শেষ বিকেলে এলে তুমি পর্ব -৩০+৩১

#শেষ_বিকেলে_এলে_তুমি
#পর্ব_৩০
#Tahmina_Akhter

আজ চারদিন অতিবাহিত হলো সেই ঘটনার। এই চারদিনে নিজের জীবনে কিছু অংশ যেন হঠাৎ করে বদলে গিয়েছে।আগে সকালের ঘুম ভেঙে যেতো কাজল আপু বা আঙ্কেলের ডাকে আর এখন ঘুম ভাঙে আদিল স্যারের ফোনকলে।ফজরের আজানের কিছু সময় পরে দেখা যায় উনি আমাকে কল করছেন।কল রিসিভ করলে, উনি জিজ্ঞেস করেন, আমি কেমন আছি?কি করছি?নামায আদায় করেছি কি না?

অতঃপর, লজ্জা অবনত মস্তকে বলি,আসলে ঘুমিয়ে ছিলাম, আপনি কল দেয়ায় ঘুম ভেঙেছে।ইনশাআল্লাহ, এখন নামাজ আদায় করবো। উনি হেসে কল কেটে দেন । আর আমি তখন নামাজ পড়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকি।

বিগত চারদিন ধরে যেই কার্যক্রম হচ্ছিল আজ হঠাৎ করেই তা বন্ধ হয়ে গেছে। আদিল স্যার আজ ভোরে বা সকালে আমার কাছে কল করেনি আর আমিও উনাকে কল দেয়ার জন্য সাহস পায়নি। কি হয়েছে, উনার? নাকি?

পড়ন্ত দুপুরে একাকী ছাঁদে দাঁড়িয়ে কথাগুলো ভাবছে রুশা। আজ কেন যেন দুপুরের খাবারের পর ঘুম আসেনি, তাই ছাঁদে এসে বসে আছে।

কিছুসময় পর রুশার পাশে এসে দাঁড়ালো ফাহিমা খালা। রুশা কাঁধে হাত রেখে বললো,

-কি গো আম্মা, দুপুরে ভাত ঠিক মতো খাইলা না যে?

-এমনি খালা, খেতে ইচ্ছে করছিলো না। তুমি এই ভরদুপুরে ছাঁদে আসতে গেলে কেন?

-বাড়িতে তুমি আর আমি ছাড়া কে আছে, কও তো?আইচ্ছা, আম্মা তুমি কি সেদিনের কাহিনি লাইগা দুশ্চিন্তা করতাছো?হেই পোলায় যা করছে তা কিন্তু ঠিক করে নাই। হেই পোলার মায় নাকি তোমারে দেখতে আইছিল?

-হ্যাঁ,এসেছিলো ওর মা। কিন্তু, খালা আমি বিয়েতে রাজি হচ্ছি না বলে,এই কাজটা সে কিভাবে করতো পারলো!আমি এখনো বুঝতে পারছি না।একপ্রকার মিথ্যে হুমকি দিয়ে চেয়েছিল যাতে আমি ওকে বিয়ে করি। কিন্তু,আল্লাহর অশেষ রহমতে আমার স্যার আর আয়াত ভাই সেখানে সময়মতো পৌঁছাতে পেরেছিলো নয়তো যে কি হতো? উদাস কন্ঠে বললো রুশা।

-চারপাশে এহন এই ঘটনার অভাব নাই। মাইয়া রাজি না হইলে এসিড ছুইরা দেয় নয়তো কোপায় মাইরা ফেলাইবো, নয়তো ইজ্জত-হরণ করবো। যেন মাইয়া কোনদিনও কারো মুখ দেহাইতে না পারে। এই পুরুষ জাত জানি কেমন! এক পুরুষ জাত আছে, যারা মহিলা গো সামনে খাড়াইয়া থাকবো কিন্ত চোখ তুইলা তাকাইতো না, আর আরেক পুরুষ জাত তো ছোট থেইকা বুড়া হগল মহিলাগো দিকে খারাপ নজরে চাইয়া থাকবো। পৃথিবীর হগল বেডা মানুষ যদি খারাপ অইতো তয় পৃথিবীতে সব মহিলারা শান্তি পাইতো না।

-হু, খালা। সত্যি কথা বলছো। আচ্ছা, খালা তুমি অনুমতি দিলে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?

-আম্মা এডি তুমি কি কও? যা মন চাও জিগাও আমি কিছু কমু না।
ফাহিমা খালা হাসিমুখে কথাগুলো বললো।

অনেক জোড়ে শ্বাস নিয়ে রুশা ফাহিমা খালাকে জিজ্ঞেস করলো,

-খালা, আপনার স্বামী, সন্তান কেউ নেই?

আমার কাছ থেকে এমন প্রশ্ন শুনে খালা হাসিমুখ আচমকা অন্ধকার হয়ে এলো। দূর আকাশের তাকিয়ে থেকে বললেন,

-আমার স্বামী থাকলেও সন্তান দেখার সৌভাগ্য আমার আছিলো না।

-কেন, খালা?

-কারণ, আমি বান্জা। আমার কোনোদিনও পোলাপাইন হইতো না।

খালার মুখে এইকথা শুনে আমার মনে অনেক কষ্ট লেগেছে। নারী হয়েও মাতৃত্বের স্বাদ তিনি পাননি।

-আমার বিয়ার যহন তিনবছর হইলো তহনও আমার ঘরে পোলাপান হয়না। আমার শ্বাশুড়ি, ননদ,জা মিইল্লা উঠতে বইতে গেলে খোঁটা দিতো, ক্যান আমার ঘরে বাচ্চা হয় না? আমার স্বামী তহন শহরে হকারের কাম করতো। বছরে দুইবার বাড়িতে আইতো।
তো সেবার যহন আমার স্বামী আইলো, তহন আমার শ্বাশুড়ি আমার বাপ-মায়েরে খবর দিয়া বাইত আইনা বিচার বসাইলো আমার নাম।আমার অপরাধ আছিল, আমার ঘরে বাচ্চা ক্যান হয় না, এই বৌ ঘরে রাখলে সংসারে বাতি দিব কে?তাই হেয় সিদ্ধান্ত নিছে তার পোলারে আবারও বিয়া করাইবো আর আমারে যেন আমার স্বামী সবার সামনে তালাক দিয়া বাইততে বাইর কইরা দেয়। সেদিন, আমার পাষাণ স্বামী আমার তালাক দিয়া দিলো একটাবার কইলো না ফাহিমা তুমি কই যাইবা?যে যাই বলুক আমি তোমারে নিয়া সংসার করমু।
হেই যে তাগো বাইততে বাইর হইছি আর কোনোদিনও হেইগ্রামে যাই নাই। হুনছি, তার তিনটা পোলা, আর একটা মাইয়া। এহন, আমি ভাবি যদি হেয় আমারে লইয়া সংসার করতো তার কি পোলা থাকতো নাকি মাইয়া থাকতো?যা হয়েছে ভালোই হয়েছে, আমার আর আফসোস নাই। আল্লাহ কি সবাইরে সব সুখ দেয় নাকি?সব সুখ যদি দুনিয়ায় পাই তয় জান্নাতের আশা করুম কেমনে?

বলেই খালা আমার দিকে চোখভরা জল নিয়ে তাকালেন।আমিও খেয়াল করলাম খালার জীবন বৃত্তান্ত শুনতে যেয়ে কখন যেন আমার চোখ ভিজে উঠেছে?

-আচ্ছা, খালা পৃথিবীতে বাঁচতে হলে তো সব প্রয়োজন। যেমন:মা-বাবার ভালোবাসা, স্বামীর ভালোবাসা, সন্তানের ভালোবাসা, টাকা-পয়সা, সম্পদ। সবাই তো সব পায় না কিন্তু সবরকম ভালোবাসা ছাড়া কি এই নশ্বর পৃথিবীতে বেঁচে থাকা যায়?

– আম্মা, আমরা হইলাম আল্লাহর সৃষ্টি সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত। আল্লাহ যে ভালোবাসা দিয়া আমগো বানাইছে সে ভালোবাসা কি আমরা আল্লাহরে দেই? দেই না তাই বইলা কি আল্লাহ আমাগো ভালোবাসা ছাইড়া দিছে? দেয় নাই। ঠিক তেমন কেউ তোমারে ভালোবাসে না বইলা তুমিও তারে ভালোবাসবা না ঠিকআছে কিন্তু ঘৃনাও কইরো না।কারণ, মানুষের দিলে আল্লাহ ভালোবাসা দিছে পশুর শরীরে না।

খালার কথাগুলো আমি খুব মনোযোগ সহকারে শুনলাম। আর শুনে যা বুঝলাম, লেখাপড়া না জানা আমাদের ফাহিমা খালার কাছে এখনো অনেক কিছু শেখার বাকি আছে, আমার।

——————————–

রেস্টুরেন্টের একটি টেবিলে বসে আছে রায়হান সাহেব, কাজল আর আয়াত। কে যেন আসবে রায়হান সাহেবের সাথে খুব জরুরি কথা বলতে?কাজল একবার চোখের ইশারায় আয়াতকে জিজ্ঞেস করলো, কে আসবে?
প্রতিউত্তরে আয়াত কাঁধ ঝাঁকিয়ে নাসূচক ভঙ্গিমা করলো।

রায়হান সাহেব কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। উনারা যে পাশটায় বসেছেন সেখান থেকে বাইরে গাড়ির পার্কিং এরিয়া দেখা যাচ্ছে। রায়হান সাহেব একটু পর দেখলেন, উনার খুব কাছের পরিচিত একটি মুখ।যে কিনা গাড়ি পার্ক করে রেস্টুরেন্টের ভিতরে খুব তাড়াহুড়ো করে প্রবেশ করছে।রায়হান সাহেব চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন।

কাজল যখন দেখলো তার আব্বা দাঁড়িয়ে পড়েছে, সেও দাঁড়িয়ে পড়লো। কাজল, তার আব্বার দৃষ্টির অনুসরণ করে তাকাতেই দেখতো পেলো, আদিলকে। যে কি না ওদের দিকে এগিয়ে আসছে।

আদিল এগিয়ে এসে সবার উদ্দেশ্য সালাম জানালো।রায়হান সাহেব যেন এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না, উনার সামনে আদিল উনার পুত্র দাঁড়িয়ে আছে।

কাজল প্রথমে অবাক হলেও পরক্ষণে হেসে আদিলকে জিজ্ঞেস করলো,

-কেমন আছো, ভাইয়া?

-আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?

-আমরা সবাই ভালো আছি। আয়াত কি তবে তোমার সাথে দেখা করানের জন্য আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে?
কাজল তার আব্বার মুখের দিকে তাকিয়ে আদিলের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো।

-হ্যাঁ,আমি বলেছিলাম আয়াতকে তোদেরকে এখানে নিয়ে আসার জন্য,জরুরি কথা ছিলো।

-তোমার জরুরি কথা তাও আবার আমাদের সাথে!
বিদ্রুপের সুরে বলে উঠলেন রায়হান সাহেব।

আদিল সেদিকে কর্ণপাত না করে কাজলকে উদ্দেশ্য করে বললো,

-রুশার ব্যাপারে জরুরি কথা ছিল, আশা করছি সবাই মন দিয়ে কথাগুলো শুনবে।
আদিল তার আব্বাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো।

আদিলের মুখে রুশার নাম শুনে রায়হান সাহেব এবার নড়েচড়ে বসলেন।রায়হান সাহেবের হঠাৎ চুপ হওয়ার কারন বুঝতে পেরে আদিল তার হাসি চেপে রেখে সবার উদ্দেশ্য বললো,

-রুশা যেদিন নিখোঁজ হয় সেদিন মিসবাহ রুশার সাথে কি করতে চেয়েছে তা হয়তো আপনারা জানেন। কিন্তু, এর বাইরেও সেদিন আরও একটি ঘটনা ঘটেছে কিন্তু সেই ঘটনা আপনাদের জানার আড়ালে রয়ে গেছে। আমি চাই আপনারা সবাই এই ঘটনা সম্পর্কে জানুন। অনুমতি দিলে আমি সেই ঘটনা সারসংক্ষেপে আপনাদের বলতে চাই।

-মিসবাহ কি রুশার সাথে?
রায়হান সাহেব আতংকিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

-না, সেরকম কিছুই হয়নি, তবে সেই রাতে যখন মিসবাহ রুশাকে ব্ল্যাকমেল করে বিয়ে করতে চাই ঠিক সে-সময় আমি সেখানে উপস্থিত হই। মিসবাহ কিছু খারাপ শব্দ প্রয়োগ করে রুশার উদ্দেশ্য আর আমি সেগুলো সহ্য করতে পারিনি, তাই আমি সেই রাতে রুশাকে আমার স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করি।

ব্যস, আদিলের শেষের কথা শুনে রায়হান সাহেব আর কাজলের মুখ হা হয়ে গেলো। মানে এতবড়ো একটা ঘটনা কি না ওদের কাছ থেকে লুকানো হয়েছে! কিন্তু, কেন?

-এতবড়ো ঘটনা কেন আমাদের কাছ থেকে লুকানো হয়েছে জানতে পারি?
রায়হান সাহেব প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো আদিলের উদ্দেশ্য।

-কারণ, আপনাদের রুশা আমাকে শর্ত দিয়েছে, যদি তার অভিভাবক মানে আপনি যদি এই বিয়ে মেনে নেন তবেই ও এই বিয়েকে মন থেকে গ্রহণ করবে। তাই,আয়াত, আমি বা রুশা কেউ এই বিয়ের ব্যাপারে আপনাকে বা কাজলকে জানায়নি। কারণ, আমি চেয়েছিলাম আপনাদেরকে এই বিয়ের ব্যাপারে জানাতে।

-মানে, এত বড়ো একটা ঘটনা!আর তোমরা সকলে মিলে আমার কাছ থেকে গোপন করে রেখেছো?
আয়াত,আমি তোমার কাছে কখনো এমনটা আশা করি নি।

আয়াতের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে আদিলের দিকে ফিরে রায়হান সাহেব প্রশ্ন করলেন,

-তবে,কি তুমি তোমার মাধুর্যকে ভুলে গিয়েছো?

-না, আমি আমার মাধুর্যকে ভুলে যাব কেন? বরং, আমি তো আমার মাধুর্যকে আজ কতবছরের অপেক্ষার পর ফিরে পেলাম।

রায়হান সাহেব আদিলের কাছ থেকে একথা শুনে চমকে গেলেন প্রায় ভুত দেখার মতন। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।এরপর আদিলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রায়হান সাহেব বললো,

-নাটক পেয়েছো তুমি।রুশাকে বিয়ে করে এখন বলছো, তোমার মাধুর্যকে ফিরে পেয়েছো।আমি জানতাম তুমি কিছু একটা করবে আমার উপর প্রতিশোধ নিতে। আর সেই প্রতিশোধের বলি হতে হলো,রুশাকে।

আদিল তার আব্বার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো, তার আব্বা কি বলছে এইসব?
#শেষ_বিকেলে_এলে_তুমি
#পর্ব_৩১
#Tahmina_Akhter

-আব্বা, আপনার এই একটা দোষ, কোনো কথার সম্পূর্ণ অংশ না জেনে আগেই রিয়াকশন দেয়া শুরু করে দেন। আগে ভাইয়ার পুরো কথা তো শুনুন।
কাজল তার আব্বার কথায় বেশ বিরক্ত হয়ে বললো।

মেয়ের কথায় কিছুটা নরম হলেও আদিলের উপর বিশ্বাস জমাতে পারেননি বোধহয়।গরম চোখে তাকিয়ে রইলো আদিলের দিকে।

আদিল কিছুসময় অতিবাহিত হওয়ার পর তার আব্বার সম্মুখে মোবাইল তাক করে বললো,

-দেখেন তো এই মেয়েটাকে চিনতে পারেন কি-না?

রায়হান সাহেব আদিলের হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবিটি পর্যবেক্ষণ করে দেখে বললেন,

-এই মেয়ে তো সে, যে সবার কাছে তোমার মাধুর্য নামে পরিচিত।

-হু, আপনি ঠিক চিনতে পেরেছেন। এবার এই ছবিটির সাথে এই ছবিটি মিলিয়ে দেখেন তো চিনতে পারেন কি-না?
বলেই আরও একটি ছবি বের করে দেখালেন রায়হান সাহেবকে।

রায়হান সাহেব দু’টো ছবি মিলিয়ে একসাথে দেখার পর ঘামতে লাগলেন। মোবাইল রেখে দিলেন টেবিলের উপর।অতঃপর কাজলের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছু বলার আশায় কিন্তু, উনার মুখ দিয়ে একটি শব্দ উচ্চারিত হচ্ছে না।

কাজল, তার আব্বার মুখের অভিব্যক্তি দেখে চেয়ার ছেড়ে তার আব্বার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো,

-কি হয়েছে, আব্বা? শরীর খারাপ লাগছে?

-না রে মা, আমি ঠিক আছি।জানিস, তোর আম্মা মারা যাওয়ার পর যখন তোর ভাই আমার সাথে রাগারাগি করে বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে গেল।সেদিনের পর থেকে আমি আস্তে আস্তে নিজের করা ভুলগুলো বুঝতে পারছিলাম। তোর আম্মা যেদিন মারা যায় সেদিন রাতে আমি অনেক রাতেই হসপিটাল থেকে বাড়িতে ফিরি। আসার পর যখন দেখলাম আদিল তার ঘরে নেই তখন তোর মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,

-আদিল কোথায় আছে?

তোর মা বেশ কিছুক্ষণ পর উত্তর দিলো,

-আদিল তার মামার বাড়ির পাশের এক মেয়েকে ভালোবাসে।সেই মেয়েকে দেখতেই কুমিল্লা গিয়েছে।

আমি তোর মায়ের কথায় হেসে বলেছিলাম,

– তোমার গুরুগম্ভীর ছেলে আবার ভালোবাসতেও জানে! তা মেয়ে কি করে?

-মেয়ে কি করে জানি না, কিন্তু মেয়ের বাবা-মা কেউ নেই। মামার বাড়িতে মানুষ হয়েছে।

-হু, সবই ঠিক আছে। তবে মামা কি করে?

-শুনেছি, খেত-খামারি করে।

-তোমার ছেলেকে এখুনি কল করে বলবে আগামীকালের মধ্যে যেন সে এই বাড়িতে উপস্থিত হয়।ডা.রায়হানের ছেলে আদিল রহমান যে কি না নিজেও একসময় ডাক্তার হবে তার পছন্দ কি না একটি এতিম মেয়েকে, আবার মামা নাকি খেত-খামারি করে!হাহ্, ছেলে হয়েছে তোমার মতো।

-মেয়ে এতিম তাই বলে আপনি সরাসরি এভাবে কথাগুলো বলতে পারেন না। আর রইলো মেয়েটির মামার কথা উনারা গরীব হলেও যথেষ্ট ভালো মানুষ।সবচেয়ে বড়োকথা, আমাদের ছেলে সেই মেয়েকে ভালোবাসে আজ পাঁচবছর ধরে।আদিল কখনোই আপনার সিদ্ধান্ত মেনে নিবে না।

পঁচিশ বছরের সংসারে সেদিন তোর মায়ের গায়ে আমি হাত তুলেছিলাম।তোর মা আমার দিকে আর না তাকিয়ে রুম ছেড়ে বের হয়ে যায়। সেই যে আমার সাথে অভিমান করে ঘর ছেড়ে বের হলো আর কখনো তোর মা আমাকে বললো না, আপনি বাড়িতে ফিরবেন কখন?আমি কিন্তু অপেক্ষা করছি।

তোর মা আমার উপর ভীষণ অভিমান নিয়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছে।ডাক্তার বলেছিলো তোর মা হার্ট এ্যাটাকে মারা গেছে অথচ ওর মৃত্যুর পেছনের কারণ ছিল আমার দেয়া আঘাত।চাইলেও কাউকে বলতাম পারতাম না আমার জুলুমের শিকার হয়ে আমার স্ত্রী আমাকে ছেড়ে পরকালে চলে গেছে। সেদিনের সেই কথোপকথন তোর মা খুব সম্ভবত তোর ভাইয়ের ডায়রিতে রেখে গিয়েছিলো। তোর ভাই তো তখন একদিকে তার মা অন্যদিকে তার ভালোবাসাকে হারিয়ে কোনোদিকে খেয়াল ছিল না। আস্তে আস্তে যখন ও শোক সামলিয়ে উঠলো, একদিন ওর ডায়েরি পড়ে জানতে পারে তার মায়ের সাথে সেদিন আমার কি হয়েছিলো?এরপরের ঘটনা তো তুই জানিস, কাজল৷
আদিল চলে যাওয়ার পর যেন আমি আরও একাকী বিষন্ন হয়ে পড়লাম। নিজের ভুলগুলো একটু একটু করে বুঝতে পারলাম।মনে মনে আল্লাহর কাছে অসংখ্যবার ক্ষমা চাইতাম আর বলতাম আল্লাহ মরে যাওয়ার আগে হলেও তুমি সেই মেয়েটির সাথে আমাকে একবার দেখা করার সুযোগ দিও।
আল্লাহ, যে আমার প্রার্থনা এত দ্রুত কবুল করবে আমি ভাবতেও পারিনি! সেই মেয়ে এলো আমার জীবনে আমারই মেয়ের মতো হয়ে। যার শরীরে একটু কাটা বিঁধে গেলে আমার শরীরে কষ্ট অনুভব হয়। একেই বুঝি আল্লাহর লীলাখেলা বলে!যাকে অদেখায় ঘৃনা করে এলাম আর দেখায় অসংখ্য ভালোবাসা দিলাম বাবার মতো হয়ে।
বলেই হু হু করে কেঁদে ফেললেন রায়হান সাহেব।

রেষ্টুরেন্ট ভর্তি লোকের নজর তখন রায়হান সাহেব দিকে।কাজল, আয়াত আর আদিলের চোখ ভরে উঠেছে তাদের আব্বার কান্না দেখে।তাদের শক্ত মনের বাবার মনেও যে এত দুঃখ জমাট বেঁধে ছিল তারা ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি।

কাজল তার আব্বার কাঁধে থেকে হাত সরিয়ে সামনে এসে বসলো,তারপরে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,

-আব্বা,থাক না পুরনো কথা৷ এখন বলুন তো রুশার জন্য কি করা যায়? নাকি আপনার পুত্রকে রুশার জীবন থেকে আউট করে দিবেন?
কাজল কিছুটা মজার সুরে কথাটি বললো যাতে এই গুমোট পরিবেশ কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হয়।

-তোর ভাইয়ের জীবন থেকে কেউ মাধুর্যকে সরাবে এমন কেউ আছে, না-কি?

রায়হান সাহেবের কথায় সবাই হেসে ফেললোও আদিল সেই আগের মতে চুপচাপ বসে আছে৷

রায়হান সাহেব ছেলের গম্ভীর মুখটি দেখে নিলেন এরপর, আদিলকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

-হারিয়ে যাওয়া জিনিস ফিরে পেয়েছো তাই বলছি যত্ন করে রাখো। বাকিটা তোমার স্ত্রী পরীক্ষা শেষ হলে নাহয় নিজে বুঝে নিও।

আদিল তার আব্বার মুখের দিকে তাকালো অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিয়ে। তার যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না যে তার আব্বা এত সহজে এই বিয়ে মেনে নিবে।

-তবে, আমার রুশা যদি কোনো কারণে তোমার কাছ থেকে কষ্ট পেয়েছে তবে বুঝে নিও সেদিন তোমার কপালে দুঃখ আছে।

-ইনশাআল্লাহ, রুশাকে আমি কখনোই স্বজ্ঞানে কোনো প্রকার কষ্ট দিব না।তবে,রুশাকে কেউ বলবে না যে ওই আমার মাধুর্য। রুশার পরীক্ষা শেষ হলে আমি ওকে বলবো ও আমার কি? কথাগুলো বলবার সময় আদিলকে বেশ আত্নবিশ্বাসী দেখাচ্ছে।

-তবে, আমার একটি শর্ত আছে আদিল।

রায়হানের সাহেবের কাছে শর্তের কথা শুনে কাজল,আয়াত আর আদিল একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি বিনিময় করলো।

————————————

আজ পনেরদিন পর হসপিটালের উদ্দেশ্য রওনা হয়েছি তবে আজ আমি একা নই।আমার পাশে বসে কার ড্রাইভ করছেন আদিল স্যার।

হুট করে সকালে কল করে বলছেন, আমাকে বাড়ির সামনে থেকে পিক করবেন । আমি যেন আগেই বাড়ি থেকে বের না হই৷ তবে,একটা জিনিস আমি বুঝতে পারছি না, মানে উনার আচার-আচরণ দেখলে মনে হবে উনি এই বিয়েটা নিয়ে বেশ খুশি,আসলেই কি তাই! যদিও আমাদের বিয়েটা আট-দশটা বিয়ের মতো স্বাভাবিক নয়।

-কি ভাবছো, রুশা?
কার ড্রাইভ করতে করতে প্রশ্ন করলো, আদিল।

-না, কিছু না। আপনি সকালের খাবার খেয়েছেন।
কথা ঘুরানোর জন্য বললো রুশা।

-না, সেই কপাল কি আর আমার আছে?বৌ থাকলে হয়তো নিজ হাতে নাশতা বানিয়ে খাইয়ে দিতো।

স্যারের এহেন কথায় আমি আর লজ্জায় মুখ তুলে তাকাতেই পারলাম না। আদিল আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো তার মাধুর্যের লজ্জারাঙায় মুখ।

-জানতে চাইবে না তোমার আঙ্কেল এই বিয়েতে রাজি হয়েছে কি না?

-কাজল আপু বলেছে আমায়। এজন্যই কি আপনি সেদিন আমার সাথে যোগাযোগ করেননি?

-কেন, আমার ফোনকলের অপেক্ষায় ছিলে, তুমি?

রুশা এতক্ষণ যাও আদিলের সাথে স্বাভাবিক ছিল এখন আর স্বাভাবিক থাকতে পারছে না। বেশ অস্বস্তি হচ্ছে ওর কিন্তু কেন?

আদিল রুশার কাছ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে মনে মনে বললো,

-অপেক্ষা তিন বর্নের একটি শব্দ হলেও এর গভীরতা অনেক। অপেক্ষা নামক বস্তুর আশায় তো মানুষ বাঁচে।অপেক্ষার অনুভূতি কেমন হয় আমি ছাড়া আর কেই বা ভালো জানে?

নানানরকম উদ্ভট কাহিনি ভাবতে ভাবতে হসপিটালের গেট দিয়ে প্রবেশ করলো আমাদের গাড়ি।স্যার, গাড়ি থামাতেই আমি গাড়ি থেকে বের হয়ে আমাদের ডিপার্টমেন্টের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম।

কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর কে যেন আমার হাত পেছন থেকে টেনে ধরলো?

#চলবে
#চলবে

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here