#শেষ_বিকেলে_এলে_তুমি
#পর্ব_৩২
#Tahmina_Akhter
-আন্টি, আপনি!
-হ্যা,মা আমি। তোমার সাথে কিছু কথা ছিল, একটু শুনবে মা?
-কি বলতে চান, বলুন?আমি অবশ্যই শুনবো।
-মা, মিসবাহকে ছেড়ে দেয়া যায় না। আমার ছেলেটা আবেগে ভুল করে বসেছে। আমার ছেলের ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যাবে।তুমি ওকে মাফ করে দাও, তুমি কেইস তুলে নাও। আমি তোমার কাছে হাত জোর করে অনুরোধ করছি।
রুশা কি বলবে, বুঝতে পারছে না। এরইমাঝে রুশার পাশে এসে দাঁড়ালো আদিল। এরপর,রুশাকে খুব ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-কে উনি?
-মিসবাহর আম্মু।
আদিল ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো মিসবাহর মায়ের দিকে। মিসবাহর আম্মু আদিলকে দেখে সালাম দিয়ে বললো,
-স্যার, আপনি একটু রুশাকে বুঝান যেন কেইসটা তুলে নেয়। আমার ছেলেটার ভবিষ্যত অন্ধকার হয়ে যাবে।
-আমি রুশাকে কী বলব? তাছাড়া, আপনার ছেলে যা করেছে আমি মনে করি ওর শাস্তি হওয়া প্রয়োজন।
-আপনি বলতে চাইছেন আমার ছেলের দোষ আছে। আমার ছেলে রুশাকে বিয়ে করতে চেয়েছে, রুশা কেন ওকে বারবার রিজেক্ট করেছে,আমি জানতেও চাইনি। বললাম তো আমার ছেলে বুঝতে পারেনি।
-আপনি একটু আস্তে কথা বলুন, এটা হসপিটাল। শুধু শুধু এখানে সিনক্রিয়েট করার কোনো মানে হয় না।আপনি বলছেন আপনার ছেলে বুঝতে পারেনি, বুঝলাম৷ কিন্তু, একটা মেয়েকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে, যেয়ে রেইপ করার মিথ্যে ঘটনা সাজিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করার জন্য ফোর্স করা, এগুলো আপনার ছেলে বুঝতে পারেনি, তাই না?
-আমি কিছু জানতে চাই না, আমি শুধু তোমাকে বলতে চাই, রুশা তুমি কেইস তুলে নাও। তুমি যত টাকা চাও আমি দিব।
রুশা এতক্ষণ মাথা নিচু করে রেখেছিল কিন্তু মিসবাহর মায়ের মুখ থেকে টাকার কথা শুনে আদিলের দিকে চোখ তুলে তাকালো। আদিল রুশার দিকে তাকালো এরপর মিসবাহর মা’কে বললো,
-আপনি টাকার লোভ কাকে দেখাচ্ছেন? রুশাকে নাকি ডা.আদিল রহমানের স্ত্রীকে? আমার স্ত্রীকে আপনি টাকা দিবেন যেন আপনার কুলাঙ্গার পুত্র যেই ঘৃন্য কাজ করেছে সেই শাস্তি থেকে রেহাই পেয়ে যায়। আমি গতকাল রাতেও ভেবেছিলাম পুলিশের সাথে কথা বলে মিসবাহকে ছেড়ে দেয়ার ব্যবস্থা করব। কিন্তু, আপনার কথাবার্তায় যা বুঝলাম, আপনার ছেলের মাঝে যতগুলো খারাপ দিক আছে সব আপনার কাছ থেকে পাওয়া। আপনি এখন এই মূহুর্তে হসপিটাল থেকে বের হয়ে যাবেন। আমি যেন আপনাকে রুশার ছায়ার আশেপাশেও না দেখি।
-রুশা তোমাকে তো আমি ভালো মেয়ে ভেবেছিলাম। তুমি এতিম,ডিভোর্সি জানার পরও আমার ছেলে যখন তোমার কথা বললো, আমি তোমাকে দেখতে যাওয়ার পর তোমার সাথে কথা বলার মনে হয়েছে তুমি দারুণ একটি মেয়ে। কিন্তু, তুমি একটা লোভী মেয়ে। যার কাছে টাকাপয়সা সবকিছুর উর্ধ্বে। এই ডাক্তারকে বিয়ে করবে বলে আমার ছেলেকে বারবার রিজেক্ট করেছো আর বলেছো তুমি আর কারো জীবনের সাথে জড়াবে না। ঠকবাজ মেয়ে, চরিত্রহীন উপরে উপরে ভালোমানুষের মুখোশ পরে থাকো। মাঝখানে আমার ছেলেটার জীবন ধ্বংস করে দিয়েছো।
মিসবাহর মায়ের উচ্চস্বরের কারণে অনেকে ওদের দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করছিল, কি হয়েছে?
আদিল পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ওয়ার্ড বয়কে বলে মিসবাহর মাকে হসপিটালের বাইরে রেখে বসতে বললো।ওয়ার্ড বয় এসে মিসবাহর মা’কে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু মিসবাহর মা যেন এতে আরও হাইপার হয়ে বিভিন্ন রকমের খারাপ কথা বলা শুরু করেছে।
আদিল দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুশার দিকে তাকালো দেখলো রুশার চোখে জল। আদিল রুশার খুব কাছে যেয়ে বললো,
-এই রুশা,তুমি কাঁদছো কেন? তুমি কি সত্যিই লোভী মেয়ে?
রুশা চোখ ভরা জল নিয়ে আদিলের দিকে তাকিয়ে না সূচক মাথা নাড়লো।
-তবে উনার কথা শুনে তুমি কাঁদছো, কেন? চোখের পানি মুছে ফেলো। আমি কিন্তু তোমার চোখের পানি মুছে দিতে পারতাম, কিন্তু তুৃি যদি মাইন্ড করো তাই দিলাম না। এই নাও টিস্যু চোখ মুছে নাও।
পকেট থেকে টিস্যু বের করে রুশার দিকে এগিয়ে দিলো আদিল। এতক্ষণ কান্নার প্রচন্ড বেগ থাকলেও আদিলের চোখ মুছে দেয়ার কথা শুনে আপনাআপনি রুশার কান্না বন্ধ হয়ে গেছে। মাথা নিচু করা অবস্থায় আদিলের থেকে টিস্যু নিয়ে চোখ মুছে নিলো।
আদিল রুশার মুখের দিকে রইলো।রুশার চোখ মোছা শেষ হতেই আদিল তাগাদা দিয়ে বললো,
-এখন ক্লাসে যাও। আমি আজ তোমাদের ক্লাস নিবো না। সুলতানা আজ তোমাদের বায়োলজি ক্লাস করাবে।
-আপনি ক্লাস করাবেন না কেন?
-আমার কাজ আছে। এখন যাও তুমি। আল্লাহ হাফেজ।
-হু, আল্লাহ হাফেজ।
বলে রুশা তাদের ডিপার্টমেন্টের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আদিল ততক্ষণ অব্দি দাঁড়িয়ে রইলো যতক্ষণ অব্দি রুশাকে দেখা যায়।
রুশা চলে যেতেই আদিল নিজের মোবাইলে কার নাম্বার ডায়াল করে কল করলো, ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই আদিল বললো,
-আমি আসছি, আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
————————–
দেখতে দেখতে কেটে গেছে দেড় বছর। রুশা এমবিবিএস ফাইনাল প্রফ দেয়ার পর এখন রেজাল্টের অপেক্ষায় প্রহর গুনে যাচ্ছে।
দেড় বছরে অনেককিছু বদলে গেছে। কাজল আপু এখন একমাস বয়সী কন্যার মা। আয়াত ভাই তো কন্যা সন্তানের পিতা হয়ে ক্ষণে ক্ষণে হেসে উঠেন আর আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করে।
মিসবাহ সেও রুশার সাথে পরীক্ষা দিয়েছে আর এই সবকিছু সম্ভব হয়েছে আদিলের জন্য। আদিল কিছু শর্ত জুড়ে দেয় মিসবাহর কাছে। আর সেই শর্ত মানার কারণে মিসবাহকে ছেড়ে দেয়া হয়। এরপরের, সময়গুলোতে রুশাকে কোনোপ্রকার হেনস্তা করেনি মিসবাহ।
আজ রুশার মন ভীষণ খারাপ। কাজলের বিছানায় শুয়ে শুয়ে কান্না করছে রুশা। রুশার পাশে শুয়ে থাকা কাজলের মেয়ে আরশি হাত-পা ছুড়ে খেলছে। রুশা কান্না করছে আর আরশিকে বলছে,
-জানিস আমার উনি অনেক খারাপ লোক। আমার জীবনে এসে আমার পুরো জীবনে উলোটপালোট করে দিয়েছে। তাকে কে বলেছিল আমার জীবনে আসতে?
-কার সাথে কথা বলো তুমি? আরশি, তোমার কথার জবার দেবে নাকি স্বান্তনা?
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে কথাগুলো বললো কাজল।
-আয়াত ভাইকে ভালোবাসো তুমি?
-হুম,ভালোবাসি।এখন আমি আয়াতকে ভালোবাসি কি না, এটা জানা তোমার জন্য জরুরি না-কি?
-ধরো, তুমি আয়াত ভাইকে ভালোবাসো, কিন্তু সে সারাদিন তোমার সামনে বা আড়ালে তার আগের প্রেয়সীকে ভালোবেসে যায়। তখন তোমার কাছে কেমন লাগবে?
-অনেক খারাপ লাগবে।
-তাহলে, আমার মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করো। সে আমার অনেক খেয়াল রাখে কিন্তু আমি এইটাই মানতে পারিনা সে তার মাধুর্যকে ভালোবাসুক। হিংসে হয়, বুক ভেঙে কান্না আসে। কেন তার প্রথম ভালোবাসা আমি হলাম না?কারো জীবনের প্রথমা হওয়া বুঝি অনেক ভাগ্যের ব্যাপার!
-তুমি তোমার আদিল স্যারকে ভালোবাসো,পুতুল?
-হু, অনেক ভালোবাসি। সে মানুষটাই এমন যে তাকে না ভালোবেসে থাকা যায় না। জানো, আমি যতক্ষণ তার সামনে থাকি সে চেষ্টা করবে যেন সে আমার উপর মনোযোগ রাখতে পারে।আমার কোন জিনিসে ভালোলাগা কোন জিনিসে খারাপলাগা, সুক্ষ্ম জিনিস গুলোতে সে অনেক খেয়াল রাখে। কিন্তু, তার এই প্রতিটা কেয়ারনেস যে আমার মনে তার প্রতি সম্মান এবং ভালোবাসা জন্ম নিয়েছে তার এইসব চোখে পড়ে না-কি, দেখেও না দেখার ভান করে।
কাজল রুশার কথা শুনে আড়ালে মুচকি হাসি দিলো। এরপর, রুশাকে বললো,
-তুমি চাও তোমার আদিল তোমায় ভালোবাসুক মাধুর্যকে না।
-হ্যা, চাই তো কিন্তু বলার সাহস পাই না। যদি সে বলে বসে, তোমার জীবনেও তো কেউ ছিল আমি কি তোমায় ওসব ব্যাপারে কিছু বলেছি?এই কথা শোনার ভয়ে তাকে কিছু বলার সাহস পাই না।
#শেষ_বিকেলে_এলে_তুমি
#পর্ব_৩৩_তথা_অন্তিম
#Tahmina_Akhter
কাজল উত্তর দেয়ার আগে ওর মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। রুশাকে ওয়েট করতে বলে মোবাইল হাতে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো,কাজল।
এইদিকে রুশা তার চোখের পানি মুছে আরশিকে কোলে নিয়ে চুপটি করে বসে রইলো। আরশিকে কোলে নিলে রুশার কেমন জানি অদ্ভুত এক শান্তি মনের মাঝে বিরাজ করে!নিজের বুকের মানিককে তো কোলে নেয়ার বা দেখার সৌভাগ্য তার কপালে জোটেনি।
-হ্যালো,ভাইয়া। আসসালামু আলাইকুম।
-ওয়ালাইকুম আসসালাম।কেমন আছিস? আরশি মা কী করে?
-তোমার আরশি মা তার মামানির কান্না দেখে।
-কেন, তার মামানি কাঁদছে জিজ্ঞেস করেনি?
-জিজ্ঞেস করেছিলো, উনার মামানি বলেছে উনি নাকি আরশির মামার জন্য কাঁদছে।
-সিরিয়াসলি!
-ইয়েস, তোমার বৌ কেঁদে ঘর ভাসিয়ে ফেলছে। কেন, তুমি মাধুর্যকে ভালোবাসো?সে কেন তোমার প্রথমা হতে পারলো না। আবার এই কথা নাকি তোমায় সাহস করে বলতেও পারছেনা যদি তুমি ওর আগের সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলো, তাই।
-ও মনে হয় হাতে-পায়ে বড়ো হয়েছে! মানে আমি ওর আগের জীবন নিয়ে কথা বলবো। এই চিনলো ও আমাকে।
-কি জানি তোমার বৌ তুমি জানো।
-আচ্ছা, আমিই জানি। এখন শোন আজ সকাল এগারোটায় তুই, আব্বা, রুশা আর আয়াত মিলে কুমিল্লায় মামার বাড়িতে চলে যাস।
-হঠাৎ করে মামার বাড়িতে কিন্তু কেন?
-মায়ের আগামীকাল মৃত্যুবার্ষিকী মনে নেই তোর।
-ওহ্, দেখলে আমার একটুও মনে নেই। আচ্ছা, আমি তাহলে সবাইকে বলছি। কিন্তু, ভাইয়া তুমি যাবে না?
-আমি যাব তবে তোদের সাথে না। হসপিটাল থেকে এখনো ছুটি পাইনি।
-আচ্ছা, ভালো থেকো ভাইয়া।
-ওকে, আল্লাহ হাফেজ।
আদিল কল কেটে বারান্দায় যেয়ে দাঁড়ালো। দূর আকাশে তাকিয়ে রইলো পলকহীন দৃষ্টিতে। আনমনে বলে উঠলো,
-পাথরের মন নরম হলো তবে। তবে কি উনি যে আমার প্রথমা, আমার মাধুর্য তা জানানোর সঠিক সময় বুঝি চলেই এলো!
————————–
হুট করেই আজ কুমিল্লায় আসতে হয়েছে। কাজল আপুর আম্মুর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে না-কি এখানে আসা৷ কিন্তু, সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে উনারা আমার মামার বাড়ির পাশের বাড়ির লোক। এই বাড়ির প্রত্যেকটি মানুষ অনেক অমায়িক। কাজল আপুর আম্মু এই বাড়ির মেয়ে ছিলেন আমি জানতাম না। হয়তো সে ভাবে পরিচয় দেয়া হয়নি। আমি কে? কি পরিচয় উনারা কেউই জিজ্ঞেস করেনি? কিন্তু, কেন? আর উনাদের ব্যবহার দেখে মনে হচ্ছে আমি এই বাড়ির অনেক পুরোনো সদস্য।
মামা-মামীর সাথে এখনো দেখা করিনি। কেন করবো আজ ছয়বছর ধরে তাদের সাথে আমার কোনোপ্রকার দেখাসাক্ষাৎ নেই। একটিবারও কি তাদের জানতে ইচ্ছে করেনি আমি কেমন আছি? কোথায় আছি? বেঁচে আছি নাকি মরে গেছি?
পুকুর ঘাটে বসে কথাগুলো ভাবছিলাম আর ঢিল ছুঁড়ে মারছিলাম পানিতে৷ এরইমাঝে বাড়ি থেকে কিছুটা হৈ-হুল্লোড় শোনা যাচ্ছে। তাই আমি পুকুর থেকে ঘাট থেকে বাড়ির ভেতরে চলে এলাম৷ দেখলাম একপাশে বাড়ির ছোট-বড় সবাই একজনকে ঘিরে রেখেছে আর নানা বিষয়ে কথা বলছে আর হাসাহাসি করছে।
আমি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে ঘরের দিকে যাচ্ছিলাম।
-কি রে ভাই হেই যে তোর আম্মায় মরলো গেলি ঢাকায় আর একবারও এই বুড়ি নানিরে দেখতে আইলি না। আমার তো মাইয়া মরছে কিন্তু তার পোলাপানরে দেখলে তো কলিজায় ঠান্ডা লাগে।
-কি যে বলো না নানু। আসতেই মন চাইতো না। একদিকে আম্মার কবর আরেকদিকে আমার মাধুর্যের কথা মনে পড়ে যেত এই এলাকার নাম শুনলে। তাই আর আসিনি।
-এহন আর সমস্যা কি। তুই তো তোর মাধুর্যেরে বলে বিয়া করছোত। ভাইরে এমন কপাল কয়জনের আছে? হারানো ভালোবাসা খুইজ্জা পাইছোছ, ভাই। যত্ন কইরা রাখিস।
-হু, তারে তো আমার মনে পিঞ্জিরায় রাখছি নানু। কিন্তু, উনি আছেন কোথায়?
-আদিল ভাইয়া, ওই যে তোমার মাধুর্য তোমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আদিল তার মামাতো ভাইয়ের দেখানো জায়গায় অনুসরণ করে দেখলো রুশা ওর দিকে রেগে তাকিয়ে আছে। রুশা যখন আদিল তার দিকে তাকিয়েছে ঠিক ওই মূহুর্তে ও বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো। আদিল তড়িঘড়ি করে ব্যাগপত্র রেখে রুশার পিছনে হাঁটতে লাগলো।
রুশা হাঁটতে হাঁটতে নদীরে পাড়ে এসে দাঁড়ালো। আদিল তাকে অনেকবার ডাক দিয়েছে কিন্তু সাড়া দেয় নি।
-কি হলো? এতবার ডাক দিলাম সাড়া দাওনি কেন?
রুশার সামনে এসে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে কথাগুলো বললো আদিল।
-এমনি ইচ্ছে করেনি। আপনি আবার পিছু আসতে গেলেন কেন?
-আর তুমি সন্ধ্যা বেলায় বোরকা ছাড়া বাড়ি থেকে বের হয়েছো কেন?
-এই যে দেখছেন না বড়ো ওড়না জরিয়ে রেখেছি।
-তুমি কি রাগ করলে আমার সাথে,রুশা?
আদিলের এমন আদুরে কন্ঠের জাদুময় কথা শুনে রুশার অর্ধেক অভিমান গলে গিয়েছে। তবুও নিজের মাঝে কঠিন একটা ভাব রেখে বললো,
-আপনার সাথে কে রাগ করবে,আমি!কখনোই না৷ রাগ তো করা যায় প্রিয়দের সাথে।
-ও তাহলে আমি তবে তোমার প্রিয় না মানলাম। কিন্তু, আজ কেন আমায় বলেছে, রুশা মাধুর্যকে হিংসে করে। কারণ, রুশার স্বামী নাকি রুশাকে ভালোবাসে না মাধুর্যকে ভালোবাসে।
-কে বললো, এই কথা?
আমতাআমতা করে বললো রুশা।
-এই যে আমার সামনে দাঁড়ানো উনি বলেছেন।
রুশার মাথায় হালকা করে টোকা দিয়ে বললো।
-মিথ্যে কথা। আপনি যেয়ে আপনার মাধুর্যকে আরও ভালোবাসুন,তার ছবি বুকে নিয়ে ঘুমান। কেউ কি আপনাকে মানা করেছে নাকি?
-রুশা, তোমার গায়ের থেকে হিংসা হিংসা গন্ধ বের হচ্ছে।তুমি অনেক হিংসুটে মেয়ে!
রাগে দুঃখে রুশার এবার কান্না পেয়ে গেলো। কে বলেছিলো এই লোককে ভালোবাসতে, যার হৃদয়ে আরেকজনের বসবাস?
আবছা আলোয়ে রুশার কান্নামাখা মুখখানি দেখে আদিলের কেমন যেন লাগলো। তাই এগিয়ে এসে রুশার সামনে দাঁড়ালো। আচমকা, আদিলকে নিজের এত কাছে দেখে ভড়কে যায় রুশা। কারণ, তাদের বিয়ের দেড়বছরে এই প্রথম এত কাছে আসা।
-দেখবে আমার মাধুর্য কে?
এমন একটা মূহুর্তে মাধুর্যের নাম শুনে রুশার মেজাজ বিগড়ে গেলো। উল্টো পথে হেটে চলে যেতে চাইলে আদিল রুশার হাত ধরে আটকে ফেললো। এরপর, খুব কাছে টেনে নিলো,একহাতে রুশার কোমড় জরিয়ে নিলো অন্যহাতে রুশার পড়ে যাওয়া ঘোমটা টেনে ঠিক করে দিলো। রুশা যেন বরফ হয়ে গেছে, কোনো নড়চড় নেই। আজ যেন আদিলের কাছ থেকে পাওয়া ছোট ছোট এই স্পর্শগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত।
আদিল রুশাকে জরিয়ে রাখা অবস্থায় পকেট থেকে মোবাইল বের করে একটি ছবি রুশার সামনে তুলে ধরলো। রুশা না চাইতেই সেই ছবির দিকে তাকালো।ছবিটা দেখে রুশা চট করে নিজেকে আদিলের থেকে মুক্ত করে নিলো এরপর আদিলকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-আপনি এই ছবি পেলেন কোত্থেকে?কারণ এই ছবি তখনকার যখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি।
– ছবি কোত্থেকে পেলাম সেটা জানা কি খুবই প্রয়োজন, মাধুর্য?
মাধুর্য সম্বোধন আদিল স্যারের মুখ থেকে শুনে ভাবলাম তিনি ভুল করে উল্টো নাম উচ্চারণ করে ফেলেছেন। কিন্তু, আমাকে ভুল প্রমাণিত করে তিনি আবারও ডেকে বললেন,
-মাধুর্য?
-বারবার মাধুর্য মাধুর্য নামে ডাকলে সে কি চলে আসবে? আগে আপনি এটা বলুন আপনি আমার এই ছবি কোথায় পেলেন?
-তুমি কি জানো তোমাকে আমি আরও বারো বছর আগে থেকে চিনি?
-মজা বন্ধ করুন,আপনি।আপনি বারো বছর আগে থেকে আমাকে চিনতেন, এই কথাটা হজম হলো না।
-কেন হজম হবে না? তুমি আজ যাদের বাড়িতে এসেছো উনারা আমার কি হয়?
-আমি কিভাবে জানবো উনারা আপনার কি হয়? কিন্তু, এটা জানি কাজল আপুর নানুর বাড়ি এটা।
-এটা কাজল আপুর নানুর বাড়ি হলেও এটা আমারও নানুর বাড়ি।
-কিন্তু, আমি তো শুনেছি এই বাড়ির একটাই মেয়ে তাহলে আপনি কার ছেলে?
-আমি তোমার কাজল আপুর আপন বড়ো ভাই।
আর সেজন্যই আমি এটা আমার নানুবাড়ি।
-আপনি মজা করছেন, তাই না?
-তোমার সাথে আমার এই মূহুর্তে কোনো মজা করার ইচ্ছে নেই।
-তারমানে, আপনি কাজল আপুর বড়ো ভাই। রায়হান আঙ্কেলের হারিয়ে যাওয়া পুত্র যে কি না তার ভালোবাসা না পেয়ে কুঞ্জ বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে?
-জি জনাবা, আপনি এবার সঠিক ধরতে পেরেছেন। আর আমার সেই ভালোবাসার মানুষ হচ্ছেন আপনি, আমার মাধুর্য। আপনাকে আমি কোনো এক শীতের মেলায় দেখেছিলাম।সেই থেকে ভালো লাগা, সময় যেতে যেতে এই ভালোলাগা এইসময় ভালোবাসায় রুপান্তরিত হলো কিন্তু যতদিনে আমি আমার ভালোবাসা বুঝতে পেরেছি ততদিনে আপনি অন্যকারো ঘরের ঘরনি। এরপরের ঘটনা আপনি সব জানেন। কিন্তু, আপনি যে আবার ঠিক ঘুরে ফিরে আমার আব্বার কাছে অতি আদরে থাকবেন, আমার স্টুডেন্ট হয়ে আমার অনেক কাছে থাকবেন এইটাই আমি কল্পনাও করিনি। কিন্তু, আল্লাহ যা পরিকল্পনা করেন তা আমাদের চেয়ে পরিকল্পনার চেয়েও অধিকতর উত্তম। সেই তুমি আমার হলে শত অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে, আমার মাধুর্য আমার জীবনে এলো অর্ধাঙ্গিনি হয়ে৷
কাজল আপুর কথা, আয়াত ভাইয়ের, রায়হান আঙ্কেলের কথার যোগসূত্র মিলিয়ে দেখলাম সব সুত্রের একটাই উত্তর। আমিই তাহলে স্যারের প্রথম ভালোবাসা, মাধুর্য।
-কিছু বলবে না, মাধুর্য?
আদিলের কাতর কন্ঠে কথাগুলো আমার পুরো শরীরে অজানা অনুভূতিতে কেঁপে উঠলো।আমি শুধু এটুকু বললাম,
-তবে, আমার সাথে কেন এত লুকোচুরি খেললেন। বিয়ের পর একটিবার বললেও হতো আমি আপনারই মাধুর্য। কাজল আপু, আয়াত ভাই উনারা কেন আমার কাছ থেকে এতবড় কথা লুকিয়ে রাখলো?
-কারণ, আমি বারণ করেছি তাই৷ বললে না তুমি আমায় ভালোবাসো কি না?
-হু, অনেক ভালোবাসি তবে আপনার মাধুর্য নয় রুশা হাসান আপনাকে অনেক ভালোবাসে।
অনেকটা সময় পর চোখ বুঁজে বলে ফেললো রুশা।
আদিল হেসে তার মাধুর্যের মুখখানা আজলে ভরে কপালে চুমু খেয়ে বললো,
-আমিও তোমায় অনেক ভালোবাসি মাধুর্য। বহু অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে শেষ বিকেলে এলে তুমি।
#সমাপ্ত