ইচ্ছে ডানা ❤️ পর্ব -১১

❣#ইচ্ছে_ডানা
#একাদশ_পর্ব ❣
প্রায় দশমিনিট যাবত রাজীব অফিসের টেবিলে বসেই আছে একভাবে। মাথায় হাত দিয়ে যেন গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে ও। আশেপাশের মানুষজনের অস্তিত্ব যেন অনুভবই হচ্ছেনা। প্রথম প্রথম রাজীবের এই অনুভূতি গুলো হতনা। জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিনগুলো বেশ ভালোই কাটছিল। নিজের করা দোষটা এভাবে চাপা পরে যাওয়ায়, উপরন্তু আবার উপরি পাওনার লোভে ও একপ্রকার অন্ধই হয়ে গিয়েছিল বলে যায়। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, ওর এই ধারণাটা ক্রমশ বদলাচ্ছে। রাজীবের মনে হচ্ছে মোহরের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে ও ধীরে ধীরে আরো জড়িয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটায়। একটা দোষ ঢাকতে গিয়ে, আরো অনেক ভুল এসে যাচ্ছে জীবনে। কিন্তু এবার কোন পথটা বেছে নেবে ও??….
মোহর নাকি সৌরিতা?? সৌরিতাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা তো ও কখনো মাথাতেই আনেনি, আনতে পারে যে এটাই কখনো মাথাতে ভাবেনি। অথচ আজকে পরিস্থিতি এমন জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে যে, সেই ভাবনা থেকে পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে রাজীব। আর এই পরিস্থিতি নিজে নিজে তৈরী তো হয়নি, এটা সৃষ্টি করেছে রাজীব স্বয়ং। ব্যাপারটা তাহলে একটু খুলেই বলা যাক…..

রাজীব আর সৌরিতার প্রায় হঠাৎ করেই হয়ে যাওয়া
বিয়েটার পর, রাজীব বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল প্রথমে। সৌরিতা এমনিতেই বাপের বাড়িতে ছোটোবেলা থেকে স্বচ্ছলভাবে বড়ো হয়েছে। সেখানে এখনকার বাজারে দুজনের সংসার ভালো ভাবে চালাতে গেলে যথেষ্ট টাকাপয়সার প্রয়োজন। আর রাজীব চাকরির শেষে যেটুকু টাকা পায় সেটা মোটেই যথেষ্ট মনে হত না ওর, সৌরিতা যদিও এ ব্যাপারে কখনো কোনো অসন্তোষ প্রকাশ করেনি। তবুও রাজীবের নিজেরই ইচ্ছা ছিল এই সাদামাটা জীবন ছেড়ে একটা উঁচুধরনের জায়গায় যেতে, যেখানে সবাই তাকে ভয় করে চলবে, সম্মান করে চলবে। আর সেই সব কিছুই একসাথে পাওয়া যায় একমাত্র অর্থের জোরে। সেই কারণে একটু দুঃসাহসের সাথেই একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রাজীব। এমনিতেই অফিসে তাকে সবাই পছন্দ করে, বিশ্বাস করে। অ্যাকাউন্টেন্সির দিকটা অনেকটাই সে নিজে হাতে সামলায়। তো টাকাপয়সার কারচুপি করাটা এমন কিছু কঠিন ছিলনা। আর এতটাই অল্প অল্প পরিমাণে সে টাকার হিসেবের গন্ডগোল করেছে যে ধরা পরারও কোনো সুযোগ বা ভয় ছিলনা। তবে দ্বিতীয় পরিকল্পনা হিসেবে রাজীব অনেক কিছুই ঠিক করে রেখেছিল। ধরা পড়ার কোনো বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা দেখলেই ও দোষটা অপর আরেকজন অ্যাকাউন্টেন্ট পরিতোষবাবুর চাপিয়ে দেওয়ার কথা ভেবেছিল ও। পরিতোষবাবু নতুন লোক অফিসে, সেরকম কথাবার্তা বলেননা কারো সাথে, ফলে ওনাকে ছেড়ে কেউ রাজীবকে অবিশ্বাস করবে এমনটা হতেই পারেনা। তবে বাস্তবে এসব কিছুই করতে হয়নি নিজে থেকে তাকে, সমস্যা একটা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা মিটেও গিয়েছিল খুব সহজেই। ব্যাপারটায় মজা হিসেবে নিলেও, এখন সে সেই মজার খেসারত দিতে গিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সমস্যার আঁচটা।

রাজীবের টাকা কারচুপির ব্যাপারটা প্রথম আবিষ্কার করে মোহর। এখন ওরা দুজনেই উঁচুপদের অফিসার হলেও, সেই সময় মোহর ওর থেকে সিনিয়র ছিল। মোহর হঠাৎই একদিন অফিস ছুটির পরে, রাজীবকে ডেকে পাঠায়। তখন এত কিছুর ঘটনার কিছুই আঁচ করতে পারেনি রাজীব। অবাক হয়ে সেদিন মোহরের রুমে ঢুকে জিজ্ঞেস করেছিল,

-” আপনি ডেকেছিলেন আমাকে?”

-” হ্যাঁ? ওহ,আপনি? হুমম। আমিই ডেকে পাঠিয়েছিলাম আপনাকে, বসুন এখানে। কয়েকটা দরকারি কথা বলার আছে”

মোহরের কথা শুনে বেশ অস্বস্তিতে পরে গেল। এমনিতে এই মেয়েটাকে দেখে ঠিক বুঝতে পারেনা রাজীব। বয়সে ওর থেকে ছোটোই হবে। অন্য সময় মোহরকে দেখলে এতটা গম্ভীর লাগেনা, সবসময় সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলে,। বিশেষ করে রাজীবের সাথে। মানে রাজীবের সাথে ও একটু বেশিই কথা বলত। তাই নিয়ে প্রথম প্রথম অফিসের কয়েকজন অন্য নজরে দেখত ব্যাপারটা। পরে অবশ্য সৌরিতার সাথে বিয়ে খবরটা পেয়ে এসব ঘটনা ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন এই মুহুর্তে মোহরের এরকম কথাবার্তার ধরণ দেখে খানিকটা ঘাবড়েই গেল রাজীব। সামনের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে, সে ধীরে গলায় বলল,

-” হ্যাঁ বলুন”

-” আচ্ছা আপনাকে যদি এই অফিসে থেকে হঠাৎ করেই ছাঁটাই করে দেওয়া হয়, মানে অপমানের সাথে বের করে দেওয়া হয়, কেমন লাগবে??”

একটুও অন্য কথা বলে সময় নষ্ট না করে, সরাসরি আসল প্রসঙ্গে চলে এল মোহর। রাজীবের চোখের দিকে তীক্ষ্ম ভাবে ও কথাটা বলার সাথে সাথেই রাজীব ভূত দেখার মত চমকে উঠল পুরো। ওর চমকটা দেখে মনে মনে সামান্য হাসল মোহর, এটা সে আগে থেকেই কল্পনা করেই রেখেছিল। আর এটাই তো তার তুরুপের তাস।
রাজীবকে কোনো কথা বলতে না দেখে মোহর আবার বাঁকা সুরে বলল,

-” কী হল, বলুন??”

-” না মানে, আপনি কী বলতে চাইছেন আমি তো ঠিক বুঝতে পারছিনা।”

-” বুঝতে পারছেন না, নাকি বুঝতে চাইছেন না? টাকার কারচুপির ফারাকটা তো এবার ভীষণই চোখে পড়ছে। মানে আপাতত আমার নজরে পড়েছে , ধীরে ধীরে এটা স্যারের কাছ অবধি পৌঁছাতে খুব বেশি দেরী হবেনা । কী বুঝলেন?? আসলে আপনার চাহিদাটা দিন দিন বেড়েই চলেছিল, নাহলে হয়তো এতটা আগে ধরা পড়তেন না।”

-” দেখুন, আমি ছাড়াও অ্যাকাউন্ট্যান্ট আরো একজন আছে, পরিতোষবাবু। আমাকে এসব বলার আগে ওনাকে আপনি জিজ্ঞেস করেছেন কি?”

-‘আপনার কী মনে হয়,আগেপিছে না ভেবেই আমি এত বড়ো অপবাদ দিয়ে দেব আপনাকে? অন্য কেউ হলে ঠিক ছিল, কিন্তু রাজীবদা আপনাকে আমি কারণ ছাড়া এরকম অপদস্থ করার কথা ভাবতেও পারিনা”

-” মা-মানে?? আমি কী এমন স্পেশাল?”

-” বলছি সব বলছি। তার আগে এটা বলুন তো, আপনি এতদিনে কি একটা ব্যাপার কখনো বুঝতে পারেননি যে আমি আপনাকে পছন্দ করি? আমার কথাবার্তা, চালচলন এসব দেখেও বোঝেননি?”

-” মোহর, আপনি কী ব-বলছেন…..আমি তো,মানে আমার অলরেডি বিয়ে হয়ে গেছে”

-” জানি। সৌরিতা, আপনার স্ত্রী। ওর সাথে আমিও কথা বলেছি। ভালো মেয়েটা। কিন্তু আমি বিবাহিত হতেই পারেন, তাতে আমার আপত্তি নেই, মানুষ একটা ভুল করে, দুটো করে, এই যেমন আপনি করে ফেলেছেন। কিন্তু ভুল শুধরে নেওয়ার তো সুযোগ থাকে। তাই না?”

-” মোহর প্লিজ, আপনি কী বলতে চাইছেন একটু পরিস্কার করে বলবেন??”

-” বেশ। বলছি। আমি আপনাকে পছন্দ করি, মনে মনে ভালোবেসেছি এতদিন, বলার সুযোগ বা পরিস্থিতি পাইনি। আজ পেয়েছি, তাই বললাম। আপনার টাকার কারচুপির ব্যাপারটা কেউ জানতে পারবেনা। মানে জানতে পারবে, কিন্তু দোষটা আপনার হবেনা। ভালো হবেনা ব্যাপারটা??”

-” সত্যি??? কিন্তু কীভাবে? মানে আমি ঠিক..”

রাজীব আমতা আমতা করে করে উঠল মোহ দের কথা শুনে। একদিকে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়, অপর দিকে বেঁচে যাওয়ার একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা- এই দুই মিশে এক অদ্ভুত অনুভূতির মধ্যে দিয়ে যেন যাচ্ছে রাজীব। মাথার ভিতরে সবকিছু জট পাকিয়ে যাচ্ছে।
ওর বিহ্বল অবস্থা দেখে, মোহর যেন আরো মজা পেল বেশ। আপনি থেকে সরাসরি তুমিতে পৌঁছে, সে আবার একটু মুচকি হেসে বলে উঠল,

-” সেসব তো আমি ম্যানেজ করে নেব, এত চিন্তা তোমায় করতে হবেনা। তুমি ধরা তো পড়বেইনা, তার সাথে প্রমোশনও হবে। কিন্তু তার বদলে তোমাকেও কয়েকটা ছোট্ট কাজ করতে হবে”

-‘কী কাজ??”

-” আমি তোমাকে ভালোবাসি, তা তো আগেই বললাম। তো তোমাকেও এর উল্টোটা করতে হবে। সৌরিতার থেকে দূরত্ব বাড়াতে হবে। ব্যস এটুকুই।”

-” মা-মানে??? এটা কিছুতেই সম্ভব না”

-” বেশ, তাহলে তোমাকে, এই অফিস, প্রমোশন এসব ছেড়ে বাস্তবটা মেনে নিতে হবে। সাথে জেলের ভাত ও। রাজি?”

-” কিন্তু …….”

-” আমি তোমাকে ভাবার সময় দিলাম দশমিনিট। এরমধ্যে যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নিয়ে নাও, দেন আমাকে জানাও।”

মোহরের এই ভালোমানুষি অথচ হুমকির কথা শুনে রাজীব হকচকিয়ে গেল। কোন পথটা বেছে নেবে সে?? একদিকে সুখী জীবনের হাতছানি, অপরদিকে অন্ধকার জীবনের আশঙ্কা। জেলে গেলে, সব কথা জানাজানি হলে, সৌরিতা এমনিতেই ওকে ছেড়ে চলে যাবে। মানসম্মান টাকাপয়সা, সবকিছু একসাথে হারাবে সে। কিন্তু মোহরের কথা মেনে নিলে, সবকিছুই বজায় থাকবে । ওর বিবাহিত হওয়া নিয়ে তো, মোহরের সমস্যা নেই। এখন আপাতত নিজেকে বাঁচাতে ওর কথায় রাজি হয়ে গেলে, পরে নাহয় কোনোভাবে ম্যানেজ করে নেওয়া যাবে ব্যাপারটা। আশা করা যায় মোহর পরে ঠিকই নিজের ভুলটা বুঝতে পারবে, আর সব ঠিক হয়ে যাবে।

এইরকম নানারকম সম্ভাবনার কথা ভেবেই মোহরের প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছিল রাজীব। কিন্তু ওর ভাবনাচিন্তার কোনোটাই বাস্তবে সত্যি হয়নি। না তো ও পেরেছে, মোহর আর সৌরিতা দুটো দিক একসাথে সামলাতে। আর এতদিন পরেও মোহর নিজের সিদ্ধান্ত থেকে নড়ে যায়নি এতটুকু। বরং এই মুহূর্তে তার দাবী ক্রমশ বেড়েই চলেছে। মোহর এখন চাইছে, সৌরিতাকে ডিভোর্স দিয়ে আইনি প্রক্রিয়ায় রাজীব যেন ওকে বিয়ে করে, ওদের সম্পর্কটার সামাজিক স্বীকৃতি দেয়। আর ঠিক এই কথাটাই নিমেষের মধ্যে রাজীবকে কল্পনার জগত থেকে বাস্তবের মাটিতে আছড়ে এনে ফেলেছে। এই মুহূর্তের দোটানায় পড়ে, ওর মনে হচ্ছে এর থেকে কয়েকবছর জেল খেটে নিলে, বা ধরা পড়ে গেলে বোধহয় এর থেকে বেশি ভালো হত…….. । এখন কোন পথে যাবে সে???

(ক্রমশ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here