“দ্বিতীয় বাসর’ (গল্প) পর্ব-১০৩
হাসিনা সাঈদ মুক্তা
মিতালীর শরীরটা আবার আগের মতো খারাপ হয়ে গিয়েছে।বন্ধন বাবুর কোনো খবর নেই।
পাগলের মতো মিতু খোঁজ পাঠিয়েছে গ্রামের বাড়ীতে মুহিন ও ঐ বাড়ীর কেয়ারটেকারকে দিয়ে।
কোনো খোঁজ নেই তার।বন্ধনের ফোন নাম্বারে সুইচড অফ।
তার অফিসের কলিগ বা বা বন্ধু সবার নাম্বার মিতালীর কাছে ছিল না।যাদের ছিল তাদের নাম্বারে কল করার পর তারা সবাই একই কথা বল্ল।
বন্ধন মিশনে গিয়েছে সে কথাই জানালো।
সব আশা ভরসা শেষ মিতুর।
মনে মনে প্রচণ্ড ক্ষোভ এখন ওর।সেতারার সাথে সেও মালয়েশিয়া চলে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় মিতালী।
ঢাকায় আসার পর আবারও মাথা ঘুরে পড়ে যায় মিতু।
সেতারা বোনের মাথাটা নিজের কাঁধে নিয়ে জানায়,
“তুই ভাবিস না বোন,বন্ধন যদি তোকে না বুঝে চলে যেতে পারে তবে তুইও ওর অপেক্ষায় থাকবিনা।ব্যাস আর কটা দিন অপেক্ষা কর।তোর কাগজপত্র রেডী করে আমি তোকে আমার সাথেই নিয়ে যাবো….।’
মিতু তার বোনের কথা শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে,
“আমার কি সব শেষ হয়ে গেল আপু?বন্ধন কি সত্যি আমাকে ছেড়ে চলে গেছে আর কোনোদিন তাকে পাবো না…?’
“কিচ্ছু শেষ হয় নি মিতু… আর শোন ঐ ফালতু স্বার্থপর লোকের কথা মুখেও আনবি না।মনে কর,এই সন্তানই এখন তোর সব।ওকে নিয়ে বাকি জীবনটা কাঁটিয়ে দিবি,পারবি না…? ‘
মিতু আর কিছুই বলে না।
তার ভাগ্য তার সাথে চরম উপহাস করেছে,সেখানে তার আর কিবা বলার থাকতে পারে।
জামানও তার অফিসিয়াল ট্রেনিং নিয়ে খুব ব্যস্ত।
মাঝে সেও সময় দিতে পারেনি তার হবু স্ত্রী পারুলকে।
পারুল এটা নিয়ে খানিকটা অভিমান করে।তার বিয়েরও এখনও অনেক শপিং বাকি পড়ে আছে।
মিতুর শরীর ভালো নেই,পারিবারিক দুশ্চিন্তা, সেতারাও চলে যাবে সব মিলে সবার মনের মধ্যে একটা মানসিক অস্থিরতা চলছে।
তাছাড়া রোজার ঈদের পর পারুলের বিয়ের অনুষ্ঠান, পারুল যখন শুনলো তার প্রিয় বোন মিতুও চলে যাবে সেতারার সাথে ও খুব হতাশ হয়ে পড়ে।
“আর না গিয়ে কি করবে মিতু আপু,বন্ধন দুলাভাই যে এইভাবে ধোঁকা দিবে আপুতো কল্পনাও করে নি?’
আক্ষেপ জানায় পারুল জামানের কাছে।
“আরে কি যে বলোনা পারুল?বন্ধন স্যারকে কি তোমার তাই মনে হয়?’
“কেন মনে হবে না?এরকম একটা ইরেরসপনসিবল হ্যাসবেন্ড কি তার মতো আছে একটাও?আপু যে আবার প্রেগন্যান্ট তা কি জানে তোমার বন্ধন স্যার?কিভাবে পারলো তোমার স্যার এমনটা করতে?’
“আহা পারুল এভাবে রাগছো কেন?স্যারের এখানে কি দোষ? ‘
“দোষ নেই? এতকিছুর পরও বলছো দোষ নেই?’
“আছে বাট মিতু ভাবীরও কম দোষ নাই,ভাবীর উচিত ছিল তার স্বামীর মন বোঝা,তা না করে তোমাদের মামাতো ভাই হীমেল না কি যেন উনার সাথে আবার মেলামেশা করার কি দরকার ছিল?আর রাতবিরাতে তাকে খাওয়ানোর কি দরকার ছিল? ‘
“কি? কি বল্লে জামান?তুমি মিতু আপুকে সন্দেহ করছো?’
“সন্দেহ নয় পারুল জাস্ট বোঝাচ্ছি, একতরফা বন্ধন স্যারকে তোমরা দোষ দিতে পারোনা।তাছাড়া স্যারের উপরও কম ধকল যায়নি?হসপিটালে ভাবীকে নিয়ে উনি কম টেনশান করেনি?তার শালার জন্যেও দৌড়াদুড়ি করেছেন স্যার।এসব কি তোমরা ভুলে গেছো?বারবার তাকে ইরেরস্পনসিবল করছো?’
“জামান তুমি কি বলতে চাইছো?হীমেল ভাইকে আপু ইচ্ছা করে কি খাইয়েছে?সেই টেবিলে বসে পড়ে খাবার চাইছিল, আপু তাকে খাবার না দিয়ে কি চলে যেতে বলতে পারতো?’
“সেটা বল্লে আজ এতো ঝামেলা হতো না,তোমরা মেয়েরা আসলে ছেলেদের এই ফিলিংসগুলো বুঝতেই চাও না।সব কিছু নিজের মতো ভাবো….।’
“জামান তুমি এসব কি বলছো?আমরা মেয়েরা মানে?তোমরা ছেলেরা কতটা বোঝো হ্যা?আর মিতু আপুকে একতরফা দোষ দিয়ে যাচ্ছো?তাকে দোষ দেয়ার আগে সবকিছু আর একবার চিন্তা করে কথা বলো, তোমরা ছেলেরা অযথা না বুঝে সন্দেহ কেন করবে?বিনা কারনে মেয়েদের মনে কষ্ট দাও আবার একথা বলো?’
ভীষনরকম ক্ষেপে যায় এবার পারুল।
রাগের এক পর্যায়ে টেবিল ছেড়ে উঠে যায় পারুল।
রেস্টুরেন্টে খাবার টেবিলে কথা বলছিল ওরা।
জামান কিছুটা ঘাবড়ে যায় এবার, পারুলকে এবার বোঝাতে নেয় ফের।
বাট সিরিয়াস এবার পারুল জামানের কথায়,
জামানকে ছেড়েই চলে যায় পারুল খাবারটা ফেলে,
“শুনুন মিস্টার জামান আপনারা সব ছেলেরাই আসলে এক।একটা মেয়ের মন যখন পুরোপুরিভাবে পেয়ে যান তখন তাকে নিয়ে খেলতে শুরু করেন।আপুর যদি কোন ভুলত্রুটি থেকে থাকে বন্ধন দুলাভাই এর উচিত ছিল তার সাথে কথা বলা,তাকে এভাবে বিপদে ফেলে চলে যাওয়া নয়, আর হ্যা আপনি?এত যে মিতু ভাবীর দোষ খুঁজছেন আপনার বন্ধন স্যার কি ধোয়া তুলসী পাতা?ইংল্যান্ডে ঐ পাঁপিয়ার কাছে কেন গেছে তাহলে?ঐটা দোষের না?আর আপনি যার সম্পর্কে বলছেন সেও কিন্তু আপনার ভাবী।ভাবীকে নিয়ে আপনি কেন এভাবে বল্লেন?’
জামান কি বলবে ভেবে পায় না,শুধু হনহন করে হবু স্ত্রীর চলে যাওয়া দেখে তাকিয়ে হতবাক জামান।
(চলবে)”দ্বিতীয় বাসর’ (গল্প),পর্ব-১০৪
হাসিনা সাঈদ মুক্তা
কাঁদতে কাঁদতেই বাসায় ফিরে এলো পারুল।
কেন যে এমন হচ্ছে ও কিছুই বুঝতে পারেনা।
শাওয়ার নিয়ে রুমে এসে আবারও ভাবে জামানের কথা গুলো।
“জামান আজকে যা বলেছে তাকি ঠিক বলেছে?মিতু আপু তাকে কত স্নেহ করে?তাছাড়া হীমেল ভাইকে নিয়ে এভাবে ওর কথাটা বলাটা কি ঠিক হয়েছে?জামান, বন্ধন দুলাভাই ওরা তো রীতিমতো মিতু আপুকে সন্দেহ করছে?কিন্তু কেন করবে?বন্ধন দুলাভাই কি আপুকে চিনতে পারেনি?’
খাবার টেবিলে বসেও কিছু খেতে পারেনা পারুল।বারবার মোবাইলটার দিকে তাকায় পারুল।জামানও পরে ওকে ফোন করেনি।তাছাড়া ও একটু রাগ করেছিল বাগদানের পর পারুলকে সময় দিতে পারেনি।পারুলের রাগ ভাঙাতেই এসেছিল জামান ওর বাসায়, ওকে নিয়ে খেতে যাবার জন্য।তারপর বিয়েরও কিছু কেনাকাটা করার কথা ছিল দুজনের।
কিন্তু কি হতে কি হলো।
মনে মনে ভাবে পারুল।
ওকি আজ একটু বেশী রিয়্যাকট করে ফেলেছে?
“তাছাড়া জামান, তার বন্ধন স্যারকে যথেষ্ট রেসপেকট করে ও তার হয়ে দুটা কথা বলতেই পারে।আমি যেমন মিতুর আপুর নামে কোন কথা সহ্য করতে পারিনা?সেও তাই বলেছে…ইশ কি দরকার ছিল এতটা রেগে যাওয়ার?তাছাড়া জামান, নীবিড়ের মতো স্বার্থপর নয়,তার ভাবীর জন্যে ঠিকই দরদ আছে তা না হলে মিতুআপুকে নিজের রক্ত দিতে চলে আসতে পারতো না জামান….?’
জামানের ফোনে ফোন করে পারুল। কিন্তু সুইচজড অফ পায় পারুল।
ওর বুকের ভেতরটা এবার সত্যি তোলপাড় করে যেন….।
অবশেষে কক্সবাজারে যাবার সিদ্ধান্ত হয় জামানের কথায়।
জামানও কিছুদিন নাপাত্তা হয়ে থাকে পারুলের কাছ থেকে।
জামান তার বাসায় আসলে নিজের কানে হাত দিয়ে ক্ষমা চেয়ে নেয় পারুল,
“আই এম সো সরি জামান, সেদিন যে কি হয়ে গেল….! হঠাৎ মাথাটা গরম হয়ে গেল প্লিজ এসব আর মনে রেখোনা?’
“হুম বাট শুনেন বেগম সাহেবা, বিয়ের পর কিন্তু এত হাইপার হওয়া যাবে না ওকে?’
“ওকে স্যার…।’
বলেই দুজন দুজনে জড়িয়ে নেয় ফের।
পারুলের কপালে আলতো চুমু খায় জামান।
পারুলের চোখে পানি টের পায়,
“সেকি পারুল তুমি কাঁদছো?’
“কাঁদবো না তুমি বিনে কি আছে এই জীবনে বলো?’
“সেটা যদি বোঝো তবে কেন এমন করলা বলোতো?’
পারুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় তার হবু স্বামী,
“সরি বলেছি তো….!’
“হাহাঃ হাঃ আচ্ছা শুনো একটা সারপ্রাইজ আছে বুঝছো?’
সাথে সাথে মাথাটা ফিরায় জামানের মুখের দিকে পারুল।চোখ মুখ ঝিলিক দিয়ে ওঠে ওর।
“কি?’
“উহুহ্ এখন বলা যাবে না আর শোন আমরা কক্সবাজার যাচ্ছি আজ রাতেই….!’
“আজ রাতেই?কিন্তু কেন?’
“কি, কেন এসব কিছুই এখন বলবো না আর ম্যাডাম আপনিও আর প্যাঁচায়েন না, একদম জিজ্ঞেস করা যাবে, পৌঁছানো অব্দি।’
“বাট এইভাবে?’
“কিভাবে?’
“মানে বিয়ের আগে?’
“হ্যা সমস্যা কি আজকাল তো বিয়ের আগেই হানিমুন হয় আর তোমাকে তো আমি আধা বিয়ে করেছি….।’
জীভ কেঁটে মজা নেয় এবার জামান।
কোমড়ে হাত রেখে পারুল,
“জ্বীনা এসব চলবে না আগে বিয়ে পড়ে ঐসব….। ‘
“আরে পাগল তুমি দেখি ফাইজলামীও বুঝো না…..?’
কি যেন বলতে গিয়ে ফের কথা ঘোরায় জামান।
“শুনেন ম্যাডাম আপনার প্রিয় সেতারা আপু ও মিতু আপুও যাচ্ছে,সো চাইলেও আপনার সাথে বাসর করতে পারবো না এখন….আর শুনুন আপনি যদি যেতে না চান তাহলে বড় শ্যালিকাদের নিয়ে ঘুড়বো সমস্যা কি?’
পারুল যেন পুরোই অবাক হয়ে যায় জামানোর কথায়।
কিছু একটা আন্দাজ করে সে।
জাপটে ধরে তার হবু স্বামীকে,
“সত্যি বলছো মিতু আপুরাও যাবে?তুমি কি করে রাজী করালে জান?আমার যে কি ভালো লাগছে….!’
আল্লাদে আটখানা এবার পারুল।
“শত হলেও হবুজামাই বলে কথা!আর আমার মতো হ্যানডসাম বোনের হ্যাসবেন্ডের কথা তারা ফেলবে কেন?’
দুজনেই হেসে ওঠে এবার।
পারুল খুব খুশি,জামানের গালে একটা হাত স্পর্শ করে বলে ফের,
“আচ্ছা প্রিয় আমাকে এতদিন মিস করোনি?খারাপ লাগেনি আমার জন্যে?’
“তা তুমি বোঝো না?না হলে এইভাবে ছুটে আসতাম…?’
“তাহলে বুঝো মিতু আপুর কেমন লাগে?আচ্ছা বন্ধন দুলাভাই এর কি এমন লাগে না মিতু আপুর জন্যে ?’
জামান এবার চুপ হয়ে যায়,পারুলকে বুকের কাছে জড়িয়ে ওর মাথাটা আবারও বুলিয়ে দেয় সযতনে….
“বন্ধন স্যারের যে কেমন লাগে তা যদি সত্যিই কেউ জানতো….?’
মনে মনে আওরায় জামান। (চলবে)