একজোড়া পায়রা পর্ব -১৪

#একজোড়া_পায়রা
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন(#কন্ঠ)
#পার্ট১৪

ক্লাস শেষে ডিপার্টমেন্টের কাছে বড় একটা বকুল গাছের নিচে আনমনে বসে এশার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।হঠাৎ করেই ভুতের মতো উদয় হয় শুভ্র।হাতে বেলী ফুলের মালা।দু দিন হলো রাগ করে সাথে কথা বলিনি।আজ বোধহয় রাগ ভাঙাতেই বেলী ফুলের মালা নিয়ে এসেছে।উনি এসে আমার পাশে বসলে আমি একটু সরে বসি।

-বেলীফুলের মালা এনেছি।নিবে না?

আমি হাত বাড়িয়ে দিই মালা পরিয়ে দেওয়ার জন্য। উনি আমার হাতে মালা পরিয়ে দেন।উনি লম্বা শ্বাস ছেড়ে বলেন,,

-রাগের কারণটা কিন্তু বললেন না মেডাম!
-এমনি।আপনার ওপর অকারণে রাগ করতে ভাল্লাগে।
-কেন ভাল্লাগে?
-এভাবে রাগ ভাঙান বলে।

উনি হেসে দেন।সাথে আমিও।বাড়িতে যাবো আজকে।কেন যেন মন টানছে আবার টানছে না।এক রকম দোটানায়ই আছি।শান্তের জন্য মন টানছে না।কেমন যেন মনে হচ্ছে এইবার লোকটা আমার কোনো বড় ধরণের ক্ষতি করতে পারে।কিন্তু প্রায় আট মাস পর ভাইয়া এসেছে।তাই যেতেই হবে আমায়।ভালো লাগছে না একদম।রাজ্যের আলসেমি যেন আমায় ঘিরে ধরেছে।হলে গিয়ে আবার ব্যাগ গোছাতে হবে।উফফ!এই গোছ গাছের জন্যই আমার কোথাও যেতে মন চায় না।কথা বাড়াই না শুভ্রের সাথে।সে ই নাকি বাসে তুলে দিয়ে আসবেন।

হলে গিয়ে সব গোছাতে প্রায় বারোটার মতো বেজে যায়।তারপর রওনা দিই মহাখালী বাস টার্মিনালের দিকে।বিদায় বেলায় শুভ্র বললো,,,

-সাবধানে যেও।আর শান্ত কিছু বললে ডিরেক্ট ভাইয়াকে বলবা। সেফলি যাইয়ো।আল্লাহ হাফেজ।

বাস ছেড়ে দেয়।বাইপাইল পর্যন্ত জ্যাম থাকায় অনেকটা ধীর কচ্ছপের গতিতে যায় বাস।আমার তো মনে হলো আমি হেঁটেই টাংগাইল যেতে পারবো। পপকর্ণ চিবোতে চিবোতে অলস সময় পার করি।কিছুদূর যেতেই রাজ্যের ক্লান্তি আমার চোখে এসে ভর করে।ব্যাগটাকে জড়িয়ে দিই এক ঘুম।ঘুম যখন ভাঙে তখন একেবারে আমি ঢাকার শেষ সীমানায়।এই মরার জ্যামের জন্য আধা ঘন্টার পথেও সারাদিন লেগে যায়।বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা সাতটার মতো বেজে যায়।বাড়িতে ঢুকেই দেখি ভাইয়া ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে টিভি দেখছে।আমাকে দেখেই ভাইয়া উঠে দাঁড়ায়।কাছে এসে মাথায় হাল্কা করে গাট্টা মেরে বলে,,,

-কিরে গাধী কেমন আছিস?
-আমি গাধী হলে তুই কি?আর শোন আমার একটা সুন্দর নাম আছে।আমায় ঐ নামেই ডাকবি।
-সুন্দর নামটা দিয়েছে কে?
-তুই
-তোর ভাইয়ের চয়েজ ভালো না তাহলে?
-হুম কিছু কিছু চয়েজ মাশাআল্লাহ।
-শুভ্রের খবর কি?
-আছে!কয়েকদিন আগে রাগ করেছিলাম।আজকে রাগ ভাঙাতে স্যার সক্ষম হলো।
-ঝগড়া করিস না তুই?
-উহু আমি ভালো মেয়ে।

আমার কথা শুনে ভাইয়া ফিক করে হেসে দেয়।আমি তাজ্জব দৃষ্টিতে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলি,,,

-হাসিস কেন?
-তো কি করবো।তুই ঝগড়া করিস না?ভালো মেয়ে তুই?
-হুম।কেন তোর জানা নেই?
-তুই যদি ভালো মেয়ে হতি তাহলে আমার সাথে ছোটবেলা থেকে ঝগড়া মারামারি করেছে কেন?তুই তো কেঁদেও জিততি মেরেও জিততি।এক নাম্বারের শয়তান ছিলি
-আর তুমি বোধহয় দুধে ধোঁয়া তুলসীপাতা!
-কিরে মেঘ আইছোত নি?আমার ঘরে আয় সি।তোর লগে কথা আছে।

দাদির ঘর থেকে দাদির ডাক আসতেই ভয়ে আমার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়।শান্ত নিশ্চয়ই বলে দিয়েছে আমি ওকে ব্লক দিয়েছি।যদিও দাদি এগুলো বুঝবেনা।তাও কি না কি বুঝিয়ে দাদির চোখে আমায় অপরাধী বানিয়েছে আল্লাহই জানেন।আমি ভয়ার্ত চোখে ভাইয়ার দিকে তাকাই।ভাইয়া ইশারায় আমায় নির্ভয় দেয়।আমি দাদির ঘরে যাই আর ভাইয়া আমার ব্যাগ নিয়ে আমার ঘরে যায়।সালাম দিয়ে মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকি।দাদি পান চিবোতে চিবোতে বলেন,,,

-বস।তোর লগে কথা আছে।

আমি গিয়ে দাদির পায়ের কাছ টায় বসি।ভয়ে আমার হাত পা রীতিমতো কাঁপা-কাঁপি শুরু করে দিয়েছে।

-হুনলাম তুই নাকি শহরে গিয়া পোলাগো লগে নষ্টামি করোস।আবার শান্তর লগেও নাকি যোগাযোগ করোস না।সাপের পাঁচ পা দেখছোত?এত ভালা পোলা তোরে বিয়া করবার লাইগা এক পায়ে খাড়া আর তুই শহরে গিয়া পোলাগো লগে নষ্টামি করোস মা*!

ধমক দিয়ে বলেন দাদি।আমি কেঁপে উঠি।দাদি আবার বলা শুরু করেন,,,

-কইছিলাম মাইয়া মাইন্সের এত লেহাপড়ার দরকার নাই।আর শহরে গিয়া লেহাপড়ার তো প্রশ্নই উঠে না।আইছোত না?দেহি শান্তর আব্বা আম্মার লগে কথা কমু।এইবারই তোর বিয়া দিয়া নিমু।নইলে পরে কি কেলেঙ্কারী করবি আল্লাহই জানে।আমার বইনে মরার আগে নাতির বিয়া দেহা হায় নাই।আমি চাই মরার আগে শান্ত আর তুই এক লগে আমার কাছে আইয়া দোয়া নেস।

দাদি বলেই যাচ্ছেন।আমি চুপচাপ বসে তার কথা শুনছি।তার কথা গুলো সোজা গিয়ে আমার কলিজায় লাগছে।খুব কান্না পাচ্ছে আমার।এইবারই বলছেন শান্তর সাথে আমায় বিয়ে দিয়ে দেবেন।তাহলে কি আমার আর শুভ্রকে পাওয়া হলো না?

-যা কইলাম মনে থাকে জানি!এহন ঘরে যা।হাত মুখ ধুইয়া নে গা।আর হুন!কাহিনি করোস না জানি মাইয়া!

আমি চাপা কান্না নিয়ে ঘরে চলে যাই।ঘরে গিয়ে দেখি বিছানায় শুয়ে যেন ভাইয়া কার সাথে ফোনে মুচকী মুচকী হেসে কথা বলছে।আমার অনেক রাগ হয়েছে।গিয়ে সব রাগ ঝাড়ি ভাইয়ার ওপর।ফোনটা চিলের মতো ছো মেরে নিয়ে দেখি ফোনের স্ক্রিনে একটা নাম্বার অহনা নামে সেভ করা।পাশে লাভ চিহ্ন।ভাইয়াও প্রেম করে নাকি?আমি গোল গোল চোখ নিয়ে ওর দিকে তাকাই।ও শুকনো ঢোক গিলে। চিৎকার করে বলি,,,

-আমি বাঁচি না আমার জ্বালায় আর তুমি আমার রুমে বসে প্রেমালাপ করো?
-হাইপার হইতেছিস কেন?ও তোর ভাবি লাগে।একটু ভদ্রতা বজায় রাখ।আর প্রেম কি আমি একা করি?তুই করিস না?

আমার মুখ কালো হয়ে যায়।ভাইয়ার হাতে ফোনটা দিয়ে ধপ করে বসে পড়ি।ভাইয়া ফোন পরে করবে বলে ফোনটা কেটে দেয়।আমার পাশে এসে বসে ভাইয়া।শান্ত গলায় বলে,,,

-কি বললো বুড়ি?
-এইবার বলে শান্তর সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দেবে

কথাটা বলেই আমি ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিই।ভাইয়া আমার কিভাবে সামলাবে বুঝে উঠতে পারে না।মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,,,

-চিন্তা করিস না।আমি দেখছি ব্যাপারটা।ওমন একটা বাজে ছেলের সাথে কখনো আমার পেত্নীর বিয়ে হতে পারে না।আমি বাবাকে আজই শুভ্রের কথা জানাবো।

শুভ্রের কথা?বাবা যদি না মেনে নেয়?পলিটিকাল লোক বাবা একটুও দেখতে পারেনা।শুভ্র রাজনীতির সাথে যুক্ত জানলে কি বাবা মেনে নেবে?


রাত্রে খাওয়ার পরে দাদি ঘুমিয়ে গেলে আমি আর ভাইয়া বাবার সাথে কথা বলতে যাই।ভাইয়াই শুভ্রর সম্পর্কে সব বলে বাবাকে।দাদির কথাও আমি বাবাকে জানাই।সবটা শোনার পর বাবার কপালে চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট। অনুর বিয়েতে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য বাবা শান্তর ওপর নারাজ।তবে শুভ্রর সম্পর্কে পুরোপুরি না জেনে আমায় শুভ্রের হাতে তুলে দিতেও বাবা দ্বিধায় আছে।আবার মায়ের কথাও অমান্য করার সাহস পাচ্ছে না বাবা।গম্ভীর কন্ঠে বলে,,,

-শুভ্রকে কি এখন ফোনে পাবো?

আমি শুভ্রকে কল দিই।ও রিসিভ করে।

-হ্যালো মেডাম।কখন পৌঁছিয়েছেন?
-সন্ধ্যায়।এসেই এক ঝামেলায় পড়েছি।বাবা আপনার সাথে কথা বলবে।
-বাবা মানে?তুমি কি আমার কথা আমাকে বলেছো?
-বলতে বাধ্য হয়েছি।
-কেমনে কি পুরোটা বলবে তো?
-পরে বলবো।এখন বাবার সাথে কথা বলেন।

আমি বাবার হাতে ফোন ধরিয়ে দিই।বাবা উনার সম্পর্কে যা জানার জেনে নেন।বাবা বিয়ের কথা বললে উনি বলেন বিয়ের চিন্তা তিনি এখনো করেন না।চাকরি বাকরি করে কিছুটা স্যাটেল হয়ে নিলে উনার বিয়ের প্ল্যান আছে।বাবা উনাকে সবটা খুলে বলেন। উনি জানান আংকেল আন্টির সাথে কথা বলে সবটা জানাবেন।

রাত্রে ঘুমানোর আগে উনাকে একবার ফোন দিই।

-ঘুমাও নাই?
-দাদি যে ভাবে থ্রেড দিয়েছে!তাতে আমার ঘুম চাঁদের দেশে গিয়েছে।
-কি থ্রেড?
-জানেন না আপনি?বাবা না আপনাকে বললো!
-কি জানি বললো?
-ঢং লাগাইছে।যখন শান্ত এসে বিয়ে করে নিতে যাবে তখন মনে পড়বে মেঘ, মেঘের ভাই,মেঘের বাবা কি বললো!
-করলে করুক বিয়ে আমার কি?
-আসলেই আপনার কিছু না?
-উহু।

এবার আমি কেঁদেই দিই।আমার কান্নার শব্দ শুনে ফোনের বিপরীত পাশ থেকে শুভ্র বলেন,,,

-আরেহ পাগল মজা করলাম।মেঘ সব সময় শুভ্রর। অন্য কারও না মেঘ।শুধু শুভ্রর।
-যে সব ইয়ার্কি আমায় কষ্ট দেয় ওই সব ইয়ার্কি কখনো করবেন না।
-আচ্ছা করবো না।
-সরি বলেন।
-আচ্ছা সরি

চলবে,,,ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here