#হবে_কি_আমার (২)
#writer_Ruhi_mondal
#পর্ব _31
রাস্তায় যেন রাশি রাশি গাড়ি’র মেলা বসেছে এক মিনিটের মধ্যেই, একটু এদিক থেকে ওদিক হলে এমন জ্যাম হয়ে যায় প্রতিদিন রাস্তায়, অফিস টাইম টা এমনই হয়ে থাকে বেশীরভাগ সময়, এটা নিত্য দিনের অভ্যাস হয়ে গেছে সমস্ত পথচারীদের, হালকা শীত শীত আমেজ সূর্যের তেজ যেন মিষ্টি লাগছে গায়ে পড়তে,তিশা বিরক্ত হয়ে আটো চালক কে ভাড়া দিয়ে নেমে পড়লো রাস্তায়,আশপাশ তাকিয়ে দেখল সমস্ত যানবাহন পরপর লাইন দিয়ে আছে, তিশা পাশকাটিয়ে যেতে লাগল আর দু মিনিটের ব্যবধানে তার কলেজ এই টুকু রাস্তা গাড়িতে সময় ব্যয় না করে হেঁটে চলে গেলে কাজের কাজ হবে। কোন রকমের গাড়ির পাশ কাটিয়ে কলেজের গেটের সামনে পৌঁছালো সে। অনু আগেই চলে এসেছে অরিন্দম তাকে রোজ একটু আগে নামিয়ে দিয়ে যায় কারণ ওর অফিস থাকে বেশি লেইট করলে তার ও অফিস যেতে লেট হয়ে যাবে সেই কারণেই। তিশা ব্যাগ থেকে মুঠোফোন বার করে অনুর নাম্বার ডায়াল করে দু সেকেন্ডের ব্যবধানে অনু কল রিসিভ করে বলল,
__’আমি কলেজের ডান সাইডে আছি, তুই চলে আয়।’
তিশা ওর কথা মতো সোজা প্রবেশ করে ডান সাইডে খানিকটা এগিয়ে যেতেই থমকে দাড়িয়ে গেল সে,অবিশ্বাস্য দৃষ্টির তাকিয়ে থাকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির দিকে। সে চোখের ভুল ভেবে দুইহাতে ভালো করে ঘষে আবার সামনের দিকে তাকিয়ে দেখল না, সে ঠিক দেখছে, ক্ষনেই বক্ষে খুশির বেদনা শুরু হয়ে গেল তার, নেত্র কোণ থেকে আনন্দের অশ্রু নির্গত হতে লাগল, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার “অনুরাগ” হ্যাঁ তার অনুরাগ দাঁড়িয়ে। সে অনু র সাথে কথা বলছে তিশা কাঁপা কাঁপা পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলো, ঠোঁটের কোণে তার হাসি উপচে পড়ছে আর চোখের কোনে জল, আজ মনে হয় তার থেকে খুশি আর কেউ না। সে অনুরাগের সামনে গিয়ে দাঁড়াল, অনুরাগ কিয়ৎক্ষণ তিশার অশ্রুসিক্ত নয়নে দিকে চেয়ে রইল, নিভৃতে কেটে যায় বুকের সমস্যা যত্নণা, তৃষ্ণা মেটে আঁখির। তিশা কাঁপা হাতে অনুরাগের গালে হাত দিয়ে গেলে, তৎক্ষণাৎ অনুরাগ অন্য দিকে তাকিয়ে গমগমে গলায় বলল,
__’ পুতুল তুই কাউকে স্পষ্ট জানিয়ে দে, আমি তার সাথে কথা বলতে চাই না।’
তিশা থেমে গেল, শব্দ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
_’ কেন তুই কথা বলতে চাস না? আমি কি অন্যায় করেছি? তুই জানিস আমার..’
__’পুতুল তুই বলে দে এ সব কান্নাকাটি দেখতে আমি এখানে আসিনি, নেহাত বাপি খুব জোর করছে তাই এখানে এডমিশন নিয়েছি, ব্যাস!’
তিশা কাঁদতে কাঁদতে হেসে দিল তার ভাবনা ঠিক হয়েছে ও কোথাও না কোথাও ভেবেছিল অনুরাগ এবার নিশ্চয়ই তার বাবার কাছে থাকতে চলে আসবে আর সেটাই হয়েছে। অনু ওদের দুজনের অবস্থা দেখে বললো,
__’আমি কাউকে কিছু বলতে পারবো না!’
অনুরাগ অনুর দিকে তাকিয়ে বলল,
__’আমি কাল রাত থেকে খাইনি চল, ক্যান্টিনে যাই!’
অনু কিছু বলতে যাবে তিশা বলল,
__’আমি টিফিন এনেছি!’
অনুরাগ অনুর হাত ধরে বলল
__’আমি তোর হাতে খাব! চল!’
অনু হাত সরিয়ে দু পা দৌড়ে দূরে গিয়ে বলল,
_’ও গড, আজ আমি আর এখানে থাকতে পারবো না। আমি কিছু জানি না বাবা,তোদের ব্যাপার তোরা নিজেরাই মেটা আমি চললাম,বাই।’
অনুরাগ অনুকে ডেকে চলেছে আর তিশা দাঁড়িয়ে অনুরাগ কে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে, অনুরাগের চুলগুলো কেমন বড় হয়ে গিয়েছে, উজ্জল শ্যামলা বর্নের ছেলেটা কেমন যেন চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে,সে খুব ভাল করেই বুঝতে পারছে এই একমাস অনুরাগ এর উপর দিয়ে কি গিয়েছে, সে যেমন ভাবে কষ্ট পেয়েছে অনুরাগও তারই মত কষ্ট পেয়েছে।
তিশা এগিয়ে গিয়ে অনুরাগের হাত ধরে টানতে দিয়ে সামনের দিকে যেতে যেতে বলল,
__’ আমার ওপর রেগে থেকে না খেয়ে নিজের বেহাল দশা করার শাস্তি তুই পাবি। ‘
অনুরাগ এতদিন পর তিশাকে চোখের সামনে দেখে তার একটু স্পর্শ পেয়ে চোখ মুখ চিকচিক করে উঠলো। সে চাইছিল তিশা তার রাগ ভাঙাক তাকে আগের থেকে অধিক ভালোবাসা দিক,
তিশা তাকে কলেজের বাহিরে ছোট পার্কে নিয়ে গেল। অনুরাগ নিশব্দে তার সাথে যেতে লাগলো, তিশা তার দেওয়া সবুজ রঙের সালওয়ার পড়ে আছে, মুখটা মলিনতা ছেয়ে আছে,সে জানে তিশাকে ও একটু বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে কিন্তু তার ও তো কষ্ট হয়েছে।
তিশা বেঞ্চে গিয়ে বসলো। অনুরাগ তখন ও অন্যদিকে তাকিয়ে বসে আছে, তিশা জলভরা চোখে খুশি হয়ে ব্যাগ থেকে টিফিন বক্স বের করতে লাগল। আজ কতগুলো দিন পর সে নিজের হাতে অনুরাগ কে খাইয়ে দেবে, স্কুল লাইফ থেকে নিয়মিত টিফিন খাইয়ে আসছে তাকে, তিশা ওড়না দিয়ে চোখের জল মুছে চামচ দিয়ে চাউমিন অনুরাগের মুখের সামনে ধরে বলল,
__’ তাড়াতাড়ি হা কর।’
অনুরাগ অন্য দিকে তাকিয়ে বলল,
__’না খাব না। আর তোর সাথে আমার কোন কথা নেই!’
__’কথা বলতে হবে না খেয়ে নে! না খেয়ে নিজের যত্ন না নিয়ে নিজের এমন অবস্থা করেছিস কেন?
এতক্ষণ আটকে রাখা অভিমান কান্না সব এসে উপচে পরলো অনুরাগ এর মধ্যে, সে অবুঝ প্রচুর অবুঝ, তাকে শুধু এই মেয়েটা বোঝে, তাকে শুধু এই মেয়েটা চেনে, এতগুলো দিনে প্রত্যেক সেকেন্ড তাকে মনে করে কখনো চোখের জলে তো কখনো গুমরে কাটিয়েছে, সেদিন সারাক্ষণ রুম লক করে কেঁদে কেঁদে জ্বর বাধিয়েছিল, তার কান্না যেন কেউ না দেখে বাড়ী থেকে কোথাও বাহির হয়নি সে, সবাই না হয় তার ওপর হাসত, বলতো ছেলেরা আবার কাঁদে না-কি? কিন্তু সত্যি কি সেটা, ছেলেরা কি কাঁদে না? কখনো কাঁদে না?
তারাও কাঁদে, প্রচুর কাঁদে, প্রিয় কিছু দূর হলে তাদের ও বুক ফাঁকা হয়ে যায়। যেটা অনুরাগের হয়েছিল,মা ছাড়া সে পৃথিবীতে শুধু তিশা কে ঘিরে বাঁচতে চায় শুধু এই মেয়েটা কে ঘিরে সুখী হতে চায়, কিন্তু তার অভিমান হয়েছে প্রচুর অভিমান। অনুরাগ অভিমানী কন্ঠে তিশার দিকে তাকিয়ে কান্নারত নয়নে চেয়ে বলল,
__’কেন সেটা আবার তোকে বলতে হবে বল? এতটাই পর হয়ে গিয়েছি যে তুই সেটা বুঝতে ও পাচ্ছি না! বাহ্!’
তিশা অনুরাগের ছলছল চোখ দেখে এতক্ষনে আটকে রাখা আবেগ আর আটকাতে পারলো না। সে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে অনুরাগের গলা জড়িয়ে ধরে, অনুরাগের নেত্র থেকে অশ্রু ঝরে পড়ে তিশার কাঁধে সে দুহাতে তিশাকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ গুজে বলল,
__’ তুই খুব খারাপ হৃদ, খুব খারাপ, আমাকে পুরো পাগল করে দিয়েছিস,দেখ রাগ করে ও শান্তি পাইনি,তোর টানে ছুটে এসেছি, অচেনা শহরে চেনা মানুষের জন্য। কিন্তু তুই আমাকেই পর করে একা ফেলে এসেছিলি, একবার ও আমার কথা ভাবিস নি, একবার ও না, তোকে ছাড়া আমি কি করে থাকব একবার ও ভাবিসনি বল?সত্যি আমি পর।’
তিশা হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
__’আমি পর হয়ে গিয়েছি, না কি তুই পর করে দিয়েছিস? গত একমাস পর আমার কথা মনে পড়ল তাই না তোর?আমি না হয় তোর কথা ভাবিনি কিন্তু তুই কি করলি,জানিস তোকে কত কতবার ফোন করেছি বারংবার সুইচ অফ পেয়েছি! তুই আমার কতটা কষ্ট হয়েছে, কতটা কষ্টে দিন পার করেছি সেটা তুই বুঝবি না। তুই এতটা অভিমান করতে পারলি? আমার সাথে এতদিন কথা না বলে থাকতে পারবি,কি করে?’
অনুরাগ চোয়াল শক্ত করে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকলো,শুধুমাত্র সেই জানে কেমনভাবে দিন পার করেছে, অলকা দেবী তাকে বুঝিয়েছেন প্রচুর বুঝিয়েছেন কিন্তু রাগের মাথায় সে আসেনি এতদিন, শেষে না পেরে পিসি মনিকে সাথে নিয়েই কলকাতা শহরে বাবার কাছে থাকতে চলে এসেছে, প্রেয়সীর কাছে।
তিশা সরে এসে বসে অতঃপর চোখের জল মুছে বলল,
__’এবার তো ভালো করে কথা বলল একবার ভালো করে তাকা আমার দিকে! আচ্ছা আমার দিকটা একবার ভাব, মা বাবা এখানে চলে আসছিল, তারা কি আমাকে ওখানে একা কে রেখে আসত?’
অনুরাগ কটমট গলায় বলল,
__’কেন আমি ছিলাম না?’
তিশা হতাশ হল অনুরাগ শুধু বয়সে বড় হচ্ছে বুদ্ধি তে এখনো বড় হয়নি! সে বলল,
__তুই ছিলিস বাবা তোর কাছে আমাকে রেখে আসত। এটাই বলতে চাইছিস তুই?
__’ হ্যাঁ! ‘
__’তুই আমাকে কোন পরিচয়ে তোর কাছে রাখতিস?’
__’ কেন তুই আমার…
অনুরাগ থেমে গেল সত্যিই তো সে কোন পরিচয়ে থাকত তার কাছে, তিশা স্মিত হেসে অনুরাগের গালে হাত রেখে বলল,
__’ যা হয়েছে ভুলে যা আর কখনো তোর থেকে দূরে যাবো না প্রমিজ। এবার বাবা’র টান্সপার হলে..
__ আমরা বিয়ে করে নেব, তুই আর তোর ওই পুলিশ বাপের সাথে দেশ দেশ ঘুরবি না।
তিশা হেসে দিল, দুদিকে মাথা নাড়িয়ে সায় দিল, অনুরাগ বুকে যেন বল পেল,সে সিরিয়াস কন্ঠে বলল,
__’ আর দু বছর পর কিন্তু আমরা বিয়ে করেই নেব,তোর বাপ রাজী না হলে তোকে কিডন্যাপ করে বিয়ে করবো,বলে রাখছি।’
তিশা কাঁটা চামচে চাউমিন নিয়ে অনুরাগের মুখের সামনে ধরতে সে নিশব্দে খেতে লাগল, তিশা বলল,
__’ কিডন্যাপ করতে হবে না, তুই আমার শ্বশুরমশাই কে নিয়ে বাড়ীতে আসবি দেখবি বাবা রাজি হয়ে যাবে।’
অনুরাগ মাথা দুলিয়ে খেতে লাগল যেন কতদিন পর সে খাবার খাচ্ছে, সমস্ত কষ্ট যন্ত্রণা তার দূর হয়েছে এখন যেন সুখ গুলো ঝাঁক ঝাঁক বেঁধে উড়ে আসছে তার কাছে,সে এখন থেকেই বিয়ের স্বপ্ন দেখছে, কিছুতেই আর তিশা কে দূরে রাখবে না সে, কিছুতেই না।
#চলবে
[