয়ে টের পেল ওর বাথরুমের দরজা বন্ধ। কিছুটা অবাক হলেও অপেক্ষা করল সে। সাধারণত ওর বাথরুমে কেউ যায়না। কারণ সবারই আলাদা বাথরুম আছে। হয়ত আম্মা গিয়েছেন। কারণ ওর ঘরে অবাধ যাতায়াত একমাত্র আম্মার। আরশ এখন ঘুমুচ্ছে। আম্মাই হবেন।
অপেক্ষা করতে গিয়ে বিরক্তি ধরে গেল মেঘার। গায়ের ভেজা কাপড় গায়েই শুকাচ্ছে। এমন সময় আম্মাকে ঘরে ঢুকতে দেখে যারপরনাই চমকে উঠল মেঘা। অজান্তেই বলে উঠল, ” ওমা, আপনি এখানে তো বাথরুমে কে ? ”
কোহিনুর বেগম জবাব দেবার আগেই বাথরুম থেকে যে বেরিয়ে এল তাকে এই মুহূর্তে এখানে আশা করেনি মেঘা। দ্রুত কোমড়ে গোঁজা আঁচলটা টেনে আগে নিজেকে আব্রু করল তারপর কাঁপা স্বরে বলল, ” আ…আপনি কখন এলেন ? মানে আমার বাথরুমে? ” না বলে পারল না। লোকটাকে এর আগে একবারই দেখেছে মেঘা। বড়ভাবির ছেলের এসএসসির রেজাল্টের দিন। সম্ভবত বড়ভাবীর ছোট ভাই। যদিও নামটা মনে নেই। কিন্তু অভদ্রের মত না বলে তার রুমে ঢুকে রীতিমত গোসল করাটা বাড়াবাড়ি মনে হল মেঘার কাছে। তবে ছেলেটা নিজেও কম হতভম্ব না। চুল থেকে টাওয়েল সরিয়ে অপরাধীর সুরে বলে উঠল, ” আমি খুবই দুঃখিত ভাবি। আমি জানতাম না এটা আপনার বাথরুম। আমাকে তো বড়আপা বলল এখানে গোসল করতে। আমি ঢাকার বাইরে থেকে সরাসরি আপার এখানে এসেছি তাই…! ইয়ে আমি খুবই দুঃখিত। ” লজ্জিত স্বরে কথাগুলো বলেই ছেলেটা দ্রুত বেরিয়ে গেল। মেঘার অস্বস্তি তখনও কাটছিল না।
বিব্রত স্বরে নালিশের ভঙ্গিতে শ্বশুড়ীকে কিছু বলতেই যাচ্ছিল সে। তার আগেই কোহিনুর বেগম বাঁকা চাহনীতে বলে উঠলেন, ” এই ছেমড়া তোমার ঘরে ক্যান বউমা ? ”
শ্বাশুড়ীর প্রশ্ন শুনে মেঘা রীতিমত বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। মাত্রই সে বলতে যাচ্ছিল যেন আর কাউকে তার রুমে এভাবে পাঠানো না হয়। সেখানে এমনতর প্রশ্নের কী জবাব দেবে সে। অপমানে লজ্জায় মেঘার মুখ লাল হয়ে এল। তাৎক্ষণিকভাবে কোন উত্তর মুখে যোগাল না ওর। তবু কোনমতে উচ্চারণ করল, ” আমি নিজেই তো আপনাকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম আম্মা। যে ছেলেটা এখানে কেন ? আমি তো জানিই না যে ও এখানে।”
-” তুমি জানো না আর একটা ধামড়া পোলা আইসা গুসুলও কইরা ফালাইল ?”
-” আপনি কী বলতে চাচ্ছেন আম্মা। আমি গিয়ে তাকে ডেকে এনেছি ? ” রাগে দুঃখে যা মুখে আসে বলে বসল মেঘা। শ্বাশুড়ীর চোখে সন্দেহের ঘনঘটা।
চলবে….