#শেষ_বিকেলে_এলে_তুমি
#পর্ব_২
#Tahmina_Akhter
-আচ্ছা, স্যার একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারি?
-হুম,
-স্যার আপনার জীবনের উনত্রিশটি বসন্ত অতিক্রম হলো আজ। এই যাবতকালে আপনার কাউকে পছন্দ হয় নি? মানে কাউকে আপন করেন নি কেন স্যার?
নিজের স্টুডেন্টের কাছে এমন প্রশ্ন শুনে কিছুটা বিব্রতবোধ করলো আদিল রহমান।দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদিল বলতে শুরু করলো,
-পছন্দ নয় আমার মনে ক্ষত সৃষ্টি করে গিয়েছে সে।যে ক্ষতের ঘা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি।
তখন আমি মেডিকেল পরিক্ষায় সদ্য পাশ হওয়া এমবিবিএস এর প্রথম বর্ষের ছাত্র।পড়াশোনার চাপ থেকে একটুখানি বিরতি নেয়ার জন্য নানুর বাড়ি কুমিল্লা বেড়াতে গিয়েছিলাম চারদিনের জন্য। শহরের বন্দী জীবন থেকে মুক্তি নিয়ে পা রেখেছিলাম গ্রামের বিশুদ্ধ পরিবেশে।ডিসেম্বরের শীত শহরে তেমন প্রভাব না ফেললেও গ্রামে এর প্রকোপ বেশি। খুব সকালে ঘুম থেকে জেগে বাইরে বেরিয়ে শিশির ভেজা ঘাসে পা রাখলেই গা কাটা দিয়ে উঠতো।সকালের নাশতা হিসেবে থাকতো হরেকরকম পদের পিঠা।কিছু পিঠার নাম জানতাম না।মামা, মামি, নানা, নানু মনি সকলেই যেন আমায় পেয়ে খুশি।টানা তিনবছর পর যে এসেছিলাম।
ওখানে যাওয়ার পরদিন আমার মামাতো ভাই রিয়াদ জানালো পাশের গ্রামে মেলা হচ্ছে। আমি তো অনেক এক্সাইটেড কারণ গ্রামের মেলা মানে চমৎকার। অতঃপর, বিকেলে আমি,রিয়াদসহ ওর বন্ধুরা মিলে মেলায় চলে গেলাম। সেখানে যেতেই দেখলাম বিভিন্ন রকমের দোকান। বেশিরভাগ দোকান মেয়েদের কসমেটিক এবং অর্নামেন্টসের আর বাচ্চাদের খেলনার দোকান। ফুচকা, চটপটি, বিভিন্ন রকমের মিষ্টি জাতীয় খাবারের দোকান। রিয়াদের বন্ধুরা এটা ওটা দেখতে লাগলো।
এরইমধ্যে, আমার মোবাইলে কল এলো। মা কল করেছে তাই ভীর থেকে একপাশে গিয়ে কল রিসিভ করলাম,
-আসসালামু আলাইকুম,আম্মা। কেমন আছেন?
-এই তো ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?
-আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আম্মা আপনি এলে আরো ভালো লাগতো।
-আমি চলে গেলে তোর আব্বাকে কে রান্না করে খাওয়াতো শুনি? এখন কই আছিস? এত শোরগোল কেন?
-আম্মা, আপনাদের পাশের গ্রামে মেলা হচ্ছে সেখানেই এসেছি।
-ভালো ইনজয় করছিস তাহলে। রাত বেশি হবার আগে বাড়িতে চলে যাস নয়তো সর্দি লেগে যাবে।
-আচ্ছা, আম্মা আব্বাকে আমার সালাম জানাবেন আর টুকিকে অনেকগুলো ভালোবাসা দিবেন।
-আচ্ছা দিবো।আগামী পরশু চলে আসিস। আল্লাহ হাফেজ।
-জি, আল্লাহ হাফেজ।আসসালামু আলাইকুম।
-ওয়ালাইকুম আসসালাম।
কথা শেষ হতে মোবাইল প্যান্টের পকেটে রেখে রিয়াদের কাছ যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই কিছু একটা দেখে পা থমকে গেলো আমার।
লাল গোল জামা পরনে একটি ছোট বালিকা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখের নোনাজল ফেলছে।পাশে দাঁড়ানো মহিলাটি অনবরত বকে যাচ্ছেন মেয়েটিকে।আমার বেশ মায়া হলো মেয়েটির জন্য। সেদিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই রিয়াদ আমাকে পিছন থেকে ডাক দিলো। আমি পিছু ফিরে একপলক রিয়াদের দিকে তাকিয়ে আবারও ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম ওই জায়গাটি ফাঁকা মেয়েটি নেই!
কিছুটা মন খারাপ হলো আমার কিন্তু কি আর করার। কিছুক্ষণ মেলায় কাটিয়ে বাড়িতে ফিরে আসি আমরা।
সেই মেয়েটির কথা আমার আর মনে পড়ে নি। যেদিন ঢাকায় চলে ফিরে যাবো সেদিন সকালে কাকতালীয় ভাবে মেয়েটির সাথে আমার দেখা হয়।
আমার নানুর চুলে তেল লাগিয়ে দিচ্ছিলো। এত সুন্দর আদুরে চেহারা মেয়েটির। হাজার জনের মাঝেও ওকে অনন্য দেখাবে।আলাদা এক মাধুর্য বিরাজ করে ওর মাঝে।
কথার ছলে রিয়াদের থেকে জেনে নিলাম মেয়ের পরিচয়।কিন্তু, আমার মন, মস্তিষ্ক ওর নাম রেখে দিলো মাধুর্য।
এরপর, যখনই এক বা দু’দিনের জন্য ছুটি পেতাম চলে যেতাম কুমিল্লায় শুধু মাধুর্যকে দেখতে।তখনও সে আমার পছন্দের তালিকায় ছিলো।তাকে ভালোবাসি এমন কোনো অনুভূতি আমার মাঝে হয় নি।
তখন সে ছিলো নিতান্তই নবম শ্রেনীতে পড়ুয়া কিশোরী।
কি ভাবে যেন দিনগুলো পার হয়ে গেলো! মাধুর্য এসএসসি পাশ করে কলেজে ভর্তি হলো রিয়াদের কাছে থেকে জানলাম।রিয়াদ ছিলো আমার দূত যে আমাকে মাধুর্যের খবরাখবর পৌঁছে দিতো।
তার বেশ কয়েকটি ছবি আমাকে দিলো রিয়াদ।আগের থেকে বেশ বড় হয়েছিলো সে। ওর মাধুর্যতা যেন আগের থেকে বহুগুণ বেড়ে গেলো।
এরপর থেকে আমার যে কি হলো! খেতে পারতাম না, ঘুমাতে গেলে এপাশ ওপাশ ফিরতাম ঘুম আসতো না। পড়তে বসলে বইয়ের পাতায় তার আদলটাই ভেসে উঠতো। কি এক অসহ্য অনুভুতি ছিলো!
একদিকে এমবিবিএস ফাইনাল পরিক্ষা অন্যদিকে আমি কিছুই পড়তে পারছিলাম না। উপায় না পেয়ে মাধুর্যের ব্যাপারে আম্মার সাথে খোলামেলা আলাপ করলাম। সব শুনে আম্মা হেসে বলেছিলেন,
-আমার জড়বস্তুর ন্যায় পুত্র ভালোবাসায় নড়লো তবে।সব চিন্তা বাদ দিয়ে আগে পরীক্ষা দে এরপরে আমি নিজে তোর আব্বার সাথে কথা বলবো।
হৃদয় শান্ত হলো আম্মার শান্তিবানী শুনে। এরপরের সময়গুলোতে নাওয়া,খাওয়া বাদ দিয়ে পরীক্ষায় মনোযোগী হয়েছি।
পরীক্ষা যেদিন শেষ হয় সেদিন আমি রওনা হই কুমিল্লার উদ্দেশ্য। সেখানে পৌঁছানোর পর জানলাম, মাধুর্যের বিয়ে হয়ে গেছে।
এই চারটি বাক্য ছিলো আমার জীবন শোনা সবচেয়ে তিক্তময় ভাষা।
মনে মনে নিজেকে গালি দিতাম কেন আমি ওকে মনের কথা বললাম না।কেন আমি ওকে একটিবারও বললাম না,
“তোমাকে না জানিয়ে আমি তোমায় ভালোবেসেছি।সেই ভালোবাসা থেকে তোমার একটি বিশেষ নাম আমি রেখেছি,মাধুর্য ”
সে রাতে আমার আব্বা কল করে জানালেন, আম্মা মারা গেছেন।
পুরো দুনিয়া কেঁপে উঠলো আমার। এই একইদিনে আমি কয়জনকে হারিয়ে ফেললাম।
এত শোক সামলাতে পারিনি পুরো ১২ ঘন্টা অচেতন ছিলাম। জ্ঞান ফিরে আসতেই তিক্ত সত্য গুলো আবারও মনে পড়ে গেলো।অজ্ঞান থাকায় আম্মার জানাযায়, কবরে দু’মুঠো মাটি কিছুই দিতে পারিনি।
চোখের পানি গুলো আপনাআপনি গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
আম্মা চলে যাবার পর বেশ ভেঙে পড়েছিলাম। কিন্তু, বোনের অনুপ্রেরণায় আবার উঠে দাঁড়ালাম। আর দেখো আজ আমি তোমাদের আদিল স্যার হয়ে এখানে তোমাদের সামনে উপস্থিত।
মাধুর্যতে বিভোর হয়ে আমি আজ ভালোবাসার কাঙাল। আমার মস্তিষ্ক জানে সে বিবাহিত কিন্তু আমার মন কি বলে জানো তোমরা? বলে, তুমি তো আর তার কাছে ভালোবাসার দাবি নিয়ে দাঁড়িয়ে নেই। চুপিচুপি ভালোবাসলে কেউ তো দেখবে না আদিল।
আদিলের কথা বলা শেষ হতেই সকল স্টুডেন্টরা চোখভড়া জল নিয়ে দাঁড়িয়ে করতালি দিলো।
তারা শুধু এতদিন জানতো তাদের আদিল স্যার বদমেজাজি, হৃদয়হীন একটা মানুষ কিন্তু আজ জানতে পারলো। তাদের স্যারের এই রুক্ষ্মতার পিছে অনেক ভালোবাসা চাপা পড়ে আছে।
————–
রুশাকে আজ হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ দেয়া হয়েছে। রুশা বসে বসে ভাবছে কোথায় যাবে সে? মামা মামীর কাছে কিন্তু উনারা যদি না রাখে আমাকে? রুশা যখন এইসব ভাবছিলো ঠিক তখনই রায়হান সাহেব কেবিনে প্রবেশ করলেন। এরপর রুশাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-কি ভাবছো? কোথায় যাবে তুমি?
-আসলেই তো কোথায় যাবো আমি! আচ্ছা, স্যার আপনি আমাকে আপনাদের বাড়িতে রাখবেন বিনিময়ে আমি সুস্থ হলে আপনাদের বাড়ির যাবতীয় সকল কাজ করে দিবো। আমাকে শুধু থাকার জন্য একটু আশ্রয় দিলে চলবে আর খাওয়ার জন্য দু’মুঠো ভাত।
করুন সুরে কথাগুলো বললো রুশা। রায়হান সাহেব দু’মিনিটের জন্য বাকশক্তি হারিয়ে ফেললেন রুশার করুনসুরের ব্যক্ত শুনে।
রুশার সমানে এসে রায়হান সাহেব বললেন,
-মা’রে আমার আল্লাহ আমাকে অনেক ধনসম্পদ দান করেছে কিন্তু খরচ করার লোক রাখেনি। মা’রে তুই যাবি আমার সাথে। সেখানে গেলে তোর একটা বড় বোন পাবি। আমার মতো একটা বুড়ো বাবাও পাবি। যাবি মা তোর এই বুড়ো বাবার সাথে?
রায়হান সাহেবের দিকে ছলছল নয়নে তাকিয়ে রইলো রুশা। এই অচেনা মানুষটি কেন তার জন্য এতকিছু করছে যেখানে তার আত্মার সম্পর্ক, রক্তের সম্পর্কের লোকেরা মুখ ফিরিয়ে রেখেছে!
দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে এক একটি শব্দ উচ্চারণ করছিলো আদিল। হাতে তার মাধুর্যের ছবি। যেটাতে কিশোরী মাধর্যুকে হুট করে পূর্ন যুবতী দেখাচ্ছিলো।
আদিলের চোখের পানি গড়িয়ে পড়লো ছবিতে থাকা মাধুর্যের হাসোজ্জল মুখশ্রীতে।
#শেষ_বিকেলে_এলে_তুমি
#পর্ব_৩
#Tahmina_Akhter
-হ্যালো,আসসালামু আলাইকুম; আঙ্কেল।
-ওয়ালাইকুম আসসালাম।আয়াত তুমি কি একটু
আমাদের বাড়িতে আসতে পারবে?
-জী, আঙ্কেল আসতে পারবো। আপনি দশ মিনিট অপেক্ষা করুন আমি বাড়ি থেকে বের হচ্ছি।
কল কেটে দিলেন রায়হান সাহেব। রুশা বসে বসে ভাবছে ছয়দিন আগেও সে ছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়ে। স্বামী সোহাগিনী, শ্বাশুড়ি ভক্ত পুত্রবধু কিন্তু আজ কিছুই নেই।কারণ, সে মেয়ে জন্ম দিবে বংশের বাতি যে দিতে পারবে না। তাদের এই কু’চিন্তার জন্য আমার অনাগত সন্তান এই পৃথিবীর আলো দেখার আগে বিদায় নিলো। দিনশেষে আমার পাওয়ার প্রাপ্তি শূন্য আর তাদের ঝুলি পূর্ণ।
এইসব ভাবতে গিয়ে কখন যে আবারও চোখ পানিতে ভরে উঠলো টের পেলাম না।
আয়াত রায়হান সাহেবদের বাড়ির গেটের কাছে যেতেই দেখতে পেলো রায়হান সাহেব গাড়ি থামিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আয়াত রায়হান সাহেবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মনে মনে বললো,
-বাড়ির সামনে গাড়ি দাড় করে দাঁড়িয়ে থাকার মানে বুঝলাম না।
আয়াতকে আসতে দেখে মুখে এক চিলতে হাসির রেখা পড়লো রায়হান সাহেবের। আয়াত উনার সামনে এসে সালাম দিয়ে বললো,
-এখানে দাঁড়িয়ে কেন আঙ্কেল?
-আসলে, বাবা আয়াত রুশা তো অসুস্থ ওকে যদি একটু বাড়ির ভিতরে দিয়ে আসতে সাহায্যে করতে।
-রুশা আবার কে?
আয়াতের কন্ঠে ছিলো অবাক-বিস্ময় হবার মিশ্র অনুভূতি।
-ও হচ্ছে রুশা।
গাড়ির একপাশের ডোর খুলে দিয়ে বললো রায়হান সাহেব। আয়াত একপলক রুশার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো। এরপর, রায়হান সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-আঙ্কেল,বাড়িতে নিশ্চয়ই হুইল চেয়ার আছে?
-হ্যা আছে, তুমি এখানে দাড়াও আমি গিয়ে ফাহিমাকে বলছি কারন ও জানে হুইল চেয়ার কোথায় আছে?
রায়হান আঙ্কেল চলে গেলো বাড়ির ভিতরে আর আমি মন মনে ভাবছি,অপরিচিত এই মেয়েকে আমাদের রায়হান আঙ্কেল সসম্মান বাড়িতে নিয়ে এলেন কিন্তু কেন!
হুইল চেয়ার এনে তাতে রুশাকে বসিয়ে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলো আয়াত। রুশা এতক্ষণ আয়াতের কান্ড গুলো দেখছিলো আর অবাক হচ্ছিল। কারণ,আয়াত একটি বারও প্রয়োজন ছাড়া ওর দিকে তাকায়নি আবার গাড়ি থেকে বের হওয়ার জন্য যখন ওর সাহায্যের প্রয়োজন হলো তখন ফাহিমা খালা মানে এ বাড়ির হ্যাল্পিং হ্যান্ডকে ডেকে এনে ওকে হুইল চেয়ারের বসাতে সাহায্যে করেছে।এমন ছেলে এই যুগে কোথায় পাওয়া যায়! এখনকার কিছু ছেলে আছে যারা নানান ছুতোয় মেয়েদের গায়ে হাত দিতে কার্পন্য করে না।
বিশেষ করেঃলোকাল বাসে,মেলায়, মার্কেটে,বাজারে।
তাদের এই অস্বাভাবিক আচরণ গুলো যে মেয়েদের মনে কিরূপ প্রভাব ফেলে তারা যদি বুঝতে পারতো তাহলে কখনোই এমন কুরুচিপূর্ণ আচরণ করতো না।
———————–
কুঞ্জ বাড়িতে আজ আমার দশমতম দিন।এই বাড়িতে আসার পর একটিবারও মনে হয়নি আমি এই পরিবারের কেউ না।অথচ, আজ চৌদ্দ দিন ধরে আমি ওই বাড়িতে নেই কেউ একটিবারও কল করে জানতে চাইলো না কেমন আছি? কোথায় আছি? আচ্ছা, রাফির কি একটিবারও আমার কথা বা আমাদের অনাগত সন্তানের কথা মনে পড়ে না! হয়তো না কারণ সে তো মুক্তি পেয়েছে আমার কাছ থেকে পেয়েছে মেয়ের বাবা হবে এই তকমা থেকে।
যদি একটিবার রাফিকে বলতে পারতাম, শুধুমাত্র তোমার অবহেলায় আমার কোল আজ শূন্য। তলপেটের সেই কাটা দাগ দেখলে মনে পড়ে আমি মা হয়েছি ঠিকই কিন্তু পরিপূর্ণ স্বাদ পেতে পারেনি
শুধুমাত্র তোমার জন্য। আমি তোমাকে কখনো মাফ করবো না রাফি কখনোই না।
কে যেন হাত বাড়িয়ে আমার চোখের পানিগুলো মুছে দিলো!তাকিয়ে দেখলাম আঙ্কেল আমার শিয়রের পাশ এসে বসে আছে।
-কি রে মা আর কত কাঁদবি?এবার তো বন্ধ কর।যদি তোর মেয়ের জন্য কাঁদিস তাহলে বলবো ওর জন্য না কেঁদে তুই শুধু দোয়া করিস যেন ওপারে সে ভালো থাকে। এখন ব্রেকফাস্ট করে নে আয়াত একটু পর আমাদের বাড়িতে আসবে। তোর সাথে নাকি ওর কথা আছে।
-উনার সাথে আমার আবার কিসের কথা, আঙ্কেল?
-রুশা, আমিও চাই আজ তুই আয়াতের সাথে বল।কারণ, ওর সাথে আজকে কথা হওয়ার পর তুই হয়তো তোর এই ভেঙে যাওয়া পৃথিবীকে নতুন করে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করবি।
আঙ্কেল চলে যাওয়ার পর ফাহিমা খালা এসে উঠিয়ে হাতমুখ ধুয়ে দিতে সাহায্য করলেন এরপর আমাকে নাশতা খাইয়ে চুল বিনুনি করে দিলেন । সবশেষে, আমার পাশে বসে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে লাগলেন৷ আর আমি শুধুই নীরব শ্রোতা হয়ে খালার কথা শুনছিলাম।
পয়তাল্লিশ মিনিট পর আয়াত এলেন আমার জন্য বরাদ্দকৃত ঘরটিতে। ঘরে ঢুকে সর্বপ্রথম সালাম দিলেন খালা সালামের উত্তর নিয়ে চলে যেতে চাইলেন কিন্তু আয়াত মানা করে দেয়াতে আর যাননি বসে রইলেন আমার পাশে ।
-তোমার পুরো নাম কি?
-রুশা হাসান।
-তোমার নামের অর্থ জানো?
-না
-রুশা নামের অর্থ হচ্ছে শান্তিপ্রিয়।তোমার স্বভাবগত আচরণ দেখে বুঝা যায় তুমি বাস্তবিকভাবে শান্তিপ্রিয় নারী।
রায়হান আঙ্কেল তোমার ব্যাপারে সব কিছু বলেছে আমাকে। সবকিছু জানার পর আমার তোমার জন্য যতটা কষ্ট লেগেছে ঠিক তার চেয়েও বেশি ঘৃণা এসেছে তোমার স্বামী নামক কাপুরষটার জন্য। সে কিভাবে পারলো তার অংশকে অস্বীকার করে তোমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে!আর তোমার শ্বাশুড়ির কথা কি বলবো? এদের কর্ম গুলো দেখলে ভাষা প্রয়োগ করতে ইচ্ছে হয় না। উনি নিজেও একজন মেয়ে, উনার নিজেরও মেয়ে আছে। সেখানে উনি কিভাবে এরকম করতে পারে। আর তোমার স্বামী সে যে এই পৃথিবীর আলো দেখেছে তাও সেই নারীর মাধ্যমে। কিন্তু, তার কন্যা সন্তানের পিতা হতেই যত আপত্তি।
রুশা তোমাকে কিছু কথা বলি মনোযোগ দিয়ে শুনবে।
আমাদের ইসলাম ধর্মে নারীদের কত সম্মানিত করা হয়েছে সেখানে কিছু মানুষ নারীদের অসম্মান করে আমাদের ধর্মকে করছে কলুষিত। নারীর অধিকারে সংরক্ষণ করার বিষয়টিকে আল্লাহ তায়ালা সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। যারা নারী অধিকারে খর্ব করে এবং তাদের সঙ্গে বৈরিতামূলক আচরণ করে তাদের ব্যাপারে তিনি কঠিন হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন৷ এমনিক নারী নামেও একটি সূরা অবতীর্ণ করেছেন যার নাম সূরা আন-নিসা।
কন্যার প্রতি বৈষম্য নিরসনে আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতে বলেছেন,
“আর যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয় তখন তার চেহারা কালো হয়ে যায়।আর সে থাকে দুঃখ ভারাক্রান্ত। তাকে যে সংবাদ দেয়া হয়েছে,সে দুঃখে সে জাতির কাছে থেকে আত্মগোপন করে। অপমান সত্ত্বেও কি একে রেখে দেবে,না মাটিতে পুঁতে ফেলবে? জেনে রেখো,তারা যা সিদ্ধান্ত নেয়, তা কতই না মন্দ! (সূরা-নাহল, আয়াত:৫৮-৫৯)”
আর এই আয়াতে আল্লাহ স্বামী-স্ত্রীর জন্য কি বলছে জানো?
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
“আর তার নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে যে,তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন,যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও।আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।নিশ্চয়ই এর মধ্যে সে জাতির জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে, যারা চিন্তাভাবনা করে।'(সূরা রুম,আয়াত:২১)”
এতক্ষণ যা যা বলেছি তুমি যদি একটু মাথা খাটিয়ে দেখো তাহলে বুঝতে পারবে তোমার স্বামী ঠিক কোন ক্যাটাগরির মানুষ। না সে একজন ভালো স্বামী হতে পেরেছে না একজন দায়িত্ববান বাবা।
সবর্শেষ একটা কথা বলবো, আমি এবং আঙ্কেল আমরা চাইছি তুমি আবারও নতুনভাবে নিজেকে গড়ে তুলো।যেখানে এই ভাঙাচোরা শরীরের রুশা নয় হাজারও নারীর অনুপ্রেরনা হিসেবে থাকবে এই রুশা হাসান।
—————-
“নিঃসঙ্গ বিকেলে
বসে আছি কেদারায়।
দুই নয়নে অপেক্ষা তুমিটাকে
এক পলক দেখার ”
(তাহমিনা আক্তার)
#চলবে
#চলবে