#কান্তা_মনি
#পর্ব_১২
#লেখনীতে_আফিয়া_অন্ত্রীশা
হাওলাদার বাড়ি থেকে আজ জমিদার বাড়ি যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়ে উঠোনে আসতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় কান্তা মনির। ঘোড়ারগাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে আছে মেহরিন ও মারজান সরদারের বেগম। তাদের উপস্থিতি খানিকটা বিচলিত করে তোলে কান্তা মনিকে। সে নিজেও জানে না কেন যেন সরদার পরিবারের সদস্যদের দেখে তার বুক দুমড়ে মুচড়ে উঠছে। তার আব্বা যে শেষ সরদার বাড়িতেই গিয়েছিল কাজের জন্য। তারপর দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। তারপর ও তার আব্বা নাকি বাড়ি ফেরেনি সেদিন। ভোর হতেই একদল পথিক ঝোপের মাঝে তার আব্বার নিথর দেহ খুজে পায়। ঠোট কামড়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করে কান্তা মনি।
-কান্তা মনি চলো। (সামনে মেহরিন ও তার আম্মাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা ভ্রু কুচকালো নিয়াজ)
-কেমন আছো বাবা? (মারজান সরদারের বেগম)
-বোঝা তো উচিত কেমন আছি। (নিয়াজ মির্জা)
-এভাবে কথা কেন বলছো নিয়াজ? (মেহরিন)
-তার কৈফিয়ত তোমাকে দিতে রাজি নই আমি। তোমাকে আমি শেষবারের মতো সতর্ক করছি আমার সাথে কোনো প্রকার কথা বলার চেষ্টাও করবেনা তুমি। আর রটা ভেবো না যে তোমাদের কাজকর্মের ব্যাপারে কোনো প্রকার তথ্য আমার কানে আসেনি। (নিয়াজ মির্জা)
নিয়াজের কথায় মুখখানা ফ্যাকাসে হয়ে যায় মেহরিনের।
-কি করেছে মেহরিন? (মারজান সরদারের বেগম)
-তা আপনার কন্যাকেই না হয় জিজ্ঞাসা করে নেবেন। তা হঠাত হাওলাদার বাড়িতে এলেন যে? (নিয়াজ মির্জা)
-রমিজ ভাইজানের পরিবারের খোজ-খবর নিতে এসেছি। রমিজ ভাইজান তো আমাদের বাড়ির একজন বিশ্বস্ত কর্মচারী ছিলেন। বড্ড খারাপ লাগে তার জন্য। শুনেছি তাকে নাকি হত্যা করা হয়েছে। (মারজান সরদারে বেগম)
-ওহ বুঝলাম। কিন্তু আমার যে সন্দেহ হচ্ছে আপনাদের সেই অতি বিশ্বস্ত কর্মচারীকে আপনারাই হত্যা করে ফেলেছে। (চোখ ছোট ছোট করে তাকায় নিয়াজ মির্জা)
নিয়াজ মির্জার কথা শুনেই বিস্ফোরিত নয়নে মেহরিন এবং তার আম্মার দিকে তাকায় কান্তা মনি। তার মস্তিষ্কে এবার কোনো একটা বিষয় নাড়া দিয়ে ওঠে। ইতোমধ্যে মেহরিন এবং তার আম্মার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
-এ এসব কি বলছো তুমি নিয়াজ? (মারজান সরদারের বেগম)
-কিছুনা। আপনারা ভেতরে যান। (নিয়াজ মির্জা)
মেহরিন আর তার আম্মা বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতেই নিয়াজ বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে কান্তা মনির হাত ধরে বলেন,
-চলো আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে কান্তা মনি।
ঘোড়ার গাড়িতে উঠতে উঠতে একবার পেছনে ফিরে হাওলাদার বাড়ির দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কান্তা মনি। রাহেলা এবং রজনীকে নিতে রাহেলার বড় ভাই এসেছেন। চিন্তার সাগরে ডুব দেয় কান্তা মনি। তার মনের ভেতরটা যে খাঁ খাঁ করছে। তার বাবাকে একা রেখে চলে যাচ্ছে সে। তার বাবার যে খুব কষ্ট হচ্ছে। কান্নারা দলা পাকিয়ে গলায় এসে বাধায় গলা বিষ ব্যথা করছে কান্তা মনির। ক্ষানিক বাদে বাদে কেঁপে কেঁপে উঠছে সে। কান্তা মনির অবস্থা বুঝতে পেরে নিয়াজ একহাত দিয়ে তার কাধ আকড়ে ধরে রাখে।
ভোজনশালায় দুপুরের খাবার খেতে ব্যস্ত জমিদার বাড়ির সবাই। খাবার গলা থেকে নামবেনা জেনেও মেহেরুন্নেছার বারবার বলার কারণে এবং স্বয়ং জমিদার খাবারের জন্য ডেকেছে শুনে সৌজন্যতার খাতিরে ভোজনশালায় উপস্থিত হয়েছে কান্তা মনি। মাথানিচু করে খাবার খেতে খেতেই হঠাত খাবার গলায় বেধে যাওয়ায় দম যায় যায় অবস্থা হয়ে পড়ে কান্তামনির। মেহেরুনেচ্ছা,হেতিজা মাথায় আর পিঠে হন্তদন্ত হয়ে হাত বুলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মুখের সামনে কেউ পানপাত্র ধরেছে দেখেই চোখ বন্ধ করে ঢকঢক করে পানিটুকু খেয়ে নেয় কান্তা মনি। কিছুটা শান্ত হওয়ার পরেই পিটপিট করে চোখ খুলে সামনে তাকাতেই অবাক হয়ে যায় কান্তা মনি। রেহানা পানপাত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখে তার চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। এই চিন্তাটা কি তার জন্য? ভাবতে তাকে কান্তা মনি।
-তুমি ঠিক আছো তো কান্তা মনি? (রেহানা)
চোখ ছলছল করে ওঠে কান্তা মনি। মাথা ঝুলিয়ে হ্যা সূচক ইঙ্গিত দেয় সে। নিয়াজ কান্তা মনিকে নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে।
পালঙ্কের ওপর বালিশের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে কান্তা মনি। জানালা গলে বাইরে থেকে আসা চাঁদের আলোয় তার মলিন মুখখানা অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হারিকেনের পিটপিট আলোয় কক্ষের আসবাবপত্রগুলো ঝাপসা দৃশ্যমান। দ্বার খুলে পানপাত্রে করে দুধ নিয়ে হাজির হয় রেহানা। মুখে কারো হাতের শীতল স্পর্শ পেতেই পাশ ফিরে তাকায় কান্তা মনি।
-শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে তোমার? দুপুরে কিছুই খেতে পারোনি। এই দুখটুকু ঢকঢক করে আমার সামনে বসে খাও তো ভাবিজান। রেহানা)
রেহানার মুখের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে রেহানা। রেহানার এমন পরিবর্তন বেশ ভাবিয়ে তুলছে কান্তা মনিকে।
চৌপায়ার ওপর পানপাত্রটি রেখে ধপ করে কান্তা মনির পাশে বসে পড়েন রেহানা।
-কি অবাক লাগছে ভাবিজানের ব্যবহারের এমন পরিবর্তনে? (রেহানা)
এখনো কোনো প্রকার কথা কান্তা মনির মুখ থেকে বের হতে চাইছে না।
কান্তামনির দুহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে রেহানা বলে ওঠেন,
-আমি তোমার সাথে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমাকে অন্যরা যেমন ধারণা তোমার সম্পর্কে দিয়ে এসেছে আমিও তোমাকে তেমনই ভেবেছিলাম। মা আর মেহরিনের পরিকল্পনার সাথে হাত মিলিয়েছিলাম তোমাকে এই বাড়ি থেকে তাড়ানোর জন্য। কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছি, আমি তোমাকে যেমন ভেবেছিলাম তুমি তেমন নও। নিয়াজ ভাইজান ও আমার সাথে কথা বলেনা। তার কানে আমাদের কার্যকলাপের কথা চলে গেছে। কান্তা মনি আমাকে ক্ষমা করে দাও তুমি।
-আহা ভাবিজান এমন বলছো কেন? আমিতো তোমার বোনের মতোই তাইনা? ক্ষমা চেয়ে আমাকে ছোট করোনা একদম। (কান্তা মনি)
কান্তা মনিকে বাহুডোরে আগলে নেয় রেহানা।
-আমাকে কেউ ভালোবাছেনা। (রোদেলা)
পিটপিট করে চোখের পলক ফেলছে রোদেলা। কান্তা মনি তা দেখে হালকা হেসে রোদেলাকে কাছে টেনে নিয়ে বলে ওঠে,
-ইশ পাকা বুড়িরে। কে বলেছে তোমাকে,যে আমরা তোমাকে ভালোবাসিনা? তোমাকে কত ভালোবাসি তুমি তা জানো? (কান্তা মনি)
-হিহিহি। চাচিমা জানো তুমি না অনেক সুন্দল। (হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে হেসে কুটিকুটি হয়ে যায় রোদেলা)
-তাই? তা তুমি জানো তুমি আমার থেকেও অনেক সুন্দর? (কান্তা মনি।
দুই গালে দুহাত রেখে অবাক হয়ে রোদেলা বলে ওঠে,
-সত্যি!
-হুম সত্যি আমার পাকা বুড়িটা। (রোদেলার গাল টেনে দিয়ে বলে ওঠে কান্তা মনি)
-কিগো বাঘিনী মনটা কি ভিষণ খারাপ? (নওশাদ)
পুরুষালী কন্ঠ পেয়েই আলমারী আটকে পেছনে ঘুরে তাকায় কান্তা মনি। নওশাদকে কক্ষে দেখে আতকে ওঠে কান্তা মনি। নিজেকে শক্ত করে নেয় সে।
-আপনি এখানে? অনুমতি ছাড়া কক্ষে প্রবেশ করেছেন কেন? উনি জানতে পারলে আপনাকে শেষ করে ফেলবেন বলে দিলাম। সেদিনের কথা আমি কিছু বলিনি। সাবধান করে দিলাম আজকে আগে থেকে। বের হয়ে যান বলছি। (একটানে বলে ওঠে কান্তা মনি)
নওশাদ বাকা হেসে আচমকা শক্ত হাতে কোমর আকড়ে ধরে কান্তা মনির। অস্বস্তিতে ছটফট করতে থাকে কান্তা মনি।
-আমাকে পুড়িয়ে তুমি কিভাবে খুশিতে থাকবে কান্তা মনি? সেদিনের থাপ্পড়রের কথা মনে আছে তোমার? দুইটা থাপ্পড়ের জন্য আজকে নিজের অতি প্রিয় একটা জিনিসকে হারালে। ভেবে নাও তাহলে, শান্ত না থাকলে আর কি কি হতে পারে। (ধাক্কা মেরে পালঙ্কের ওপর কান্তা মনিকে ফেলে দিয়ে কক্ষ থেকে হনহন করে বেরিয়ে যায় নওশাদ)
বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায় কান্তা মনি। এসব কি বলে গেল নওশাদ? তার মানে কি তার আব্বার হত্যাকারীদের মধ্যে নওশাদ একজন? মাথায় চক্কর দিয়ে ওঠে কান্তা মনির।
শীতের সকাল। বাইরে এখনো আবছা অন্ধকার বিদ্যমান। কুয়াশার কারণে যেন আলো এসে আকাশকে রাঙানোর সুযোগই পাচ্ছেনা। আড়মোড়া ভেঙ্গে ঘুম থেকে ওঠে কান্তা মনি। বিছানা ছেড়ে উঠতে নিতেই আচলে টান বাধায় পেছন ঘুরে তাকায় সে। নিয়াজের বলিষ্ঠ হাতের নিচে চাপা পড়ে আছে তার শাড়ির আছল। মৃদু হাতে তা ছাড়িয়ে নেয় কান্তা মনি। নিয়াজের মুখপানে তাকাতেই থমকে যায় কান্তা মনি। কি স্নিগ্ধতা বিচরণ করছে নিয়াজের মুখে। নিয়াজের ঘুমানোর ভঙ্গিমা দেখে আনমনে হেসে ওঠে কান্তা মনি। এ যেন কোনো ছোট শিশু ঘুমিয়ে আছে। দ্বারে হালকা ঠকঠক শব্দ হতেই নড়েচড়ে ওঠে কান্তামনি। আলমারি থেকে মোটা শাল বের করে গায়ে পেচিয়ে দ্বার খুলে দেয় কান্তা মনি। দাসী তানিয়াকে দেখে স্বস্তিরে স্বাস ফেলে সে। দ্বার হালকা চাপিয়ে দিয়েই দুজনে বেরিয়ে পড়ে অজানা কোনো গন্তব্যের পথে। সকলে উঠে পড়ার আগেই যে আবার ফিরে আসতে হবে তাদের।
জমিদার বাড়ি ছেড়ে বেরোতেই মনে হচ্ছে যেন প্রকৃতিও এখনো ঘুমিয়ে আছে। কিছুদূর যেতেই এদিক ওদিক ছড়ানো ছিটানো বাড়ি-ঘর চোখে পড়ছে কান্তা মনি। স্নিগ্ধ এই আবছা আলোয় রাঙা ভোরে শরীর ও মন যেন বেশ সতেজ সতেজ লাগছে তার। শীতের মৃদু হাওয়াও যেন শরীরে হালকা কাপুনি উঠিয়ে দেয়।
ছোট একখানা চৌকি পেতে বসে আছে কান্তা মনি। তার বরাবরই মেঝেতে বসে আছে এক পয়তাল্লিশ কি ছেচল্লিশ বছর একজন মহিলা। উসকোখুশকো চুলগুলো যেন কত বছর কাঁকুইয়ের ছোঁয়া পায়না। গায়ে ময়লাযুক্ত বহু তালিযুক্ত কাপড়। স্বচ্ছল চোখ জোড়ায় মায়া স্পষ্ট। কিন্তু মানুষটার মুখ দেখে যেন বোঝাই যায়না মাথায় গন্ডগোল আছে।
#কান্তা_মনি
#পর্ব_১৩
#লেখনীতে_আফিয়া_অন্ত্রীশা
ছোট একখানা চৌকি পেতে বসে আছে কান্তা মনি। তার বরাবরই মেঝেতে বসে আছে এক পয়তাল্লিশ কি ছেচল্লিশ বছর একজন মহিলা। উসকোখুশকো চুলগুলো যেন কত বছর কাঁকুইয়ের ছোঁয়া পায়না। গায়ে ময়লাযুক্ত বহু তালিযুক্ত কাপড়। স্বচ্ছল চোখ জোড়ায় মায়া স্পষ্ট। কিন্তু মানুষটার মুখ দেখে যেন বোঝাই যায়না মাথায় গন্ডগোল আছে।
-কেমন আছেন আপনি চাচীজান? (কান্তা মনি)
মহিলাটি ফ্যালফ্যাল করে কান্তা মনির দিকে তাকিয়ে আছে।
-চাচীজান? (কান্তা মনি)
-কেডা তুই? এইখানে কেন আসছিস? আমারে মারবি তুই তাইনা? (মুঞ্জিলা)
-না না আমি কেন আপনাকে মারব? আমি নিয়াজ মানে আপনার জা বেগম নূর জাহানের পুত্রের বেগম। আমাকে দেখে ভয় পাবেন না। তাকান আমার দিকে চাচীজান। (ব্যস্ত কন্ঠে বলে উঠল কান্তা মনি)
– না না তুই মিথ্যা বলতেছিস। আমি জানি তুই আমারে মারবি। ওরা যেভাবে আমাকে মারত তুইও সেইভাবে আমাকে মারবি। চলে যা বলতেছি। চলে যা। চলে যা। (উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে)
মুঞ্জিলাকে তেড়ে আসতে দেখেই কান্তা মনি আতকে ওঠে। দ্বারের খিল নিয়ে কান্তা মনিকে আঘাত করতে নিতেই মুঞ্জিলার বড় ভাইয়ের বেগম রশিদা কান্তা মনির হাত টেনে নিয়ে কক্ষের বাইরে বেরিয়ে এসে কক্ষের দ্বার বন্ধ করে দেন। কক্ষের ভেতর থেকে আসা ভাঙ্গা-চূড়ার আওয়াজে ক্ষানিক বাদে বাদে কেঁপে উঠতে থাকে কান্তা মনি।
-আচ্ছা আপনি বলতে পারবেন কে বা কারা চাচীজানকে মারতো যে সে এভাবে আতংকিত হয়ে থাকে? (কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে ওঠে কান্তা মনি)
কান্তা মনির এহেন প্রশ্নে চোখ-মুখ চুপসে যায় রশিদার।
-কি হলো বলুন? (কান্তা মনি)
-মুঞ্জিলার স্বামী মানে জমিদারের ভাই সুলতান মির্জা। সুলতান মির্জা আমার এই বোনটারে রাত-দিন শুধু অত্যাচার করত। মারতে মাততে সারা শরীরে কালশীটে দাগ বসিয়ে ফেলেছিল।সে দাগ এখনো যায়নি। এমনকি ওই আহসান ও তাই ওর গায়ে হাত তুলতো। গর্ভের সন্তান তাই নিজের মাইয়ের গায়ের হাত তুলতো। মাথায় গন্ডগোল কি সাধে হয়েছে? এত অত্যাচার সহ্য কে সহ্য করতে পারে? ঘুমের মানুষকে টেনে তুলে মারধর করত। গরম লোহা দিয়ে হাত-পা পুড়িয়ে দিত। কখনো মুখ দিয়ে টু শব্দটি করত না। স্বামী ভক্ত ছিল খুব। যখন মারত কেউ টের ও পেতোনা। দিনের পর দিন এত অত্যাচারে সুস্থ মানুষটা পাগল হয়ে গেছে। সবাইকে বলা হয় যে জ্বীনের আচড় পড়েছিল নাকি মুঞ্জিলার ওপর,তাই পাগল হয়ে গেছে। শেষে আর ওই জমিদার বাড়িতে মুঞ্জিলার ঠাই হলো না। নিজের মেয়েটাও তাই মায়ের কোনো খোজ নেয় না। মেঝ ছেলেটা মাঝে মাঝে এসে খোজ নিয়ে যেত। আজ দশটা বছর আমি আর মুঞ্জিলার বড় ভাইজান দুজনে ওর দেখাশোনা করি। জমিদারের বেগম নূর জাহান মানুষটা ভালো। প্রায়ই এসে মুঞ্জিলার সাথে দেখা করে যায়। ভালো-মন্দ রান্না করলে এসে খাইয়ে দিয়ে যায়। (রশিদা)
এমন নিষ্ঠুরতার বর্ণনা কান্তা মনির কর্ণগোচর হতেই চোখ ছলছল করে ওঠে তার।
-কেন এত অত্যাচার হতো তার সাথে? (কান্তা মনি)
-মা আমার দ্বারা আর কিছু বলা সম্ভব না। তোমাকে দেখে আমার বেশ ভরসা যোগ্য মনে হলো তাই বললাম। তুমি বেশ সাহসী তুমি নিজেই এর উত্তর খুজে নিতে পারবে আমি জানি। কিন্তু মা তুমি সাবধান থেকো। কিছু মানুষ আছে খুব জঘন্য তারা। আমি তাদের নাম উচ্চারণ করতে চাই। কেউ যদি জানে যে তোমাকে আমি কিছু বলেছি তো আমাকে আর মুঞ্জিলার ভাইজানকে একদম জানে মেরে ফেলবে। (রশিদা)
বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে যায় কান্তা মনির।
-আচ্ছা আমি কিছুই আর জিজ্ঞাসা করব না আপনার কাছে। (কান্তা মনি)
-একটা কথা। গ্রামে যে প্রজাদের ঘরে ঘরে লুটপাট হয়েছে কয়েকদিন তাতে কার কার হাত রয়েছে জানো? (রশিদা)
-হ্যা আমি জানি। (কান্তা মনি)
-শেষ দিন লুটপাট করে ভেগে যাওয়ার সময় আমার স্বামী মানে তোমার মুঞ্জিলা চাচীর ভাইজানের সামনে পড়ে যায় ওরা। উনি ওদের চিনে যাওয়ার পর উনার গলায় তরোয়াল ঠেকিয়ে হুমকি দেয়, সে যদি এই কথা কাউকে বলে দেয় তো তাকে মেরে ফেলবে। ওরা মানুষ না মা। ওদের মনে বিন্দু মাত্র মায়া-দয়া নেই। তুমি সাবধানে থেকো। (রশিদা)
-আমি সব জানি মামিজান। আমি উনাকে (নিয়াজ মির্জা) বলার সুযোগ খুজে পাচ্ছিনা। উনাকে খুব দ্রুত এসব জানাতে হবে। (কান্তা মনি)
-বেগম সাহেবা? এখন বের হতে হবে নাহলে দেরি হয়ে যাবে ফিরতে। (দাসী তানিয়া)
ফেরার কথা মনে পড়তেই কান্তা মনির বুকের ভেতর ধুকপুক করে ওঠে।
-মামিজান? চাচীজানের কাপড়গুলো পালটে দিয়ে মাথার চুলগুলো কাঁকুই দিয়ে আছড়িয়ে দিন। (কান্তা মনি)
-কি বলব মা বল কাছে গেলে কেমন চিল্লাপাল্লা শুরু করে দেয়। কখনো কখনো মারাত্মকভাবে আঘাত করে বসে। (রশিদা)
-আচ্ছা আমি চেষ্টা করে দেখছি। আপনি চাচীজানের কাপড়-চোপড় নিয়ে আসুন। (কান্তা মনি)
গ্রামের আকা-আকা মেঠোপথ ধরে এগিয়ে চলেছে কান্তা মনি। হিমশীতল বায়ুতে বারংবার কেঁপে কেঁপে উঠছে সে। গায়ের মোটা শালটিকে আর একটু জাপটে ধরে সামনে এগিয়ে চলল দাসীকে নিয়ে।
সরদার বাড়ির পাশ ঘেষে যেতে নিতেই চোখ আটকে যায় কান্তা মনির। দাসীকে ইশারা করে নিয়ে একটা গাছের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে সরদার বাড়ির সিংহদ্বারের দিকে ভ্রু কুচকে তাকায়। শাহ সুলতান মির্জা কালো মোটা শাল দিয়ে আপদমস্তক ঢেকে চুপিসাড়ে সরদার বাড়ির সিংহদ্বার হতে বের হয়েই দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করে। কান্তা মনির মাথায় নানারকম প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে শুরু করে। শাহ সুলতান মির্জা হঠাত এই সরদার বাড়িতে? তাও এত ভোরে?
-আচ্ছা ফুফুজান মুঞ্জিলা চাচীজানকে এই বাড়িতে নিয়ে আসলে কেমন হয়? আমিই না হয় দেখাশোনা করব তার। (কান্তা মনি)
কান্তা মনির মাথায় তেল দিয়ে দিতে দিতে হঠাত কান্তা মনির মুখে এমন কথা শুনে খুশখুশ করে কাশতে শুরু করেন মেহেরুন্নেছা।
-মুঞ্জিলা ভাবিজানের তো মাথায় গন্ডগোল কান্তা মনি। তুমি তো তাকে এখানে এনে সামলাতে পারবেনা। তাকে তার বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল শুধুমাত্র তাকে কেউ সামতে পারত না বলে। (মেহেরুন্নেছা)
-আমি না আজ গিয়েছিলাম ভোরে চাচীজানের সাথে দেখা করতে। মানুষটাকে না অনেক কোমল কোমল মনে হয়। আমার খুব মায়া হয় তার জন্য। (কান্তা মনি)
ভ্রু কুচকে আসে মেহেরুন্নেছার।
-কারো অনুমতি নিয়েছিলে? একা একা ওখানে গিয়েছো নিয়াজের কানে গেলে কিন্তু অনেক ক্ষেপে যাবে কান্তা মনি। (মেহেরুন্নেছা)
একটা শুকনো ঢোক গেলে কান্তা মনি।
-আপনি কিছু বলবেন না উনাকে। দোহায় লাগে ফুফুমনি। (মনতির সুরে বলে ওঠে কান্তা মনি)
-আচ্ছা বলব না। কিন্তু হ্যা আর কখনো ওখানে কেন কোথাও কাউকে না জানিয়ে যেয়োনা ঠিক আছে? (মেহেরুন্নেছা)
-আচ্ছা ফুফুমনি।
কান্তা মনি কিছু একটা বলতে গিয়ে মাঝে পথে থেমে যায় হেতিজার ডাকে।
পালঙ্কের ওপর বসে কিছু কাগজ-পত্র নেড়ে চেড়ে দেখছে নিয়াজ শাহ। পানপাত্রটা পাশের চৌপায়ার ওপর রেখে নিয়াজের পাশে বসে পড়ে কান্তা মনি।
-এই যে শুনছেন? (কান্তা মনি)
-হুম। (কাগজ-পত্রের দিকেই চোখ স্থির রেখে বলে ওঠে নিয়াজ মির্জা)
-একটা কথা বলার ছিল আপনাকে। (কান্তা মনি)
কাগজ-পত্রগুলো একপাশে রেখে কান্তা মনির আরও পাশ ঘেষে বসে কান্তা মনির মুখ পানে তাকায় নিয়াজ মির্জা।
-হুম বলুন আমার বেগম? (নিয়াজ মির্জা)
-আসলে…
কথার মাঝখানেই দ্বারে ঠকঠক আওয়াজ হতেই কান্তা মনি উঠে দাঁড়ায়।
-কে? (গম্ভির কন্ঠে বলে ওঠে নিয়াজ মির্জা)
-সাব, নওশাদ সাব আসছেন। (রক্ষী)
দ্বার খুলে দিতেই নওশাদ হুড়মুড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করে হন্তদন্ত হয়ে বলে ওঠে,
-ভাইজান মামাজান হঠাত অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তাড়াতাড়ি আসো।
জমিদারের অসুস্থতার কথা শুনে বুকের মাঝে হঠাত ছ্যাত করে ওঠে কান্তা মনি। তার আব্বাজানের মৃত্যুতে সে যে শোক বয়ে বেড়াচ্ছে এই আরেক আব্বাজানের কিছু হলেও তো সে নিজেকে সামলাতে পারবেনা।
-কবিরাজকে খবর পাঠিয়েছিস? (হন্তদন্ত কন্ঠে)
-হ্যা ভাইজান খবর পাঠানো হয়েছে। তাড়াতাড়ি আসো। (নওশাদ)
হঠাত জমিদারের অসুস্থ হয়ে পড়ায় জমিদার বাড়িতে দুশ্চিন্তার ছায়া নেমে এসেছে। বাচা-মরার দ্বারপ্রান্তে এসে জমিদার সকলকে সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন খুব শিঘ্রয়ই নিয়াজকে জমিদাররের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। তাছাড়া তারও বেশ বয়স হয়েছে।
বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। জমিদার শাহ জাহাঙ্গীর মির্জার শরীরের অবস্থার বেশ উন্নতি হয়েছে। জমিদার বাড়িতে যে খুশির বন্যা বয়ে চলেছে। আজ শাহ নিয়াজ মির্জার হাতে জমিদারির দায়িত্ব অর্পণ করা হবে। জমিদার বাড়িতে অতিথিতে গিজগিজ করছে। বাইরে প্রজা সাধারণের জন্য বিশাল ভোজনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। হেতিজাকে আজ দেখতে এসেছে শাহতাজ ও তার পরিবার। এ যেন আজকের দিনে আর এক আনন্দের নতুন মাত্রা যোগ করে দিয়েছে।
সকাল হতেই নিয়াজ পুরো গ্রামে সবার মাঝে মিষ্টি বিলিয়েছে নিজ হাতে। কান্তা মনি তার প্রাণ প্রিয় স্বামীর চোখে এমন আনন্দ দেখে যেন নিজেও আনন্দে ফেটে পড়ছে। তার মধ্যে যে ধীরে ধীরে আরও একটা প্রাণ বেড়ে উঠছে। আজ জমিদার বাড়িতে যেন একে একে খুশিরা এসে হানা দিচ্ছে।
রান্নাবান্না কতদূর হয়েছে তা পর্যবেক্ষণ করার জন্য সেদিকে যেতেই একটা কক্ষের সামনে এসে চলার গতি থেমে যায় নূর জাহানের। দ্বারের পাশ ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকে নূর জাহান। বিস্ফোরিত নয়ন স্থির হয়ে আছে । কক্ষের ভেতর থেকে আসা কথোপকথনের ধ্বনি কানে এসে বাজতেই চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে নূর জাহানের।
চলবে…