বিকেলে ভোরের ফুল পর্ব ১৫

#বিকেলে_ভোরের_ফুল

#পর্ব_১৫

#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

স্পর্শ ফুলের দিকে তাকাতেই ওর চোখ আটকে গেল। আগুনের এই আলোতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে ফুলকে। যদিও ফুল অসম্ভব ফর্সা নয় তবুও স্পর্শর কাছে ফুলকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। আগুনের আলোয় ফুলের গালদুটো লাল লাল দেখা যাচ্ছে। ফুলকে শীতে কাঁপতে দেখে স্পর্শ উঠে গিয়ে ফুলের গা ঘেঁষে বসল। সাথে সাথে ফুল বিষ্ফরিত চোখে স্পর্শর দিকে তাকালো। কিন্তু স্পর্শ চুপচাপ আগুনের উপর হাত দুটো তুলে ধরল। ফুল রাগন্বিত স্বরে বলল,

–“কি ব্যাপার??”

স্পর্শ ফুলের দিকে তাকিয়ে বলল,

–“কোন ব্যাপার না।”

–“কোন ব্যপার না মানে?? আপনি আমার ঘা ঘেঁষে বসলেন কেন??”

–“খুব শীত লাগছিল তাই ভাবলাম কাছাকাছি বসি যাতে একটু শীত কম লাগে।”

–“কি মতলব আটছেন বলুনতো?? আপনাকে দিয়ে বিশ্বাস হচ্ছে না।”

–“ওয়াও আমি মতলব আটছি। আর তুমি এতদিন আমার সাথে থেকেও বিশ্বাস হচ্ছে না যে আমি তোমার ভালো কিছু করব।”

–“না হচ্ছে না। আপনি খুব বাজে লোক আমাকে জোর করে এখানে আটকে রেখেছেন।”

–“দেখ আমি কিন্তু এখন আর তোমাকে আটকে রাখছি না।যদি তোমার যেতে ইচ্ছে হয় তো চলে যেতে পারো।”

–“যাবটা কিভাবে শুনি?? আপনি তো এমন একটা জায়গায় এনেছেন যখান থেকে যাওয়াটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”

–“তাহলে আমাকে দোষারোপ করছো কেন??”

–“উফফফ আপনার সাথে কথায় পারব না আমি।”

শুরু হয়ে গেল দুজনের ঝড়গা। স্পর্শ যেটা বলে ফুল তার বিপরীত কথা বলে। এভাবে ঝড়গা করতে করতে ফুল ঘুমিয়ে পড়ল তাও আবার স্পর্শের ঘাড়ের উপর মাথা রেখে। স্পর্শ ফুলের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ফুলের চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দিল। স্পর্শ মনে মনে বলল,”এই মুহূর্তে একটা সেলফি না হলেই নয়।” আজকে সকালেই ওর লোকেরা ওর ফোনটা দিয়ে গিয়েছে। যাক কাজটা ওরা মন্দ করেনি। যথা সময়ে কাজে লেগে গেল। স্পর্শ চট করে কয়েকটা সেলফি তুলে নিলো। সেলফিগুলো স্পর্শ ভয়ে ভয়ে তুলল। ফুল যদি আবার জেগে যায় তবে তো এবার চারটা চড় মারবে। এর আগে তো দুটো মেরেছিল।

বৃষ্টি রাতেই থেমে গিয়েছিল। সমুদ্রের চারপাশের পরিবেশ এখন ঠান্ডা। কালকে বৃষ্টি হলেও ঝড় হয়নি। সকালের সূর্য উঁকি দিয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু ফুল আর স্পর্শ দুজনের খুব কাছে এসে ঘুমাচ্ছে। কিছুক্ষণ বাদেই স্পর্শের ঘুম ভাঙল। ঘুমঘুম চোখে ফুলের দিকে তাকালো। ফুল স্পর্শকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। আগুন নিভে গেছে। কয়লা গুলো জ্বলজ্বল করছে। স্পর্শ আস্তে করে ফুলকে খড়ের গাদায় শুইয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। দরজাটা খুলতেই কেউ একজন স্পর্শকে ঘুষি মারল। আচমকা এমনটা হওয়াতে স্পর্শ দূরে ছিটকে পড়ে। সেই শব্দে ফুলের ঘুম ভেঙ্গে যায়। ফুল ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো। কি হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করলো।

সাথে সাথেই দুজন পুলিশ ঘরে ঢুকলো। স্পর্শকে নিচ থেকে টেনে তুললো। ফুল তো অবাক তার সাথে খুশিও হলো পুলিশ দেখে।স্পর্শের ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছে। পুলিশ দুজন স্পর্শকে ধরে রেখেছে। তখনই চারজন পুরুষ পুলিশ ও দুজন মহিলা পুলিশ ঘরে এসে ঢুকলো। মহিলা পুলিশ দুজন ফুলকে নিয়ে বাইরে আসলো। বাইরে এসে তো ফুল আরেকদফা অবাক। সমুদ্রের তীরে প্রায় বিশ থেকে পঁচিশ টা বোট ভিরানো। আর পুরো দ্বীপে পুলিশে ভরে গেছে। ফুল ভেবে পাচ্ছে না ওর খবর পুলিশ পেল কোথা থেকে?? ফুল দৌড়ে সমুদ্রের তীরে গেল। ওখানে আজমল চৌধুরী দাঁড়িয়ে আছে। বাবাকে দেখেই ফুল কেঁদে ওঠে। বাবার প্রতি শতঘৃণা থাকা সত্ত্বেও আজকে কেন যেন ওর বাবার প্রতি কৃতজ্ঞ মনে হচ্ছে। ফুল বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। আজমল চৌধুরী মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

–“কাঁদে না ফুল।এইতো আমি এসে গেছি।আর এখন ওই ছেলেটার কি অবস্থা করি সেটা দেখো। আমার মেয়েকে কিডন্যাপ করে এনেছে।ওর শাস্তি অনেক ভয়াবহ হবে।”

একথা শুনেই ফুল ওর বাবাকে ছেড়ে দেয়।স্পর্শর জন্য ওর এখন একটু খারাপ লাগছে। এতদিন স্পর্শর সাথে থাকা সত্ত্বেও ছেলেটা ওঁর সাথে কোন খারাপ কিছু করেনি। এমনকি ওকে বাজেভাবে ছোয়ওনি। বরং ওকে সাহায্য করেছে। আজকে ফুলের কেমন জানি অস্বস্তি লাগছে। কেন জানি ওর মনে হচ্ছে স্পর্শ ওর খুব কাছের কেউ। ফুলের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছে ফুল। ফুল কে এরকম করতে দেখে একজন অফিসার ওর দিকে এগিয়ে এসে বলল,

–“দেখ মামনি তুমি একদম ভয় পেয় না।দেখ এখানে তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা সবাই এসেছি। তুমি আর ভয় পেয় না ওই ছেলেটাকে।”

আজমল চৌধুরী বললেন,

–“হ্যা ফুল আমরা তো সবাই আছি।”

ফুল তবুও কাঁপতেছে। ঘরটার দিকে বারবার তাকাচ্ছে। ওরা এখনও স্পর্শকে নিয়ে আসছে না কেন?? ওকে কি খুব মারছে?? ফুলের প্রায় কেঁদে দেওয়ার মতো অবস্থা। কিন্তু ওর কেন স্পর্শর জন্য কান্না পাচ্ছে??স্পর্শকে তো ফুল ঘৃণা করতো। তাহলে আজ কেন ওর জন্য কান্না পাচ্ছে ফুলের???এসব ভাবতে ভাবতেই ফুলের গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। ফুল বারবার ঢোক গিলতে লাগলো। তখনই স্পর্শকে নিয়ে আসেতে লাগলো। ফুল দূর থেকে স্পর্শের দিকে তাকিয়ে রইল। কেন এরকম হচ্ছে ফুলের সাথে?? পুলিশ সুপার স্পর্শকে নিয়ে তীরে আসতেই আজমল চৌধুরী স্পর্শের দিকে এগিয়ে এসে ওর গালে একটা চড় মারল। সাথে সাথে ফুল কেঁপে উঠলো মনে হচ্ছে চড়টা ফুলের গালে পড়েছে।
আজমল চৌধুরী ক্রোধে ফেটে পড়ে বলল,

–“তোর সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি তুই আমার মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়েছিস। তোকে বলেছিলাম না তোকে একদিন আমি ধরেই ছাড়ব।”

স্পর্শ ঠোঁটে হালকা হাসি ঝুলিয়ে বলল,

–“অনেকটা দেরি করে ফেলেছেন চৌধুরী সাহেব। এবার মোড়টা অন্যদিকে ঘুরবে।সব প্রশ্নের জবাব আপনাকেই দিতে হবে।”

আজমল চৌধুরী স্পর্শের কলার চেপে ধরে বলল,

–“কি বলতে চাস তুই??”

–“মানে আপনার মেয়ে এতদিন ফাঁকা একটা দ্বীপে একটা ছেলের সাথে কি করতে পারে তা ভেবে দেখেছেন কি??”

স্পর্শের মুখে এই কথা শুনে আজমল চৌধুরী আরও রেগে যায়। স্পর্শকে তিনি এলোপাথাড়ি চড় মারতে লাগলেন।সবাই ওনাকে টেনে দূরে নিয়ে গেল। ফুল এখনও স্পর্শের দিকে তাকিয়ে আছে।স্পর্শ ও এবার ফুলের দিকে তাকালো। মুচকি হেসে পুলিশ সুপার কে বলল,

–“অফিসার আমি একটু ফুলের সাথে কথা বলতে চাই।”

–“ওয়াট তুমি ভাবলে কি করে তোমার কাছে আবার ফুলকে ছেড়ে দেব।”

–“আমি জাস্ট কথা বলব। আর আমার কাছে কোন অস্ত্র নেই। জাস্ট ফাইভ মিনিট।”

অফিসার অনুমতি দিচ্ছে না দেখে ফুল বলে উঠলো,

–“অফিসার আমি ওনার কথা শুনতে চাই।প্লিজ,,,,,,,।”

ফুলের কথা শুনে অফিসার অনুমতি দিলেন। স্পর্শ ফুলের সামনে এসে দাঁড়াল। ফুলের চোখ স্পর্শের হাতে লাগানো হ্যান্ডকাফ এর দিকে। স্পর্শ তখনই বলে উঠলো,

–“কুসুম,,,,,,”

স্পর্শের এই কথাটা বলার সাথে সাথেই ফুল চোখ তুলে স্পর্শের দিকে তাকালো। ফুল ভাবলো কুসুম মানে তো ফুল।আর এই নামটা তো ছোটবেলায় ওকে স্পর্শ দিয়েছিল। তাহলে এই ছেলেটা ওকে এই নামে ডাকলো কেন??স্পর্শ আবার বলে উঠলো,

–“দেখ কুসুম আজকে আবার তুই আর আমি আলাদা হয়ে যাচ্ছি।তোর সাথে হয়তো আর কখনো দেখা হবে না। সময়টা খুব তাড়াতাড়ি চলে যায় তাইনা??সময় যদি আটকে রাখা যেত তাহলে আমার থেকে খুশি আর কেউ হতো না।সময়টা আটকে ধরে তোকে নিয়ে থাকতাম।

স্পর্শ একটা দম ফেলে আবার বলল,

–“এতদিন পর তোর সাথে দেখা অথচ দেখ তুই আমাকে চিনতে পারলি না। আমাকে তুই ঘৃণা করিস। আমার থেকে দূরে থাকতে চাস।দেখ আজকে তাই হচ্ছে। আমরা আবার দূরে সরে যাচ্ছি। আর কখনো আমাদের দেখা হবে না।”

ফুলের যে দম বন্ধ হয়ে আসছে। কি বললো ছেলেটা?? ওরা একসাথে ছিল আবার আলাদা হয়ে যাচ্ছে এর মানে কি?? ফুল ধরা গলায় বলল,

–“ক কে আপনি??কি আপনার পরিচয়??”

স্পর্শ ইশারায় ভাঙা ঘরটাকে দেখিয়ে বলল,

–“তোর সব প্রশ্নের উত্তর ওই ঘরটাতে লুকিয়ে আছে।”

পিছন থেকে পুলিশ সুপার বলে উঠল,

–“ইউর টাইম ইজ ওভার।”

স্পর্শকে দুজন পুলিশ টেনে নিয়ে যেতে লাগল।স্পর্শ জোর বলে উঠলো,

–“ভালো থাকিস #বিকেলে_ভোরের_ফুল”

ফুল আর এক মূহুর্ত ওখানে দাঁড়ালো না। ভাঙা ঘরের দিকে দৌড় দিল। পেছন থেকে সবাই ফুলকে ডাকতেছে কিন্তু ফুল কিছুই শুনছে না। দৌড়ে ঘরে এসে সবকিছু ওলটপালট করে দেখতে লাগলো। স্পর্শ বলেছে এই ঘরে ফুলের সব উওর আছে। ফুলের মনে হচ্ছে আজকে বড় একটা সত্য জানবে ও। ফুল সবকিছু তছনছ করে ফেলেছে। স্পর্শের ব্যাগ থেকে সবকিছু বের করে ফেলেছে। কিন্তু কিছু পেল না তাই ফুল অস্থির হয়ে গেছে। হঠাৎ ফুলের চোখ গেল ওর পায়ের কাছে পড়ে থাকা ওয়ালেটের দিকে।এটা তো স্পর্শের ওয়ালেট। ফুল কাঁপা কাঁপা হাতে ওয়ালেটটা হাতে নিয়ে খুলতেই ছবিটা দেখতে পেল। ফুলের পা থেকে যেন মাটি সরে গিয়েছে। তার পাশেই স্পর্শের ফোনটা পড়ে ছিল। ফুল ফোনটা হাতে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে সবটা বুঝে গেল। কান্নার মাঝেও ফুলের মুখে কিছুটা হাসি ফুটে উঠল।

ফুল দৌড়ে বাইরে এলো ততক্ষণে স্পর্শকে বোটে তোলা হয়েছে। বোট সবে মাত্র ছেড়েছে তখনই ফুল গিয়ে দাঁড়ালো।স্পর্শ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে। ফুল কিছু বলার আগেই বোট চলে গেল। ফুল চিৎকার করে বলতে লাগলো,
–“বোট থামাও,বোট থামাও।”

বোটটা অনেক দূরে চলে যাওয়াতে কেউ শুনতে পেল না। আজমল চৌধুরী ফুলের কাছে এসে বললো,

–“কি হয়েছে ফুল?? এরকম করছো কেন??”

ফুল হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,

–“বাবা ও কে জানো তুমি??”

–“হ্যা জানি।”

–“জানো মানে??”

–“হ্যা জানি ও হলো তোমার রাজির আঙ্কেলের ছেলে স্পর্শ।”

স্পর্শের নামটা শুনে ফুলের নিঃশ্বাস আরো ভারি হয়ে এলো। এতদিন ও স্পর্শের সাথে ছিল আর একবারের জন্যও চিনতে পারল না। আজমল চৌধুরী আবার বললেন,

–“ও আমার উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তোমাকে কিডন্যাপ করেছিল। কিন্তু এখন ওকে আমি কঠিনতম শাস্তি দেব। ওর সাহস বড্ড বেড়েছে।”

ফুল আর কিছু শুনতে পেল না শুধু এটুকুই শুনল “ও তোমার রাজির আঙ্কেলের ছেলে।”
চোখদুটো টানছে ফুলের। সাথে সাথেই বাবার বুকে ঢলে পড়ে ফুল,জ্ঞান হারায়।

চলবে,,,,,,,,,,

কালকের পর্বে সব জানতে পারবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here