#ভালোবাসার রংমশাল
#পর্ব-৫
#সিফাতী সাদিকা সিতু
দুই ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরলো নিঝুমের। নিজেকে হসপিটালের বেডে দেখে অবাক হলো।মনে পরলো ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে রাস্তা পেরোনোর সময় একটা মোটরসাইকেল তাকে ধাক্কা দিয়েছিলো, এরপর কিছুই মনে নেই তার। নার্স নিঝুমের জ্ঞান ফিরেছে দেখে ডাক্তার ডেকে আনলো। ডাক্তার চেকআপ করে বললেন,কোনো সমস্যা নেই তবে সে আজ উঠতে পারবে না। কপালের আঘাতটা বেশি জন্য উঠলে মাথা ঘুরাবে।আগামিকাল চেকআপের পর জানাবেন,হসপিটাল থেকে কবে রিলিজ করবে।নিঝুম নিরবে সব শুনলো।ডাক্তার বেরিয়ে যাওয়ার পর নার্সকে বললো,”আপনি জানেন আমাকে হসপিটালে কে এনেছে?
হ্যাঁ,জানি তো।আপনার হাসবেন্ড এনেছেন আপনাকে।উনি তো সব ফর্মালিটি করলেন, আপনার জন্য ব্লাড ডোনার যোগার করেছেন।সত্যি ওনাকে যা পেরেশান হতে দেখলাম খুব ভালোবাসে বোধহয় আপনাকে!
নিঝুম খুব করে চমকালো,সাম্য তাকে হাসপাতালে এনেছে! কিভাবে তাকে পেলো, সে তো ভার্সিটির কাছে ছিলো? তাছাড়া তার মতো মেয়ের জন্য সাম্য এতসব কেন করতে যাবে?মানবতার খাতিরে করেছে, নাকি দায়িত্ব পালন যাতে মামনি, বড়বাবাকে দেখাতে পারে।মামনির কথা মনে হতেই নিঝুম নার্সের কাছে জানতে চাইলো,”তার নিজের আর কেউ এসেছে কিনা?”
এসেছে একজন মহিলা,উনি আপনার মা বোধহয়।ওনাদের সাথে আপনার দেখা হতে একটু সময় লাগবে।এটা আমাদের হসপিটালের রুলস তবে রাতের আগেই দেখা করতে পারবেন।
সাম্য হসপিটালের করিডরে পায়চারী করছে।নাজনীন বেগম বসে আছেন চেয়ারে। নীরবে চোখের জল পরছে তার।বোন দুলাভাই মারা যাওয়ার পর নিঝুমকে নিজের সন্তানের মতো মানুষ করেছেন।ভালোবাসায় কোনো কমতি রাখেন নি।আজ নিঝুমের যে বিপদ হয়েছে তাতে যদি বড় কোনো অঘটন হতো!সাম্যর দিকে তাকালেন, ছেলেটাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাচ্ছে খুব।ভাগ্যিস সে নিঝুমের ভার্সিটির কাছে গিয়েছিল তা না হলে সময়মতো কে নিয়ে আসতো হসপিটালের? সাম্য, নিঝুমকে নিয়ে তার দুশ্চিন্তা আজ পুরোপুরি দূর হয়ে গেছে।সাম্যর চোখে তিনি নিঝুমের জন্য ভালোবাসা দেখতে পেয়েছেন!
সাম্যর বুকের ভেতরটা কেমন ফাকা হয়ে আছে।নিঝুম কে এক নজর দেখতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে! অথচ এই ইচ্ছে নিষিদ্ধ!নিঝুমের প্রতি যেটা অনুভব করছে তা একদম ঠিক নয়।নিঝুমকে ঘৃণা ছাড়া কিছুই করা উচিত নয়।নিজের মনকে কিছুতেই মানাতে পারছে না।নিঝুমকে রাস্তায় ওভাবে পরে থাকতে দেখে তার বুকে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছিল?কেন হয়েছিলো এমনটা?নিজেই যেন সে নিজেকে বুঝে উঠতে পারছে না।নিঝুমের রক্তে তার শার্ট ভিজে গিয়েছিলো।তখন সাম্যর মনে হয়েছিলো তার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে। নিঝুমকে এমন অবস্থায় দেখবে তা কল্পনাও করেনি কখনো।
কোহিনূর বেগম উকিলের কাছে গিয়েছিলেন নিঝুম, সাম্যর ডির্ভোসের ব্যাপারে কথা বলতে।বাড়িতে এসে শুনলেন,নিঝুম হাসপাতালে আছে।তার কপাল ফেটে অনেক রক্তক্ষরন হয়েছে।সাম্যও সেখানে আছে।নিঝুমের কথা শুনে একটু খারাপ লাগলেও সাম্যর হসপিটালে থাকার কথা শুনে সেটা বিলীন হয়ে গেলো।উল্টো রাগ হলো তার।সাম্যকে ফোন করলেন কিন্তু সাম্য ফোন ধরছে না।শামসুন্নাহার এসে দেখলেন কোহিনূর বেগম কেমন ছটফট করছেন। তিনি ভাবলেন নিঝুমের কথা শুনে চিন্তায় এমন করছেন। তাই এগিয়ে এসে বললেন, চিন্তা করিস কেন ছোটো,তোর বউমা তো ভালই আছে। অবশ্য,কপালে একটু বেশি আঘাত পেয়েছে।
কোহিনূর বেগম নিজেকে সামলাতে না পেরে প্রায় চিৎকার করে বললেন, ওই নিঝুমের কি হলো না হলো তাতে আমার কি যায় আসে,আমার সাম্য কেন হাসপাতালে গিয়েছে?ফোন পর্যন্ত ধরছে না।
শামসুন্নাহার প্রায় হতভম্ব হয়ে গেছেন।কোহিনূর বেগম এসব কি বলছেন।নিঝুম অসুস্থ আর সাম্য হাসপাতালে থাকবে না এটা কেমন কথা এর জন্য এতো রাগের কি আছে।তার মানে কি কোহিনূর নিঝুমকে ছেলের বউ হিসেবে মেনে নেয়নি!নিঝুমের আজ বড় কিছু হয়ে যেতে পারতো।এতোদিন ধরে মেয়েটা এই বাড়িতে আছে অথচ কোহিনূর বেগম বলছেন তার যায় আসে না?বড় ভাবী ফিরলে কথাটা বলতে হবে।ব্যাপারটা তার ঠিক মনে হচ্ছে না।কিছু একটা গোলমেলে আছে!
নিঝুম এক সপ্তাহ হলো হসপিটাল থেকে ফিরেছে। এখন সে অনেকটাই সুস্থ মাঝে মধ্যে একটু মাথার যন্ত্রণা হয়।পরিক্ষার আগে এভাবে অসুস্থ হয়ে গেলো। তাই নিয়েই তার চিন্তা। সে ছাঁদের এক কোণে বসে বই নিয়ে পরছে।এমন সময় তার ফোনটা বেজে উঠলো।বই রেখে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো তার বান্ধবী সিঁথি ফোন করেছে।
-কিরে, তুই এখন কেমন আছিস?
-অনেকটাই ভালো।তোর প্রস্তুতি কেমন?আমার তো এবার কোনোরকম পাশ করা ছাড়া কিছু হবে না।
-কে বলেছে কিছু হবে।তোর মতো এতো ভালো স্টুডেন্ট যদি শুধু পাশ মার্ক তোলে তাহলে আমি তো ফেইল করবো।
-নারে, বিয়ের ঝামেলায় পড়তে পারি নি, এখন আবার অসুস্থ। মামনি খুব বেশি পরতে দেয় না।মাথা যন্ত্রণা করে তো।
-তা, তোর হাবি কি বলেরে।অসুস্থ হয়েছিস, তোর সেবা-শুশ্রূষা খুব করছে তাই না!
নিঝুম কোনো কথা বললো না।হসপিটাল থেকে ফেরার পর সাম্যর সাথে তেমন কোনো কথাই তার হয়নি।রাতে ঔষধ খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমোতে হয়।সেদিনের পর সাম্যও তাকে কিছু বলে নি।নর্মাল বিহেভ করেছে।হয়ত সে অসুস্থ বলে।তবে নিঝুমের হসপিটালের সেইদিনটার কথা মনে পরলো।রাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙে যায়।চোখ মেলেই দেখতে পায় সাম্য তার সামনে বসে তার দিকেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। প্রথমে একটু ভয়ই পেয়েছিলো সে।
তাকে চোখ খুলতে দেখে সাম্য অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলো।কোনো রকমে বলেছিলো, “বড় মা আমার থাকতে বলেছে।”
নিঝুম জানে এই হসপিটালে পেশেন্টের কবিনে কাউকে থাকতে দেয়া হয় না তাহলে সাম্য কিভাবে এসেছিলো?
নার্সটার কাছে জানতে চেয়েছিলো,নার্স হেসে বলেছিলো,আপনার হাসবেন্ড খুব ত্যাড়া লোক।আমাকে ঘুস দিয়ে আপনার কাছে এসেছে। আপনাকে না দেখতে পেলে তো উনি পাগল হতেন!
সাম্যর এই আচরণ তার কাছে অপ্রত্যাশিত। যা সাম্যর সাথে মেলানো যায় না।
নিঝুম এতসব ভাবনায় ভুলেই গিয়েছিল সিঁথি ফোনের ওপাশ থেকে কথা বলছে।সিঁথি নিঝুমের সাড়া না পেয়ে ফোন কেটে দিয়ে আবার কল করলো।
ফোন বেজে ওঠায় চমকে গেলো নিঝুম।তার এমন কান্ডে নিজেই লজ্জা পেলো। ফোনটা রিসিভ করে বললো,”স্যরি।”
-কিসের স্যরি,মানুষ যে ফোনে কথা বলতে বলতে ভাবনায় ডুবে যেতে পারে তা তোকে না দেখে বুঝতেই পারতাম না।সাম্য ভাইয়ার কথা বলতেই তুই কোথায় হারিয়ে গেলি শুনি?কোনো রোমান্টিক দৃশ্য ভাবছিলি নিশ্চয়ই তোর আর ভাইয়ার!
-ধুর কি যে বলিস!এখন বল ফোন কেন দিয়েছিস?
-কাল ভার্সিটি যেতে হবে।আমাদের ভিসি স্যারের ছেলে টিচার হিসেবে জয়েন করবে।তাই কাল নাকি সবাইকে ডেকেছে!
-তুই যাবি?
-যাবো তো,কেন তুই যাবি না?
-ঠিক জানি না,দেখি মামনি কে বলে, বেরোতে দিলে যাবো।
-গেলে আমাকে জানাস।
-ঠিক আছে।
**************
আশফি ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।নিজেকে পরখ করছে সে।আজ থেকে তার জীবনে নতুন একটা পার্ট শুরু হবে।বাবার ইচ্ছে পূরন করা ছাড়া আর কোন অপশন নেই তার।নিজের লাইফ নিয়ে অন্যরকম ভাবনা থাকলেও সেটা সম্ভব হলো না।তবে দেখা যাক কি হয়!
আশফাক আহমেদ স্ত্রীকে বললেন ছেলেকে ডেকে আনতে।বেরোনোর সময় হয়ে গেছে।প্রথম দিনেই সে বেশ দেরি করে ফেলেছে।
মিনারা আহমেদ আশফির রুমে ঢুকে দেখলেন ছেলে ফোনে কথা বলছে। নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।ছেলেটাট কোনো হেলদোল নেই। তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে। একটাই ছেলে হওয়ায় সমস্ত আদর, ভালোবাসা দিয়েছেন। ছেলেটা পড়াশোনায় ভালো তাই বিদেশে পাঠিয়েছেন।সেটাই যেন কাল হলো।বাবা মায়ের গুরুত্ব হারিয়ে গেলো।আশফি তো দেশেই ফিরতে চাইছিলো না।আশফাক আহমেদ অনেক কিছু করে ছেলেকে দেশে এনেছেন।আশফির যেন কোনো কিছুতেই মন নেই।বন্ধু -বান্ধব, ঘুরে বেরোনোতেই সে জীবনের মানে খুঁজে। বয়স হয়ে যাচ্ছে, বিয়ে সঠিক সময় এসেছে, সে বিয়েও করবে না।দু’একটা মেয়ে বন্ধু হলেই চলে যায়।একটা ভালো মেয়ে পেলে ছেলেটাকে সংসারের বাহুডোরে বেঁধে ফেলতেন।আশফাক আহমেদ তো একটু রাশ টেনে ধরেছেন।আজ ছেলেটা ভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে জয়েন করছে।এটা তাদের জন্য অনেক আনন্দের বিষয় অথচ আশফিকে দেখে মোটেও তা বোঝার উপায় নেই। আশফি ফোনে কথা বলা শেষ করে মাকে বললো,”বাবা নিশ্চয়ই ডাকছে,চলো যাওয়া যাক।”
মিনারা ছেলের পানে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলেন।
সাম্য হন্তদন্ত হয়ে নিঝুমের ভার্সিটিতে ডুকলো।রাসেল নামের ছেলেটা তাকে ডেকে নিয়ে গেলো।সেই জানিয়েছে নিঝুমের কথা।নিঝুমের সব খবরাখবর সাম্যর রাসেলের কাছ থেকেই পেয়ে থাকে।সাম্য নিঝুমের ক্লাসের দরজার বাইরে থেকে দেখলো,”নিঝুম একটা সুর্দশন ছেলে ঘাড়ে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আছে আর ছেলেটি নিঝুমের চুল গুলো সরিয়ে দিচ্ছে।” পাশেই নিঝুমের বান্ধবী সিঁথি দাঁড়িয়ে আছে।
চলবে….