#মেঘবৃত্ত
#পর্ব_৩০
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
সময়ের আবর্তনে কেটে গেছে সম্পূর্ণ একটা সপ্তাহ! মেঘার শরীরের ঘা অনেকটাই শুকিয়ে গেছে। তবে, মনের ক্ষত, মনের শূন্যতা সেই আগের মতই। তাজা, হাহাকারপূর্ন! এখনো মাঝেমধ্যে মেঘা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, আলতো হাতে পেটে হাত বুলায়। কথা বলে নিজের ‘মরে যাওয়া সন্তানের’ সাথে। বৃত্তের সাথেও আগের ন্যায় কথা বলে না। ঘরের কাজ সামলে সারাক্ষন বারান্দায় দোলনায় বসে থাকে। উদাস নয়নে চেয়ে রয় আকাশের দিকে। বৃষ্টি পড়ে, মেঘা ভিজে! রোদ হাসে, মেঘা ঝরঝরে হয়। সবই মেঘার উদাসীন থেকে উপভোগ করে। দিন যায়, মেঘার এমন নিশ্চুপতা বৃত্তকে পুড়ায়। বৃত্ত মেঘার আগেরকার চাঞ্চল্যতাকে প্রচন্ড ‘মিস’ করে। কিন্তু, মুখ ফুটে মেঘার সাথে কথা বলার সাহসটা আর হয়ে উঠে না। কি অদ্ভুত না বিষয়টা? যারা প্রায় সারাদিন একে ওপরের সাথে কথা বলায় মশগুল থাকে, যাদের সারাদিনের পুঁজি বলতে সেই আড্ডা,হাসি,মজা,মাস্তি ছিলো, আজ তারাই একে অপরের সাথে কথা বলে না। সারাটাদিন কেটে যায়, একে অপরের নীরবতায়।
আজ ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। বৃত্ত রেজাল্ট আনতে ভার্সিটি এসেছে। বৃত্তকে দেখে সিদ্ধার্থ আর প্রনয় এগিয়ে এলো। বৃত্ত তাদের দেখে মৃদ হেসে তাদের হালচাল জিজ্ঞেস করলো। কিন্তু বৃত্তের সেই কৃত্রিম হাসি তাদের দুজনকে খুব একটা প্রভাবিত করতে পারলো না। সিদ্ধার্থ তো বলেই ফেললো,
— ভাই, এমন সেন্টি মাখা হাসি হাইসো নাতো। তোমারে স্যুট করে না। কি হইসে ফটাফট উগলে দাও তো। শুনি আমরা!
বৃত্ত এড়িয়ে যেতে চাইলো সিদ্ধার্থের কথা। সে চায়না, মেঘবৃত্তের ভেতরকার সমস্যাটা বাইরের কেউ জানুক। কিন্তু, সিদ্ধার্থ আর প্রণয়ের জবরদস্তিতে শেষমেশ মুখ না খুলে পারলো না সে। বৃত্তের মুখে তাদের সমস্যা শুনে সিদ্ধার্থ আর প্রণয় দুজনই হতবাক, বিস্মিত। সিদ্ধার্থ তো বলেই ফেললো,
— আর ইউ সিরিয়াস? তুই মেঘার সাথে এক সপ্তাহ কথা না বলে থাকলি কি করে? আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না। যে তুই মেঘার সাথে এক ঘন্টা কথা না বলে রীতিমত মরে যেতি আর আজ সে তুই এমন করে বেঁচে আছিস কি করে?
বৃত্ত দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কপালে হাত রেখে বললো,
— সবই আমার ফুটা কপাল, ভাই।
প্রণয় বললো,
— মেঘার এই বাচ্চা নিয়ে এত সিরিয়াস হওয়ার কারণ কি? বাচ্চা শেষ তো তোদের মধ্যে সব সমস্যা শেষ। কাউকে আর বাচ্চা নিয়ে কোনো কৈফিয়ত দিতে হবে না। তোদের আর বদনামও হবে না। মেঘা কি সেটা বুঝে না?
বৃত্ত হাতে থাকা পেপসি এক চুমুকে পুরোটা শেষ করে ফেললো। অতঃপর, সেই বোতল ঢিল দিয়ে ফেলে দিলো রাস্তায়। প্রণয়ের দিকে চেয়ে বললো,
— বাচ্চাটা নিয়ে মেঘা প্রথম থেকেই খুব বেশি সিরিয়াস ছিলো। কারণটা জানিনা আমি। আর মেঘা আর আমি দুজনই চাইনি বাচ্চাটা মরে যাক। বরং, আমরা এই বাচ্চাসহই সব সমস্যা সলভ করতে চাইছিলাম। কিন্তু, মাঝখানে সেই অ্যাক্সিডেন্ট…
বৃত্ত আর বললো না। বাকিটা যা বোঝার বুঝে গেলো সবাই। প্রণয় ঠোঁট উল্টে বললো,
— বহুত সিরিয়াস কেইস, মামা।
— আমি বুঝতে পারছি না, মেঘার সাথে কিভাবে কথা বলা শুরু করবো। আমি কথা বলতে চাইলে ও চুপ করে থাকে। রেসপন্স করে না। আরে বাল, আমি তো এটাই বুঝছি না বাচ্চাটা মরার পেছনে আমার দোষটা কোথায়? সে কেনো শুধু শুধু আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলো। ভালো লাগছে না কিছুই, বাল।
বৃত্তের কথার পিঠে সিদ্ধার্থ হঠাৎ করে বলে উঠলো,
— মামা, এক কাজ করতে পারিস তুই। মেঘা যখন একা থাকবে তখন তুই তার পাশে বসবি। কথা বলার সর্বোচ্চ ট্রাই করবি। কথা না বললে কারণ জিজ্ঞেস করবি। মানে, যেকোন ভাবেই মেঘাকে কথা বলিয়েই ছাড়বি। নো ছাড়-টার।
— হ্যাঁ,এসব করি। আর পরে মেঘের হাতের থাপ্পড় খাই। দরকার নাই ভাই এসবের।
— আরে ধুর। একটা দুটো থাপ্পড় খাইলে কিছু হবে না। মেঘার হাতের থাপ্পড়কে মধু ভাববি। মধু ভেবে হজম করে আবার কথা বলা শুরু করবি। এমন করলে মেঘা কথা বলবেই, হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিউর।
বৃত্তের মনে হলো, প্ল্যানটা মনে ধরেছে। হয়তো সে জন্যেই সে আর তর্ক করলো না। বন্ধুদের থেকে বিদায় নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। আজ মেঘবৃত্তের সম্পর্কের একটা হিল্লে করতেই হবে। যে করেই হোক!
____________________________
রাত তখন কটা বাজে? বৃত্ত জানে না। এই মুহূর্তে ঘড়ির দিকে তাকাতেও তার বিশাল আলসেমি। বরাবরের মত চোখ গেলো বারান্দার দিকে। ঠিক, মেঘা এখনো দোলনায় বসে আছে। আজ সারাদিন ধরে বৃত্ত নিজেকে প্রস্তুত করেছে, মেঘার সাথে কথা বলবে বলে। এখন সঠিক সময় এসেছে। বৃত্ত মনেমনে দোয়া দুরুদ পড়ে নিলো। এই প্রথম বৃত্ত প্রচন্ড নার্ভাসনেস অনুভব করতে পারছে। মেঘার সামনে দাঁড়াতেই যেনো তার জান শুকিয়ে যাচ্ছে। নাহ, এভাবে হাল ছাড়লে চলবে না। যা করার জলদি করতে হবে।
বৃত্ত এগিয়ে গেলো বারান্দার দিকে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। মেঘা এখনো আকাশের দিকে চেয়ে। বৃত্ত গলা খাঁকারি দিলো। মেঘা শুনলো, তবে পাত্তা দিলো না। বৃত্ত এবার ধীর পায়ে মেঘার পাশে এসে বসলো। দোলনাটা একটু নড়ে উঠলো তাতে। মেঘা এবারও নিশ্চুপ! মেঘার এমন চুপ থাকা বৃত্তের সকল সাহসকে ভেঙে তছনছ করে দিল। হুট করেই তার সমস্ত কথা হারিয়ে গেলো। বৃত্ত চুপ করে গেলো। মেঘা বৃত্তের উপস্থিতি লক্ষ করলো, লক্ষ করলো বৃত্তের নার্ভাসনেস। তবুও এসবের পরোয়া করলো না ও। আগের ন্যায় ঠায় বসে রইলো।
বৃত্ত একসময় বিন্যস্ত হলো। বুকের মধ্যে সাহস সঞ্চার করে মৃদু কন্ঠে ডাক দিলো,
— মেঘ?
বৃত্তের এই একটা ডাক মেঘার সমস্ত ইন্দ্রিয়কে নাড়িয়ে দিলো। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলো ও। হুট করেই তার কান্না পেয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, বৃত্তের বুকের ঝাঁপিয়ে পড়ে হু হা করে কাঁদতে। কিন্তু না। মেঘা শক্ত হয়েই রইলো। কথা বললো না একবিন্দুও।
#চলবে