#বিকেলে_ভোরের_ফুল
#পর্ব_১৩
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ফুলকে কোলে নিয়ে হেঁটে চলছে স্পর্শ। শুকনো পাতার উপর স্পর্শ পা ফেলতেই খসখস আওয়াজ হচ্ছে। ফুল অবাক হয়ে স্পর্শের দিকে তাকিয়ে আছে আর স্পর্শ সামনের দিকে তাকিয়ে এগোচ্ছে। কিন্তু আড়চোখে কয়েকবার ফুলের দিকে তাকিয়ে ছিল স্পর্শ। স্পর্শ বিড়বিড় করে বলল,”ওভাবে তাকাস না ফুল আমার বুকটা ভারি হয়ে আসে।” কিন্তু মুখে বলল,
–“আমি কি কোন সেলিব্রিটি যে ওভাবে দেখতে হবে??”
ফুল চোখ কুঁচকে বলল,
–“আপনি আমাকে কোলে তুলে নিলেন কেন??”
–“তাহলে কি মাটিতে বসিয়ে পা ধরে টেনে হিচড়ে নিয়ে যেতাম??”
–“সবসময় কথা পেচান কেন??যা জিজ্ঞেস করছি তার ঠিক ঠিক উওর দিলেই তো পারেন।”
–“আমি তো ঠিক উওর দিলাম। আর তাছাড়া তোমার পায়ে কাটা বিধেছে,রক্তও পড়েছে এই পা নিয়ে তুমি হাঁটতে পারতে না। তাই কোলে তুলে নিলাম।”
–“আমি কি বলেছি আপনাকে কোলে নিতে?”
–“বাহ বাহ খুব ভালো। এতদিন তো বলছিলে তোমাকে কিডন্যাপ করে এনেছি বলে কি কোন রিসপন্সিবল নেই, আর এখন বলছো অন্য কথা। এই তোমরা মেয়েরা যে কখন কি বলো কখন কি করো তা বোঝা বড় দায়।”
–“বুঝেছি। একটু আগেই তো কলার কাদি আনতে পারবেন না বললেন আর এখন কলার কাঁদি সহ আমাকে কোলে তুলে নিয়েছেন তো এখন সমস্যা হচ্ছে না??”
–“হচ্ছে তো কিন্তু কিছু করার নেই। আমাকে তো আমার দায়িত্ব পালন করতেই হবে।”
ফুল অন্যদিকে মুখটা ঘুরিয়ে বলর,
–“এমন ভাব করছেন যেন আমি আপনার বিয়ে করা বউ।”
–“একদম না। আমি মোটেও সেরকম ভাব করছি না। বিয়ে করা বউ হলে এভাবে কোলে নিতাম না।”
–“তাহলে কিভাবে কোলে নিতেন??”
–“আদর করে জড়িয়ে ধরে কোলে নিতাম।”
–“আপনি সত্যি অসভ্য একজন কিডন্যাপার।”
–“আমি তো তোমার সাথে কোন অসভ্যতামি করিনি আর এতেই অসভ্য বলছো। যদি অসভ্যতামি করি তাহলে কি করবে??”
–“আপনার সাথে কথা বলাই বেকার খাটুনি।”
ফুলের কথা শুনে স্পর্শ কিছু বলল না বিনিময়ে একটা হাসি দিল। এখনও অনেকটা পথ বাকি। স্পর্শ ক্লান্ত, ফুল স্পর্শের মুখটা দেখেই তা বুঝতে পেরে গেছে। ঘামে ভিজে একাকার,স্পর্শর কপাল বেয়ে ঘাম পরছে কিন্তু তবুও স্পর্শ দিব্যি হেঁটে চলেছে। অবশেষে গন্তব্যে পৌঁছে গেল ওরা। ঘরের ভেতর গিয়ে ফুলকে বসিয়ে দিল ওর হাত থেকে কলার কাঁদি নিয়ে একপাশে রাখলো। তারপর স্পর্শ ব্যাগ থেকে ফার্স্ট এইড বক্স এনে ফুলের পা ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দিলো। ফুল এতক্ষণ স্পর্শের দিকে তাকিয়ে ছিল। এতটা পথ ওকে কোলে করে এনে একটু ও না জিরিয়ে ওর পা ব্যান্ডেজ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে স্পর্শ। ফুল ভেবে পাচ্ছে না স্পর্শ ওর জন্য এতটা করছে কেন??ওর এতো কিসের টান??স্পর্শ এইড বক্স গোছাতে গোছাতে বলল,
–“আমার কাছে কোন ব্যাথার ওষুধ নেই। তাই ব্যথা সারতে একটু দেরি হবে। চুপচাপ বসে রেস্ট করো। তাহলে দেখবে খুব দ্রুত ব্যথা সেরে গেছে। আমি আসছি।”
স্পর্শ এইড বক্স রেখে শার্ট প্যান্ট আর তোয়ালে নিয়ে চলে গেল। ফুল ওর পায়ের দিকে তাকালো। অতটাও ব্যথা পায়নি ও আর এতেই স্পর্শ এতকিছু করলো?? যেভাবে জঙ্গলে লতাপাতা খোঁজার জন্য দৌড়াচ্ছিল মনে হচ্ছিল স্পর্শের পায়ে কাঁটা বিধেছে। কেমন যেন এক অন্যরকম অনুভুতি হচ্ছে ফুলের। আগে তো এই কিডন্যাপারকে অসহ্য লাগতো। তাই তো বারবার পালানোর চেষ্টা করতো। কিন্তু এখন আর আগের মতো অসহ্য লাগে না। আর এখান থেকে পালানোর তো প্রশ্নই আসে না। পালাবেই বা কিভাবে?? চারিদিকে সমুদ্র। ফুল তো সাঁতার জানে না। সমুদ্রে সাঁতার কেটে তীর খোঁজা আর মরুভূমি তে পানি খোঁজা একই হলো।
ফুল আস্তে করে উঠে দাঁড়ালো। খুড়িয়ে খুড়িয়ে জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিলো। স্পর্শ সমুদ্রে সাঁতার কাটছে দূর থেকে ফুল তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। স্পর্শ মনের সুখে এদিক ওদিক সাঁতার কাটছে। ফুল তা দেখতেছে। ফুলের খুব ইচ্ছে করছে সমুদ্রে নেমে গোসল করতে। কিন্তু ও তো সাঁতার জানে না। ছোটবেলা থেকে সমুদ্র তো দূরের কথা পুকুরে পর্যন্ত ওকে নামতে দেওয়া হয়নি। একবার ফুলের বাবা মা জাইফ সাইফ কক্সবাজার ঘুরতে গিয়েছিল। কিন্তু ফুলকে নেয়নি, ফুলের দাদির এক কথা মেয়ে মানুষের এত ঘোরা কিসের?? বিয়ের পর স্বামীর সাথে ঘুরবে। আপাতত ফুল ঘরেই থাকবে। সেকথা মনে পড়ে ফুলের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল। ফুল আবার বসে পড়ল।
কিছুক্ষণ পরেই স্পর্শ ঘরে আসলো তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে। ফুল স্পর্শের দিকে একপলক তাকিয়ে আবার নিচের দিকে তাকালো।কেমন জানি অস্বস্তি লাগতেছে ওর।
স্পর্শ ভালো করে মাথা মুছে খড়ের গাদায় গা এলিয়ে দিলো। চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলো স্পর্শ আর সাথে সাথেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। সারারাত ঘুমাতে পারনি তাই এখন ওর ঘুমের প্রয়োজন। স্পর্শর এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যাওয়াতে ফুল একটু অবাক হলো। এত তাড়াতাড়ি মানুষ ঘুমায় কিভাবে??আর এরকম অবেলায়, এখন তো মনে হচ্ছে দশটাও বাজেনি। ফুল চুপচাপ বসে আছে। এভাবে অনেকক্ষন বসে থাকতে থাকতে ফুলের কোমড় ধরে গেছে তাই সে উঠে দাঁড়ালো। পায়ে তেমন ব্যথা নেই। ফুল হালকা খুড়িয়ে খুড়িয়ে বাইরে এসে একটা গাছের গুঁড়ির উপর বসলো। বাইরের বাতাসে বসে থাকতে ওর খুব ভালো লাগে। চারিদিকে কাঠবিড়ালী গুলো দৌড়াচ্ছিল। ওরা ফুলকে দেখে কেউ গর্তে লুকালো আর কেউ গাছে চড়ে গেল। ফুল গুনগুন করে গান ধরল,
“”তুমি আমার এমনই একজন যারে একজনমে ভালোবেসে ভরবে না এ মন(২)
একজনমের ভালোবাসা একজনমের কাছে আসা (২)
একটি চোখের পলক পড়তে লাগে যতক্ষণ যারে একজনমে ভালোবেসে ভরবে না এ মন।
ভালোবাসার সাগর তুমি,,,,হো,,,, ভালোবাসার সাগর তুমি বুকে অথই জল,,,,,,””
এটুকু বলতেই ফুল থেমে গেল। কারণ আকাশে হঠাৎ করেই কালো মেঘ জমেছে। গুড়ুম গুড়ুম মেঘ ডাকছে।এখুনি বোধহয় বৃষ্টি হবে। ফুল আকাশের দিকে চেয়ে আছে। একটু আগেই তো কি সুন্দর রোদ উঠেছিল আর এখন মেঘ করেছে অবিশ্বাস্য। ফুল আকাশ পানে চেয়ে আছে। মেঘলা আকাশটা অন্যরকম একটা রূপ ধারণ করেছে। কালো মেঘের আড়ালে সাদা সাদা মেঘ দেখা যাচ্ছে এ যেন প্রকৃতির একটা অন্যরূপ।এ রূপের সৌন্দর্য চারিদিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ফুল আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে তখনই একফোঁটা বৃষ্টির পানি ওর গালে এসে পড়লো। বৃষ্টির পানি গালে পড়তেই ফুলের হুস আসল। ওকে তো ঘরে যেতে হবে না হলে তো ভিজে যাবে। তখনই চড়চড় আওয়াজ করে বৃষ্টি পড়তে লাগলো। ফুল তাড়াতাড়ি আসতে পারলো না। পাশে গাছের গুঁড়িতে স্পর্শর জামাকাপড় মেলা ছিল সেগুলো নিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে আসতে আসতে ফুল পুরোটাই ভিজে গেছে।
দরজা খোলার ঝনাৎ করে শব্দ হওয়াতে স্পর্শ চোখ মেলে তাকালো। ফুলকে ভেজা অবস্থায় দেখে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে ফুলের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
–“তুমি এই অবস্থায় বাইরে গিয়েছিলে কেন?? আর এভাবে ভিজেছো কেন??”
স্পর্শর মুখে অস্থিরতা দেখে ফুল বলল,
–“তেমন কিছু না আমি এমনি বাইরে গিয়েছিলাম আর তখনই বৃষ্টি পড়লো আমি আসতে গিয়ে ভিজে গেলাম। এই যে আপনার কাপড়।”
ফুল স্পর্শের দিকে ওর কাপড় এগিয়ে দিতেই স্পর্শ ছোঁ মেরে কাপড়গুলো নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রেগে বলল,
–“তোমাকে কে বলেছে এসব আনতে?? আর তোমাকে তো আমি বারবার বারণ করলাম না উঠতে তুমি উঠেছো কেন??”
স্পর্শর ধমকে ফুল কেঁপে উঠল।বলল,
–“সামান্য একটা ব্যাপারে আপনি এত রেগে যাচ্ছেন কেন??”
–“তুমি এটাকে সামান্য ভাবছো??”
–“সামান্যই তো যেখানে আমার পরিবার আমাকে নিয়ে ভাবে না সেখানে আপনি বাইরের মানুষ হয়ে সামান্য ব্যাপারে এত ভাবছেন কেন??”
স্পর্শ ফুলের কথায় আরও রেগে গেল। কোনরকমে নিজের রাগ কন্ট্রোল করে বলল,
–“আচ্ছা বাদ দাও এসব তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে নাও। এভাবে ভেজা কাপড়ে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে।”
বলেই স্পর্শ অন্যদিকে ঘুরে তাকালো। ফুল গিয়ে ব্যাগ থেকে কাপড় বের করে দাঁড়িয়ে আছে। স্পর্শ পিছনে ঘুরে তাকিয়ে বলল,
–“কি হলো তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করো।”
ফুল আমতা আমতা করে বলল,
–“আপনার সামনেই??”
–“আমার সামনে কেন চেঞ্জ করবে??”
–“তাহলে আপনি এখান থেকে যান।”
–“বাইরে তো বৃষ্টি পড়তেছে। আমি কিভাবে,,,,,,??”
–“তাহলে থাক আমি এভাবেই থাকি।”
–“নো তুমি এখনি চেঞ্জ করবে।”
বলেই স্পর্শ ফুলের হাত থেকে টান দিয়ে ওড়নাটা নিয়ে নিলো। তারপর নিজের চোখ বেঁধে ফেলল।
–“নাও এবার চেঞ্জ করো।”
ফুল একটু অবাক হলো। বলল,
–“আপনি কিছু দেখতে পাচ্ছেন না তো??”
–” না আমি কিছু দেখতেছি না।”
–“ওয়েট আগে আমি চেক করে নেই।”
ফুল স্পর্শের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওর চোখের সামনে দুই আঙ্গুল তুলে ধরে বলল,
–“বলুন তো এখানে কয়টা আঙ্গুল??”
স্পর্শ বিরক্তি নিয়ে বললো,
–“পাঁচটা।”
–“উফফ বাঁচা গেল। আপনি তো কিছু দেখতেই পাচ্ছেন না।”
–“হুম তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করো।”
–“এক মিনিট। আমি চেঞ্জ করার সময় আপনি যদি চোখের বাঁধন খুলে ফেলেন তাহলে?? আপনার চোখ বাঁধা কিন্তু হাত তো নয়। যদি হাত দিয়ে চোখের বাঁধন খুলে ফেলেন??”
–“উফফ তোমার সন্দেহ না গেলে আমার হাত দুটো ও বেঁধে দাও।”
–“গুড আইডিয়া।”
ফুল আরেকটা ওড়না বের করে স্পর্শের হাত দুটো পিছমোড়া করে বেঁধে দিলো। তারপর স্পর্শকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিজে চেঞ্জ করে নিলো। চেঞ্জ করে ফুল স্পর্শের বাঁধন খুলে দিয়ে বললো,
–“আমার চেঞ্জ করা শেষ এবার আপনি চোখ খুলতে পারেন।”
স্পর্শ ওড়নাটা খুলে ফুলের হাতে দিয়ে আবার খড়ের গাদার উপর গিয়ে বসে পড়ল। আর ফুল দরজার সামনে বসে বাইরে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বৃষ্টির পানি হাতে নিয়ে খেলতে লাগলো।
পরেরদিন সকালে স্পর্শর আগেই ফুলের ঘুম ভাঙল। ফুল আড়মোড়া ভেঙে উঠে আস্তে আস্তে বাইরে এলো। তখনই ফুলের চোখ গেল সমুদ্রের তীরে। তীরে একটা বোট ভিড়ানো। বোট থেকে কালো পোশাক পরা তিনজন লোক নামতেছে। এটা দেখে ফুল ভয় পেয়ে যায়। এরা কারা??ডাকাত নয়তো?? ফুল তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে স্পর্শকে ডাকতে লাগলো। স্পর্শ উঠছে না দেখে ফুল স্পর্শকে জোরে ধাক্কা মারতেই স্পর্শ লাফ মেরে উঠল।
চলবে,,,,,,,,
খুব শীঘ্রই ফুল স্পর্শের আসল পরিচয় জানতে পারবে।