স্মৃতিতে তোমার বন্দনা পর্ব ১১

#স্মৃতিতে_তোমার_বন্দনা
#পর্ব_১১
#Saji_Afroz
.
.
সোফার উপরে হেলান দিয়ে বসে গল্পের বই পড়ার চেষ্টা করছে ছোঁয়া । অবসর সময়ে বই পড়তে ভালোবাসে সে । এতে করে একাকী সময়টাও কেটে যায় তাএ । তাই আজও বই নিয়ে বসেছে সে । কিন্তু কেনো যেনো আজ পড়তে তার একদমই ইচ্ছে করছেনা ৷ প্রেমের কাহিনী পড়ে তার মনের ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করতে শুরু করলো । কেনো এমন করছে এটা তার অজানা নয় । ইদানীং এসব কাহিনী পড়লে হিংসে হয় তার । একটা সময় সে বিরক্তিতে বইটি সোফার এক পাশে ছুড়ে মারলো ।
নয়নতারা এতোক্ষণ যাবৎ ছোঁয়ার কর্মকান্ড লক্ষ্য করছিলো ।
সে জিজ্ঞাসা করলো-
কি হয়েছে?
-কিছুনা ।
-আমাকে বল?
-বলে কি হবে? আগেও বলে লাভ হয়েছিলো কি?
.
থেমে গেলো নয়নতারা । এখন কিছু জিজ্ঞাসা না করাটাই উত্তম মনে করলো সে ।
এমন সময় পাশের বাসার মধ্যবয়সী মহিলা জহুরা খাতুন এসে বললেন-
কিরে নয়নতারা? কোনো কাজ পেলিনা?
-না আন্টি ।
-তা সংসার চলছে কেমনে?
-যা জমানো ছিলো তা দিয়ে আপাতত চলছি ।
-আমার কাছে লুকোতে হবেনা । হবু শ্বশুড় বাড়ি থেকে চালাচ্ছে বল ।
-এমন কিছুনা ।
-এমন কিছুনা! কেনো?
-বিয়ের আগেই সমস্ত দায়িত্ব ওদের ঘাড়ে চাপাতে পারিনা ।
-তাহলে কিছুতো করা উচিত । আমার জানামতে জমা-জাটি বেশিতো নেই তোর । এভাবে চললে পরপুরুষের কাছে শরীর এলানো ছাড়া উপায় থাকবেনা ।
.
ছোঁয়া রাগে কটমট করে বললো-
এসব কি বলছেন আপনি?
-আরে আমি কথার কথা বললাম । তা নয়ন একটা কাজের কথা বলতে পারি । করবি?
-কি কাজ?
-গামেন্টস এ কাজ করবি? তোরাই বলিস, ছোট-বড় সব কাজই সম্মানের ।
.
কিছুক্ষণ ভেবে নয়নতারা বললো-
মন্দ বলেননি আপনি!
.
ছোঁয়া বললো-
এসব কি বলছো তুমি আপু? আমি মানলাম সৎ পথে সব কাজই সম্মানের । তবে এতে তোমার ক্ষতি হতে পারে । হবু শ্বশুড় বাড়ির কথা ভাবো । উনারা কখনো এসব মেনে নিবেনা । সবার মাইন্ড এক না ।
.
জহুরা খাতুন বললেন-
ছোঁয়ার কথা শুনলে তোদের না খেয়ে মরতে হবে । কাজ করতে চায়লে আমাকে বলিস । আমি ব্যবস্থা করে দিবো সব । স্থায়ী কাজ, ভালো বেতন পাবি । আর কি চায়? তুই সিদ্ধান্ত নে । আমি গেলাম ।
.
জহুরা খাতুন চলে যেতেই নয়নতারা বললো-
সমস্যা কি ছোঁয়া? সে না আসা অবধি বিয়েটা আমি করতে পারছিনা । বিয়ের আগে তাদের কাছে সাহায্যও চাইতে পারছিনা,
সংসার তো চালাতে হবে?
আমি এটা করবো ।
-একান্তই যদি করতে হয় তবে আমি করবো । তোমার সামনে বিয়ে ।
-বিয়ে কি তোর হবেনা?
-তুমি বড় বোন আমার । আমার না হলেও সমস্যা নেই ।
-তুই ছোট বোন আমার । আমি আমার পড়াশোনা শেষ করতে পারিনি । তুই করবি ৷ আমি চাইনা তোর পড়াশোনায় কোনো ধরনের ক্ষতি হোক । আর কাজটা আমি করবোই । এটাই আমার শেষ সিদ্ধান্ত ।
.
ছোঁয়া রাগান্বিত হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো । এলোপাতাড়ি হাঁটতে লাগলো সে । এভাবে হাঁটলে যেনো রাগ কিছুটা হলেও কমে!
এমন সময় কিছু ছেলে তাকে দেখে হেসে উঠলো । ছোঁয়া দাঁড়িয়ে হাসার কারণ জিজ্ঞেস করাতে একজন বললো –
শুনলাম তোমার আপা এখন বেকার । হবু বর কোথায়? টাকা দেয়না? আমরা কি ফোন করে রিকুয়েষ্ট করবো? নাহলে চলবে কিভাবে তোমরা?
.
চুপ করে থাকার মেয়ে ছোঁয়া নয়। কিন্তু এখন তার কথা বলতে মোটেও ইচ্ছে করছেনা । তাই হনহনিয়ে বাসায় ফিরে এসে চেঁচিয়ে বললো সে-
এই রাফসানের জন্যই এতো কথা শুনতে হচ্ছে আমার ।
.
আফিয়া জান্নাত বললেন-
প্রথমবার ছেলেটাকে ভাই ডাকা ছাড়া কথা বললি তাও আবার এতো রাগ নিয়ে! কি হলো?
-কতো টাকা দিয়েছে সে? যার জন্য বাইরের লোকেদের কাছেও আমাদের কথা শুনতে হবে! সে না থাকলে কি মরে যেতাম আমরা?
-আমি জানি ওর উপর তোর রাগ । তাই বলে…
-তুমি আসলেই জানো? যদি জানতে আমাকে এতোটা কষ্ট তুমি দিতেনা । ওই রাফসানের জন্যই…
-চুপ! একদম চুপ । ও না থাকলে আমাদের অবস্থা আরো বেশি খারাপ হতো । অকৃতজ্ঞের মতো কথা বলিস না তুই ছোঁয়া ।
-উনি না থাকলেও আমরা ভালোই থাকতাম । বরং আরো বেশি ভালো থাকতাম ।
-আচ্ছা তাই! দেখি কতো ভালো থাকিস । নিজেতো কিছু করার ক্ষমতা নেই । রাফসান আর নয়নের ঘাড়ে বসে গিলেছিস । এখন রাফসানও নেই, না আছে নয়নের চাকরী । দেখি ভালো থেকে দেখা তুই ।
-দেখতে চাও?
-আমাদের সাহায্য ছাড়া গামেন্টর্সের চাকরীও তুই পাবিনা ।
.
নয়নতারা বললো-
মা শান্ত হও । ও বাচ্চামানুষ । রাগের বশে বলে ফেলেছে এসব ।
-বাচ্চামানুষের এতো কিসের রাগ! আমিও দেখবো কতো ভালো থাকে সে । দেখাক দেখি!
.
আবারো বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো ছোঁয়া ।
তার নিজেরি কিছু একটা করতে হবে । মাকে তার প্রমাণ করতেই হবে, মানুষের সাহায্য ছাড়াও ভালো থাকা যায় ।
.
.
গাড়ি চালাতে চালাতে রাস্তার পাশে একটা বড় বট গাছের নিচে পরশ গাড়িটি পার্ক করলো । গাড়ি থেকে বেরিয়ে চারদিকে নজরটা বুলালো । বেশ কয়েকবার জায়গাটিতে এসেছে সে । নিরিবিলি একটা জায়গা । আরেকটু ভেতরে গেকেই কাশবন, যেখানে কাশফুলের ছড়াছড়ি । দুপুরের পরপরই এখানে জোড়ায় জোড়ায় কপোত-কপোতীতে চারপাশ মুখোরিত হয়ে পড়ে । পরশ তার গাড়িতে হেলান দিয়ে আপনমনে বললো-
হায়! ছোঁয়ার সাথে দেখা হলে এতোদিনে আমরাও প্রেমিক প্রেমিকা হয়ে যেতাম!
.
.
নিজের রুমে পায়চারী করছে ছোঁয়া । তার কিছু একটা করতেই হবে, এটিই এখন তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে । কিন্তু করবে তো করবেটা কি? এমন কিছু করতে হবে, যেটায় তার পড়াশোনারও ক্ষতি হবেনা ও অনেক বেশিই ভালো থাকতে পারবে সে । কিন্তু কি করবে?
কোচিং সেন্টার খুলবে কি? মুহুর্তেই নিজের গালে নিজে চড় বসালো সে । তার কাছে কখনো এতো বাচ্চা পড়তে আসবেনা । তাছাড়া মুখে বললেই একজনের পক্ষে এই উদ্যেগ নেয়া সম্ভব না ।
আবারো পায়চারী শুরু করলো ছোঁয়া ।
এভাবে বেশকিছুক্ষণ কেটে যাবার পর ফোন দিলো সে রুপালিকে ।
-হ্যালো?
-আমি কাজ করতে চাই রুপালি ।
-তো কর!
-উফফ বাসার কাজ না । এমন কোনো কাজ যাতে আমি উপার্জন করতে পারবো । এমন কোনো কাজ, যেটা পেতে বাসার কারো হেল্প নিতে নাহয় ।
-আমার কি অফিস আছে?
-না ।
-বড়বড় দোকান আছে?
-আমি জানি তুই কাজ দিতে পারবিনা । আইডিয়া দিয়ে সাহায্য তো করতে পারবি?
-কিন্তু তুই কেনো…
-এখন কোনো কথা না । কোনো আইডিয়া থাকলে সেটা দে ।
-অভিজ্ঞতা নেই । সময় লাগবে । তুই রাখ । আমি ভেবে বলছি ।
.
.
উঠোনে বসে নখ কাটছিলেন সাফিনা আহম্মেদ ৷ পরশকে বাড়িতে আসতে দেখে বললেন-
আমার চুলটা আঁচড়ে দিবি একটু?
-আমি?
-আমার কি কোনো মেয়ে আছে, যাকে দিয়ে এসব করাবো?
-বুয়াকে বলতে পারো ।
-আরাম পাইনা ওর হাতে ।
-আমারটাতে আরো বেশি পাবেনা ।
-তুই মাথায় শুধু হাত দিলেও আরাম পাই আমি ।
.
মুচকি হেসে ভেতর থেকে তেলের বোতল ও চিরুনি নিয়ে আসলো পরশ ।
মায়ের চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বললো-
ব্যথা পেলে বলিও ।
-তোহাকে নিয়ে আসি । কি বলিস?
-ওর বাবাতো আসেনি এখনো । বিয়ে কিভাবে হবে?
-উহু এমনিতেই! আমার ভালো লাগেনা । ও থাকলে সময় কাটবে । গল্প করবে, চুল আঁচড়ে দিবে, নখ কেটে দিবে, মাথা টিপে দিবে, রান্না করে খাওয়াবে । ব্যস এতোটুকুই…
-অন্যের মেয়ে বিয়ে ছাড়া এভাবে আসবে বলে তোমার মনেহয়?
-তাও ঠিক ।
.
কিছুক্ষণ পর সাফিনা আহম্মেদ বললেন-
হয়েছে । ভেতরে চল ।
-ব্যথা পেয়েছো তাইনা?
-আরেনা । সারাদিন তোকে দিয়ে খাটনি করাবো নাকি!
.
সাফিনা আহম্মেদ উঠতে চায়লে মুখে ‘আহ’ শব্দ করে ধপাস করে বসে পড়লেন আবার ।
পরশ বললো-
কি হয়েছে মা?
-ইদানীং কোমরের ব্যাথাটা আবার বেড়েছে । পায়েও ব্যথা করে । একটু আগেও নিজে তেল দিয়ে মালিশ করে নিলাম ।
-কি বলছো!
-বয়স বাড়ছে তো । এসব স্বাভাবিক ।
-তাহলে তোমার জন্য একজন আয়ার প্রয়োজন । যে তোমার এসব কাজ করবে ।
-কোনো দরকার নেই । আমার একজন বান্ধবী প্রয়োজন । যার সাথে থাকলে এসব ব্যথা আমার অনুভবই হবেনা । আর সে হলো তোর বউ ।
.
.
ছোঁয়ার ফোন বেজে উঠলো । রুপালির ফোন এসেছে । এটারই অপেক্ষায় ছিলো সে ।
রিসিভ করে বললো-
উপায় পেয়েছিস?
-হ্যাঁ । সেই পাগলের ডাক্তারের কথা মনে আছে তোর?
-কে?
-ওইযে আমার ক্রাশ ।
-ওহ! সাইকিয়াট্রিস্ট পরশ আহম্মেদ?
-হ্যাঁ । তুই উনার সাহায্য নিতে পারিস ।
-উনার সাহায্য কেনো নিবো আমি! আমি নিজে কিছু করতে চাই ।
-আরে আমিতো সেটাই বলছি । তুই উনার ওয়ালেট ফিরিয়ে দিয়েছিলি বলে, উনি তোকে যেকোনো সাহায্য লাগলে জানাতে বলেছিলেন । উনি একজন ডাক্তার । হাসপাতালে বিভিন্ন কাজ আছে । তাছাড়া তিনি তোকে অন্য কাজেরও ব্যবস্থা করে দিতে পারেন । মোট কথা চেষ্টা করতে সমস্যা কি?
-হাসপাতালে আমাকে কি কাজ দিবে? ঝাড়ু দিতে বললে?
-না যাওয়ার আগেই বকবক করছিস কেনো তুই? গিয়েতো দেখ । তোর এখন কাজের দরকার । আর পরিবারের কারো সাহায্য ছাড়া কোনো কাজ পেতে এই ছাড়া আর উপায় নেই ।
.
ফোন রেখে ঠান্ডা মাথায় ভাবলো ছোঁয়া । রুপালি ঠিকই বলেছে, একবার চেষ্টা করে দেখতে সমস্যা নেই । ড্রয়ার টেনে কার্ডটা খুঁজতে লাগলো ছোঁয়া । তার মনে পড়লো, সে রুপালিকে কার্ডটি দিয়েছিলো । তাকে ফোন দিয়ে বললো-
সাইকিয়াট্রিস্ট এর কার্ডটি তোর কাছে । ওখান থেকে মোবাইল নাম্বারটি নিয়ে মেসেজে সেন্ড কর আমায় ।
-ইয়ে মানে…
-কি?
-পাগলের ডাক্তারকে পটাতে না পেরে হতাশ হয়ে আমি তার কার্ডটি ছিড়ে ফেলেছিলাম রে!
-কি?
-হু । সিমটাও বন্ধ করে রেখেছিলাম, সেইভ না করার কারণে সিমেও থাকবেনা ।
.
হতাশ হয়ে ছোঁয়া বললো-
এখন কি হবে?
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here