বাসন্তী প্রেম পর্ব ৩

#বাসন্তী_প্রেম 🌼🌼
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)
#তৃতীয়_পর্ব

– ” হ্যাঁ, আমি দেখেশুনে চলতে পারি না! সেই ক্ষমতাই আমার নেই। কেননা আমার দৃষ্টিশক্তি অনেক আগেই হারিয়ে গিয়েছে!”
ধীর গলায় মাথা নিচু করে বলে উঠল সিরাত‌। চারপাশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। আর ফাইয়াজের কানে সেই কথা পৌঁছাতেই সেও থম মেরে যায়। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। অবাক দৃষ্টিতে শুধু ফ্যালফ্যাল করে সিরাতের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

– ” আপু, এই আপু তুই এখানে কি করছিস একা?”
সিরাতকে ডাকতে ডাকতে সেখানে উপস্থিত হলো নিশাত। চোখে মুখে একরাশ আতংক।
– ” তুই ঠিক আছিস? সরি আপু ভীড়ের মধ্যে কখন যে তোর নাগাল হারিয়ে ফেলেছিলাম টের পাইনি।”
সিরাতের বাহুদ্বয়ে‌ হাত রেখে প্রলাপ বকা শুরু করে দেয় নিশাত।
– ” আরে আমি ঠিক আছি! আসলে আমারই একটু কেয়ারফুল হওয়া উচিত ছিলো। আসলে একটা সমস্যায় পড়ে গিয়েছিলাম।”

সিরাতের কথা শুনে নিশাত কিছু বলবে তার আগেই নিশাতের চোখ গেল সিরাতের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন সুদর্শন যুবকের উপর‌।

– ” ভাইয়া আপনি? আপনি না কালকে আমাদের হেল্প করেছিলেন?”
নিশাতের প্রশ্নে ধ্যান ফিরে ফাইয়াজের।
– ” হ্যাঁ, আমিই ছিলাম কাল রাতে।”
– ” কাল রাতে আপনাকে ভালো করে ধন্যবাদ ও জানাতে পারলাম না, তার আগেই আপনি চলে গিয়েছিলেন। বাই দা ওয়ে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি না থাকলে কাল রাতে যে কি হতো?”

বিনিময়ে একটা সৌজন্যমূলক হাসি দিলো ফাইয়াজ।
– ” হাই ভাইয়া আমি নিশাত। আর এ হলো আমার আপু সিরাত আনবার পূরবী!”
ফাইয়াজের দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে বলে উঠলো নিশাত।
– ” আমি ফাইয়াজ। ফাইয়াজ আহমেদ মুগ্ধ।”

– ” আরে আপনি কি সেই ফেমাস রকস্টার মুগ্ধ? যার কনসার্ট শো আর কয়েকদিন পর লাইভ টেলিকাস্ট হবে!”
নিশাত অতি এক্সাইটেড হয়ে জিজ্ঞেস করতেই হালকা হাসে ফাইয়াজ।
– ” হ্যাঁ আমিই রকস্টার মুগ্ধ!”
– ” ও মাই গড! আনবিলিভেবল! এভাবে আপনার সাথে দেখা হবে আমি কল্পনাতেও ভাবিনি! ইউ নো আ’ম ইউর বিগ ফ্যান‌।”

এদিকে নিশাত আর ফাইয়াজের কথোপকথন নিশ্চুপ শ্রোতার মতো একমনে শুনে যাচ্ছে। মুখ দিয়ে টু শব্দও বের হচ্ছে না। আসলে করার ই বা কিছু নেই। নিশাত মেয়েটাই সবার চেয়ে একটু বেশি চঞ্চল স্বভাবের অধিকারী আর অন্যদিকে সিরাত হলো তার সম্পূর্ণ বিপরীত।

– ” কি ব্যাপার তোমরা দুজন আমাকে এভাবে না বলে এসে পড়লে কেন পূরবী, নিশাত? ভেতরে তোমাদের দুজনকে হঠাৎ না পেয়ে কি ভয়টাই না পেয়েছিলাম!”
পেছন থেকে চন্দ্রিকা উদ্বিগ্ন গলায় বলে উঠলো। পরক্ষণে নিশাতের‌ সাথে একটা ছেলেকে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখে বেশ খটকা লাগলো তার। এখানে তো চেনা পরিচিত কেউ আছে বলে মনে হয় না চন্দ্রিকার।
– ” নিশাত, এই ছেলেটা কে?”
নিশাতকে উদ্দেশ্য করে বলল চন্দ্রিকা।
– ” চন্দ্রিকা আপু, তোমাকে বলেছিলাম না যে কাল রাতে একজন আমাদের ঐ গুন্ডাদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল? ইনিই সেই। ফাইয়াজ ভাইয়া।”
চোখের ইশারা দিয়ে ফাইয়াজকে লক্ষ্য করে বলে উঠলো নিশাত‌।

– ” ওও আচ্ছা! যাক আপনার সাথে দেখা হয়ে ভালোই লাগলো! আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ঐ সময় এই দুজনের হেল্প করার জন্য।”
এভাবেই মিনিট পাঁচেক কিছু আলাপচারিতার মধ্য দিয়েই কেটে গেল।

– ” ফাইয়াজ? ওখানে দাঁড়িয়ে কার সাথে কথা বলছিস? আনোয়ার আঙ্কেল আমাদের দুজনকে পিকআপ করার জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। এবার এই লাগেজ নিয়ে তারাতাড়ি চল!”
ধ্রুব প্রলাপ বকতে বকতে এসেও থমকে দাঁড়ালো।
ফাইয়াজের সামনে দাঁড়ানো এক নারীর অবয়বে তার চোখ আটকে গিয়েছে।
হালকা গোলাপি রঙের কুর্তি পড়নে‌, হোয়াইট কালারের হিজাব গলায় পেঁচিয়ে রাখা, চুলগুলো সুন্দর করে উঁচু করে বাঁধা। মুখে অযথা কোনো বাহ্যিক মেকআপের আস্তরণ নেই।

– ” আচ্ছা ঠিক আছে। আমরা এখন আসি! পরিচয় হয়ে অনেকটাই ভালো লাগলো।”
নিশাত, চন্দ্রিকা আর সিরাতকে কথাটি বলল ফাইয়াজ। তবে গন্তব্যে পা এগোনোর পূর্বে কেন জানিনা হঠাৎ করে আবারো থমকে দাঁড়ালো সে। চোখ দুটো ‌সিরাতের উপর আবদ্ধ। কিন্তু কি কারণে যে থমকে দাঁড়ালো সে নিজেও জানে না।
এদিকে সিরাত ও পূর্বের তুলনায় আবারো নিশাতকে অবলোকন করে তার পিছু পিছু এগিয়ে গেল। ধ্রুবের কথায় ধ্যান ফিরে আসতেই ফাইয়াজ ও লাগেজ হাতে উল্টো দিকে পা বাড়ায়।
দুটো মানুষের গন্তব্যই আলাদা আলাদা। দু দিকে দুটি রাস্তা। উভয়েই দু দিকে পা বাড়িয়েছে। এই দেখাই কি শেষ দেখা নাকি আবারো নিয়তি তাদের দুজনকে মুখোমুখি এনে দাঁড় করাবে‌?

ট্রেন রেলওয়ে স্টেশন থেকে বের হতেই খানিকটা দূরে সারি সারি সিএনজি, ক্যাব, অটোরিকশা চোখে পড়ে নিশাত আর চন্দ্রিকার। হাতে ঝুলন্ত ব্যাগ থেকে ফোন বের করতেই খেয়াল করলো অনেকটাই বেলা হয়ে গিয়েছে।
ছোট একটা ক্যাব ঠিক করতেই সেটাতে তিনজন উঠে পড়লো। এতক্ষণ পর যেন মাথা থেকে সব দুশ্চিন্তা এক ঝটকায় নেমে গেল সিরাতের‌। সিটে বসে শুধু আপনাআপনি কিছু একটা ভেবে মুচকি হাসি দিল। হয়তো সেটা এত কিছুর থেকে মুক্তি পাওয়ার কারণে।

গাড়ি এসে একটা বাংলোর সামনে থামতেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলো ফাইয়াজ আর ধ্রুব। পেছনে ডিকি থেকে লাগেজ বের করে ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়লো বাংলোর ম্যানেজার আনোয়ার হোসেনের উপর।
– ” আরে ফাইয়াজ বাবা, ধ্রুব বাবা তোমরা এসেছো? এসো, এসো! এতদিন পর এই বুড়োর মনে পড়লো তোমাদের?”

– ” আরে আঙ্কেল, কি যে বলো এগুলো? তুমি তো জানোই যে এতদিন স্টাডি নিয়ে একটু বেশিই বিজি ছিলাম। এখন দেখো, একটু ছুটি পেতেই তোমার কাছে ছুটে এসেছি! আর তুমি বলছো কি না আমি তোমাকে মিস করি না, নট ফেয়ার!”
ফাইয়াজের বলা কথায় খিলখিল করে হেসে উঠলেন আনোয়ার সাহেব।
ক্লান্ত শরীরে দোতলা ডুপ্লেক্স বাড়ির দোতলায় সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই কর্ণারের দিকে থাকা রুমটা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লো ফাইয়াজ আর ধ্রুব।
রুমের একপাশে বড় একটা ব্যালকনি, মাঝ বরাবর একটা মাঝারি সাইজের খাট, পাশেই স্টাডি টেবিল, একটা বুকশেলফ আর টুকটাক জিনিসপত্র।
রুমে প্রবেশ করে বিছানায় ধপ করে বসে পড়লো ধ্রুব। ক্লান্ত শরীরটাকে যেই একটু বিছানায় বিছানায় এলিয়ে দিতে যাবে তখনই মুখের উপর কেউ সজোরে তোয়ালে ছুড়ে মারতেই হালকা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় ধ্রুব।

– ” আলসেমি ছেড়ে আগে ফ্রেশ হয়ে আয়! তারপর রেস্ট নিবি, আমি একটু বাইরে আছি। পনেরো মিনিটের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে নে। আমি আসছি।”
বলেই ফোন নিয়ে গটগট করে রুমের বাইরে চলে এলো‌। আর এদিকে অন্য কোন উপায়ন্তর না পেয়ে ধ্রুবও পা বাড়ালো ফ্রেশ হওয়ার জন্য।

কলিং বেলের আওয়াজ কানে পৌঁছাতেই একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক দরজা খুলে দিলেন‌। দরজার অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা চন্দ্রিকার উপর চোখ পড়তেই তার চোখে মুখে খুশির রেখা দেখা গেল।
– ” প্রভা মা, তুই? এতদিন পর? কেমন আছিস মা তুই?”

লোকটার কথা শুনে চন্দ্রিকা এগিয়ে গিয়ে লোকটাকে জড়িয়ে ধরলো।
– ” ভালো আছি, চাচা! তুমি কেমন আছো? ”
– ” তোকে ছাড়া ভালো থাকি কি করে বল?
কিন্তু এরা কারা, প্রভা?”
সদর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা সিরাত আর নিশাতকে পরখ করে বললেন ইয়াসিন সাহেব ওরফে চন্দ্রিকার চাচা।
– ” বলছি চাচা, সবটাই বলছি! আগে সবাই ভেতরে চলো তারপর তোমাকে সবটা বলছি!”

চন্দ্রিকার কথামতো সিরাতকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো নিশাত‌। মাঝারি সাইজের দোতলা বাড়ি, সামনের দিকে বাগানের অংশ যেখানে বিভিন্ন ধরনের গাছপালা রয়েছে আর বিকেলের দিকে আড্ডা দেয়ার মতো ছোট একটা জায়গা আর বাচ্চাদের হরেক রকমের খেলার জিনিস।
তিন মাস বয়সে চন্দ্রিকাকে যখন তার নিজের মা-বাবা রাস্তায় একটা শুনশান জায়গায় ফেলে দিয়ে এসেছিল তখন সেটা খেয়াল করতেই ইয়াসিন সাহেব চন্দ্রিকাকে নিজের সাথে এই অনাথাশ্রমে নিয়ে আসেন। তারপর থেকেই নিজের পরিচয়ে চন্দ্রিকাকে‌ বড় করা, পড়াশোনা করানো সব তিনিই করান‌।
অবশ্য কয়েক বছর আগে নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ কথা জানতে পেরেও ঘৃণায় নিজ বাবা মায়ের পরিচয়, তাদের সম্পর্কে খোঁজ চালানোর বিন্দুমাত্র প্রচেষ্টা করেনি সে।………..

#চলবে 🍂

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here