স্মৃতিতে তোমার বন্দনা পর্ব ১৫

#স্মৃতিতে_তোমার_বন্দনা
#পর্ব_১৫
#Saji_Afroz
.
.
সকাল দশটা হতেই ছোঁয়ার ফোন বেজে উঠলো । পরশ ফোন দিয়েছে ।
-হ্যালো?
-ছোঁয়া বলছেন?
-জ্বি ।
-আপনার বাড়ির সামনে গাড়ি এসেছে । উঠে চলে আসুন।
-আচ্ছা ।
.
ছোঁয়া ফোন রেখে চেঁচিয়ে বললো-
কই তোমরা? আমি যাচ্ছি ।
.
নয়নতারা চুলে বেণি করতে করতে বললো-
আমিও যাবো ।
-সত্যি যাবা? আমি ভেবেছি এমনিতে বলেছো ।
.
আফিয়া জান্নাত বললেন-
কেনো যাবিরে নয়ন? প্রথমদিন মেয়েটা কাজে যাচ্ছে । সাথে করে বোন নিয়ে যাবে । কেমন দেখায় না?
-তোমার মেয়ে কোথায় কাজ করতে যাচ্ছে এটা জানার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়না তোমার? নাকি বেতন পাবে শুনেই তুমি খুশি হয়েছো?
-নয়ন!
.
নিজেকে স্বাভাবিক করে নয়নতারা বললো-
আজকাল কাউকে বিশ্বাস করতে নেই । আমি একবার দেখে আসতে চাই ।
-রুপালি দেখেছে না?
-রুপালি ছোট মানুষ কি বুঝবে?
.
চুপসে গেলেন আফিয়া জান্নাত ।
ছোঁয়া বললো-
আপু তুমিও উনাকে চেনো । কালই তো বললাম । তোমার সাথে একবার দেখা হয়েছে ডাক্তার পরশের ।
-একবার দেখা হয়েছে মানেই কি তার সম্পর্কে সব জেনে ফেলেছি আমি! নিজের চোখে না দেখে অপরিচিত কোনো বাড়িতে তোকে পাঠাতে পারিনা আমি ।
.
বাইরে বেরুতে বেরুতে নয়নতারা বললো-
আয় ছোঁয়া ।
.
ছোঁয়া এসে সালাম করলো তার মাকে । তারপর জড়িয়ে ধরে বললো-
দোয়া করো, রাফসান ভাইয়ার কাছে যেনো আর হাত পাততে না হয় ।
-রাফসান নিজেই…
-থাক ওসব ।
.
ছোঁয়া বেরিয়ে যেতে আফিয়া জান্নাত বিড়বিড়িয়ে বললেন-
রাফসান যা করেছে ভালোবেসে করেছে । তুই ওকে বুঝলিনা ছোঁয়া । আমি কখনো তোর খারাপ চাইনি । একদিন ঠিক বুঝবি তুই ।
.
.
টেবিলে হরেক রকমের নাস্তা সাজানো । আজ নিজের হাতে নাস্তা বানিয়েছে পরশ । সাফিনা আহম্মেদ বললেন-
তুই এসব পারিস আমার তো জানা ছিলোনা!
-ইউটিউবের কামাল সব ।
– তা কি মনে করে এসব?
-মন চাইলো তাই ।
.
শফিউল আহম্মেদ এসে বসে বললেন-
আজকাল আমাদের পরশকে কেমন যেনো খুশি খুশি লাগছে না?
-হ্যাঁ, সেটা আমিও খেয়াল করছি ।
-কেনো বলো তো?
-কেনো?
-প্রেমের বাতাস লেগেছে তোমার ছেলের গায়ে । এমন সময় আমিও পার করেছি তাই বুঝতে অসুবিধে হচ্ছেনা ।
.
হো হো শব্দে হেসে উঠলেন তিনি ।
পরশ বললো-
আসলেই বাবার আইডিয়া ঠিক ।
.
সাথে সাথে কলিংবেল বেজে উঠলে পরশ সেদিকে এগিয়ে গেলো ।
সাফিনা আহম্মেদ মুচকি হেসে বললেন-
তোহাকে ওর জন্য ঠিক করে তাহলে আমরা ভুল করিনি ।
.
দরজা খুলে ছোঁয়া ও নয়নতারাকে দেখতে পেলো পরশ । নয়নতারাকে চিনতে তার অসুবিধে হলোনা ।
মৃদু হেসে বললো-
চিনেছেন আমাকে?
-আপনি আমাকে চিনেছেন এতেই আমি অবাক ।
-না চেনার কিছু নেই । আপনি ছোঁয়ার বড় বোন ।
.
তাদের কথা শুনে ছোঁয়া বেশ অবাক হলো । তার বোনকে পরশ চিনেছে কিন্তু তাকে চিনেনি সেদিন । আসলেই চিনেনি? নাকি না চেনার ভান করেছিলো?
.
পরশের সাথে সোজা ডাইনিং রুমে এলো তারা ।
পরশ তাদের পরিচয় করিয়ে দিলো মা ও বাবার সাথে । সাফিনা আহম্মেদ বসতে বললেন তাদের । নয়নতারা বললো-
আমি দুঃখিত এখানে আসার জন্য । আসলে ছোঁয়া কোথায় কাজ করতে আসছে এটা জানা জরুরী মনে হয়েছে আমার ।
.
শফিউল আহম্মেদ বললেন-
অনেক ভালো করেছো মা এখানে এসে । এটা তো বড় বোনের দায়িত্ব । তুমি একেবারে ঠিক কাজ করেছো । এবার দেখে নাও, মানুষ হিসেবে আমরা খারাপ নয় ।
.
শব্দ করে হেসে উঠলেন তিনি ।
সাফিনা আহম্মেদ বললেন-
ও একটু এমনি, রসিকতা করতে পছন্দ করে বেশি ।
তোমরা নাস্তা করো আমাদের সাথে ।
.
ছোঁয়া বললো-
এতো দেরীতে নাস্তা করেন আপনারা?
-আরেনা! সকালে করেছিলাম সেই কবে । এই সময় আরেকবার করা হয় । তবে আজকের এসব পরশ নিজ হাতে বানিয়েছে । খেয়ে দেখো কেমন হয়েছে । তবে ভালো হয়েছে কিনা গ্যারান্টি দিতে পারছিনা ।
.
ছোঁয়া নুডলস মুখে দিয়ে বললো-
অনেক বেশি ভালো হয়েছে ।
.
পরশ নিজেরমনে বললো-
আমার কষ্ট সার্থক হলো ।
.
নয়নতারা চোখ বুলিয়ে চারপাশে দেখতে থাকলো । সাজানো গোছানো পরিপাটি একটা বাড়ি । এমন একটা বাড়ি মানুষের স্বপ্ন হয়ে থাকে । ভেতরে ঢুকতেই দুইজন কাজের মানুষের দেখা পেয়েছে সে । তার মানে সত্যিই ছোঁয়া শুধু সাফিনা আহম্মেদের দেখভাল করবে?
নয়নতারার চোখের ভাষা যেনো পড়তে পারলেন সাফিনা আহম্মেদ । তার পাশেই বসে ছিলেন তিনি । নয়নতারার হাতে হাত রেখে বললো-
বোনকে নিয়ে চিন্তা করোনা । বান্ধবী ডেকেছি ওকে আমি । বান্ধবীর মতোই থাকবে আমার সাথে । তুমি নিশ্চিতে থাকতে পারো ।
.
আনন্দে নয়নতারার চোখ ছলছল করে উঠলো । এতো ভালো মানুষের সঙ্গ ছোঁয়া পাবে, ভাবেনি সে ।
.
কিছুক্ষণ তাদের সাথে সময় কাটানোর পর নয়নতারা বললো-
আজ আসি আন্টি । ভালো লাগলো এসে ।
-আবার এসো কিন্তু ।
.
সবাইকে বিদায় জানিয়ে পরশের সাথে বেরুলো নয়নতারা ।
গাড়ির সামনে এসে পরশ বললো-
ড্রাইভার পৌঁছে দিবে আপনাকে ।
-আমি যেতে পারবো বাসে চড়ে । আমার অভ্যেস আছে ।
-আমার বাড়ি থেকে বাসে চড়ে যাবেন, এটা হবেনা ।
.
কিছুট সংকোচ করে নয়নতারা বললো-
আমি জানি ছোঁয়া জাস্ট আন্টির পারসোনাল কাজ করবেভ। এতে ছোঁয়ার অসুবিধে নেই । কিন্তু ও আমার একমাত্র আদরের ছোট বোন । ওকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে আমার । ওর বদলে কাজটা কি আমি করবো? না মানে শুধু আন্টির দেখাশোনা নয়, পুরো ঘরের কাজ সামলাতে পারবো আমি ।
-কি যে বলছেন না আপনি! আমাদের বাড়িতে কম হলে চারজন কাজের লোক আসে । বিভিন্ন কাজের জন্য লোক ভাগ করা আছে । ছোঁয়ার একমাত্র কাজ হলো আমার মাকে খুশি রাখা । আর মা যেহেতু ওকেই পছন্দ করেছে সেহেতু…
-আমি বুঝতে পেরেছি ।
-আপনি চিন্তা করবেন না ।
.
নয়নতারা চলে গেলে পরশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো-
আমারো কি ইচ্ছে করে কাজের অজুহাতে ছোঁয়াকে এখানে রাখতে? কি করবো আমি! এই ছাড়া কোনো উপায় নেই । কাজ ছাড়া আমার কোনো সাহায্য যে ছোঁয়া নিবেনা ।
.
.
সাফিনা আহম্মেদের সাথে তার রুমে এলো ছোঁয়া । বেশ বড়সড় একটা রুম । রুমের প্রত্যেকটা জিনিসই পরিপাটি । ছোঁয়া বললো-
কে গুছিয়ে রাখে ঘর?
-বুয়া । তবে আমি নিজের রুম নিজে গোছাতে বেশি পছন্দ করি ।
.
বিছানার উপরে বসলেন তিনি ।
ছোঁয়া বললো-
আমি কি চুল আঁচড়ে দিবো আপনার?
-দিতে চাও?
-হুম ।
-তবে দাও ।
.
ড্রেসিংটেবিলের উপর থেকে চিরুনি ও তেলের বোতলটা নিয়ে, সাফিনা আহম্মেদের পেছনের দিকে বসে পড়লো ছোঁয়া । চুলে তেল লাগিয়ে আঁচড়াতে লাগলো সে । সাফিনা আহম্মেদ বললেন-
উম্ম… অনেক দিন পর আরাম পাচ্ছি ।
.
এদিকে নয়নতারা ঘরে আসতেই আফিয়া জান্নাত প্রশ্নের ঝুড়ি খুলে বসলেন ।
নয়নতারা বললো-
ছোঁয়া সেখানে ভালো থাকবে । কষ্টের কাজ নয় । একটু মানিয়ে নিলেই হয়ে যাবে । কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা ।
-কি?
-এতসব সুবিধা ছোঁয়াকে কেনো দেয়া হলো? না মানে তাদের বাড়িতে আরো অনেকে কাজ করে, সবাইকে নিশ্চয় গাড়ির সার্ভিসও দেয়া হয়না ।
-এতো ভাবিস নাতো । খালি পেটে থাকতে হবেনা এখন আর এটাই অনেক । মাথা থেকে তোরও একটা বোঝা কমলো ।
.
নয়নতারার ফোন বেজে উঠলে দেখলো রাফসানের ফোন ।
রিসিভ করে বললো-
কেমন আছো রাফসান?
-ভালো । তুমি কেমন আছো?
-আছি ভালো ।
-আন্টি?
-ভালো ।
-আর ছোঁয়া?
-ভালোই ।
-কি করে এখন?
-তাকে ফোন দিলেই পারো ।
-কি করে দিবো? কথা বলতে চায়না আমার সাথে । লজ্জা পায় বোধহয় । শুধু হুম হ্যাঁ করতে থাকে । এমন করলে কথা বলে শান্তি আছে?
-বুঝলাম নেই ।
-তো কোথায় সে মহারানী?
-আছে হয়তো কোথাও । এক জায়গায় তো স্থির থাকেনা । তোমার কি খবর বলো?
.
রাফসানের সাথে কথা বলা শেষে আফিয়া জান্নাত বললেন-
রাফসানকে না জানিয়ে ভালো করেছিস । ছোঁয়া কারো বাসায় কাজ করছে জানতে পারলে মানতো না বিষয়টা ।
-কিন্তু লুকোবো কতোদিন?
-যতোদিন না বিয়েটা হচ্ছে ।
-আমি চাকরী পেলেও ছোঁয়া এই কাজটা করুক তুমি চাও?
.
আফিয়া জান্নাত উঠতে উঠতে বললেন-
আমার মনেহয়না তুই আর কোনো চাকরী পাবি ।
.
.
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলো । রান্নাঘরে এসে চা বানাচ্ছে ছোঁয়া ।
পরশ বললো-
শুধু কি আন্টির জন্য বানাবেন? না মানে আমিও কি পেতে পারি এক কাপ?
-আমি ভালো চা বানাই সো কেনো নয়!
-আবার যদি বলেন? একজনের বান্ধবী হবার কথা ছিলো এখন অন্যজন বন্ধু হবার জন্য পেছনে লেগেছে?
-এক কাপ চা বানিয়ে দিলেই কি বন্ধুত্ব হয়ে যায়?
.
কিছু না বলে হাসলো পরশ । ছোঁয়া চায়ের পাতা খুঁজতে লাগলো ।
পরশ এসে তাকে সব দেখিয়ে দিলো । ছোঁয়া তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে চা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো ।
হাতঘড়ির দিকে চোখ পড়লো তার । একটু পরেই ছোঁয়া চলে যাবে । আজ সময়টা এতো দ্রুত চলে যাচ্ছে কেনো? কেনো সময় থামেনা? থামলে যে পরশ এখানেই সময়টা থামিয়ে দিতো । রান্নাঘরেই নাহয় দুজনে থাকতো, তবুও সাথেতো থাকতো…
.
চলবে
.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here