তোমায় পাবো বলে পর্ব -১৫

#তোমায়_পাবো_বলে
#পর্ব_১৫
#নিশাত_জাহান_নিশি

“তোমার বদলে অন্য কাউকে বিয়ে করার অতিপূর্বেই যেনো আমার মৃত্যু হয়! মৃত্যুকে আমি অতি স্বাভাবিক ভাবেই গ্রহণ করে নিবো। তবু ও তোমার বিপরীতে অন্য কাউকে গ্রহন করতে পারব না। যখন আমি থাকব না, তখন আমার অপূর্ণ ভালোবাসারা পুরনো বইয়ের ভাঁজে শীত ঘুম যাপন করবে। শুধু তোমার স্মৃতিরোমন্থন করে!”

এই সংকটাপন্ন মুহূর্তে দাঁড়িয়ে ঘাঁড়ে লেগে থাকা পরশ ভাইয়ার বাইটের বিশাল আঘাতটা ও অতি তুচ্ছ বলে মনে হচ্ছে! স্বাভাবিক ভাবেই হজম করে নিয়েছি ঐ তীক্ষ্ণ আঘাতটা। তবে হজম করতে পারছি না পরশ ভাইয়ার মুখ থেকে নিঃসৃত “মৃত্যু” নামক শব্দটা। ক্ষোভের দাম্ভিক পাহাড় ঝেঁকে বসেছে মনের গহীনে। নিদারুন যন্ত্রনায় ভিতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে অতি অগোছালো ভাবে। ভালোবাসা মানেই কি তবে ভবিষ্যত মৃত্যুর সম্ভাবনা? ভালোবাসার সমীকরণে কি তবে মৃত্যুর নামক বেদনাতীত সমীকরনটা ও ঠাঁয় পায়? ভালোবাসায় জটিল কিছু অপূর্ণতা থাকবেই। তাই বলে কি সেই অপূর্ণতার কারণ হয়ে দাঁড়াবে একমাএ মৃত্যু? কেনো বললেন লোকটা আমায় না পেলে অতি স্বাভাবিকভাবেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নিবেন? লোকটা কি এখন ও অবধি বুঝতে পারছেন না? আমার বুকে ও কষ্টেরা অতি যত্নে আত্নাহুতি দিতে চাইছে শুধুমাএ উনার ঐ মৃত্যু নামক দুটো অক্ষরের কারণে? কতোটা ভারী পড়েছে ঐ অক্ষর দুটো আমার মনের কোটর জুড়ে!

আঁখি পল্লবে অশ্রবিসর্জন হতেই আমি পরশ ভাইকে সজোরে এক ধাক্কা মেরে আমার থেকে প্রায় এক ফুট দূরত্বে ছিটকে ফেললাম। লোকটা অতি আশ্চর্যিত দৃষ্টিতে আমার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই আমি অশ্রুসজল চোখে তেঁড়ে এসে লোকটার শার্টের কলার চেঁপে ধরে কর্কশ গলায় বললাম,,

“মৃত্যু কি এতোই সহজ? যে আপনি আহ্বান করলেন আর উপর ওয়ালা তাৎক্ষণিক মন্জ্ঞুর করে নিলেন? তবে শুনে রাখুন। উপর ওয়ালা বাধিত নন আপনার কথানুযায়ী মৃত্যুকে আপনার হায়াত পরিপূর্ণ হওয়ার পূর্বেই মন্জ্ঞুর করতে। উপর ওয়ালার যখন ইচ্ছে হবে ঠিক তখনই উপর ওয়ালা আপনাকে, আমাকে এবং পৃথিবীর প্রতিটা জনপ্রাণিকে মৃত্যুর পথে অগ্রসর করবেন। মৃত্যুর স্বাদ পৃথিবীর সবকটা জনপ্রাণিকেই আস্বাদন করতে হবে। আপনি কে হ্যাঁ? উপর ওয়ালার ইচ্ছেকে নিজের ইচ্ছে বলে দাবী করার?”

পরশ ভাই নির্বিকার ভঙ্গিতে কিঞ্চিৎ মুহূর্ত ধরে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আমায় পর্যবেক্ষন করলেন। অতঃপর আকস্মিকভাবে ঠোঁটের আলিজে ক্রুর হাসি ফুটিয়ে পাল্টা আমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললেন,,

“কি ব্যাপার? এতো ক্ষিপ্র হয়ে উঠলে কেনো? আদৌতে কি আমার মৃত্যুর আগাম সংবাদে তোমার কিছু আসে যায়? ব্যাথাটা ঠিক কোথায় লেগেছে তোমার? ঘাঁড়ে না বুকে?”

“কোথাও লাগে নি। আপনি আমার জন্য মোটে ও বাঞ্ছনীয় নন। যে আপনার দেওয়া আঘাতে আমি বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীনভাবে খুব আঘাত প্রাপ্ত হবো!”

“তাহলে চোখ থেকে অশ্রু ঝড়ছে কেনো? আর বুকে? বুক থেকে নিঃসৃত অতিব কষ্টের হু হু শব্দের কান্নারা কেনো দলা পেঁকে আমার কর্ণকুহরে এসে ঠেঁকছে? অনুভূতিরা যেনো ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বলছে,,

“এই পরশ শোন? টয়া তোর কাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর সংবাদে ভীষণভাবে আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে। এই বুঝি তার মনের মৃত্যুটা ও ঘটল!”

“ভুল ভাবেছন আপনি। নিতান্তই ভুল ধারনা আপনার! আপনার মৃত্যু কখনো আমার জন্য কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না। না আপনার মৃত্যুর কারনে আমার মনের মৃত্যু ঘটবে!”

“কতোদিন লুকিয়ে রাখবে মনের সেই অব্যক্ত কথা গুলো? একদিন কি তারা কপাট খুলে হুড়মুড়িয়ে বের হতে চাইবে না? অন্ধকারে কি তারা হাঁফিয়ে উঠবে না? তখন কিন্তু তারা আলোর পথ খুঁজবে! আর তুমি ও তখন বাধিত থাকবে কপাট খুলে তাদের নির্দ্বিধায় বের করতে!”

“হয়েছে আপনার? এবার আপনি যেতে পারেন!”

“ভাগ্যিস মৃত্যু নামক দু অক্ষরের শব্দটা মুখ থেকে নিঃসৃত করতে বাধ্য হয়েছিলাম! নয়তো কখনো জানতেই পারতাম না টয়া ও আমাকে…

অসভ্য লোকটার শার্টের কলার ছেড়ে আমি দাঁতে দাঁত চেঁপে লোকটার নেশাক্ত দৃষ্টিতে ভযানক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,,

“যেতে বলেছি না আপনাকে? অহেতুক কথা টানছেন কেনো?”

পরশ ভাই শার্টের কলারটা ঠিক করে মোহসিক্ত চোখে আমার দিকে খানিক ঝুঁকে এসে বাঁকা হেসে বললেন,,

“ওহো! এতো রেগে যাচ্ছ কেনো? ভালোই তো লাগছিলো তোমার তপ্ত শ্বাসের মহা প্রলংকারী শব্দে, শরীরের মাতাল করা ঘ্রাণে, মোহ মায়ায় আচ্ছন্ন ঐ দুটো চোখে, বুকের মধ্যিখানে এতোটাই মিশে ছিলে যেনো, নিশ্বাসেরা ফাঁকফোকর খুঁজে পাচ্ছিলো না পালিয়ে বেড়াতে!”

“ভেজায় অসভ্য লোক দেখছি আপনি। এতক্ষন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছিলেন? অমনি যখন শার্টের কলারটা ছেড়ে দিলাম তখনই আসল রূপটা প্রকাশে আনলেন?”

পরশ ভাই রঙ্গরসিক ভঙ্গিতে হেসে রুম থেকে প্রস্থান নিচ্ছেন আর পিছু ফিরে আমার উদ্দেশ্যে বলছেন,,

“শাড়িটা পড়ে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এসো। তোমার সেহেলিরা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।”

“এই কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”

“শপিং কমপ্লেক্স!”

“কেনো?”

“হোয়াট রাবিশ? তোমরাই শাড়ি পড়ে ঘুড়বে। আর আমি একই বস্ত্রে অবলা পুরুষদের মতো ঘুড়ব?”

“যাক, সুবুদ্ধি হয়েছে তবে!”

“পিয়াস বলল, নারীদের ইমপ্রেস করতে নাকি পোষাক নির্বাচনে খুব সতর্ক হতে হয়?”

“এ্যাঁ?”

“এ্যাঁ না হ্যাঁ! পুরুষ হিসেবে ও নাকি খুব ইমপ্রেসিভ হতে হয়। এই ধরো চুলের স্টাইল, চোখের ইশারা, ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা অতি সামান্য এক চিলতে হাসি, কথা বলার অতি মার্জনীয় ধরন, একটু খানি গম্ভীর ভাব, অত্যধিক রাগী ভাবটা অবশ্যই বর্জনীয়। দাম্ভিকতা টোটালি ভুলেই যেতে হবে। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে প্রেমিকার সাথে কথা বাড়াতে হবে। হাঁটা চলার ধরনে ফিল্মস্টার শাহরুখ খান টাইপ ভাব থাকতে হবে। মোদ্দা কথা সব মিলিয়ে নিজেকে অতি ইমপ্রেসিভ ভাবে জাহির করতে হবে। যেনো তেনো প্রকারেই হোক, প্রেমিকার মন জয় করতেই হবে।”

মুখ টিপে হেসে আমি খানিক নিম্ন আওয়াজে বললাম,,

“নির্ঘাত মিলি আপু এবার হার্ট ফেইল করবেন!”

এ্যাঁ বাবা! লোকটা সব শুনে নিলেন! কথাটা বলে যে একটু খানি দম নিবো তার সুযোগটা ও পেলাম না পর্যন্ত৷ অমনি লোকটা আমার সুরে সুর মিলিয়ে কেমন যেনো ক্রুর হেসে বললেন,,

“ইয়েস। ইমপ্রেস তো মিলিকে হতেই হবে! দুর্লভ জিনিস পেতে কষ্ট তো করতেই হয়!”

মানে কি? আমি তো জাস্ট মজা করে কথাটা বলেছিলাম! ভেবেছিলেন লোকটা রেগে এসে আমাকে চেঁপে ধরবেন! কিন্তু না। লোকটা তো দেখছি রীতিমতো আমার আপুকে দুর্লভ জিনিস ভাবতে শুরু করেছেন। আমার হ্যাঁ তে হ্যাঁ ও মিলাতে আরম্ভ করেছেন। সত্যিই কি তবে লোকটা মিলি আপুকে ইমপ্রেস করতে নিজেকে পরিবর্তন করতে চাইছেন? এমন হলে কিন্তু লোকটাকে আমি মেরে ফেলব। ঠিক গলা টিপে মেরে ফেলব। অত্যধিক রাগে বশীভূত হয়ে আমি লোকটার দিকে তেঁড়ে এসে বললাম,,

“সত্যিই আপনি মিলি আপুকে ইমপ্রেস করতে চাইছেন?”

পরশ ভাই পূর্বের মতোই মুখের আদলে সাবলীলতা বজায় রেখে ভ্রু যুগল খানিক নাচিয়ে বললেন,,

“তুমি এক্সয়েক্টলি কি শুনতে চাইছিলে একটু বলবে? কোনো ক্রমে তুমি আবার আমার মুখ থেকে তোমার নামটা শুনতে চাও নি তো?”

সাংঘাতিক ধূর্ত এই লোক! পিঞ্চ মেরে কথা বলা যেনো এই লোকটার চিরাচারিত স্বভাব। ঠিক ধরতে পেরেছেন, আমি আমার নামটাই উনার মুখ থেকে শুনতে চেয়েছিলাম। বুঝে ও না বুঝার ভান ধরাটা যেনো উনার অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ যাই হোক, কিছুতেই আমার দুর্বলতা এই লোকটাকে বুঝানো যাবে না। সন্তপর্ণে এই প্রতিকূল পরিস্থিতিটাকে সামলে নিতে হবে। গলা খাঁকিয়ে আমি ঘাঁড়ের দিকে আঙ্গুল তাক করে লৌহ কন্ঠে লোকটাকে শাসিয়ে বললাম,,

“বাইটের দাগটা ঢাকব কি করে হুম? কাইন্ডলি একটু বলবেন? আমি আপনার কি লাগি? কোন সাহসে আপনি আমার ঘাঁড়ে বাইট বসান?”

আচমকা পরশ ভাই শুকনো ঢোক গিলে চোখ দ্বারা অগ্রে ইশারা করে আমায় কিছু বুঝাতে চাইছেন। আশপাশটায় তাকিয়ে আমি কেবল বাচ্চাদের হৈ, হট্টগোল, আত্নীয়-স্বজনের গোলমালের আওয়াজ শুনছি। মানে লোকটা আমায় যে দিকে ইশারা করছেন আমি সেইদিকে তাকানোর বুদ্ধিটাও পর্যন্ত কুলাতে পারছি না। যাই হোক পরিশেষে আমি উনার ইশারা বুঝে অগ্রে কৌতুহলী দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই বুকের মাঝখানে দু হাত বেঁধে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকা আন্টিকে দেখতে পেলাম৷ সঙ্গে সঙ্গেই আমি পরশ ভাইয়ার সম্মুখ থেকে সরে মাথা নুঁইয়ে নিলাম। অমনি আন্টি রাগে গজগজ করে পরশ ভাইয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পরশ ভাইয়ার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললেন,,

“এই তোর শপিং কমপ্লেক্স না? এই রুমেই তুই শপিং করতে এসেছিস?”

“সবসময় এভাবে রেগে থাকো কেনো মা? যাচ্ছি তো আমি!”

“রেগে থাকি। কারন… কিছু কিছু ব্যক্তিকে আমার পছন্দ না। তাদের দেখলেই রাগে আমার গাঁ পিত্তি জ্বলে উঠে!”

দাঁতে দাঁত চেঁপে কথা গুলো বলে আন্টি দ্রুত পায়ে হেঁটে আমাদের সম্মুখ থেকে প্রস্থান নিলেন। পরশ ভাই দীর্ঘশ্বাস নির্গত করে অসহায় ভঙ্গিতে আমায় কিছু বুঝাতে এলেই আমি ঠাস করে উনার মুখের উপর রুমের দরজাটা আটকে দিলাম! বিষন্ন মন নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে আমি ড্রেসিং টেবিলের সামনে দন্ডায়মান হলাম। ঘাড়ের দিকটায় পরশ ভাইয়ার বাইটের দাগটা সুস্পষ্টভাবে দৃষ্টিলোকন হতেই আমি এক গাঁধা পাউডার মেখে জায়গাটা সম্পূর্ণ ফিল-আপ করে নিলাম! মানে ঢেকে নিলাম। অতঃপর জামা পাল্টে শাড়ি পড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম! আন্টির রাগ কবে, কখন শান্ত হবে আল্লাহ্ নৌজ। আদৌ শান্ত হবে কিনা তাও অনিশ্চিত।

,
,

ঢং ঢং ঘন্টার শব্দে ঘড়িতে বিকেল ৫ টা বেজে উঠল। ঘরোয়া ভাবেই মেহেন্দির স্টেইজ সাজানো হয়েছে আমাদের ড্রইং রুমে। শাড়ি, চুড়ি, টিপ, আলতা পড়ে আমি বিষন্ন মনে বসে আছি মেহেন্দির স্টেইজে। পাশেই অবস্থান করছেন বিয়ের কনে, আমার সব কাজিনরা, পিয়ালী আপু এবং পায়েল ও। সেজে গুজে একেক জন একদম বিয়ে বাড়ি হয়ে আছে। কনের পরে এক এক করে সবাই মেহেন্দি পড়তে ব্যস্ত। স্নিগ্ধা এবং নীলার মেহেন্দি পড়া প্রায় শেষের দিকে। এদের দুজনের শেষ হলেই পিয়ালী আপু এবং পায়েলের পালা। বড় আপু, মিলি আপু এবং আমি সবার পরেই মেহেন্দি লাগাবো হাতে। তাই দল পাঁকিয়ে সবাই বসে আছি মেহেন্দি ওয়ালীদের আশেপাশে। স্টেইজটা সম্পূর্ণ হলুদ গাঁদা, গোলাপ, টিউলিপ এবং রজনীগন্ধা ফুলে সাজানো হয়েছে। ঘ্রানে পুরো স্টেইজটা ম ম করছে। নাক টেনে আমি ফুলের সতেজ ঘ্রান নিচ্ছি। আশেপাশে বাড়ির বাচ্চা কাচ্চারা সবুজ ড্রেস, শাড়ি, পাঞ্জাবি পড়ে গানের তালে তালে নাচছে এবং গাইছে। বাড়ির মহিলা মেহমানরা চেয়ার, টেবিলে বসে আমাদের মেহেন্দি পড়ানো দেখছেন পাশাপাশি বাচ্চাদের নাচ গান দেখে বুক ফাঁটিয়ে হাসছেন। সারা ড্রইং রুম জুড়ে হৈ হৈ, রৈ রৈ এক অবস্থা। বাড়ির সব মহিলা এবং পুরুষ সদস্যরা বিয়ে বাড়ির নানান তোড়জোড়ে ব্যস্ত। দমা ফালানোর সময়টা নেই পর্যন্ত তাদের। রান্নাঘর থেকে রকমারি খাবারের খুশবু ভেসে আসছে নাকে। তবে এদের মাঝে বিরিয়ানির ঘ্রানটাই অত্যধিক। নির্ঘাত আম্মু এবং চাচাীমনিরা হলেন এই স্পেশাল বিরিয়ানির রাঁধুনি! এতো মিষ্টি ঘ্রাণ নাকে ভেসে আসতেই হঠাৎ যেনো ক্ষুধামন্দাটা তড়তড় করে বৃদ্ধি পেলো আমার। এর মধ্যেই আচমকা আন্টি স্টেইজের মাঝখানে এসে হাসিমুখে দাঁড়ালেন। চট জলদি মিলি আপুকে উদ্দেশ্য করে আন্টি উচ্চ আওয়াজে বললেন,,

“মিলি একটু শুনবে? কিছু প্রয়োজনীয় কথা ছিলো তোমার সাথে!”

মিলি আপুর অতি উত্তেজিত মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে এই বুঝি আকাশের চাঁদটা টুপ করে আপুর হাতে এসে পড়ল। দুর্লভ বস্তু হাতে পাওয়া মাএই আপু তড়িঘড়ি করে বসা থেকে উঠে আন্টির সম্মুখস্থ হলেন। অমনি আন্টি আপুর হাত ধরে ড্রইং রুম থেকে প্রস্থান নিয়ে কোথাও একটা মিলিয়ে গেলেন। সামান্য মন খারাপে মাথা নুঁইয়ে নিতেই বড় আপু আমার পাশ থেকে নিম্ন আওয়াজে আমায় শুধিয়ে বললেন,,

“হিমেশকে দেখেছিলি?”

এতো কিছুর মধ্যে হিমেশের কথাটা প্রায় মাথা থেকে বের হয়ে গিয়েছিলাম আমার! আপু বলতেই হঠাৎ স্মরনে এলো। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে আমি আপুর দিকে চেয়ে কৌতুহলী কন্ঠে বললাম,,

“হিমেশ এসেছে তুমি জানো?”

“হুম! আমিই আসতে বলেছিলাম হিমেশকে!”

“কিন্তু কেনো?”

আপু মাথা নুঁইয়ে ইতস্তত গলায় বললেন,,

“জিহাদকে আমি আমার অতীত সম্পর্কে সমস্তটা খুলে বলেছিলাম। সবটা জানার পর জিহাদই আমায় বলল হিমেশকে ইনভাইট করতে! সরাসরি হিমেশের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে!”

“ক্ষমা চেয়েছিলে?”

“না! এখনো হয়ে উঠে নি!”

“যতো দ্রুত সম্ভব ক্ষমা চেয়ে নাও। চিন্তা করো না একদম। সব অবস্থাতেই আমি তোমার পাশে আছি!”

মৃদ্যু হেসে আপু আমার দিকে তাকালেন। অতঃপর আমার বাঁ হাতটা চেঁপে ধরে স্বস্তির শ্বাস নির্গত করলেন। বিনিময়ে আমি ও জোরপূর্বক হাসি টেনে আপুর হাতে আলতো হাত ছোঁয়ালাম।

,
,

সন্ধ্যা ৭ টা বাজছে ঘড়িতে। মেহেন্দি শুকিয়ে আসতেই নাচের প্র্যাক্টিস করতে আমরা সব কাজিনরা দল বেঁধে ছুটে এলাম ছাদের চিলিকোঠায়। নাচ, গান এসব সাংস্কৃতিক দিকে ভীষণ ঝোঁক আমার। শুধু আমার বললে ভুল হবে। বরং কথাটা আমার প্রতিটা কাজিনদের ক্ষেএেই বলা সমভাবে বাঞ্চনীয় হবে। কারণ, নাচ, গানের প্রতি তাদের ও অত্যধিক ঝোঁক। বাড়ি, মহল্লা, পাড়া যেকোনো জায়গায় যেকোনো অনুষ্ঠানে আমাদের নাচ, গান তো মাস্ট বি থাকবেই! নয়তো সবক’টা অনুষ্ঠানই নিরামিশ ঠেঁকবে। আজ যেহেতু নিজেদের কাজিনের বিয়ে। বুঝতেই তো পারছেন! স্টেইজে নাচ, গান করে পুরো ফাটিয়ে দিতে হবে! মিলি আপু ডিসাইড করে রেখেছেন “রাঙ্গিলা তারা” গানটা দিয়ে আমরা সব কাজিনরা নাচব। সাথে অবশ্য পিয়াস ভাই ও থাকবেন! এখন আবার নতুনভাবে যুক্ত হলেন পিয়ালী আপু এবং পায়েল ও! তো আমরা সেই অনুসারেই ছাদের শান্ত, নির্মল, কোলাহলমুক্ত পরিবেশেই নাচের প্র্যাক্টিস করতে চলে এলাম। খানিক ক্ষন বাদেই পার্লারের মেয়েরা চলে আসবে। তাই যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। শাড়ি পড়ে অবশ্য এই নাচটা কোনো মতেই ঠিকঠাক ভাবে তোলা যাবে না। তাই আমরা সবাই একই রঙ্গের লেহেঙ্গা পড়ে নাচটা প্রেজেন্ট করার সিদ্ধান্তে একমত হলাম।

চিলিকোঠার দরজা ভেজিয়ে কোঁমড়ে ওড়না বেঁধে আমরা সব কাজিনরা ফুল ভলিউমে মিউজিক ছেড়ে নাচ করছিলাম। এর মাঝে হাসি, ঠাট্টা, খুনসুটি, ভুল ভ্রান্তি তো আছেই! দিন দুনিয়ার খবর নেই আমাদের। আমরা এখন নিজেরা নিজেদের মধ্যে সস্পূর্ণ মত্ত। কার নাচটা বেশি আকর্ষনীয় হয় তাই দেখার পালা। যাই হোক, খুব মন দিয়ে নাচ করছিলাম এর মাঝেই হঠাৎ আমার কানে এলো দরজার ঠিক ওপার থেকে পুরুষালী কন্ঠের মিনমিন শব্দ। মনে হচ্ছে যেনো এক দল পুরুষ ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে দরজার ঠিক বাইরে। তারা যেনো নিজেদের মধ্যে কোনো এক বিবেধে মত্ত। বাক বিতন্ডা চলছে খুব। কৌতুহল প্রবণ হয়ে আমি উন্মুক্ত চুলে কালো রঙ্গের গোল গাউনটার নিচের অংশে হাত রেখে হুট করে দরজার কপাট খুলতেই কেউ একজন আমাকে নিয়ে ধপ করে মাটিতে ছিটকে পড়ল! কোমড়, মাজা সব গেলো আমার। হাড্ডি-গুড্ডি হয়তো সব গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেছে। চোখ বুজে আমি চিৎকার করে আর্তনাদ প্রকাশ করার পূর্বেই আমার কাজিনরা পাশ থেকে সমস্বরে চিৎকার তুলে বললেন,,

“পরশ ভাই? আপনি এখানে কি করছেন?”

নিমিষের মধ্যেই সমস্ত ব্যাথা, যন্ত্রনা ভুলে আমি অগ্রে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। হায় আল্লাহ্! এতো দেখছি পরশ ভাই! পরশ ভাই আমার গাঁয়ের উপর কি করছেন? লজ্জায়, শঙ্কায়, রাগে মুখের আদলে টকটকে লাল বর্ণ ধারন করে পরশ ভাই হুড়মুড়িয়ে আমার গাঁয়ের উপর থেকে উঠে সংকুচিত দৃষ্টিতে ফ্লোরে চিৎ হয়ে পড়ে থাকা আমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললেন,,

“আর ইউ ফাইন টয়া?”

অমনি পরশ ভাইয়ার পেছন থেকে হিমেশ ভাই এবং পিয়াস ভাই পরশ ভাইয়ার কাঁধে হাত রেখে অট্ট হেসে আমার দিকে অকপট দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,,

“আরে এ আবার জিগ্যেস করার কি আছে? টয়া নিশ্চয়ই বেটার ফিল করছে। এমন সৌভাগ্য কার হয় বল? হিরোয়িনের বুকে হঠাৎ হিরোর এন্ট্রি!”

#চলবে….?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here