গল্প:- হয়ত
পর্ব:- ১
.
উত্তরের কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে তাপৌষির। সামনের পুকুরপাড়ের পাখ-পাখালির কিচিরমিচির আওয়াজ ভেসে আসছে। আজকে সম্ভবত ওদের বৈঠক বসেছে। পুকুরপাড়ে চারপাশে ধার ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য নারিকেল গাছ। নারিশ্যার এই গ্রামটিতে আজ তাপৌষির প্রথম দিন। গতকাল রাত করে আসার কারনে কিছুই তার দৃশ্যগম্য হয় নি। যখন নারিশ্যা বাজারে বাস থামে চারপাশ তখন নিকষ কালো চাদরে মুড়ানো।
-‘ আপু বড়মা আপনাকে ডাকছেন। ‘
-‘ যাচ্ছি। ‘
হাত খোপা করতে করতে বারান্দা থেকে বের হয়ে আসে তাপৌষি। গ্রামে হলেও বাড়িটি দুইতলা ডুপ্লেক্স বিল্ডিং। তাপৌষিকে থাকতে দেওয়া হয়েছে দুইতলায় শেষের দিকের একটি ঘরে। গলির মত মাঝখানে, আর তার দুইপাশে ঘর। বাড়িটার ডিজাইন কেমন যেন হোটেল হোটেল।
সকালের নাস্তার জন্য এই নিয়ে দুইবার এসে ডেকে গেলো মেয়েটা। মেয়েটার সাথে পরিচিত হওয়া হলো না। কী ভাবেই বা পরিচিত হবে! মেয়েটি যেন দৌড়ের উপর থাকে সব সময়। তাপৌষি খুব সাধারণ, স্বল্পভাষী একটি মেয়ে। কেউ কথা বলতে না আসলে নিজের মুখ দিয়ে বিন্দুমাত্র কথা বের করতে পারে না সে।
হাত মুখ ধুয়ে চুলটা আঁচড়িয়ে নিলো। গত দুইদিন ধরে চুল আঁচড়ানো হয়না তার। মাথায় কাপড় দিয়ে রেখেছে সব সময়।
.
-‘ খালামনি ডেকেছিলেন? ‘
প্লেটে প্লেটে রুটি, লাউ ভাজি আর ডিম ভাজা সাজিয়ে রাখছিলেন তনয়া বেগম। তাপৌষির ডাকে কাজে ছেদ ঘটে। চোখ মেলে তাকিয়ে একবার দেখে নিলেন সামনে দাঁড়ানো মেয়েটিকে। গত কালকে রাতে সম্ভবত কেঁদেছিল। চোখ দুটো ফুলে আছে। সুন্দর মুখখানা ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করেছে। চোখের নিচে কাজলের মতো কালো কালি জমাট বেধেছে। তিন বছর আগে যখন দেখেছিলেন তখন তাপৌষি কী সুন্দর দেখতে ছিল! মেয়েটিকে দেখে তার নিজেরই কান্না পাচ্ছে।
-‘ যেকোনো একটা প্লেট নিয়ে খেতে বসে যাও। ‘
চেয়ার টেনে সামনে থেকে একটা প্লেট তুলে নিলো তাপৌষি। রুটি ভাজি মনে হয় এখনি করা হয়েছে। বেশ গরম। রুটি ছিঁড়তে কষ্ট হচ্ছে। আগে তো গরম রুটি মা ছিঁড়ে দিতো। এখন তো তার মা নেই।
-‘ রুটি ছিঁড়তে কষ্ট হচ্ছে? আমি ছিঁড়ে দেই?’
প্রশ্ন করেও প্রশ্নের উত্তর না নিয়েই তনয়া বেগম রুটি ছিঁড়ে দিতে লাগলেন। মেয়েটা খুবই লক্ষ্মী।
-‘ খাইয়ে দেবো?’
তাপৌষি ডানে-বামে মাথা নাড়ল। যার অর্থ সে নিজেই খেয়ে নিতে পারবে। তবে তনয়া বেগম শুনলেন না। রুটির টুকরো ছিঁড়ে ডিম আর ভাজি দিয়ে তাপৌষিকে খাইয়ে দিতে লাগলেন।
মা’ও তো এভাবেই খাইয়ে দিতো। সকালে কখনোই তাপৌষিকে নিজে খেতে হয়নি।
-‘ খালামনি আর খেতে পারবো না। ‘
-‘ চুপ আর একটু। রিপাকে কখন বলেছি সবাইকে ডেকে আনতে। করছে টা কী কে জানে? এই রুটি শেষ। আর দিবো না। ‘
.
দুইটা রুটি যেন অনেক কষ্টে খেলো তাপৌষি। ক্ষুদা লেগেছিল সত্য তবে খাওয়ার রুচি নেই তার। খাওয়ার পরপরই তনয়া বেগম একটা বনপ্লেটে দুধ পুলি তুলে দিলো।
-‘ রাতে কিছু খাও নি। খালি পেটে পিঠা খেলে জান ঘাটত। এখন খাও। শীতের সকালে পিঠা খাওয়ার মজাটাই আলাদা। আর এই মজা কিন্তু গ্রামেই পাওয়া যায়। ‘
পিঠা মজা হয়েছে সত্যি। তবে এক চামচ খেয়েই আর খেতে ইচ্ছে করছে না তাপৌষির। প্লেট সামনে নিয়ে বসে আছে সে। চামচ দিয়ে পিঠাগুলো নাড়াচাড়া করে চলেছে। না খেলে খালামনি হয়তো মন খারাপ করবে। মা সমতুল্য খালামনিকে কষ্ট দেওয়া ঠিক হবে না।
চেয়ার টানার আওয়াজে সামনে তাকালো তাপৌষি। সাদা টি-শার্ট পড়া বেশ ফর্সা একটা ছেলে বসে আছে তার সামনে। চোখে চশমা, গুরুগম্ভীর ভাব। জ্ঞানী জ্ঞানী চেহারা।
-‘ তুমি তাইলে রাজশাহী থেকে এসেছ? তনিমা খালামনির মেয়ে?’
-‘ জি।’
-‘ বাহ! তো কোন ক্লাসে পড় তুমি? ‘
-‘ এখন অবসর। তবে একমাস আগে ভর্তি পরীক্ষার পাট চুকিয়ে এসেছি। অনার্সে এখনো ভতি হইনি। ‘
-‘ কোথায় কোথায় হয়েছে?
-‘ রাজশাহী বিশ্ববিদালয়ে। ঢাবিতে ওয়েটিং।’
-‘ তুমিতো তাইলে বেশ ভালো স্টুডেন্ট। রাজশাহীতেই তো ভর্তি হবা?’
-‘ ভর্তি ডেট দেয় নি?’
-‘ ডিসেম্বরে।’
-‘ এখন তো নভেম্বর। আর কোথাও তো পরীক্ষা দাও নি মনে হয়। দিবাও না তাইনা? তো একমাস আরাম করে ঘুরো।’
-‘ জি।’
-‘ চল পরিচিত হয়ে নেই। আমার নাম রৌদ। আমি কিন্তু তোমার অনেক বড়। অনার্স শেষ বর্ষ। আমাকে তুমি রৌদ ভাইয়া বলে ডাকবে কেমন? আর আমি তোমাকে ছোট আপু বলে ডাকাবো। ঠিক আছে?’
-‘ জি। ‘
-‘ আবার জি? বাংলা ভাষায় কিন্তু জি বাদে অনেক শব্দ আছে। তা ছোট আপু ঘুরতে এসেছো এখানে? কক্সবাজার যেতে। এসময় সাগর খুব সুন্দর থাকে। নভেম্বর -ডিসেম্বরেই পর্যটকেরা সাধারণত সমুদ্র তীরে ভীড় জমায়।’
-‘ না ভাইয়া। বাবা একা যেতে দিবে না। এখানে খালামনি নিয়ে এসেছে জোর করে।’
-‘ যাক জি বাদে অন্য কিছু তো বললা। যাই হোক শুনো, বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছো বলে নিজেকে বড় ভাববে না। সচেতন থাকবে। এসময়ও পড়া অনেক। এখান থেকেই তোমার পরবর্তী জীবন নির্ধারিত হবে। বুঝেছ? ‘
-‘ হ্যাঁ ভাইয়া। ‘
-‘ উহ! ছোটভাইয়া থামবে তুমি? মেয়েটা গতকালই এসেছে। ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন, ও এখানে ঘুরতে এসেছে। তোমার মোটিভেশনাল স্পিচ শুনতে আসেনি। আমার উপর কম জুলুম করো না। এবার এই মেয়েটিকে রেহাই দাও। কেমন আছো তাপৌষি? ‘
এই মেয়েটিকে তাপৌষি চিনে। তিন বছর আগে তনয়া বেগমের সাথে এই মেয়েটিও রাজশাহীতে গিয়েছিল। মেয়েটির নাম দিশা। দুইদিনেই তাপৌষির সাথে ভাব হয়ে যায় দিশার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যেয়ে তাপৌষিদের বাড়িতে উঠেছিল দিশা ও তনয়া বেগম।
তনিমা বেগম ও তনয়া একই বাবার সন্তান হলেও মা আলাদা। তবে দুই বোনের মধ্যে সখ্যতা ছিল দেখার মতো। হঠাৎ একদিন দাবানলের অগ্নিশিখা আছড়ে পড়ে ওদের উপর। প্রায় অনেক বছর দেখা সাক্ষাৎ ছিল না দুই বোনের। তনয়া বেগমই খুঁজে বের করেন তনিমা বেগমকে। মেয়ের পরীক্ষার ছুঁতোয় বোনের সাথে সব ভুল বুঝাবুঝি দূর করেন তিনি।
তাপৌষি উত্তর দিবার আগেই সাদা টি-শার্টের ছেলেটি ঠ্যাস মারা গলায় বলে উঠে,
-‘ এহ, তোকে বলে কোন লাভ হয়েছে? এতোই যদি জুলুম করতাম তাহলে আমার মতো ঢাবিতে পড়তি। বাপের টাকা আছে তাই প্রাইভেটে পড়তে পারছিস। টাকা না থাকলে বিয়ে হয়ে যেত এতদিনে। ‘
-‘ মা দেখো ছোট ভাইয়া আবার আমাকে জ্বালাচ্ছে।’
-‘ উচিত কথা বললে তো জ্বলবেই। ঠিক বলি নি ছোট আপু?’
-‘ এই তোরা খাবি চুপচাপ। দুইজন মিলে মেয়েটার কানের কাছে প্যাচোর প্যাচোর করেই চলেছে। আর একটাও শব্দ যেন আমার কানে না আসে।’
এই দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে তনয়া বেগমের ভারী জ্বালা। সারাক্ষণ একটা আরেকটার পিছে লেগে থাকে। দুইটা বাড়িতে থাকলে বাড়ি চিড়িয়াখানা হয়ে উঠে।
.
.
চলবে
[ভুল হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে না দেখে ভুল গুলো ধরে দিলে খুশি হবো অধিক। ধন্যবাদ]