#তুমি_আছো_মনের_গহীনে 💖
#পর্ব- ৪৯ [ ধামাকা 😳]
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
সকলের সামনে আরহাম মেহেভীনকে কোলে নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে। মেহেভীন হাত-পা ছড়াছড়ি করলেও, তেমন কোন লাভ হয়না। বাড়ির ভিতরেই ঢুকতেই মেহেভীন থমকালো। পুরো বাড়ি বিয়ের সাঁজে নিজেকে সাঁজিয়ে তুলেছে। চারদিকে লোকের ছড়াছড়ি তাদের সাথে আরহামের মা-বাবা হাঁসিমুখে
কথা বলছে। আরিয়ান প্যান্ডিলের লোকদের সব কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছে। বাড়িতে আবার কার বিয়ে লাগলো? কথাটি বার বার মেহেভীনের মাথায় ঘুড়পাক খাচ্ছে। মেহেভীনের অবস্হা খানিক্টা বুঝতে পেরে,আরহাম মেহেভীনের কানে আস্তে করে বলে,
‘ কার বিয়ে হচ্ছে তা নয় পরে বলি। ‘
‘কিন্তু আপনি তার আগে আমাকে কোলে থেকে নামান। বাড়ির সবাই দেখলে কি ভাব্বে? ‘
মেহেভীনের বলা ব্যক্ত বানীকে সম্পূর্নভাবে নাঁখোচ করে দিয়ে, আরহাম ধরা গলায় বললো,
‘ ছাড়বো না তোমায়। কোলে বসিয়ে রেখে দিবো আজীবন। যেন বার বার ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যেতে না পারো। ‘
আরহামের কথা শুনে মেহেভীন শুকনো ঢুগ গিললো। আরহামের বলা বানীটি তার কানে কেমন করে যেন ঠেকলো। মেহেভীন লক্ষ্য করছে আরহাম তাকে কোলে নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকেছে,অথচ তাতে কারো কোন ভাবান্তর নেই। সবাই সবার মতো
কথা বলে যাচ্ছে। যা মেহেভীনের চিন্তাকে দ্বিগুনভাবে বাড়িয়ে তুলছে।কেউ কেউ তো আরহাম এবং মেহেভীনকে এইভাবে দেখে মিটিমিটি হাঁসছে।
মেহেভীনের তো ইচ্ছে করছে মাটি ফাঁক করে ঢুকে যেতে। লজ্জায় কুচকে আছে। আরহাম তা দেখে স্মিত হেসে মেহেভীনকে কোলে নিয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে যেতে থাকে। মেহেভীনের মনে পড়ে যায় কিছুক্ষন আগের কথা।
কিছুক্ষন আগে…..
মেহেভীন ঠিক করেছে সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে এই বাড়ি ছেড়ে, এই শহর ছেড়ে সবাইকে ছেড়ে চলে যাবে। কেননা এই বাড়ির প্রতিটা কোণায় কোণায় লুকিয়ে আছে তার সন্তানকে নিয়ে ঘিড়ে থাকা সকল
স্মৃতি। যা প্রতিনিয়ত মেহেভীনকে ভিতরে ভিতরে শেষ করে দিচ্ছে। তাছাড়াও অভ্র বিভিন্নভাবে মেহেভীনের সাথে দেখা করার চেস্টা করছে। যা মেহেভীনের পুরোনো ক্ষতগুলো পুনরায় জাগিয়ে তুলছে। এমনকি মেহেভীন জানে আরহাম তাকে কতটা ভালোবাসে, কিন্তু আরহামের এই অফুরন্ত ভালোবাসার বদলে সে শুধু আরহামকে কষ্ট ছাড়া
কিছুই দিতে পারবে না। তাই মেহেভীন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে সবার থেকে দূরে চলে যাবে। যেখানে তাকে কেউ পাবে। মেহেভীন তার সিদ্ধান্তে অটল থেকে,আরহামকে নিবেদন করার উদ্দেশ্য ছোট্ট একটা চিরকুট নিয়ে, বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায়। বাড়িতে রাহেলা এবং মজনু ছাড়া কেউ ছিলো। তারাও বাগানে তাদের প্রেমালাপে ব্যস্ত। এইটাই ছিলো মেহেভীনের জন্যে সুবর্ন সুযোগ। আরিয়ান প্রথমে বাড়িতে এসে,মেহেভীনের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে মেহেভীনের রুমে যেতেই,সর্বপ্রথম তার চোখে পড়ে টেবিলে রেখে যাওয়া চিরকুট খানা। আরিয়ান চিরকুটটা খুলে বুঝতে পারে, মেহেভীন বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে। তাই আরিয়ান সময় নষ্ট করে আরহামকে ফোন করে সবটা জানায়। আরহাম আর দেরী না করে রাগে ফুশতে ফুশতে তৎক্ষনাৎ
অফিস থেকে বেড়িয়ে এসে,বাড়িতে চলে আসে।
বাড়িতে এসেই চিরকুটটা পড়ে, রাগে আরহামের মাথায় আগুন জ্বলে উঠে। কেননা চিরকুটে লেখা ছিলো..
‘ আরহাম সাহেব প্রথমেই আপনার কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। এইভাবে আপনাদের সকলকে না বলে চলে যাওয়ার জন্যে। আমি একটা বিষয় খুব ভালো করেই রিয়ালাইজ করেছি যে, আমি যত বেশি আপনার কিংবা আপনার পরিবারের সাথে নিজেকে যুক্ত রাখবো আপনাদের ঝামালা ততই বাড়বে।
আপনারা আমাকে শতাধিক ভালোবাসা দিলেও, আমি তার এক ভাগ ও দিতে পারেনি বরং তার বদলে শুধু কষ্টই দিয়েছে। আমি সত্যি এই শহরে আর থাকতে পারছি না। তাই দূরে চলে যাচ্ছি। আশা করি
আপনারা কেউ আমাকে খুঁজার চেস্টা করবেন না, পারলে আরহাম সাহেব নতুনভাবে জীবনটাকে শুরু করবেন। ভুলে যাবেন মেহেভীন নামক কোন কালো ছায়াকে। ‘
চিরকুটটা দেখেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে আরহাম।
চিটকুটটা হাতে নিয়ে মুহুর্তেই ছুড়ে ফেলে দিয়ে, আরিয়ানকে কিছু একটা বলে বেড়িয়ে যায়। আরিয়ান ও বুঝেছে আজ তার ভাই যা ক্ষেপেছে আজ সত্যি মেহুর রক্ষে নেই। আরিয়ান মনে মনে মেহেভীনের জন্যে দোয়া করতে থাকে এবং কাজে লেগে পড়ে। কেননা তার ভাই যে তাকে অনেক বড় গুরুদায়িত্ব অর্পন করেছে। আরিয়ান মনে মনে অনেক খুশি হয় আরহামের নেওয়া সিধান্তে। এইটাও তো চেয়েছিলো সে।
_________________
শহরের থেকে কিছুটা দূরে নদীর পাড়ে শিউলি গাছের নীচে বসে আছে মেহেভীন। এই জায়গাটা কেন যেন তার খুব ভালো লাগে। এই জায়গাটাতে সে অন্যরকম শান্তি খুঁজে পায়। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে শিউলি ফুলের গাছ থেকে থেমে যায় মেহেভীন। গাছের নীচে বসে থাকে কিছুক্ষন। শিউলি ফুল গুলো ঝড়ে যাচ্ছে গাছ থেকে। মেহেভীনের নিজের জীবনটা কেমন যেন শিউলি ফুলের মতো লাগছে। শিউলি ফুলের মতো তার জীবনেরও সমস্ত হাসি খুশি
আনন্দের মুহুর্তগুলো কেমন করে যেন হারিয়ে গেলো। মেহেভীনের মনে পড়ছে আরহামের সাথে কাটানো প্রতিটা হাঁসি খুশির মুহুর্ত। আরহামের প্রতিটা যত্ন। এমন করে কে বা এতোটা খেয়াল রাখবে মেহেভীনের? মেহেভীন নিজের মনটাকে শত শক্ত করতে চাইলেও,পারেনা ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। আরহামের থেকে দূরে চলে আসলেও তার কষ্ট সে হারে হারে টের পাচ্ছে। কিন্তু কেন এতো কষ্ট হচ্ছে তার? তার সঠিক কারণ খুঁজতে লেগে আঁতকে উঠে মেহেভীন। সেই যেই অনুভুতি থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছা সেই অনুভুতিটিই কী তবে তাকে নিজের মায়ার জালে জড়িয়ে ফেললো।
আরহাম তখনি তার গাড়িটা মেহেভীনের থেকে কিছুটা দূরে সাইডে রাখে। আরহামের গাড়ি দেখে কিছুটা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে মেহেভীন। আরহাম এখানে কি করে এলো? কি করে জানলো মেহেভীন এখানে থাকতে পারে। তখনি তার মনে পড়ে যায় একদিন পূর্নিমার রাতের কথা।
‘ আমাকে যদি কখনো হারিয়ে ফেলো তবে আমায়
খুঁজতে থেকো কোন শিউলি গাছের ফুলের ভীরে।
সেখানেই আমি শিউলি ফুলের মাঝে নিজেকে লুকিয়ে রাখবো।’
মেহেভীন আনমনে কথাটি বলে ফেলেছিলো, তখন আরহাম শুনে বলেছিলো,
‘ তোমার শিউলি ফুল ভালো লাগে? ‘
‘ খুব ভালো লাগে। সবচেয়ে ভালো লাগে নদীর পাড়ের সেই শিউলি গাছটা। ‘
মেহেভীনের বলা সেই কথাটি আরহামের মনে ছিলো,তাইতো খুব তাড়াতাড়িই মেহেভীনকে খুঁজে বের করে। মেহেভীনকে খুঁজে বের করে ফেলে।
আরহাম মেহেভীনের কাছে আসতে চাইলে, মেহেভীন পিছাতে পিছাতে থমথমে গলায় বললো,
‘ এগোবেন না প্লিয। আমি ফিরে যেতে চাইনা।’
আরহাম খুব শান্ত থেকেই বললো,
‘ কিন্তু তোমাকে যে যেতেই হবে আমার সঙ্গে।’
মেহেভীন তেঁতো গলায় বললো,
‘ যেতেই হবে মানে? আপনি কি আমার উপর অধিকার খাটাচ্ছেন? কোন অধিকার নেই আমার উপর আপনার। আমি আপনার সাথে ফিরবো না।
এতোদিন অনেক কিছু করেছেন আপনি আমার জন্যে। আমি আপনার আর বোঁঝা হয়ে থাকতে চাইনা….’
মেহেভীনের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে, আরহাম মধুর গলায় বললো,
‘ বোঝা নয় ভালোবাসা তুমি আমার। বাকি রইলো অধিকারের কথা? সেই অধিকার আজ আমি নিজেই তৈরি করে নিবো। ‘
[লেখিকাঃ জান্নাতুল ফেরদৌস রিমি]
কথাটি বলেই আরহাম মেহেভীনের কাছে এসেই,আরহাম মেহেভীনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই, মেহেভীনকে কোলে তুলে নিয়ে নেয়। এতে মেহেভীন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।মেহেভীন নামার জন্যে উদ্ধত হলেই, আরহাম তাকে রামধমক দেয়। সে চুপ হয়ে যায়। কেননা আরহামের চোখ-মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে যথেষ্ট পরিমানে রেগে আছে। আরহামের রাগে ঝলসে থাকা মুখশ্রীখানা দেখে মেহেভীন আর কিছু বলার সাহস পেলো না। আরহাম মেহেভীনকে কোলে নিয়ে গাড়ি দিয়ে সোজা বাড়িতে চলে আসলো। বাড়িতে এসেই মেহেভীন দেখতে পেলো বাড়িতে ছোটখাটো বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে।
_____
আরহাম মেহেভীনকে নিজের রুমে নিয়ে আসে। মেহেভীন ভাবনা থেকে বেড়িয়ে আসে আরহামের কথায়। আরহাম বললো,
‘ তুমি কি এখনো কোলে বসে থাকবে? ঘরে তো চলেই এসেছি। নাকি এখনো আমার কোলেই বসে থাকবে। যদিও আমার তেমন একটা সমস্যা নেই।’
মেহেভীন আরহামের কথায় আরেকদফা লজ্জা পায়। সে দ্রুত আরহামের কোল থেকে নেমে আসে। সে এখন আরহামের ঘরে। আরহামের কাউকে গলায় উচিয়ে কাউকে হাক করে ডাকে। আরহামের গলা শুনে, কিছু মেয়েরা বিয়ের শাড়ি -গয়না বিছানায় রেখে দিয়ে চলে যায়। মেহেভীন সবকিছু দেখে বিস্মিত হয়ে বলে,
‘ এইসব বিয়ের জিনিস কিসের জন্যে? ‘
আরহাম মেহেভীনের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,
‘ আজ যে আমাদের বিয়ে ম্যাডাম। এইগুলো তোমরাই বিয়ের শাড়ি-গয়না। ‘
মেহেভীন কথাটি শুনে অবিশ্বাসের সাথে আরহামের দিকে তাকাতেই,আরহাম তার অধরের কোণে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বলে,
‘ ভেবো না তোমার উপর আমি কোন স্বামীর অধিকার খাটানোর জন্যে বিয়েটা করছি কিংবা তোমাকে ভালোবাসতে বাধ্য করছি। আমি শুধু তোমায় সারাটাজীবন আগলে রাখার জন্যে বিয়েটা করছি।
ভালোবাসি তোমায় আমি। তুমি আমাকে ভালো না বাসলেও আমার পাশে সারাজীবন থেকে যেও। আমি তোমাকে আগলে রাখবো সযত্নে প্রেয়সী। ‘
অতঃপর আরহাম মুখশ্রীতে কাঠিন্য ভাব এন বললো,
‘ তোমাকে আমি কখনোই নিজের থেকে দূরে চলে যেতে দিবো না। তুমি কখনো আমার থেকে দূরে যেতে পারবে না, কেননা সেই অধিকার আমি তোমাকে দেইনি।’
#তুমি_আছো_মনের_গহীনে 💖
#পর্ব- ৫০ (Wedding special)
#Jannnatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
প্রাক্তন স্ত্রী এখন নিজেরই ভাইয়ের বউ হবে কথাটি ভাবতেই গা শিউরে ওঠে অভ্রের। ভালোবাসার মানুষটি অন্য কারো হয়ে যাবে? মেহেভীনকে তো সে অনেক ভালোবাসে, তাহলে অভ্র কীভাবে মেহেভীনকে অন্য কারো বউ হতে দেখবে? না অভ্র কিছুতেই দেখতে পারবে না। অভ্রের কাছে খবর এসেছে তালুকদার বাড়িতে নাকি বিয়ের আমেজ পড়েছে। আজকেই আরহাম এবং মেহেভীনের বিয়ে,কিছুটা হুট করেই বিয়েটা ঠিক করা হয়েছে। কিছুক্ষন আগেই জানতে পেরেছে অভ্র,কিন্তু অভ্র
তা কিছুতেই হবে না। সে খুব ভালো করেই জানে মেহেভীন তাকে এখনো ভালোবাসে। সে অন্য কাউকে কিছুতেই বিয়ে করবে না। ইশরা বেগম ছেলের জন্যে খাবার নিয়ে এসে, তার ছেলে একপ্রকার কোন মরণ যন্ত্রনায় ভিতরে ভিতরে কাতরাচ্ছে। ছেলের কাছে জানতে চাইলে,তার ছেলে তাকে একপ্রকার এড়িয়ে গিয়েই চলে যায়। এতে ইশরা বেগমের চিন্তা খানিক্টা বেড়ে যায়।
______
আরহাম এইবার মেহেভীনের দিকে এগোতে এগোতে ভাবুক কন্ঠে বলে,
‘চিরকুটে কি লিখেছে যেনো?উম আমি যেন তোমাকে ভূলে যাই রাইট? ‘
মেহেভীন ঘন ঘন পলক ফেললো। ভয়ে বুকটা বার বার কাপুনি দিচ্ছে৷ মনে হচ্ছে এখুনি আরহাম তাকে চেপে ধরবে। গিলে একেবারে খেয়ে ফেলবে। আরহামের গম্ভীর্যপূর্ন বানীগুলো তার কাছে কেমন যেন ভয়ংকর ঠেকছে। সে মুখ থেকে শব্দ বের করার পূর্বেই, আরহাম ঝাঁঝালো গলায় বললো,
‘ আর কি যেন বলেছিলে? আমি যেন নতুনভাবে শুরু করি। তাও আবার অন্য কারো। হাউ ডেয়ার ইউ মেহেভীন। এতোটা সাহস তোমাকে আমি কবে দিয়েছি। ‘
মেহেভীন স্হীর হয়ে দাঁড়াতে পারলো না। পিছাতে লাগলো। আরহাম রোষপূর্ন দৃষ্টি মেহেভীনের দিকে নিক্ষেপ করে, একেবারেই মেহেভীনের কাছে এসে পড়লো। যতটা কাছে চলে এলে, একে-অপরের নিঃশ্বাস, একে অপরের বুকের ভিতরের কাপনী গভীরভাবে অনুভব করা যায়। আরহাম মেহেভীনের চোখে চোখ রেখে বললো,
‘ হাও হার্টলেস ইউ আর! কোন হার্ট নেই তোমার।
কোন অনুভুতি বুঝার ক্ষমতা নেই। নাহলে ওই চিরকুটটা লিখে যেতে পারতে না। ‘
মেহেভীন এইবার নিজেকে সামলাতে পারলো ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। নিচু হয়ে ফুপিয়ে কেঁদে বলে উঠলো,
‘ আমি আপনার ভালোর জন্যেই আপনার থেকে দূরে যেতে চেয়েছিলাম। আমি তো সবসময় আপনাকে কষ্ট দেই আপনার ঝামালা বাড়াই,কিন্তু তার বদলে ভালোবাসা দিতে ব্যর্থ হয়েছি আমি। আমি আপনার ভালোবাসা ডিসার্ভ করেনি। ‘
আরহাম শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মেহেভীনের মুখশ্রী আলতো করে নিজের হাত দিয়ে ছুইয়ে দিয়ে বলে,
‘ তুমি আমাকে ভালোবাসা কিনা সেইটা বড় কথা নয়। সব থেকে বড় কথা হলো আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি খুব ভালো করেই জানি আমি
সঠিক মানুষটাকেই ভালোবেসেছি। আমার প্রেয়সী তুমি কী করে ভাবলে তোমাকে ছাড়া আমি অন্য কারো সাথে নিজের জীবন জড়াবো?’
মেহেভীন কান্নামিশ্রিত গলায় আরহামের দিকে তাকাতেই আরহাম মেহেভীনের কপালে নিজের কপাল ঠেকিয়ে বলে,
‘ আর কতবার বললে বুঝবে তুমি প্রেয়সী? তোমার আরহাম সাহেব শুধু তোমাকে আজীবন ভালোবেসে যেতে চায়। সযত্নে আগলে রাখতে চায় তোমার হাতখানা। তুমি যদি জানতে প্রেয়সী তোমার আরহাম সাহেবের মনের কতটা গহীনে তোমার বসবাস তাহলে
কেঁপে উঠতো তোমার ভিতরের হৃদয়টা। ‘
কথাটি বলতে গিয়ে আরহামের গলা ধরে এলো। ভিজে গেলো আখিঁজোড়া। মেহেভীন এখনো ফুপাচ্ছে। খানিক্টা ফুপানি কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ এতো ভালোবাসার যোগ্য নই আমি আরহাম সাহেব। আপনি আমাকে বিয়ে করে আপনি শুধু কষ্টই পাবেন। ‘
মেহেভীনের বলা একিই কথায় বার বার বিরক্ত হচ্ছে আরহাম। বিরক্তিতে নাক উচিয়ে মেহেভীনকে পুনরায় কোলে নিয়ে নিলো। মেহেভীন ভরকে গেলো। আরহাম মেহেভীনকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসিয়ে বললো,
‘ বুঝলাম! তুমি আমাকে বিয়ে করার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছো তাই এইসব বাজে কথা বলছো যেন আমি রেগে এখন খুব তাড়াতাড়িই তোমাকে বিয়ে করে ফেলি। ওকে নো প্রব্লেম। তোমার যা ইচ্ছে। ‘
আরহামের উদ্ভুট কথায় নাক ফুলালো মেহেভীন।মাথাটা কেমন ঘুড়াচ্ছে। সে কি বললো আর আরহাম তার উল্টো বুঝলো,তাকে কোনপ্রকার বানী ব্যক্ত করার সুযোগ না দিয়ে, আরহাম গলা উচিয়ে কয়েকজন মেয়েকে ডাকলো। তাদের দেখেই মনে হচ্ছে তারা পার্লার থেকে আগত। আরহাম তাদের দেখেই বললো,
‘ আমার হবু বউকে একদম লাল টুকটুকে বউয়ের মতো সাঁজিয়ে তুলবেন। আর হ্যা কোন ভারি ম্যাকাপ দিবেন না। হাল্কাতেই আমার প্রেয়সীকে সুন্দর লাগে।’
আরহাম মেহেভীনের দিকে তাকিয়েই কথাটি বললো। আর মেহেভীন সে তো যেন ঘোরের মাঝে রয়েছে।
মেয়েগুলো হেসে বললো, ‘ জ্বী স্যার আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আপনার হবু বউকে আপনার মন মতোই সাঁজিয়ে তুলবো আমরা। ‘
আরহাম রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। মেয়েগুলো তাদের সাঁজানোর কাজে লেগে পড়লো। মেহেভীন চাইলেও আটাকতে পারলো না।
_________
লাল টুকটুকে বেনারশি পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মেহেভীন। মুখে হাল্কা সাঁজ থাকলেও মেহেভীনের সৌন্দর্যকে দ্বীগুনভাবে ফুটিয়ে তুলছে খুব নিঁখুতভাবে। মেহেভীন আয়নায় নিজেকে দেখেই চিনতে পারছে না। তার মনে অস্হিরতা কাজ করছে। মনে হচ্ছে এই বিয়ে না হলেই ভালো হবে। তার অস্হিরতাকে কাটাতে আরিয়ানের আগমন ঘটলো। সে মেহেভীনকে দেখেই মুচকি হেসে বললো,
‘বাহ রে আজ যে আমার বেস্টুটাকে অন্যরকম সুন্দর লাগছে। ভাই তো চোখই সরাতে পারবে না।’
মেহেভীন আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে অনুনয়ের সুরে বললো,
‘ আরিয়ান প্লিয তুই আরহাম সাহেবকে বুঝা। উনি যা চাইছেন তা ঠিক নয়। আমি উনার যোগ্য নই।’
মেহেভীনের কথা শুনে, আরিয়ান মেহেভীনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘ এই মুহুর্তে এইসব বাজে কথা বলার কোন মানেই হয়না মেহু। আজকে কতটা স্পেশাল দিন জানিস?আজ তোর এবং ভাইয়ের বিয়ে। বলেছিলাম না? একদিন কেউ একজন আসবে, যে তোর জীবনকে আলোকিত করে তুলবে। হ্যা সেই সঠিক মানুষটিই হলো তোর আরহাম সাহেব। তাকে এইভাবে হারিয়ে ফেলিস না মেহু। সঠিক মানুষ জীবনে একবারই আসে। বুঝলি মেহু? ‘
আরিয়ানের কথা শুনে মেহেভীন চিন্তার পড়ে গেলো। আরিয়ান আবারোও বললো,
‘ তুই ভাইয়ের কাছে ঠিক কতটা বিশেষ তুই জানিস না মেহু। তুই ভাইয়ের প্রতিটা হাসির কারণ। প্রতিটা খুশির কারণ। তুই ভাইয়ের প্রেয়সী মেহু।ভাই তো তোর কাছে ভালোবাসা চাইছে না।
শুধু তোকে সারাজীবনের জন্যে পাশে চাইছে। এইটুকু তুই ভাইকে দিতে পারবি না মেহু? ‘
[লেখিকাঃ জান্নাতুল ফেরদৌসি রিমি]
মেহেভীন আরিয়ানের কথার উত্তর দেয়না। চুপটি করে বসে থাকে বিছানায়। আরিয়ান চলে যায়। মেহেভীন ভাবতে থাকে যে মানুষটা তাকে নিঃস্বার্থাভবে এতোটা আগলে রাখলো,এতোটা ভালোবাসলো। তাকে কষ্ট দেওয়াটা কী ঠিক হবে আদোও? মেহেভীনের মনে হচ্ছে আরহাম কষ্ট পেলে তারও খুব করে কষ্ট হবে। অনেক কষ্ট হবে। সেই কষ্টের পরিমাণ হয়তো বলতে পারবে না মেহেভীন।
তখনি কারো পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলো মেহেভীন। মেহেভীন উঠে দাঁড়িয়ে দেখে, আরহাম এগিয়ে আসছে। সাদা কালারের সাথে মেচিং করে কিছুটা গোল্ডেন কালারের শেরওয়ানী পড়েছে। এলোমেলো চুলগুলো কপালে এসে লেপ্টে রয়েছে। মুখে চমৎকার হাঁসি ঝুলিয়ে রেখেছে। আরহামকে দেখে কেন যেন বড্ড তাকাতে ইচ্ছে করলো। লোকটা যেন আজ বররুপে সকল মেয়েকে ঘায়েল করে রাখার জন্যে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। অপরদিকে আরহাম মেহেভীনের দিকে কিছুক্ষন স্হীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। লাল টুকটুকে শাড়িতে মেহেভীনকে কবে থেকে সে এইরকম বউরুপে দেখতে চেয়েছিলো আজ তা পূরন হয়ে গেলো। মেহেভীন ঘন ঘন পাপড়িগুলো বার বার পলক ফেলছে। ঠোটজোড়া কেমন কামড়ে ধরে রেখেছে,যা মেহেভীনের প্রতি আরহামকে দ্বীগুনভাবে মোহিত করে রাখছে।
‘ বউরুপে তোমাকে এতোটা মোহনীয় লাগে প্রেয়সী?
আগে জানলে প্রতিদিন তোমাকে বউ সাঁজিয়ে নিজের ঘরে বসিয়ে, সারাদিন দেখতাম। ‘
আরহামের এমন শীতল কন্ঠে বলা কথায় লজ্জায় শিউরে উঠে মেহেভীনের হৃদয়টা। তা কি আরহাম বুঝতে পারছে?
আরহাম এইবার মেহেভীনের দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,
‘ যদিও আমি বিয়েটা কিছুটা জোড়া খাটিয়ে করছি। তবুও এই শেষ মুহুর্তে এসে তোমার কাছে জানতে চাইছি। তুমি কি আমায় বিয়ে করবে প্রেয়সী? আগলে রাখতে দিবে বাকিটা জীবন?একটিবার হ্যা বলে দেখো আজীবন মনের রানী করে রাখবো তোমায়। একটিবার সুযোগ দিবে? ‘
আরহামের করা এই গভীর অনুরোধকে প্রতিহত করার আদোও কোন যুক্তি মেহেভীনের কাছে নেই। সে কাঁপা কাঁপা হাতে আরহামের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। আরহাম তৃপ্তির হাঁসি দিয়ে, মেহেভীনের হাত ধরে নীচে নিয়ে যায়। সকলে মেহেরহামকে একসাথে দেখে মুগ্ধ পানে তাকিয়ে থাকে। আরহাম মেহেভীনকে স্টেজে নিয়ে আসতেই, অভ্র……
#তুমি_আছো_মনের_গহীনে 💖
#পর্ব- ৫১ (‘ Meherham Wedding Special) 💞
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
নিজের বিয়ের আসরে প্রাক্তন স্বামীকে দেখে কিছুটা বিচলিত হয়ে যায় মেহেভীন। ভয়ার্থ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অভ্রের দিকে। অভ্রকে বর্তমানে যে কেউই আশা করেনি তা সবার মুখেই স্পষ্ট। অভ্র মেহেভীনের দিকে এগোতে নিলে,মেহেভীন আরহামের পিছনে চলে যায়। আরহাম মেহেভীনের হাত ধরে, শক্ত মুখে অভ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে।অভ্র অসহায় হয়ে বলে,
‘ মেহু তুই কী আমাকে ভয় পাচ্ছিস নাকি আরহামকে বল? তুই এই বিয়েটা নিজে থেকে করছিস না তাইনা?তুই তো আমাকে ভালেবাসিস। আরহামকে নয় তাইনা? তোকে তো আরহাম জোড় করে বিয়ে করছে। তুই ভয় পাস না মেহু। তোর অভ্র চলে এসেছে। ‘
কথাটি বলে অভ্র মেহেভীনের দিকে হাত বাড়াতে নিলে,আরহাম অভ্রের হাত খপ করে ধরে ঝাঝালো গলায় বলে,
‘ নিজের লিমিট ক্রস করিস না অভ্র। মেহেভীনের দিকে হাত বাড়ালে তোর হাত ভেঙ্গে আমি গুড়োগুড়ো করে ফেলবো।তুই কী ভেবেছিস? এইসব ড্রামা করে? তুই আজ আমাদের বিয়েটা আটকাতে পারবি? একদমই না।’
অভ্র বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বলে, ‘ আমি জানি আমার মেহু আমাকে ভালোবাসে। তুই ওকে জোড় করে কখনোই বিয়ে করতে পারবি না আর না কখনো মেহুর ভালোবাসা পাবি। মেহু আমাকেই ভালোবাসে আমি তাতে মেহুর সাথে যতই প্রতারণা করিনা কেন। তাইনা মেহু? ‘
মেহেভীনের পক্ষে এইবার নিজেকে আর নিয়ন্ত্রন করার সম্ভব হচ্ছে না। রাগে থর থর কাঁপছে তার দেহ। সে আরহামের সামনে এসে,অভ্রের সামনা সামনি দাঁড়ায়। অতঃপর রোশপূর্ন দৃষ্টি অভ্রের দিকে নিক্ষেপ করে বলে,
‘ ভালোবাসা আর তোমাকে? তোমাকে কখনো ভালোবাসা যায়না অভ্র! তোমাকে শুধু ঘৃণা করা যায়। আর তুমি আরহাম সাহেবের সাথে নিজের তুলনা করছো? আরহাম সাহেবের জায়গায় যেতে হলে, তোমাকে একাধিক বার জন্ম নিতে হবে অভ্র। ‘
অভ্র মেহেভীনের দিকে ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে খুব ভালো করে লক্ষ্য করে আজ মেহেভীনের চোখে
শুধুমাত্রই ঘৃণা রয়েছে,কিন্তু একসময় সেই চোখে অভ্র শুধু নিজের প্রতি ভালোবাসা দেখতে পারতো।
সেসব কিছুর জন্যে অভ্র নিজেই দায়ী।
পাশ থেকে দুই তিনজন মহিলা একে- অপরের দিকে
তাকিয়ে আরহামের বাবা-মাকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো, ‘ এ কেমন মেয়ে রে বাবা?
এক ভাইকে ডিভোর্স দিয়ে, আরেক ভাইকে বিয়ে করছে। আর আপনারাও এই মেয়েকে নিজের বাড়ির বউ করে নিয়ে আসছেন? আপনাদের মতো শিক্ষিত উচ্চবিত্তশালী মানুষদের কাছে এমন আশা করেনি। ‘
আরেকজন ও তাল মিলিয়ে বলতে থাকে,
‘ শুনেছিলাম আবার আরহামের ভাইয়ের বাচ্চা পেটে নিয়ে, আরহামের বাচ্চা বলে চালিয়ে দিয়েছিলো। কিসব যুগ এসেছে রে। ছিহ। থাকে একজন এর সাথে থাকে এবং দোষ চাপায় আরেকজন এর ঘাড়ে। এই মেয়ের চরিত্রের ঠিক নেই।’
মেহেভীন কথাটি শুনে চুপ হয়ে যায়। শেষে কিনা তার
চরিত্র নিয়েও তাকে এতোগুলো বাজে কথা শুনিয়ে দিলো। মেহেভীনের চোখ ভিজে যায়।
আরহামের বাবা -মা কিছু বলার আগেই, আরহাম চিৎকার করে বলে,
‘ ব্যাস! অনেক বলে ফেলেছেন। আমার হবু স্ত্রীকে নিয়ে কোনপ্রকার বাজে কথা আমি আরহাম হাসান তালুকদার শুনবো না। একটা মেয়ে এই সমাজে সবসময় অপমানিত হয় প্রতারিত হয় এই আপনাদের মতোই কিছু নিচু মন-মানষিকতার নারীদের জন্যেই।
আপনারাই অভ্রের মতো কিছু ঘৃণিত পুরুষদের সুযোগ করে দেন এইভাবে অন্যায় করার জন্যে।
একটা ছেলে যতই অন্যায় করুক। দিনশেষে একটা মেয়েকেই সব দোষ মাথা পেতে নিতে হয় কেন? সে একজন নারী বলে? তার স্বামী তার সাথে যতই প্রতারণা করুক। যতই অন্য নারীকে বিয়ে করুক, সে
সবটা সহ্য করে যাবে। সে যদি সেই প্রতারককে ফেলে আবারোও নিজের জীবন নতুনভাবে শুরু করতে যায় তাহলে আপনাদের মতোই কিছু নারীরা সেই অত্যাচারীত নারীকে ‘চরিত্রহীন ‘ তকমাটা মাথায় লাগিয়ে দিতে একবারও ভাবেন না তাইনা?’
আরহামের প্রতিবাদের সুরে বলা প্রতিটা কথা কাটা গাঁয়ের মতো লাগলো মহিলাগুলো কাছে।
আরহাম বাবা এইবার মুখ খুলে বললেন,
‘ শিক্ষার কথা বলছেন? সব থেকে বড় মুর্খ তো আপ্নারা। হাই সোসাইটিতে থেকেও মেন্টালিটি আপনাদের চেঞ্জ হয়নি। আবার শিক্ষার কথা কোন মুখ বের দিয়ে বের করেন?’
‘আপনারা বড় তাই সম্মানের সাথে বলছি এতোই যখন মেহেভীনকে আপনাদের সমস্যা তাহলে প্লিয আপনারা আসতে পারেন। নো প্রব্লেম! ‘
আরহামের ঠান্ডা গলায় বলা অপমানে তেঁতে উঠলেন তারা। গটগট করে পা বাড়িয়ে চলে গেলেন বিয়ের আসর থেকে। আরিয়ান মেহেভীনের কাছে এসে, মেহেভীনের চোখ মুছিয়ে বলে, ‘ কাঁদছিস কেন তুই?
তুই না আমার লিটেস সিস? এইভাবে একটা শুভ দিনে কয়েকজন বাজে লোকদের জন্যে কাঁদবি?
দেখ তোর হাব্বিরকে। তুই কাঁদলি যে তার ও
কষ্ট হয়। ‘
মেহেভীন অশ্রুসিক্ত চোখে আরহামের দিকে তাকাতেই, আরহাম তাকে হাত নাড়িয়ে ইশারা করে
যেন চোখের জল মুছে নেয়। সে যে কিছুতেই তার প্রেয়সীর চোখের জল সহ্য করতে পারবে না। মেহেভীন দ্রুত চোখের জলে মুছে ফেলে। অতঃপর এক পা এগিয়ে, আরহামের হাত খানা ধরে, প্রাপ্তির হাসি দিয়ে বলে,
‘ ধন্যবাদ আরহাম সাহেব। আমার জীবনে আসার জন্যে। আমার জীবনে নিজের ভালোবাসার রঙ্গে রাঙ্গিয়ে তোলার জন্যে। জানেন আজকে নিজেকে বড্ড ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। আগে শুধু নিজের ভাগ্যকে দোষ দিতাম। কেন এতো কষ্ট আমার জন্যে? অতঃপর আমার মাথায় আজ একটা কথা উকি দিলো তা কী জানেন? ‘
আরহাম প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাতেই, মেহেভীন মুচকি হেসে বললো,
‘ মহান আল্লাহ তায়ালা সর্বশ্রেষ্ট পরিকল্পনাকারী। তিনি সবসময় কষ্টের পর সুখ দিয়েছেন। তিনি যা করেন ভালোর জন্যেই করেন। আজ যদি অভ্র আমাকে ধোঁকা না দিতো তাহলে আপনার মতো মানুষকে হয়তো আমার জীবনে পেতাম না। আজ আমি নিজে বলছি আরহাম সাহেব আপনার জীবনসঙ্গিনী হওয়ার সুযোগ টুকু দিবেন? থাকতে দিবেন আপনার পাশে দিবেন? হতে দিবেন আমায় আপনার অর্ধাঙ্গিনী? ‘
আরহাম ও তৃপ্তির হাঁসি হেসে, মেহেভীনের হাত দুটো সযত্নে ধরে বললো,
‘ হাত যখন ধরেছি তোমায় প্রেয়সী। আজীবন সযত্নে আগলে রাখবো তোমার হাতজোড়া। শুধু তুমি পাশে থেকো। ‘
মেহেভীন হাঁসে। আরহাম মেহেভীনকে নিয়ে, স্টেজে নিয়ে যায়। কাজি সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করে দেয়। অভ্র পিছিয়ে যায়। দাঁড়িয়ে থাকা দায় হয়ে পড়ে তার। সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে তার এবং মায়রার যখন বিয়ে হয়েছিলো তখনি মেহেভীনরেও কতটা কষ্ট হয়েছিলো। নিজের চোখের সামনে ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারো হতে দেখা
অনেকটাই মরণ যন্ত্রনার সমান!
আরহাম অভ্রের অবস্হা খানিকটা বুঝতে পেরে,ঠাট্টার ছলেই বলে,
‘ ভাই তুমি কিন্তু আবার কোথাও যেও না।
পেট ভরে বিয়ের খাবার খেয়ে যাবে। তাছাড়া তোমার তো অনেক দায়িত্ব আছে তাইনা? তুমি যেমন মেয়ে পক্ষের তেমনি ছেলে পক্ষের। মেয়ের খালাতো ভাই আবার ছেলেরও চাচাতো ভাই। তোমার কি কম দায়িত্ব বলো? ‘
[লেখিকাঃ জান্নাতুল ফেরদৌসি রিমি]
অভ্র আরিয়ানের কথার জবাব দেয়না। সে জানে আরিয়ান তার মজা এখন খুব ভালো করেই নিচ্ছে।
সে তো একপ্রকার ঠাট্টার বস্তু হয়ে গিয়েছে। আশিক ও রাহেলাও আরিয়ানের সাথে তাল মিলিয়ে বলে,
‘ কি অভ্র ভাই? দেখতাছেন তো? আমাদের আরহাম ভাই এখন আপনার সামনে দিয়া আমাগো ভাবিরে বিয়া কইরা লইয়া যাইবো। আর আপনি বইসা বইসা চাইয়া চাইয়া দেখবেন আর লুচির মতো ফুলবেন। ‘
কথাটি বলেই আশিক এবং রাহেলা অভ্রকে আঙ্গুল দিয়ে কাচকলা দেখায়। অভ্র রাগে, অপমানে, কষ্টে বেড়িয়ে যায়। মেহেভীনকে অন্য কারো হতে সে দেখতে পারবে না। অভ্র চলে যেতেই, আরিয়ান, রাহেলা এবং আশিক ফিক করে হেঁসে দেয়।
কাজি সাহেব বিয়ের কার্যকম শুরু করে দেয়। প্রথমে তিনি মেহেভীনকে কবুল বলতে বলে, মেহেভীন আরহামের দিকে স্মিত হেসে নির্ধিদ্বায় কবুল বলে দেয়। আরহাম ও ফটফট করে অতি দ্রুততার সাথে কবুল বলে দেয়। সবাই একসাথে ‘ আলহামদুলিল্লাহ ‘ বলে। মেহেভীন এবং আরহাম বিয়ের মতো স্নিগ্ধ এবং পবিত্র বন্ধনে নিজেদের আবদ্ধ করে ফেলে সারাজীবনের সাথে। বিয়ে শেষ হওয়ার পরে, আরহাম মেহেভীনের কানে ফিসফিস করে বলে,
‘ আজ থেকে তুমি সত্যিই মিসেস আরহাম হাসান তালুকদার হয়ে গেলে প্রেয়সী। ‘
মেহেভীন লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। সেই লজ্জামাখা মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে আরহাম অদ্ভুদ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকে।
________________
বিয়ের অনেকটা সময় পরেই ফারিয়া আসে। তার আজকে পরীক্ষা ছিলো, তাই আসতে কিছুটা দেরী হয়ে যায়। ফারিয়াকে দেখে কিছুক্ষন এর জন্যে স্হীর হয়ে দাড়িয়ে থাকে আরিয়ান। কেননা আজ প্রথমবার সে ফারিয়াকে শাড়ি পড়তে দেখেছে। গোলাপী রং এর শাড়ি পড়েছে ফারিয়া। বেশ মিষ্টি লাগছে ফারিয়াকে। ফারিয়া আরিয়ানকে দেখেই, আরিয়ানের সামনে আসে। ফারিয়াকে দেখে আরিয়ানের ঘোর কাটে।ফারিয়াকে দেখেই আরিয়ান তড়িঘড়ি করে বলে,
‘ এতোটা লেট হলো যে? ‘
‘ এক্সাম তো ছিলোই? তার মধ্যে আবার ট্রাফিক জ্যাম। তাই দেরী হয়ে গিয়েছে। বিয়েটা হয়ে গিয়েছে?’
‘ হুম কিছুক্ষন আগেই হয়ে গেলো। ‘
ফারিয়া মন খারাপের সুরে বলে,
‘ ইসস আমি মিস করে গেলাম। ‘
‘ যাই বলো আজকের বিয়ের আসরটাকে আরেকটু আলোকিত করতেই বোধহয় এইভাবে ভয়ংকরী রুপ ধারণ করেছো তুমি। ‘
আরিয়ানের দুষ্টুমি ছলে বলা কথা বুঝতে পেরে, ফারিয়া ও মুচকি হেসে বলে, ‘ কিন্তু আমার দিকে কী কারো লক্ষ্য রয়েছে আরহাম সাহেব? বিয়ের বাড়ির মেয়েদের নজর এখন আরহাম ভাইয়া এবং আপনার উপরই। এইভাবে গোল্ডেন শেরওয়ানী পড়ে তামিল হিরোদের মতো না আসলে বুঝি আপনার হতো না?’
আরিয়ান ফারিয়ার দিকে ঝুঁকে বলে,
‘ আর ইউ জেলাস? ‘
ফারিয়া মুখ ঘুড়িয়ে মুচকি হাঁসে।
ফারিয়া এবং আরিয়ানকে অনেকক্ষন ধরেই লক্ষ্য করছেন আরহামের মা।
____________
তালুকদার বাড়ির নিয়ম বিয়ের স্টেজ থেকে বাড়িতে প্রবেশ করার সময়, নতুন বউকে কোলে নিয়ে বরকে বাড়িতে প্রবেশ করাতে হবে। যথারিতিতে আরহাম মেহেভীনকে কোলে নিয়েই বাড়িতে প্রবেশ করে। যদিও মেহেভীনের লজ্জা অনুভব হচ্ছিলো। বাড়িতে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের উপর ফুলের বর্ষন হয়।
______________
বউরুপে আরহামের রুমে বসে আছে মেহেভীন। চারদিকে বিভিন্ন ফুল দিয়ে সাঁজানো হয়েছে তাদের বাসরঘর। আজ থেকে মেহেভীন আরহামের সত্যিকারের বউ। মেহেভীন কখনো ভাবেনি তার জীবনে এমন খুশির মুহুর্তও আসবে। বাইরে আরিয়ান এবং আরহামের কাজিনরা আরহামকে ঢুকতে দিচ্ছে না। তাদের ভাষ্যমতে টাকা না দিয়ে,বাসরঘরে ঢুকা যাবেনা।
মেহেভীন ভাবলো এইবার একটু চেঞ্জ করে নেওয়ার দরকার। তাই মেহেভীন খাট থেকে নামতে নিলেই,ঘরের লাইট সব বন্ধ হয়ে যায়। মেহেভীন ঘাবড়ে যায় তখনি……..
#তুমি_আছো_মনের_গহীনে 💖
#পর্ব- ৫২
#Jannatul_ferfosi_rimi (লেখিকা)
গর্ভবতী অবস্হায় ডিভোর্স পেপার হাতে নিয়ে অভ্রের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে মায়রা। সে আজ নিজের মনকে হাজারোবার ক্ষতবিক্ষত করে বুঝিয়েছে অভ্র তার নয়। অভ্র শুধু মেহেভীনকেই ভালোবাসে। তাহলে মিছে মিছে বিয়ের মতো সম্পর্কটা বয়ে চলার কোন মানেই হয়না। মায়রা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে অভ্রের কাছে তার কিংবা তার সন্তানের কোন মূল্যই নেই। তাদের বিয়েটাও এখন অভ্রের কাছে বোঝা মাত্র। তাই মায়রা উকিলের সাথে কথা বলে তাদের ডিভোর্স পেপারটা তৈরি করিয়ে ফেলেছে। এখন শুধু অভ্র সাইন করে দিলেই ডিভোর্সটা হয়ে যাবে। অভ্র আজীবনের জন্যে
মায়রার থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। মায়রা একবার ভাবলো ছুটে গিয়ে অভ্রের রুমে গিয়ে, ডিভোর্স পেপারটা দিয়ে আসবে,কিন্তু অভ্রের বাড়িতে যাওয়ার সাহসটুকুও তো তার আসছে না। কত স্বপ্ন কতটা আশা নিয়ে অভ্রের সাথে অভ্রের বাড়িতে প্রবেশ করেছিলো। আজ তা নিমিষই শেষ হয়ে যাবে। মায়রার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম এসে জমাট বাঁধে। বুকের ভিতরে ঝড় বইতে থাকে,তবুও মায়রা নিজেক শক্ত করার প্রয়াস করে।
___________
অভ্র দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বসে থাকে। চোখে কেমন জল এসে জমাট বেঁধে রয়েছে। একটু হলেই যেন গড়িয়ে পড়বে। অভ্রের জোড়ে শ্বাস নিয়ে মেহেভীনের ছবিটা নিয়ে আপনমনে বিড়বিড় করতে থাকে,
‘মেহু একটা ভুলের জন্যে তুই আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলি? আরহামকে বিয়ে করে নিলি মেহু?কেন করলি? আমার যে বড্ড কষ্ট হয় রে। এই সীমাহীন কষ্ট লাঘব করবো কীভাবে? ‘
ইশরা বেগম তড়িঘড়ি করে ছেলের কাছে ছুটে এসে বললেন, ‘ অভ্র বাবা! তোকে এতোটা দুর্বল লাগছে কেন? তুই ঠিক আছিস তো? ‘
অভ্র জোড়ানো কন্ঠে বললো,
‘ মা আমি ঠিক আছি। আমাকে নিয়ে এতোটা চিন্তা করো না তুমি। ‘
ছেলের মুখ দেখে খুব ভালো করেই ইশরা বেগম বুঝতে পারলেন ছেলে তাকে মিথ্যে বলছে। ছেলের মিথ্যে বুঝতে পেরে ইশরা বেগম তার ছেলের কপালে হাত রেখেই ঘাবড়ে উঠেন। কেননা অভ্রের আগুনের মতো শরীর গরম হয়ে রয়েছে। ইশরা বেগম থার্মোমিটার দিয়ে ছেলের জ্বর দিয়ে মেপে দেখলেন প্রায় ১০০ ডিগ্রির উপরে জ্বর। ছেলের এতো ঘাড় কাপানো জ্বর দেখে মুহুর্তেই চোখ জল চলে আসলো ইশরার।
______________________
বাসরঘরে হঠাৎ সব লাইট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মেহেভীনের মনে কিছুটা আতন্ক এসে হানা দেয়। সে
চট জলদি উঠতে নিলে,অনুভব করে তার ঘাড়ে কারো ঘন ঘন নিঃশ্বাস উপচে পড়ছে। মেহেভীন স্হীর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষন। নিঃশ্বাসের শব্দেই সে টের পেয়ে যায় পিছনে থাকা ব্যক্তিটি
আর কেউ নয় স্বয়ং তার আরহাম সাহেব। আরহাম তার হাত ধরে আস্তে আস্তে ধরে বারান্দার দিকে নিয়ে যেতে থাকে। চারদিকে শুধু ঘন কালো অন্ধকার। শুধু
চাঁদের আলো এসে বারান্দাকে নিজের আলো দিয়ে আলোকিত করছে। হাতে কোন কিছুর স্পর্শ পেতে, মেহেভীন চোখ পিটপিট করে দেখে আরহাম হাটু গেড়ে ডায়মন্ডের আন্টি মেহেভীনের আঙ্গুলে পড়িয়ে দিচ্ছে। ছোট্ট ডায়মন্ডের পাথরের আন্টিটা অদ্ভুদ সুন্দর লাগছে মেহেভীনের অনামিকায়। আরহাম হাটু গেড়েই মেহেভীনকে বললো,
‘ পছন্দ হয়েছে? ‘
মেহেভীন স্মিত হেসে বলে, ‘ একদম। ‘
আরহাম ও ঠোটে চমৎকার হাসি ঝুলিয়ে বলে,
‘ জানো প্রেয়সী? আজ আমি ইচ্ছে করেই আমাদের ঘরের সব লাইট বন্ধ করে দিয়েছে। আজ পূর্নিমার
চাঁদ উঠেছে দেখেছো? আজ যেহুতু আমাদের বাসর রাত তাই এই রাতে তোমাকে কি আমি নরমাল ভাবে দেখতে পারি? তাই ভাবলাম আমি আমার প্রেয়সীকে এই বিশেষ রাতে চাঁদের আলোতে দেখবো। ‘
মেহেভীন মাথা নিচু করে ফেলে। আরহাম মেহেভীন হাতে নিজের হাত রেখে মুগ্ধ গলায় বলে,
‘ চাঁদের আলোয় তোমার মুখশ্রীট কতটা মায়া কতটা
স্নিগ্ধতা ধরা দিচ্ছে তা যদি তুমি দেখতে তাহলে
নিজের মুখশ্রীর প্রেমে পড়ে যেতে। আজ যেমন আমি বার বার প্রেমে পড়ে যাচ্ছি নিজের সদ্য নবুবধুকে দেখে। ‘
মেহেভীন আরেকদফা লজ্জা পেয়ে যায় আরহামের শীতলকন্ঠে বলা মধুর বানী শুনে। আরহাম আরেকটি প্যাকেট মেহেভীনের হাতে ধরিয়ে দেয়।
মেহেভীন প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে আরহামের দিকে তাকাতেই,আরহাম মিষ্টি হাঁসি উপহার দিয়ে বলে,
‘ খুলে দেখো আরেকটা গিফ্ট তোমার জন্যে। ‘
[লেখিকাঃ জান্নাতুল ফেরদৌসি রিমি]
মেহেভীন বেশ কৌতহল নিয়েই, প্যাকেটটা খুলে দেখেই একটা ছবির ফ্রেম। ছবির ফ্রেমটা দেখেই
চোখের পানি নিজের বাঁধ ভেঙ্গে গলায় বেয়ে বেয়ে মেঝেতে গড়িয়ে পড়তে থাকে। কেননা ছবির ফ্রেমে
আরহাম মেহেভীন এবং মেহেভীনের ছোট্ট মেয়ে সন্তানটি রয়েছে। যাকে আরহাম এবং মেহেভীন একসাথেই কোলে নিয়ে দাঁড়িয় আছে। ছোট্ট বাচ্চাটা ছবিটাতেও তোয়ালাতে মোড়ানো রয়েছে। চোখ বুজে আছে। মুখটা অস্পষ্ট। যেমনটি আরহাম হসপিটালে দেখেছিলো। ঠিক তেমনিই ছবিটা একেঁছে। আরহামের নিঁখুত শিল্পির ফলে ছবিটাকে জীবন্ত মনে হচ্ছে। মেহেভীন চোখ বন্ধ করে ছবিটাকে জড়িয়ে ধরে বুকের মাঝে। আরহাম এগিয়ে এসে মেহেভীনের
চোখের জল মুছে বলে, ‘ একদম কাঁদবে না কিন্তু
আমি আগেও বলেছি আমার প্রেয়সীর চোখের জল আমি সহ্য করবো না। যখনি বেবীর জন্যে মন খারাপ করবে তখনি এই ছবিটা বের করবে কেমন? ‘
মেহেভীন সঙ্গে সঙ্গে আরহামকে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘ ধন্যবাদ আরহাম সাহেব। এতোটা মূল্যবান উপহার দেওয়ার জন্যে। ‘
আরহাম এইবার মেহেভীনের কানের কাছে গিয়ে,শীতল কন্ঠে বলে,
‘ আমারও কিন্তু গিফ্ট পাওনা রইলো তোমার কাছে। ‘
আরহামের শীতল কন্ঠে বলা বানীটা মেহেভীনের ভিতরে তোলাপাড় সৃষ্টি করে দিলো মুহুর্তেই।
‘ কি….কি উপহার? ‘
খানিকটা কাঁপাকাঁপা গলায় মেহেভীন কথাটি বলতেই, আরহাম মেহেভীনের দিকে এগিয়ে আসতে নিলে, মেহেভীন তৎক্ষনাৎ নিজের হাত দিয়ে শাড়িটা খামচে ধরে। মনে তার অদম্য ভয় জন্ম নেয়। আরহাম কি আজকেই মেহেভীনের কাছে তার স্বামীর অধিকার চেয়ে বসবে?কিন্তু মেহেভীন তো এখনো সম্পূর্নভাবে তৈরি নয়। তার তো সময় প্রয়োজন তা কী আরহাম বুঝবে? মেহেভীনকে সম্পুর্নরুপে অবাক করে দিয়ে, আরহাম মেহেভীনের কপালে ভালোবাসার স্পর্শ একেঁ দেয়। অতঃপর নরম গলায় নিজের প্রেয়সীকে বললো,
‘ এই অধিকার টুকু আমাকে তোমার দিতেই হবে প্রেয়সী। কি দিবে তো? ‘
[লেখিকাঃ জান্নাতুল ফেরদৌসি রিমি]
মেহেভীন চোখ বন্ধ করে ছিলো আরহামের ঠোটের স্পর্শে তার শরীরে অনুভুতি গুলো কেমন দুলে উঠছিলো। অতঃপর মেহেভীন চোখ বন্ধ করেই আলতো হাঁসে। যার অর্থ সে এই অধিকার টুকু তার আরহাম সাহেবকে দিয়েছে। আরহাম আবারোও মেহেভীনকে কোলে তুলে নিলো। অতঃপর ফুলের বিছানায় মেহেভীনকে বসিয়ে, কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো,
‘ প্রেয়সী আমি তোমাকে আগেও বলেছি এখনো বলছি। আমি তোমাকে শুধু নিজের পাশে পেতে চাই সারাটাজীবন। তোমার হাত টা ধরতে চাই। তুমি কখনো আমাদের বিয়েটাকে বোঁঝা মনে করো না। এই বিয়েটা হলেও কখনো আমি তোমার কাছে নিজের স্বামীর অধিকার কিংবা ভালোবাসা চাইবো না। তাই এতোটা নারভাস হওয়ার কোন দরকার নেও। তুমি আমার পাশে থেকো দ্যাটস ইনাফ। ‘
আরহামের কথা শুনে মেহেভীন কিছুটা ভরসা পেলো।
‘ তাহলে আপাতত গুট নাইট মিস থুরি মিসেস মেহেভীন আরহাম হাসান তালুকদার। আপাতত আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি সোফায় গিয়ে ঘুমাচ্ছি।’
আরহাম মেহেভীনের গালে হাত রেখে কথাটি বলে উঠে চলে যেতে নিলে,মেহেভীন আরহামের হাত ধরে
আটকে নিয়ে বলে,
‘ সোফায় যেতে হবেনা। বিছানাতেই ঘুমিয়ে পড়ুন। আমার স্বামীর প্রতি আমার এইটুকু ভরসা আছে যে সে বিনা অনুমুতিতে এমন কিছু করবে না, যাতে আমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। ‘
আরহাম আবার কিছুক্ষন চুপ থেকে মেহেভীনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
‘ ভালোবাসি তোমায়। আজীবন ভালোবাসতে চাই।
আমাকে কখনো ছেড়ে যেও না কখনো। নাহলে তোমার আরহাম সাহেব যে বড্ড একা হয়ে যাবে। তুমি হীনা ছন্নছাড়া হয়ে যাবে তার জীবন। ‘
আরহামের আবেগমাখা কথায় মেহেভীন আরহামের বুকে মাথা রেখে দিলো পরম শান্তিতে।
__________
অভ্র জ্বরের ঘোরেই বিড়বিড় করতে লাগলো,
‘ মা আমি তো মেহুকে অনেক ভালোবাসি। তবুও মেহু আমার হলো না। অন্য কারো হয়ে গেলো নিমিষেই। আহা সে যে কি কষ্ট রে মা। মরন যন্ত্রনার থেকেও বড্ড কষ্টকর। ‘
ছেলের মুখে এমন কষ্টকর করুন সুরে বলা আর্তনাদে বুকে কেঁপে উঠলো ইশরা বেগমের। নিজেকেই তিনি দুশতে লাগলেন ছেলের এমন পরিনতির জন্যে। অভ্র আবারো চটজলদি বলে উঠলো,
‘ না মা। মেহুর তো কোন দোষ নেই৷ সব দোষ আমার। আমি এতোটাই খারাপ। এতোটাই পাপী যে আমাদের সন্তানটাও পৃথিবীর আলো দেখতে পারলো না। না মেহু একদম ঠিক করেছে। আমার মতো প্রতারক মেহুর কেন কারো ভালোবাসাই ডিসার্ভ করে না। ‘
ইশরা বেগম অভ্রের কপালে আবারো হাত দিলেন। না জ্বর বেড়েই চলেছে। ডাক্তারকে এখন ডাকতেই হবে অভ্র এখন তার নিজের অবস্হায় নেই। কথাটি ভেবে
ইশরা বেগম দ্রুত ডাক্তার ডাকতে চলে গেলেন।
ইশরা বেগমের যাওয়ার পানে এক পলক তাকিয়ে অভ্র আবারোও দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে। কতটা বিষাদময় হয়ে উঠছে তার জীবনটা। আহা কি ভয়ংকর বিষাদময় জীবন। ইশরা বেগম চলে যেতেই, মায়রা ঘরে প্রবেশ করে। অভ্রকে দেখেই তার ও প্রচন্ড কষ্ট হয়। অভ্রের কাছে সে যেতে চাইলেও যেতে পারেনা। যদি অভ্র তাকে কাছে দেখে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় তখন? অভ্র তো এখন তাকে সহ্য করতেই পারেনা। মায়রা দূর থেকেই বলে,
‘ অভ্র আমি ডিভোর্স পেপারটা নিয়ে এসেছি। আমি সাইন করে দিয়েছি। তুমি করে দিও। তাহলেই তুমি আমার থেকে আজীবনের জন্যে মুক্তি পেয়ে যাবে। ‘
খুব স্বাভাবিক কথাটি বললেও,মায়রার কথায় স্পষ্ট লুকায়িত ছিলো অভ্রের জন্যে এক সমুদ্র পরিমাণ অভিমান। অভ্র……
#তুমি_আছো_মনের_গহীনে 💖
#পর্ব- ৫৩
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
মেহেভীনকে জড়িয়ে ধরে আরহাম অনুভব করলো
তার সদ্য বিবাহিত বউ তার বুকেই পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে। বউয়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে আরেকদফা হাঁসলো আরহাম। জানালার দিকে আরেকপলক তাকিয়ে দেখতে পেলো। চাঁদ মেঘের মাঝে নিজেকে ধীরে ধীরে ভাবে লুকিয়ে ফেলছে। যেন আজ তার বিরাট অভিমান হয়েছে৷ অভিমান হওয়াটাই স্বাভাবিক সে যেন খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে তার থেকেও সুন্দর কেউ আছে আরহামের চোখে। সে আর কেউ নয় আরহামের প্রেয়সী। তাইতো অভিমানে একপ্রকার লজ্জায় চাঁদ যেন মেঘের মাঝে নিজেকে আড়াল করছে। নিজের উদ্ভুট চিন্তাগুলো মাথা আসতেই আপনমনে হাঁসে। তার এই মায়াবী বউ তাকে এইবার সত্যি পাগল করে ছাড়বে।
আরহামের কাছে সবকিছুই যেন নিছক স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। সে কখনোই ভাবেনি সে তার প্রেয়সীকে তার বউ রুপে পাবে। আরহাম মেহেভীনের হাতজোড়া নিজের গালের সাথে মিশিয়ে বলে,
‘ ভালোবেসে তোমায় রেখে দিবো মনের গহীনে। যদি তুমি দূরে যেতে চাও তবে জোড় করে করে হলেও তোমাকে নিজের কাছে রেখে দিবো। মাইন্ড ইট। ‘
কথাটি বলে আরহাম পুনরায় মেহেভীনের কপালে ভালোবাসার পরশ একেঁ দিয়ে, মেহেভীনকে জড়িয়ে ধরেই ঘুমিয়ে পড়ে।
_________
জ্বরের ঘোরে থাকলেও, অভ্র স্পষ্ট শুনতে পারছে মায়রার অভিমানে সিক্ত প্রতিটা বানী। অভ্র দেয়ালে মাথা ঠেকিয়েই বিদ্রুপের হাঁসি দিয়ে বলে,
‘ তুমি নও আমি তোমাকে মুক্তি দিবো মায়রা। তুমি আমার থেকে দূরে থাকো। মেহেভীনের মতো
নতুন জীবন শুরু করো। পারলে আমার ক্ষমা করি দিও। ‘
অভ্র একদম একদমেই কথাগুলো বলে দিলো। কি সহজেই! একটুও বাঁধলো না? মায়রাকে কতটা সহজ করে বলে দিলো।
মায়রার ঠোট চেপে কান্না আসলো। কান্না গুলো গলায় কেমন যেন দলা পাকাচ্ছে। মায়রা খানিক্টা কেঁদেই বললো,
‘ তুমি আমাকে সহ্য করতে পারো না ঠিক আছে, কিন্তু প্লিয অভ্র আমাকে এইটা বলো না যে অন্য কারো সাথে নিজের জীবনটা জড়াতে। আমি তোমাকে ভালোবাসি। ‘
অভ্র এইবার মায়রার দিকে তাকিয়ে কাতরতার সুরে বললো,
‘ তাইতো বলছি আমাকে ভালোবাসো না মায়রা। আমাকে ভালোবাসলে শুধু যন্ত্রনা ছাড়া আর কিচ্ছু পাবে না। ‘
মায়রাকে আর কোনপ্রকার বানী উচ্চারণ করার সুযোবটুকু দিলো না অভ্র। অসুস্হ শরীর নিয়েই ঢুলু ঢুলু ভাবে মায়রার কাছে এসে মায়রার হাত ধরে দরজার কাছে নিয়ে আসলো। অভ্রের স্পর্শ পেয়ে চমকে গেলো মায়রা। অভ্রের শরীর যেন আগুনের মতো গরম হয়ে রয়েছে।
মুহুর্তেই অভ্রের জন্যে মনে এক ঝাঁক ভয় বাসা বাঁধা দিলো। অভ্র মায়রাকে দরজার কাছে নিয়ে গিয়েই হাত ছেড়ে দিলো। অতঃপর নিষ্প্রান কন্ঠে বললো,
‘ আমিও ডিভোর্স পেপার সাইন করে দিবো। যদিও বেবীর ডেলিভারির পরে তা কার্যকর হবে। কার্যকর হওয়ার পরে নতুনভাবে সবকিছু শুরু করো মায়রা। ‘
মায়রা মাথা নিচু করে চোখের জল ফেলছে। আচ্ছা অভ্র কী একবার ও ভাবছে না তার এমন কথায় কতটা কষ্ট হচ্ছে মায়রার।
‘ আমাকে ভুলে যাও মায়রা। আমি ঘৃণার যোগ্য
ভালোবাসার নয়।
অভ্র আর অপেক্ষা করলো না। কথাটি বলেই মায়রার মুখের সামনেই দরজাটা আটকে দিলো। মায়রা আহত দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো অভ্রের দরজার দিকে।
______________
সকালে সূর্যের তীব্র আলো জানালা ভেদ করে খানিক্টা মুখে এসে পড়লো মেহেভীনের মুখস্রীতে। চোখ বন্ধ করেই মেহেভীনের কপালে কুচকালো খানিক্টা। নিজেকে আরহামের বক্ষে আবষ্কার করলো। পরক্ষনেই তার চোখ গেলো তার শাড়ির উপর। কেমন এলোমেলো হয়ে রয়েছে।
এই একটা ঝামালা মেহেভীনের। সে শাড়ি পড়লেই
শাড়িটা এলোমলো হয়ে যায়। মেহেভীনের ভালো করে খেয়াল করে দেখলো তার শাড়ি খুব একটা ভালো অবস্হাতে নেই। এই অবস্হায় আরহাম তাকে দেখলে তার তো লজ্জায় মরণ ঘটবে। মেহেভীন আরহামের থেকে নিজেকে সরানোর চেস্টা করলেই, আরহাম জেগে যায়। সে ঘুম ঘুম কন্ঠে মেহেভীনকে বলে,
‘ এতো সকাল সকাল নড়ছো কেন? চুপচাপ ঘুমিয়ে থেকো। ‘
মেহেভীন খানিক্টা নিচু গলায় বললো,
‘ আমি এখন ঘুমাতে পারবো না। আমাকে ছাড়ুন। ‘
মেহেভীনের কন্ঠে স্পষ্ট লজ্জার আভাস ছিলো।
আরহামের চোখ বন্ধ করেই বললো,
‘ এতোটা লজ্জা পাওয়ার তো কিছুই নি। আমি তো কিছুই দেখছি না। আমি কিন্তু চোখ বন্ধ করেই রেখেছি। ‘
আরহামের কথা বলার ভঙ্গিমাতে দুষ্টুমির আভাস পেলো মেহেভীন। মেহেভীন চোখ বড় বড় করে
দ্রুত ছিটকে দূরে সরে গেলো আরহামের থেকে। নিজের লজ্জাকে ঢাকডে দ্রুত বাথরুমে গেলো। আরহাম চোখ বন্ধ রেখেই মুচকি হাঁসলো।
____________________
ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে মেহেভীন দ্রুত শাড়ি চেঞ্জ করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, নিজের ভেজা চুলগুলো মুছতে লাগলো। আরহাম ল্যাপটপ নিয়ে বসে ছিলো। সামনে থাকা সদ্য স্নান নেওয়া রমনীকে দেখে তার আখিঁজোড়া কিছুক্ষন স্হীর হয়ে গেলো।
মেহেভীন আপনমনে ভেজা চুলগুলো মুছতে লাগলো। আরহাম ল্যাপটপ টা বিছানায় রেখে, ধীর পায়ে মেহেভীনের কাছে গিয়ে, মেহেভীনের থেকে তোয়ালাটা নিয়ে, মেহেভীনের চুলগুলো মুছে দিতে লাগলো সযত্নে। অতঃপর মেহেভীনের কাছে গিয়ে, অতি শীতল কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ রাতে তো তেমন কিছুই হয়নি। সবকিছুই নরমাল ছিলো, তাহলে এই শীতের সকালে গোসল করলে কেন? ঠান্ডা লেগে যাবে তো। ‘
আরহামের কথায় আরেকদফা লজ্জা পায় মেহেভীন। মুখের লজ্জায় লাল রং এসে ধরা দেয়। আরহামের আজ হয়েছেটা কি? কথায় কথায় শুধু মেহেভীনকে লজ্জা দিচ্ছে। মেহেভীনকে লজ্জা পেতে দেখে আরহাম বেশ মজা পাচ্ছে। আরহাম আবারোও মেহেভীনের লজ্জামাখা মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে আরহাম বললো,
‘ ওগো প্রেয়সী তুমি কি জানো? তোমার লজ্জামাখা মুখশ্রী আমাকে কতটা আশক্ত করে? তাইতো তোমার আরহাম সাহেব অসভ্য হয়ে উঠছে প্রতিনিয়ত। ‘
মেহেভীন নিচের দিকে তাকিয়ে আলতো হাঁসে। তখনি সেখানে আবির্ভাব ঘটে। আরহাম এবং মেহেভীনকে এতোটা কাছাকাছি দেখে,দ্রুত পিছনে ঘুড়ে বলে,
‘ সরি নিউ কাপল! আসলে আমি ভুলে গিয়েছিলাম। এখন তো তোমাদের রোমান্স টাইম। আমি ভুল টাইমে চলে আসলাম। আম সো সরি। ‘
মেহেভীন এবং আরহাম একে অপরের থেকে তাড়াতাড়ি দুরে সরে আসলো। মেহেভীন আর কথা না বাড়িয়ে নীচে চলে আসলো। আজ এই দুই ভাই তাকে শুধু লজ্জাই দিচ্ছে। মেহেভীন রান্নাঘরে গিয়ে, আরহামের মাকে সাহায্য করলো।
আরহাম মেহেভীনকে চলে যেতে দেখে, আরিয়ানের দিকে তীক্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
‘ রোমান্সের বারোটা বাজিয়ে আবার সরি বলছিস?
তুই জাস্ট রেডি থাক তুই যখন বিয়ে করবি তখন তোর এবং তোর বউয়ের রোমান্সের টাইমেও আমিও এমনভাবে এন্ট্রি নিয়ে তোকে সরি বলবো। তখন দেখবো তোর কেমন লাগে। ‘
আরহামের কথায় আরিয়ানের মুখ পানষে হয়ে গেলো। সে দ্রুততার সাথে বললো,
‘ ইটস নট ফেয়ার ভাই। ‘
‘ আমার জন্যে এইটাই ফেয়ার। ‘
আরহামের পাল্টা জবাবা। আরিয়ান তার বিপক্ষে কিছু বলতে যাবে তখনি তার ফোন টা বেজে উঠলো। অগত্যা সে আর কিছু বলতে পারলো না। সে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে ফারিয়ার ফোন। সে বিড়বিড় করে বললো,
‘ ভাই নিশ্চই ম্যাজিক জানে। নাহলে বউয়ের কথা বললো আর তারই ফোন চলে আসলো। ‘
‘ কি বললি তুই? ‘
‘ কিছু না আমি আসছি ভাই। ‘
আরিয়ান কথাটি বলে একপ্রকার কেটে পড়লো।
_____________
মেহেভীন বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফুলের গাছে পানি দিচ্ছিলো। আরহামের বারান্দা বেশ বিশাল। বিশাল এই বারান্দাটিতে বিভিন্ন ফুলের সমাহার। এই ফুলের সমাহারে মেহেভীন প্রান ভরে নিঃশ্বাস নেয়। তখনি হুট করে তার পা পিছলে….
#তুমি_আছো_মনের_গহীনে 💖
#পর্ব- ৫৪
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
মেহেভীন পা পিছলে পড়ে যেতে নিলে,আরহাম মেহেভীনের কোমড় চেপে ধরে নিজের বুকের মাঝে আবদ্ধ করে রাখে। অভ্রের দৃশ্যটি দেখেই নিজেকে সামলাতে পারেনা। আখিজোড়ায় জলগুলো নিজের নিয়ন্ত্রন হারিয়ে অভ্রের গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। অভ্রের শরীরে জ্বর থাকা সত্ত্বেও, সে আজ অফিসের উদ্দেশ্যে বেড়িয়েছিলো। অভ্রের অফিসটি যাওয়ার পথে আরহামের বাড়িটি পড়ে। অভ্র যখন গাড়ি নিয়ে অফিসে যাচ্ছিলো তখনি বারান্দায় মেহেভীনকে দেখে গাড়ি থামিয়ে দেয়। নিষ্প্রান দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে তার ভালোবাসার মানুষটির দিকে। যদিও সে জানে তার ভালোবাসার মানুষটি এখন অন্য কারো। তবুও ভালোবাসার মানুষটিকে এক পলক দেখার লোভ অভ্র কিছুতেই সামলাতে পারলো না। তখনি তার সামনে ঘটনাটি ঘটে গেলো। আরহাম এবং মেহেভীনকে এতো কাছে দেখে তার বুকচিরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। গাড়ি ঘুড়িয়ে ফেললো তৎক্ষনাৎ।
মেহেভীন আরহামের বুকে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আরেকটু হলেই, সে পা পিছলে পড়ে যেতো বারান্দা থেকে। মেহেভীন আরহামের বুকে মাথা রেখে স্পষ্ট শুনতে পারছে আরহামের হৃদয়ের স্পন্দন কতটা গতিশীল হয়ে গিয়েছে। হয়তো সে ও কিছুক্ষন এর জন্যে ভয় পেয়ে গিয়েছিলো তার প্রেয়সীকে হারানোর । আরহাম কিছুক্ষন স্হীর দাঁড়িয়ে থেকে, মেহেভীনকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলো। অতঃপর মুখের গাম্ভীর্য ভাব এনে, মেহেভীনের বাহু চেপে ধরে ক্ষিপ্ত গলায় বলে,
‘ হাও স্টুপিড ইউ আর মেহেভীন। এতোটা স্টুপিডের মতো সারাদিন কাজ করো কেন? একটু হলেই তো দুতলা থেকে পড়ে যেতে কখন কি হতো বলো তো?
মেহেভীন তুমি তোমার স্টুপিড কাজ কখনো বন্ধ করবে না তাইনা? একটু দেখে শুনে তো কাজ করা যায়না? না আপনি তা করবেন কেন? আপনি তো একজন স্টুপিড মেয়ে। ‘
আরহামের রাগে শরীর বলতে গেলে একপ্রকার কাঁপছে। মেহেভীনকে নিয়ে ঠিক তার কতটা ভয় তা তার বকাতেই খুব স্পষ্টভাবে বুঝা যায়। অন্যদিন হলে আরহামের বকা খেয়ে মেহেভীন নাক ফুলিয়ে থাকতো না হয় পাল্টা উত্তর দিতো, কিন্তু আজ সে তা
করবে না। সে স্মিত হেসে আরহামের বুকে মাথা রেখে বলে,
‘ এতো কিসের চিন্তা আপনার বলুন তো? ‘
আরহাম হতাশ হয়ে কিছুটা ঠান্ডা গলায় বললো,
‘ তুমি বুঝো না কেন? ‘
‘ উহু…’
‘ যদি তোমাকে কখনো হারিয়ে ফেলি তবে মরণ ঘটবে আমার। তাই আমার জন্য হলেও তোমাকে আমার চাই আজীবন। ভালোবাসি বলেই এতোটা ভয়। প্রতিনিয়ত তোমাকে হারানোর ভয়ে আমার ভিতরটা পুড়ে যাচ্ছে। ‘
‘ সেই সাধ্যি যে আমার নেই। আপনি ভালোবেসে আমায় নিজের বুকে আবদ্ধ রাখুন। কথা দিচ্ছি হারিয়ে যাবো না কখনো। ‘
____________________
ফারিয়ার ফোন পেয়ে আরিয়ান ফোনটা রিসিভ করে তাড়াহুড়ো করে বলে,
‘ হ্যা বউ বলো। ‘
‘ বউ ‘ নামক উদ্ভুট ডাকটি শুনে বিষম খেয়ে গেলো ফারিয়া। তার কাছে বউ ডাকটি উদ্ভুটই বটে। তার জানা মতে সে এখনো সিংগাল আন্ডা বাচ্ছা। তাহলে সে কেন অন্য কারো বউ হতে যাবে কেন?
‘ এই আপনি কাকে বউ বলছেন? নাম্বারটা ভালো করে দেখেছেন তো? আপনি ভুলে আপনার জিএফ এর জায়গায় আমাকে বউ ডেকে ফেলেছেন।’
আরিয়ান বিড়বিড় করে বলে,
” এমনি এমনি কি আর এক্সামে ফেল করে? গাঁধি একটা বুঝেও না যে আমি ওকেই বউ ডেকেছি। যাক গে গাঁধি হলেও আমার হবু বউ তো। আস্তে আস্তে আমার সাথে থাকতে থাকতে গাধিটা এই আরিয়ান হাসান তালুকদার এর মতো চালাক হয়ে যাবে। ‘
‘ এই কি বললেন আপনি? ‘কি এতো বিড়বিড় করছেন? ‘
‘ না মানে তুমি হয়তো ঠিকই বলেছো আমি গার্লফ্রেন্ড ভেবে তোমাকে বউ ডেকে ফেলেছি। ‘
আরিয়ানের গার্লফ্রেন্ড আছে শুনে চোখ-মুখে অন্ধকার নেমে আসলো ফারিয়ার। সে মন খারাপের সুরে বলে,
‘ আপনার গার্ল ফ্রেন্ড আছে? ‘
আরিয়ান ভাবলো ফারিয়াকে কিছুক্ষন না জ্বালালে মন্দ হয়না। তাই একটু-আকটু মিথ্যে বললে খুব একটা ক্ষতি হবেনা। সে ও দেখতে চায় ফারিয়ার মনে
তার জন্যে আদোও কোন অনুভুতি আছে কিনা। তাই আরিয়ান মিথ্যেটাই ফট ফট করে বলে দেয় হ্যা তার অবন্তি নামে একটি গার্লফ্রেন্ড আছে। যদিও অবন্তি শুধুমাত্র আরিয়ানের বানানো নাম মাত্র।
ফারিয়া কথাটি শুনে আরিয়ানের সাথে আর কথা বলে না। সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা কেটে দেয়। কেন যেন তার একদমই ভালো লাগছিলো না। কেমন করে যেন বুকটা কেপে উঠলো। আচ্ছা তার এতো খারাপ লাগছে কেন? আর অবন্তি বা কে? তাকে সামনে পেলে ফারিয়া নিশ্চিত পানিতে চুবিয়ে রাখতো। ফারিয়া মুখ ফুলিয়ে বলে,
‘ আমার ছোট্ট মাথায় একটা প্রশ্ন বার বার ঘুরঘুর করছে। ডাক্তার সাহেবের জিএফ এর আছে এতে
আমার কি? আমার এতো রাগ উঠছে কেন? ‘
ফোনটা কেটে আরিয়ান বসে থেকে ফিক করে হেঁসে দেয়। সে খুব করেই বুঝতে পারছে ফারিয়া এখন নিশ্চই খুব রেগে গিয়েছে। আরিয়ান এখন রাগি হিংসুটে মুখটাকে খুব করে দেখতে। আরিয়ান ফারিয়াকে ফোন করার আগেই,আরিয়ানের মা আরিয়ানের কানে মোলা দিয়ে বলে,
‘ ওরে পাজি ছেলে তাহলে তুমি তলে তলে এইসব করো? ‘
নিজের মাকে দেখে ঘাবড়ে যায় আরিয়ান। তার মানে এখন সে শেষ। আরিয়ান তোতলিয়ে বলে,
‘ মা আমি আবার কি করলাম? ‘
‘ ওরে আমার ছেলে টা রে কি মাসুম। কিচ্ছু জানে না।
যাকে জ্বালাচ্ছিলে সে কে রে? নাম কি তার? ‘
_________________
আরহাম অফিসে বসে ঘেটে ঘেটে ফাইল দেখছে। তাহসান আরহামের পাশে বসে কিছুক্ষন চুপ করে এদিক সেদিক তাকাতে থাকে। তাহসানকে দেখে কিছুটা চিন্তিত মনে হচ্ছে। চিন্তিত হওয়াটাই স্বাভাবিক কয়দিন পরে তার বিয়ে রুশার সাথে। হ্যা রুশাও তাহসানের সাথে কয়দিন পরে বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হতে চলেছে। তাহসান অনেক আগে থেকেই রুশাকে ভালোবাসতো কিন্তু প্রকাশ করতে পারতো না। কেননা রুশা আরহামকে ভালোবাসতো। যখন রুশা একেবারে ভেঙে পড়ে তখন তাহসান তার মনের কথা খুলে বলে রুশাকে। রুশাও ভেবে চিন্তে অতীতকে ভুলে তাহসানের সাথে নতুনভাবে সবকিছু শুরু করতে চায়। সে জানে মরিচীকার পিছনে ছুটলে শুধু কষ্টই পাওয়া যায়।
আরহাম ফাইল ঘাটতে ঘাটতে বলে,
‘ এতো কিসের চিন্তা করছিস তুই? ‘
‘ ভাই কয়দিন পরে বিয়ে আমার ভুলে গেলি? ‘
‘ তাহলে তো খুশি হওয়ার কথা তোর। ‘
‘ আমি তো খুশিই বাট আমার হবু বউ আমাকে এখুনি পাগল করে ছাড়ছে তার কি হবে? দিন রাত শুধু শপিং আর শপিং। এর বিয়ের কেনাকাটা আর শেষ হয়না। কি জানি বিয়ের পরে মনে হয় পুরো শপিং মলটাই তুলে আনবে। ‘
‘ হবে কি করে? এখন তো সবে শুরু। বিয়ে করো চান্দু আগে আগে দেখো হোতা হে কেয়া। ‘
কথাটি বলে আরহাম তাহসানের দিকে বাঁকা হাঁসি নিক্ষেপ করলো। তাহসান ক্ষেপে উঠলো। সে আছে নিজের জ্বালায় আর ফাজিল বন্ধুটা কীভাবে মজা নিচ্ছে। তাহসান কোনপ্রকার বানী উচ্চারণ করার আগেই, হুড়মুড়িয়ে একটা মেয়ে বিনা অনুমতিতে ঢুকে পড়লো। মেয়েটা সেলোয়ার কামিজ পড়ে আছে। চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া। মেয়েটাকে দেখেই মনে হচ্ছে বয়সে বেশ ছোট হবে। মেয়েটা আরহামকে দেখেই বললো,
‘ আপনি আরহাম হাসান তালুকদার তাইনা?’
আরহাম ‘হ্যা ‘ বোধক মাথা নাড়ায়। মেয়েটি লাফিয়ে উঠে। আরহামের কাছে একপ্রকার ঘেষে দাঁড়িয়ে বলে,
‘ আমার তো এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। আমি আরহাম দ্যা গ্রেট আর্টিটেক এর সামনে দাঁড়িয়ে আছি। জানেন আপুর কাছে আপনার নাম অনেক শুনেছি।
লাইফের ফার্স্ট ক্রাশ আপনি। ‘
আরহাম মেয়েটার কথায় ভরকে গিয়ে তাহসানের দিকে তাকাতেই, তাহসান দাঁত কেলিয়ে বলে,
‘ রুশার কাজিন তন্নি।বিয়ে উপলক্ষ্যে রুশাদের বাসায় এসেছে। তোর কথা অনেক শুনেছি। তাই ছুটে অফিসে চলে এসেছে। ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। ‘
আরহাম তন্নির দিকে তাকিয়ে মেকি হাঁসি দিয়ে বলে,
” ওহ আচ্ছা তুমি রুশার কাজিন? আচ্ছা তুমি বসো আমি একটু আসছি ওকে? ‘
আরহাম উঠতে নিলে, তন্নি তাতে ব্যাঘাত ঘটিয়ে বলে,
‘ আপনি কোথায় যাচ্ছেন? আমি তো আপনার সাথেই দেখা করতে এসেছি। আচ্ছা আপনি কি সিংগাল? ‘
‘ উনি বিবাহিত। ‘
শক্ত মুখে কথাটি বলে মেহেভীন কেবিনে জবাব দেয়।
মেহেভীন আজকে আরহামের জন্যে নিজ হাতে খাবার বানিয়ে অফিসে নিয়ে এসেছিলো তখনি তার সামনে ঘটনাটি ঘটে। মুহুর্তেই তার রাগে নাক লাল হয়ে উঠে। বাচ্চা একটা মেয়ে কিনা বলে মেহেভীনের স্বামী তার ক্রাশ? মেহেভীন কি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে? সে সঙ্গে সঙ্গে কবিনে প্রবেশ করে আরহামের জন্যে নিয়ে আসা টিফিনের বাটিটা রেখে, জোড় করে হাসার চেস্টা করে বলে,
‘ আমি তার ওয়াইফ মিসেস আরহাম হাসান তালুকদার। বুঝলে পুচকি? এইবার তুমি আসতে পারো। উনি এইবার খাবেন। ‘
তন্নি মুখটা কাঁদো কাঁদো করে বেড়িয়ে গেলো। তাহসান ও মুচকি হেসে তন্নির পিছনে গেলো।
আরহামের কপালের বলিরেখায় গভীর ভাঁজ পড়লো। সে হাত দুটো আড়াআড়িভাবে ভাজ করে মেহেভীনের দিকে তীক্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
‘ এইটা কি হলো? ‘
‘ কেন আপনি দেখতে পেলেন না? মেয়েটা আপনার গাঁয়ে কিভাবে পড়ছিলো। ‘
ক্ষিপ্ত গলায় কথাটি বলে মেহেভীন। আরহাম দুষ্টু হাঁসি দিয়ে মেহেভীনের কানের কাছে গিয়ে শীতল কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ তাই বলে কি আমার বউয়ের হিংসা হচ্ছে? আচ্ছা তুৃমি কী আমায় সত্যি ভালোবেসে ফেললে? দেখো জেলাসি কিন্তু ভালোবাসার লক্ষন। ‘
আরহাম দুষ্টুমির ছলে কথাটি বললেও কথাট গভীরভাবে দাগ কাটে মেহেভীনের মনে। সত্যিই তো
তার এতো রাগ হচ্ছিলো কেন? তবে কি সে সত্যি ভালোবেসে ফেললো তার আরহাম সাহেব কে?
রাত প্রায় ৩টা।
মেহেভীন প্রতিদিনের মতো নিশ্চিন্তে আরহামের বুকে নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে রয়েছিলো তখনি তার ফোনটি বেজে উঠে। ফোনের শব্দে আরহাম ও জেগে উঠে। মেহেভীন তড়িঘড়ি করে ফোনটা রিসিভ করার পরে এমন কিছু শুনে যা শুনে মুহুর্তেই তার হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায়। গাল বেয়ে অজান্তেই অশ্রুপাত ঘটে।
#তুমি_আছো_মনের_গহীনে 💖
#পর্ব- ৫৫+৫৬ [ রহস্যের মায়াজাল সমাধান]
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
‘ অভ্র আত্মহত্যা করেছে ‘কথাটি শুনে একপ্রকার স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে মেহেভীন। চোখের কোন জল চিকচিক করতে থাকে। প্রাক্তনের এমন দুঃসংবাদ শুনার জন্যে সে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। মেহেভীনকে চুপ থাকতে দেখে আরহাম নিজেই মেহেভীনের থেকে ফোনটা কানে নিয়ে শুনতে পাই ইশরা বেগমের গলা ফাটানো আর্তনাদ। অভ্র নাকি নিজের হাত কেটে ফেলেছে। হাত থেকে নিগত রক্ত ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো। ইশরা বেগম ছেলের জন্যে খাবার নিয়ে এসে এই কান্ড দেখে মুহুর্তেই
থমকে যান। রক্তাক্ত অবস্হায় মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে শুয়ে ছিলো তার ছেলে। নিজের একমাত্র ছেলেকে এই অবস্হায় দেখে শব্দহীনভাবে মেঝেতে বসে কাতরাতে লাগলেন। অতঃপর পাড়ার কয়েকজন মিলে অভ্রকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে। অভ্রের মা আর অপেক্ষা করেনা তিনি বুঝে গিয়েছেন আজ মেহেভীনকে না পাওয়ার কষ্টেই তার ছেলে এমন একটা কাজ করেছে। তাই তিনি দ্রুত মেহেভীনের নাম্বারে ফোন দিয়ে জানান বিষয়টি। ঘটনাটি শুনার পরে আরহামের মাথাও কেমন ফাঁকাফাঁকা লাগছে। এমন একটা মুহুর্তে তার ঠিক কি করা উচিৎ সে বুঝতে পারছে না। যতই হোক অভ্র তাই ভাই। তার ভাইয়ের এমন পরিনতি সে কখনোই আশা করেনি। আরহাম মেহেভীনের দিকে তাকাতেই সে দেখতে পায় মেহেভীন নির্বিকার ভঙ্গিতে ঠায় বসে আছে। অশ্রু গুলো বাঁধন ছাডা হয়ে শান্ত ভঙ্গিতে গড়িয়েই পড়ছে।
মেহেভীনের এমন নিরবতা আরহামের অস্হিরতাকে দ্বিগুনভাবে বাড়িয়ে তুলছে। আরহাম ঠোট নাড়িয়ে বলে,
‘ মেহেভীন হসপিটালে যাবে তো? ‘
‘ হ্যা যাবো আমি। আমায় নিয়ে চলুন আরহাম সাহেব।’
মেহেভীন স্পষ্টভাবেই জবাব দিলো। আরহাম অপেক্ষা করলো না তৎক্ষনাৎ গাড়ির চাবিটা নিয়ে
আরিয়ানকে সাথে নিয়ে মেহেভীন এবং সে বেড়িয়ে গেলো হসপিটালের উদ্দেশ্যে।
___________
হসপিটালে এসেই আরিয়ান এবং আরহাম সর্বপ্রথম ডাক্তারদের সাথে কথা বলতে চলে গেলো। ডাক্তারদের ভাষ্যমতে অভ্রের শরীর থেকে যথেষ্ট রক্তপাত হয়েছে। সঠিক সময়ে অভ্রকে হাসপাতালে নিয়ে না আসলে হয়তো অতিরিক্ত রক্তপাতে অভ্রের মৃত্যু ঘটতো। এখনো অভ্রের যথেষ্ট ঝুঁকি রয়েছে।
তাই অভ্রকে আই সি ইউ তে ভর্তি করা হয়েছে। সবকিছু শুনে আরিয়ান এবং আরহাম দুজনেই দুশ্চিন্তার ভাবনায় ঢুবে গেলো।
আই সি ইউ এর সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কাঁচের জানালা দিয়ে অভ্রের কাঠ কাঠ শক্ত মুখখানা কিছুটা দেখা যাচ্ছে। অক্সিজেন মাস্ক অভ্রের মুখে দিয়ে রাখা হয়েছে। মেশিং দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে অভ্রের হৃদয়ের স্পন্দন কতটা ধীরে ধীরে কম্পিত হচ্ছে। অভ্র এখন মেহেভীনের প্রাক্তন স্বামী হলেও এইটা তো সত্য অভ্র একসময় তার ভালোবাসার মানুষ ছিলো। এর থেকে কঠিন সত্যি আর কিছু হতে পারে না আদোও। তখনি পাড়ার একজন চিকন খাটো ছেলে
মেহেভীনের হাতে একটি চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বলে,
‘ মেহু আপু! অভ্র ভাইয়ের ঘর থেকে পেয়েছিলাম চিঠিটা। আপনার নাম লিখা ছিলো। তাই আপনাকে দিলাম। ‘
মেহেভীন কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠিটা নিলো। চিঠিটাতে
অভ্রের রক্ত লেগে রয়েছে। মেহেভীন চিঠি খুলেই দেখতে পেলো তাতে লেখা,
‘ মেহু কেমন আছিস তুই? যদিও আমি জানি না
তোকে মেহু বলে ডাকার অধিকার আছে কিনা তবুও ডাকলাম। জানি তুই ভালো আছিস। আরহামের সাথে। ভালো থাকারই কথা। আরহামই পারে তোকে সুখী রাখতে। তা আজ নিজ চোক্ষে দেখলাম। জানিস মনটা বড় বেহায়া তুই সুখে আছিস তবুও আমার কষ্ট হয়। মরণ যন্ত্রনা অনুভব নয়। যতই খারাপ হই না কেন ভালোবাসি তোকে।
নিজেকে সবসময় ঘৃণিত মনে হয়। আজ যদি আমি তোর সাথে প্রতারণা না করতাম। তাহলে আমাদের জীবনটা তো অন্যরকম হতে পারতো তাইনা? আমাদের সন্তান আজ বেঁচে থাকতো। আমি সত্যিই বড্ড খারাপ। আমি মায়রার জীবনটাও শেষ করে দিয়েছি। আমার এখন নিজেকে দেখলে শুধু ঘৃণা হয়। অতিষ্ট হয়ে উঠছে এই জীবনটা। আমি আর পারছি না। জীবনের সাথে পেড়ে উঠছি না। তাই আমি এইবার সবাইকে মুক্ত করে দিবো। চলে যাবো বহুদূর। পড়তে দিবো না তোদের জীবনে অভ্র নামক কোনপ্রকার কালো ছায়াকে। ভালো থাকিস মেহু। ভালোবাসি। ‘
ইতি…..
বাকিটুকু আর লিখতে পারনি অভ্র হয়তো তার আগেই চোখ বুজে ফেলেছিলো সে।
চিঠিটা পড়ে মেহেভীন মুখ চেপে কেঁপে কেঁপে কেঁদে উঠলো মেহেভীন নিজের অজান্তেই। অভ্রকে সে এই অবস্হায় দেখবে কখনো আশা করেনি। হ্যা সেই চেয়েছিলো অভ্রের কঠিন শাস্তি হোক। যাকে বলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। তাই বলে অভ্রের মৃত্যু সে কখনোই কামনা করেনি।
গালে কারো হাতের আলতো স্পর্শে আখিজোড়া বন্ধ করে ফেললো মেহেভীন। স্পর্শেই সে খুব ভালো করে অনুভব করতে পারে। এই স্পর্শ তার স্বামীর।
মেহেভীন ঠোট জোড়া কামড়ে চিঠিটা দেখিয়ে আরহামের দিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে চেয়ে বলল,
‘ আরহাম সাহেব দেখুন না অভ্র এইসব কি লিখেছে।’
আরহাম তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে স্বান্তনার রেশ ধরে বলে,
‘ উত্তেজিত হওয়ো না মেহেভীন। কঠিন পরিস্হিতিতে যত নিজেকে শান্ত রাখবে ততটাই পরিস্হুতি শান্ত থাকবে। ‘
মেহেভীন শান্ত হলো না বরং আগের থেকেও বেশি অস্হির হয়ে জানতে চাইলো ডাক্তার কি বলেছে অভ্রের ব্যাপারে? আরহাম নিরবতা পালন করলো কিছুক্ষন। স্হীর হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো। মেহেভীন কিছু বলার আগেই, ইশরা বেগম হন্তদন্ত হয়ে হাসপাতালে ছুটে এলেন। এসেই মেহেভীনকে দেখে কাঁদতে কাঁদতে, মেহেভীনের হাত জোড়া ধরলেন। অনুনয়ের সুরে বললেন,
‘ আমাকে ক্ষমা কর মেহু মা। আজ যা কিছু হয়েছে সব আমার জন্যে। বিশ্বাস কর আমার ছেলের দোষ ছিলো না। হ্যা তার শুধু একটাই দোষ ছিলো যে, সে মা ভক্ত হয়ে অন্যায় কাজে নিজেকে যুক্ত করেছিলো। ‘
ইশরা বেগমের কথায় আরহাম মেহেভীন দুজনেই অবাক হয়। ইশরা বেগমের কথায় মাঝেই উপস্হিত হয় মেহেভীনের মা নয়না। তিনি হাত নাড়িয়ে বলে,
‘ মেহু মা আমার। ‘
এতো বছর পরে নিজের মাকে দেখে অনেকটাই বিস্মিত হতভম্ব হয়ে যায় মেহেভীন। এ কি করে সম্ভব? তার মা আজ এতো বছর পরে তার সামনে?
আদোও সেইটা মানা যায়? মেহেভীনের মাকে চিনতে এক দন্ড ও সময় নিলো না আরহাম। সে চিনে ফেললো মেহেভীনের মাকে। মেহেভীন তখন খুব ছোট তখন মেহেভীনের আম্মু তাদের বাড়িতে আসতো। ইশরা বেগমের আপন বোন বলে কথা। বোনের শ্বশুড় বাড়িতে প্রায় যাতায়াত ছিলো তার। তাই আরহাম খুব ভালো করেই চিনে ফেলে মেহেভীনের মাকে।
মেহেভীনের মুখ থেকে আপনি আপনি বেড়িয়ে এলো,
‘ মা! ‘
নয়না নামক মধ্যবয়সী মহিলা চোখ আঁচল দিয়ে মুছে কাছে ডাকলো তার মেয়েকে। মেহেভীন কি ভেবে এগোতে গিয়েও গেলো না। পা দুটো থামিয়ে দিলো অভিমানে। অভিমানি কন্ঠে অভিযোগ নিক্ষেপ করে বললো,
‘এতো বছর কোথায় ছিলে তুমি মা? কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে তুমি? বলো আমায়? ‘
মেহেভীনের কথায় ফোড়ন কেটে, ইশরা বেগম মুখটা শক্ত করে নয়নার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘ কোন মুখে বলবে নিজের পাপের কথা? আমি বলছি। ‘
নয়না অসহায় হয়ে মাথা নিচু করে। মেহেভীন ইশরা বেগমের দিকে তাকাতেই ইশরা বেগম খুলে বললেন
সমস্ত অতীত।
____________
অতীতে যখন মেহেভীনের বাবা এক্সিডেন্টে মারা যায় তখন মেহেভীন এবং তার মা একেবারে একা হয়ে পড়ে। মেহেভীন তখন খুব ছোট। মেহেভীনের মায়ের এবং মেহেভীনের সমস্ত দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন অভ্রের বাবা ইশরা বেগমের সম্মতিতে। অভ্রের বাবার প্রায় সেই সুবাধে মেহেভীনদের বাড়িতে আশা যাওয়া ছিলো। অনেকসময় নানা কাজের বাহানায় তিনি সেখানে থেকেও যেতেন। ইশরা বেগম ও সরল মনে এতোটা তলিয়ে দেখেননি ব্যাপারটা। কিন্তু তিনি জানতেন না তার স্বামী এবং বোনের মনে অন্য কিছু ছিলো। তারা পরক্রিয়ার সম্পর্কে লিপ্ত হয়ে পড়ে।
তখন নয়নার মাথায় শুধু ছিলো মাথায় কোন হাতের।
যার ছায়াতলে সে এবং তার মেয়ে জীবনটা শান্তিতে পাড় করে দিতে পারবে। অন্যদিকে রকিব অর্থাৎ অভ্রের বাবার চোখে শুধু ছিলো এক রাশ মোহ নয়নার প্রতি। একদিন ইশরা বেগম অভ্রের বাবা এবং নয়নাকে কাছাকাছি দেখে সবকিছু বুঝে যান। তখনি অভ্রের বাবা ইশরা বেগমের গাঁয়ে হাত তুলে তাকে চুপ থাকতে বলে। ইশরা বেগম চুপ থাকেনা বরং খুলে বলে সব টা সবাইকে। সবকিছু শুনে আরহামের বাবা-মা অভ্রের বাবাকে শাসন করলেও সে শুনে না। বরং অভ্রের মাকে ডিভোর্স দিয়ে, পরেরদিন নয়নাকে নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমান একপ্রকার লুকিয়ে। নয়নার মাথায় তখন তার মেয়ের কথাও ছিলো না।
অভ্রের মা ইশরা বেগম রাগে অভিমানে অপমানে
তালুকদার বাড়ি থেকে চলে আসে অভ্রকে নিয়ে। সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় তালুকদার বাড়ি থেকে। এমনকি মেহেভীনকেও তিনি তার কাছে নিয়ে রেখে বড় করতে থাকেন। অভ্রকে ছোট থাকতেই তিনি বিদেশে পাঠিয়ে দেন।
এই ঘটনার ঠিক এক মাস পরে অভ্রের বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা যান।
সময়ের পালাবদলে মেহেভীন বড় হতে থাকে। দেখতে দেখতে কেটে যায় অনেকগুলো বছর।
অভ্র ও দেশে ফিরে আসে,কিন্তু মেহেভীন তো জানতো না তার জন্যে ঠিক কি অপেক্ষা করছে। অভ্র দেশে এসেই মায়রাকে নিয়ে তার মায়ের সাথে দেখা করিয়ে বলে,
‘ মা ও হচ্ছে মায়রা। যার কথা আমি তোমাকে বলেছিলাম। ‘
মায়রাকে অভ্রের মা জড়িয়ে ধরে বলে,
‘ বাহ মাশা-আল্লাহ তো। আমার কিন্তু বেশ পছন্দ হয়েছে। ‘
অভ্র কিছুটা লাজুক ভঙ্গিমায় বলে,
‘ আমি ওকে অনেক ভালোবাসি। আমরা দুজন বিয়ে করতে চাই।’
ইশরা বেগম কিছুটা নিরবতা থেকে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন,
‘ তা না করবে কিন্তু তার আগে যে তোমাকে কয়েকটা মাস অপেক্ষা করতে হবে বাবা। ‘
অভ্র ও মায়রা দুজনেই অবাক হলো। অভ্র ভ্রু কুচকে বলে,
‘ হঠাৎ কেন মা? ‘
‘ তোমাকে মেহেভীনের সাথে প্রেমের অভিনয় করে
বিয়ে করতে হবে। তারপর না হয় ডিভোর্স দিয়ে মায়রাকে বিয়ে করো। ‘
ইশরা বেগমের কথায় অভ্র এবং মায়রা দুজনেই বিস্মিত হয়। অভ্র এগিয়ে এসে অবিশ্বাসের সুরে বলে,
‘ এইসব তুমি কি করছো মা? আমি এইসব কেন করতে যাবো? মেহেভীনের সাথে মিথ্যে নাটক কেন করবো? ‘
[লেখিকাঃ জান্নাতুল ফেরদৌসি রিমি]
‘ প্রতিশোধ নিবে তুমি। ‘
ইশরা বেগমের নির্লিপ্ত উত্তর। অভ্র নির্বিকার। ইশরা বেগম চশমাটা চোখে লাগিয়ে, অধরের কোণে হাল্কা হাসি ফুটিয়ে বললেন,
‘ শুনলাম নয়না নাকি দেশে ফিরেছে। মেয়ের খোঁজ খবর নিচ্ছে। যতই হোক নিজের মেয়ে তো,কিন্তু নিজের কৃতকর্মের জন্যে সামনে আসতে পারছে না। তাই এইটাই সুযোগ। ও আমাদের সংসার ভেঙ্গেছে। তাই আমি ওর মেয়ের সংসার ভেঙ্গে বুঝিয়ে দিবো সংসার ভাঙ্গার কতটা কষ্ট। তাই তুমি মেহেভীনের সাথে মিথ্যে বিয়ের নাটক করবে। ‘
‘ কিন্তু তাই বলে মা এইটা অন্যায়। এখানে মেহেভীনের কি দোষ?’
অভ্র আর কিছু বলার সুযোগ পেলো তার আগেই ইশরা বেগম ভেজা গলায় বলে,
‘ তুই তোর মায়ের জন্যে এইটুকু করতে পারবি না?
দেখ অভ্র আমি হয়তো আর বেশিদিন বাঁচবো না,কিন্তু তার আগে আমি নয়নার কাছে প্রতিশোধ নিতে চাই। ফিরিয়ে দিবো সমস্ত যন্ত্রনা যা ও আমাকে দিয়েছে। মেয়ের যন্ত্রনায় মায়ের পরাণ ঠিক কাঁদবে। তা আমি তৃপ্তি ভরে দেখতে চাই অভ্র।
তুমি যদি তোমার মাকে ভালোবাসো তাহলে কাজটি তুমি করবে। ‘
অভ্র অসহায় দৃষ্টিতে তার মায়ের দিকে তাকালো।
না চাইতেও সে অন্যায় কাজটি করে ফেলে। এমনকি ভালোবেসে মায়রাও অভ্রের সাথে প্রতিশোধের নোংরা খেলায় যুক্ত থাকে।
বর্তমান,
সবকিছু শুনে দাঁড়িয়ে থাকা দায় হয়ে পড়ে মেহেভীনের। সে পড়ে যেতে নিলে আরহাম এসে তাকে ধরে ফেলে। মেহেভীনের বিশ্বাস হচ্ছে না তার মা এতোটা নীচ। সে ঘৃণার চোখে তার মায়ের দিকে তাকায়। তার মায়ের দৃষ্টি নীচে। অপরাধীর ন্যায় মাথা নিচু করে রয়েছেন।
আরহাম রোষপূর্ন দৃষ্টিতে ইশরা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘ ছোট মা তুমি প্রতিশোধের নেশায় এতোটা অন্ধ হয়ে গিয়েছিলে? মাথা ঠিক আছে তোমার? একজন এর প্রতিশোধ আরেকজন এর উপরে নিচ্ছো। এই খারাপ কাজটি অভ্রকে দিয়ে একটুও বিবেকে বাঁধলো না তোমার? আজ তোমার জন্যে সবার জীবন এতোটা এলোমেলো হয়ে গেলো।’
‘ হ্যা তাই। আমারই দোষ। প্রতিশোধের নেশায় মাথা কাজ করেনি আমার। নির্দোষ মেহেভীনকে শাস্তি দিয়েছি আমি। তারই শাস্তি পাচ্ছি আমি। আজ আমারই জন্যে আমার ছেলেটা মৃত্যুর মুখে রয়েছে।’
ইশরা বেগম মুখ চেপে কেঁদে দিলেন। মেহেভীনের মাথায় ঘুড়পাক খাচ্ছে অভ্রের কথাগুলো। অভ্র তাকে এই কথাগুলো বলতে চাইতো, কিন্তু সে শুনেনি। মায়রার গর্ভবতী অবস্হায় হসপিটালে চলে আসে।
ডাক্তার জানিয়েছে অভ্রের নাকি বাঁচার তেমন একটা আশা নেই। অভ্রের এমন অবস্হা শুনে মায়রা তৎক্ষনাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে……..
চলবে…..