#হবে_কি_আমার(২)
#writer_Ruhi_mondal
#পর্ব_26
সারা রুমে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে, সিলিং ফ্যান ধীর গতিতে চলতে,অনু ক্রোধিত নয়নের অরিন্দমের দিকে অগ্নি নিক্ষেপ করছে, অরিন্দম তা দেখে শুকনো ঢোক গিললো, সে বাঘিনীকে আবার খেপিয়ে দিয়েছে কিন্তু তার ও যে কিছু করার ছিল না সব বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিচ্ছিল তখনই তনয় নতুন বাইক নিয়ে হাজির। আজ নতুন বাইক কিনেছে আর সেটা নিয়ে শিখতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে হাত-পা ভেঙেছে। তাকে নিয়েই হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে হয়েছে আর এত রাত হয়ে গেছে অরিন্দম বাড়ি আসার জন্য ছটফট করছিল কিন্তু বন্ধু হিসেবে সে কিভাবে পারে ফেলে আসতে কিন্তু হেমন্ত বাবু তাকে ডাকতে,সে যে ভয়টা পাচ্ছিল সেটাই হয়েছে অনুর প্যানিক অ্যাটাক হয়েছে তাই সে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে বাড়িতে কিন্তু অনু’কে দেখে তার নিজেরই হাত-পা কাঁপছে, সে কীভাবে সামলাবে এই উড়নচন্ডী মেয়েটাকে? অরিন্দম নিজেকে ধাতস্থ করে এক পা এগিয়ে যেতে গেলে অনু চিল্লিয়ে বলল,
__’একদম কাছে আসবে না বজ্জাত হনুমান! সারাদিন আমার কথা মনে ছিল না! এখন কেন এসেছ এখানে? নাটক করতে!
অরিন্দম ভড়কায় ক্ষীণ প্রহর সে রক্তিম বর্ন ধারন করা মেয়েটার দিকে চেয়ে রইল, সে দ্রুত অনুর নিকট যেতে নিলে অনু হেঁচকি তুলে কেঁদে ওঠে, চেঁচিয়ে বলে,
__”তুমি আমাকে একদম ভালো বাসো-না, একটু ও না! তাই তো অসুস্থ আমাকে রেখে ভুলে গেছ।”
অরিন্দম আহত হল,অনুর নালিশ ভুল না। অসুস্থ স্ত্রী কে রেখে, তাকে না জানিয়ে সারাদিন বাইরে থাকলে তার মনে অভিমান জমবেই, অরিন্দম সেটা খুব ভালো করে বুঝতে পারছে! তাই সে নম্র গলায় বলল,
___”আমার কথাটা একটু শোন আমি…
অনু কাঁদতে কাঁদতে তাকে ধাক্কা দিল। অরিন্দম এক পা পিছিয়ে গিয়ে ভড়কানো গলায় বলল,
___তোমার পায়ে লেগে যাবে!.. অনু শুনলো না খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দরজা খুলতে গেল অরিন্দম বাঁধা দিল অনু আরো কেঁদে ওঠে বলল,
__’আমি থাকবো না আর তোমার কাছে, চলে যাব এখান থেকে!’
অরিন্দম পিছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে। অনু হাত পা ছোড়াছুড়ি করতে থাকে, তার শব্দ করা কান্নায় অরিন্দমের হৃদয় কাঁপে, সে অনুকে উঠিয়ে খাটে নিকট এনে তাকে বসিয়ে দেয় অতঃপর সে নিজে নিচে বসে বলল,
__’ প্লিজ বউ। আ’ম সরি, কান্না থামাও! আমার দেরি কেন হলো একবার শোন আমি আড্ডা দিতে যাইনি।’
অনু কিছু না পেয়ে নিজের মাথার চুল দুহাতে টেনে বলল,
__’আমি কোন কথা শুনতে চাই না!’
অরিন্দম তা দেখে চমকালো দ্রুত অনুর হাত ধরে চুমু দিতে থাকে,মেয়েটা কত কষ্ট পেয়েছে তার জন্য, ভেবেই চোখ ছলছল করে ওঠে অরিন্দমের,সে জড়ানো গলায় বলল,
__’শাস্তি দিতে হলে আমাকে দাও! নিজের শরীরে একটা ও আঘাত করবে না! আমি সেটা সহ্য করতে পারবো না! আমার ভুল হয়েছে কিন্তু..
অনু কেঁদে কেঁদে বিছানায় নেতিয়ে পড়ল। অরিন্দম তা দেখে চমকে উঠে,সে উঠে দাড়িয়ে অনুকে তুলে বক্ষবন্ধনী করে অতঃপর মুখে আলতো চাপড় মেরে ভীত স্বরে বলল,
__’এই বউ, কি হয়েছে? শরীর অসুস্থ লাগছে?’
অনু নিভু নিভু চোখে চেয়ে জেদ নিয়ে বলল,
__’ছাড়ো আমাকে তুমি পঁচা!’
অরিন্দম পাশের টেবিল থেকে জলের গ্লাস নিয়ে অনুর মুখে চেপে ধরে বলল,
___’ ঠিক বলেছ আমি পঁচা। হয়েছে, এবার জলটা খেয়ে নাও!’
অনু মাথা সরিয়ে নিতে গেলে অরিন্দম এবার চোখ রাঙিয়ে দেখায় অনু তা দেখে জল খেয়ে আবার ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠে অরিন্দমের বুকে কিল দিয়ে বলল,
__’ তুমি আমাকে চোখ কেন দেখাচ্ছ? বকছ কেন?’
অরিন্দম স্বস্তির শ্বাস ফেলল অনু আপাতত অন্য টপিকে গিয়েছে ভেবে মনে শান্তি এল, তাই সে দুইহাতে অনু’র চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,
__’আর বকবো না! কাঁদে না লক্ষী বউ আমার। আচ্ছা বলো তুমি খাবার খেয়েছ?’
অনু অরিন্দমের কথায় বাচ্চাদের মতো ভুলে গেল,আর তার সত্যি খুব খিদে পেয়েছে,সে ঠোঁট উল্টে দুদিকে মাথা নাড়ল। অরিন্দম তা দেখে বলল,
__’আমি এক মিনিটে হাতমুখ ধুয়ে আসি তারপর খাইয়ে দিচ্ছি!’
অনুকে খাইয়ে ওষুধ দিতে সে অরিন্দম কে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজিয়ে নেয়, অরিন্দম তার মাথা হাত বুলিয়ে দিতে সে চুপচাপ ঘুমে তলিয়ে যায়, শরীর তার খুব ক্লান্ত তাই শুতেই ঘুমিয়ে যায়, অরিন্দম তাকে ঘুমাতে দেখে ছোট শ্বাস ফেলে। তাকে কাকিয়ার কাছে যেতে হবে কাকিয়া তাকে ডেকেছেন,সে অনুকে সাবধানে বালিশে শুয়ে দিয়ে গায়ের চাদর টেনে দিল অতঃপর অন্ধকার আচ্ছন্ন মধ্যে তার জন্য পাগল মেয়েটার দিকে চেয়ে রইল ক্ষীণ প্রহর,ক্ষনে বক্ষে অদ্ভুত যন্ত্রণা শুরু হলো তার,অনুর শুকিয়ে যাওয়া মুখমন্ডলে ডান হাত বুলিয়ে দেয় খুব যতনে। অতঃপর কপালে অধর ছুঁয়ে সে উঠে বসলো এখন তাকে কাকিয়ার মুখোমুখি হতে হবে। অরিন্দম বুঝতে পারছে কাকিয়া তাকে কি বলবে সে তপ্ত শ্বাস ফেলে পাশের রুমে গিয়ে দেখল চন্দ্রানী দেবী ও হেমন্তবাবু গম্ভীর মুখে বসে আছেন। অরিন্দম যেতেই চন্দ্রানী দেবী গম্ভীর গলায় বললেন,
__”অরিন্দম তুই কাকে বিয়ে করেছিস? এ মেয়ে তো অসুস্থ! মনে হয় ওর মাথা কিছু সমস্যা আছে! মেয়েটা পাগল টাগল না-তো?’
অরিন্দম গমগমে গলায় বলল,
__” কাকিয়া কি সব বলছ?”
___’যা বলছি ঠিক বলছি এমন অদ্ভুত ব্যবহারের মানে কি? আমার তো মনে হচ্ছে একটা পাগল মেয়েকে তোর ঘাড়ে..
__” কাকিয়া ও পাগল না। যার কথা বলছ সে আমার স্ত্রী!”
__’জানি আর আমরাও খুশি ছিলাম তোদের দেখে কিন্তু আজ মেয়েটাকে দেখে আমাদের অদ্ভুত লাগছে! দুপুরে খেতে খেতে কেমন কাঁদছিল আমি একটু বোঝাতে আবার হেসে হেসে খেয়ে নিল, একটু আগে বাড়ী মাথায় করে নিয়েছিল,এ কেমন ব্যাবহার?’
__”কাকিয়া ও অসুস্থ! কিন্তু পাগল না।”
__’কি হয়েছে ওর?’
অরিন্দম অগোছালো পায়ে হেমন্ত বাবুর পাশে গিয়ে বসল। চন্দ্রানী দেবী অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন, হেমন্তবাবু অরিন্দমের কাঁধে হাত রেখে বললেন,,বৌমা ঠিক আছে তো? কোনো বড় অসুখ হয়নি তো?
অরিন্দম চোখ বন্ধ করে একটা লম্বা শ্বাস নিল এবং বিয়ের দিন রাতে অলকা দেবীর বলা কথা গুলো বলতে লাগলো।
______
অনু তখন ক্লাস ইলেভেনের পড়ত,হাসিখুশি দুরন্ত একটি মেয়ে সারাক্ষণ গ্রামে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করত আর যতক্ষণ বাড়িতে থাকত সবাইকে জ্বালিয়ে অতিষ্ট করত, তনুশ্রী বোনকে লায় দিয়ে দিয়ে আরও বিগড়ে দিত। স্কুলের গেলেও সেখানেও তার সাথে অনুরাগ সামিল হতো তিশা শান্তশিষ্ট হলেও অনুরাগ আর অনু দুজন একই লেভেলের দুজনে একসাথেই মানুষকে বিরক্ত করতো। এমন ই একদিন তাদের গ্রামে শহর থেকে রিসার্চের জন্য কিছু সাইন্সের স্টুডেন্ট ক্যাম্প করেছিল, সেটা অনুদের বাড়ির থেকে কিছুটা দূরত্বে। তারা সেখানে বিভিন্ন গাছের পাতা শিখড় নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করত ছোট লেবে। অনু অজানা বিষয়ে জানার আগ্রহ প্রবল ছিল, তাই সে কিছু স্টুডেন্ট দের সাথে বন্ধুত্ব করে ফেলেছিল বেশ,আর কয়েকটা ছেলে মেয়ের খুব ক্লোজ হয়ে গিয়েছিল অনু সাথে। তাদের নিয়ে একবার নিজেদের ছোট বাগানে ও নিয়ে গিয়েছিল সেখান থেকে তারা জবা গাছের থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে গিয়েছিল টেস্ট করার জন্য,মামীর সাথে ও কথা হয়েছিল তাদের। একদিন অনু তাদের সাথে বসে গল্প করছিল কিন্তু বিপদ ঘটে তার কিছুক্ষণ পর, স্টুডেন্টদের মধ্যে এক”বিশাল” নামের স্টুডেন্ট মানসিক দিক থেকে অদ্ভুত ছিল খানিকটা সাইকো টাইপ সর্বদা সাইন্সের বইয়ের মুখ ডুবিয়ে থাকত সবাই তাকে সাইকো নাম দিয়েছিল কারন সে সব সময় নিজের মনে কি সব বিড়বিড় করত আর বইয়ের পাতায় সর্বত্র থাকত, কি যেন আবিষ্কার করতে চেয়েছিল সে। বিশাল গ্রামের একটা ছোট গাছের শিকড় নিয়ে সেটাতে আরও কিছু কেমিক্যাল মিশিয়ে জুস বানিয়ে পরিক্ষা করার জন্য ক্যাম্পের কাউকে খুজছিল, সে বাইরে সেটাকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করছিল সেদিন। কিন্তু কেউ তাকে পাত্তা দেয় না। তখন স্যার রা ও নিজেদের কাজে ব্যাস্ত ছিলেন। বিশাল বাইরে বার হয়ে অনুকে দেখতে পায়,অনু এক জায়গায় বসে কাঁচের বোয়ামে ধরা রাখা প্রজাপতি দেখছিল,বিশাল তার পিছনে গিয়ে দাঁড়াতে অনু পিছনে বিশাল কে দেখে হেসে বলল,
__”আরে চারচোখ দাদা তুমি জুস নিয়ে কোথায় যাচ্ছ?”
বিশাল বা হাত দিয়ে চশমা ঠিক করে বলল,
___ ‘এ টা এটা তোমার জন্য খেয়ে দেখ এনার্জি পাবে!’
অনু চোখমুখ কুঁচকে বলল,
___’আমার দরকার নেই তুমি খাও!’
__’আরে খাও না অনেক টেস্টি আর সুইট!’
অনুর পিপাসা ও পেয়েছিল সাথে মিষ্টি শুনে খেতে নিচ্ছে করে,অনু কিছু আর না ভেবেই জুস খেয়ে নেয়, কিন্তু বিপত্তি ঘটে আধা ঘন্টা পর বাড়িতে এসেই বমি করতে করতে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে নিচে পরে, তাকে জ্ঞান হারাতে দেখে অলকা দেবী চমকে উঠেন তনুশ্রী তো তা দেখে কেঁদে দেয়, অলকা দেবী অনুরাগকে ফোন করে ডাকে সে অনুকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করায়। সেখানে ডাক্তার বললেন তরল জাতীয় কিছু খেয়ে তার বমি হয়েছে সেন্স ফিললে বাদবাকি দেখা যাবে। অনুর সেন্স ফিরতে জানতে পারা যায় সে বিশালের দেওয়া জুস খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। সেন্স ফেরার পর তেমন কোন অসুবিধা না দেখে ডক্টর তাকে রিলিজ করে দেন। কিন্তু তার পর থেকে বিশাল কে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না, হসপিটাল থেকে ফিরে দশ বারো দিন পর অনুর অস্বাভাবিক ব্যাবহার চোখে পড়তে থাকে বাড়ির সবার। মাঝেমাঝে রেগে যাওয়া সামান্য কারনে অত্যাধিক মাত্রায় চিৎকার করা কান্না করা দেখে অলকা দেবী দুশ্চিন্তায় পড়ে যান এবং তিনি ডাক্তার দেখান গ্রামে উন্নত মানের তেমন হসপিটাল না থাকায় টেস্টগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে বেশ কিছুদিন সময় ব্যয় হয়। আর যখন শহর থেকে ডক্টরের কাছে রিপোর্ট পৌঁছায় তখন রিপোর্ট ভয়ঙ্কর আসে ডক্টর বলেন অনুর শরীরের কিছু বিষাক্ত ক্যামিকেল দেওয়া হয়েছে যা তার মস্তিষ্ককে হঠাৎ হঠাৎ কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে প্যানিক অ্যাটাক হচ্ছে ভয় পাচ্ছে তাকে ইমিডেটলি ট্রিটমেন্ট করতে হবে। অলকা দেবীর তা শুনে হাত-পা শিথিল হয়ে গিয়েছিল, তিনি দিকদিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। অনুরাগ তাকে ভরসা দিতে তিনি হুহু করে কেঁদে দিয়েছিলেন, অনুরাগ সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছিল শহর থেকে অনু মেডিসিন সে প্রতি মাসে নিয়ে যেত। মেডিসিনের অনিয়ম হলে অনু মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে পারে। বিশাল কে পরে পুলিশ অ্যারেস্ট করে কিন্তু সে মানসিক রোগী তাই তাকে ও অ্যাসাইলেম এ রাখা হয় সে বিশাল বড় বিজ্ঞানী হতে চেয়েছিল, কিন্তু তার স্বপ্ন অনুর জন্য ভারী পরে গেল।
অরিন্দম এতক্ষণে থামল,চন্দ্রানী দেবী কি বলবেন বুঝতে পারছেন না,এত কিছু হয়েছে তিনি ভাবতে পারেননি। তিনি নিজেকে শান্ত করে বললেন
__”বৌমা কি কখনো সুস্থ হবে না?”
__”হবে। ও সুস্থ হবে! মেডিসিন আমি ওকে নিয়মিত দিচ্ছি, কিন্তু আমাকে সচেতন হতে হবে আর দুমাস ওকে সামলে রাখলে অনেকটাই সুস্থ হয়ে যাবে ও!”
#চলবে
[