#হয়ত
পর্ব:- ৮
.
বাড়ি থেকে বের হয়ে তাপৌষির চক্ষু চড়াক গাছ। এত সুন্দর গ্রাম! একেবারে ছবির মতো। একটু হাটলেই সামনে পাকা পিচ ধালা রাস্তা। রাস্তা দিয়ে হাটলে মনে হবে ধরণী তার সর্ব সৌন্দর্য দিয়ে গ্রামটি সাজিয়েছেন।
প্রতিটি বাড়ির সামনে পুকুর। পুকুরের ধার ঘেষে কয়েক প্রকার গাছ। বাড়ির সামনের পুকুর বাড়িগুলোকে আলাদা রূপ দিয়েছে। যে সৌন্দর্য তাপৌষি টিভিতে দেখেছিল, আজ স্বচক্ষে দেখছে। প্রতিটি বাড়ি টিনের তবে তাতে রং করা। সবুজ সতেজ গ্রামটি যেন আজ একেবারেই শান্ত; কোলাহল নেই কোন।
-‘ তাপৌষি এই প্রথম রাজশাহীর বাইরে পা রাখলে?’
তাপৌষি পাশে তাকিয়ে বর্ষণকে দেখতে পেলো। ওর পাশেপাশেই হাটছে।
-‘ না। ঢাকায় এর আগেও এসেছি ভর্তি পরীক্ষা দিতে।’
-‘ ওহ হ্যাঁ। গ্রামে এসেছো আগে কখনো?’
-‘না। এই প্রথম।’
-‘ ওহ আচ্ছা। তো গ্রাম কেমন লাগছে?’
-‘ ভালোই। গতকালকে অনেক রাত করে এসেছি। চারপাশের পরিবেশ কিছুই দেখতে পাইনি। এখন মনে হচ্ছে কোন রূপকথার রাজ্যে এসেছি। কী সুন্দর চারপাশ!’
বর্ষণ আর কিছুই বললো না। ওর বাম পাশে তাপৌষি আর ডান পাশে অথৈ হাটছে। দিশা, রৌদ আর বাকীরা পিছে পিছে হেটে আসছে।
.
তাপৌষিরা এখন দাঁড়িয়ে আছে নাড়িশ্যা বাজারে। রাস্তার পাশের প্রকাণ্ড এক বটগাছ মাথা উঁচু করে ওদের সামনে নিজের ডালপালা বিস্তৃত করে রেখেছে।
-‘ তাপৌষি তোমার কী কী কিনতে হবে বলো।’
-‘ আমার তো কিছু লাগবে না দিশা আপু। আমি তো ঘুরতে এসেছি তোমাদের সাথে।’
-‘ বললেই হলো। ওই দিকে দোকান আছে কসমেটিক্সের। চলো।’
.
অনেকক্ষণ ধরেই রৌদ দিশাদের কেনাকাটা দেখছে। এরা মানুষ নাকি এলিয়েন! এই টুকো বাজারও ঘুরে ফেলেছে দুইবার। কোন দোকানের জিনিস পছন্দ হলেও সেটা না কিনে ওই দোকান ছেড়ে আরেক দোকানে ঢুকে। পরবর্তী দোকানে ঢুকে আবার বলে আগের দোকানের কসমেটিক্স বেশি ভালো ছিল। আচ্ছা ঝামেলা সব। হঠাৎ রৌদ বলে উঠলো,
-‘ কে কে আমার সাথে এখন ডাক বাংলো যাবে?’
-‘ ভাইয়া আমাদের কেনাকাটা এখনো শেষ হয়নি।’
-‘ আমি সবাইকে ডাক দিসি নাকি? আমি বলেছি কে কে যাবে? তোকে এমনি তেও নিব না। যা ভাগ। তাপৌষি তুমি যাবে?’
তাপৌষি যেন এমন কিছুরই অপেক্ষায় ছিল। দ্রুত মাথা উপর নিচ করতে লাগলো। যার অর্থ সে এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচবে। এই কেনাকাটা কখনোই ওর পছন্দ ছিল না। মা’ই সব পছন্দ করে কিনে দিতো। মা’র পছন্দ ছিল চমৎকার।
.
অটোতে জনপ্রতি দশ টাকা ভাড়া। ডাকবাংলোয় যাওয়ার সময় পথের একপাশে প্রমত্ত পদ্মা নদীর বয়ে চলার অপরূপ দৃশ্য দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। গ্রামের বিশুদ্ধ বাতাসের উৎস তাহলে এই তটিনী!
অটো যখন ডাকবাংলোর ওখানে দাঁড়ালো, তাপৌষির মনে হলো রাজশাহী শহরে এই একই পথ মাত্র পাঁচ টাকা ভাড়া দিয়ে যাওয়া যায়।
অটো থেকে নেমে তাপৌষি শত শত মানুষের মিলন মেলা দেখতে পেলো। পদ্মার পাড়ে বসেছে বহু খাবার দোকান। বিকাল হওয়ায় এলাকাটা লোকে লোকারণ্য। পাশেই জাহাজ তৈরি হচ্ছে। বিশাল বিশাল জাহাজ। নদীর বুকে স্টিমার, জাহাজ আর ছোট ছোট নৌকা চলতে দেখা যাচ্ছে।
তাপৌষি যখন নদীর পানিতে পা ভিজালো, বুকটা প্রশান্তিতে ছুঁয়ে গেল। শীতের সময় ঠাণ্ডা পানিতে পা দেওয়ার কারনে শরীর একটু কেঁপে উঠলো।
.
বর্ষন অনেকক্ষণ ধরেই তাপৌষিকে লক্ষ্য করছে। ওদের সাথে আসা বাকী মেয়েগুলো ফুচকা বলে দৌড় মেরেছে। রৌদের মাথা খাচ্ছে ফুচকা খাওয়ানোর জন্য। আর এদিকে তাপৌষি প্রকৃতির বুকে মিশে যাচ্ছে।
-‘ আমার জানা মতে রাজশাহীতেও পদ্মা নদী আছে। তাও এই পদ্মা নদী দেখে এত খুশি? পদ্মার ধারে আগে কখনো যাও নি?’
-‘ রাজশাহীর পদ্মার পানি শুকিয়ে গেছে; মৃত প্রায় অবস্থা। শীতকালে তো পানি খুঁজেই পাওয়া যায় না। হেটে নদী পাড় করা যায়। এখানের পদ্মার সাথে প্রমত্ত কথাটা একেবারেই মিলে গেছে। দেখুন কী সুন্দর চারপাশ! নীল পানি শুধু সব দিকে।’
কথা শেষ করেই তাপৌষি বর্ষণের দিকে তাকালো। লোকটার চোখ সত্যি খুব সুন্দর। তাকালে তাকিয়ে থাকতেই মন চাইবে।
বর্ষণ হালকা হেসে জবাব দিল,
-‘ সব সুন্দর জিনিস কিন্তু ভয়ংকর হয় তাপৌষি।’
তারপর বিরবির করে বললো, ‘ যেমন তোমার সৌন্দর্য।’
-‘ কিছু বললেন?’
বর্ষণ হেসে উত্তর দিলো,
-‘ আরে নাহ্।’
লোকটার হাসিও খুব সুন্দর। উনি হাসলে সম্মোহিত হতে হবে বারংবার।
-‘ ওহ আচ্ছা।’
-‘ জি। চলো তোমাকে একটা যায়গা দেখাবো। দাঁড়াও ওদের ডেকে নিয়ে আসি।’
.
দুইতলা বাড়িটার অর্ধেক অংশ নদী গর্ভে তলিয়ে গেছে। পাশে একটা হাসপাতাল। কোন রকমে নদীর কিনারা ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। হাসপাতালেরও অর্ধেক অংশ নদী গর্ভে।
-‘ তাপৌষি ভয়ংকর সৌন্দর্যের দেখা পেলে?’
-‘ আসলে বড়ই ভয়ংকর। আচ্ছা এত এত বাড়ি, হাসপাতাল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সরকার বাঁধ দিচ্ছে না কেন।’
-‘ আমার আঙুল বরাবর তাকাও, কী দেখতে পাচ্ছো?’
-‘ বড় বড় পাথর। ওহ আচ্ছা। এগুলো দিয়ে বাঁধ নির্মান করবে? তাহলে কাজ আরও আগে কেন শুরু করেনি?’
-‘ পাথর খুঁজে পেলে তো করবে।’
-‘মানে?’
বর্ষণ একটা গভীর নিশ্বাস ত্যাগ করলো।
-‘ শুনো তাপৌষি। আমরা মানুষ হিসেবে খুব খারাপ। এই যে পাথর গুলো দেখছো, এগুলো গতকাল আনা হয়েছে। সাতদিনের মধ্যে দেখবে পাথর উধাও।’
-‘ পাথর চুরি হয়? নিজেদের ক্ষতি নিজেরা কেন করছে?’
-‘ সাময়িক সুখের আশায়।’
-‘ এই চুরির পাথর দিয়ে ওরা কী করবে?’
-‘ বিল্ডিং বানানোর কাজে লাগে। একসময় সিলেটের জাফলং থেকে পাথর আনা হতো বিল্ডিং তৈরির কাজে। ভীতে পাথর দিলে বাড়ি মজবুত হয়। তবে এতে খরচ বেশি। কেনার চাইতে চুরি সহজ। তাই মানুষ এগুলো এখান থেকে চুরি করে। নিজেদের লাভের অংশ রেখে কম টাকা দিয়ে বিক্রি করে আর তাছাড়াও বাসা বাড়িতে শীলপাটা তৈরির কাজেও এই সকল বড় বড় পাথর দরকার হয়।’
-‘ স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা নেয় না কেন?’
এবার তাপৌষির প্রশ্নের জবাব রৌদ দিলো।
-‘ কয়জন কে আটকাবে বলো। আর বেশির ভাগ সময় দেখা যায় ক্ষমতাসীন দলের লোকের এগুলোর সাথে জড়িত। আর শুধু কী পাথর। ইট, বালুর বস্তা, সিমেন্টের ব্লক সব চুরি হয়ে যায়।’
তাপৌষির খারাপ লাগতে লাগলো। না জানি কত মানুষ বাড়িঘর হারিয়েছে! সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে মানুষ বাড়ি বানায়। আর যখন সেই বাড়ি নদী কেড়ে নিয়ে যায় তখন তাদের কীরূপ অবস্থা হয় তা ভাবতেই তাপৌষির গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা চুরির টাকা কখনো হজম হয়?
.
তাপৌষিরা যখন ফিরল ততক্ষণে বিয়ে বাড়ির উঠান রঙবেরঙের লাইট দিয়ে সাজানো হয়ে গেছে। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে আসছে। উঠানের একপাশে চৌকি দিয়ে স্টেজ বানানো হয়েছে। বাড়িতে ঢুকেই সবাই যে যার মতো তৈরি হতে চলে গেলো। দিশাদের বাড়ির নিচতলায় কোন বেডরুম নেই। দুই তলাতেই পাঁচটা রুম। এটাচ বাথরুম মাত্র দুটো রুমের সাথে। সেই দুটো বাথরুমের একটি দিশার রুম আরেকটি তনয়া বেগমের রুমে। দিশার বাবা সৌদিতে থাকেন। প্রবাসী। বছরের একবার আসেন মাত্র। তাপৌষি কখনো তাকে দেখে নি। বাড়ির বাথরুম সংকটের কারণে তাপৌষি, রৌদ আর বর্ষণকে একটা কমন বাথরুম ব্যবহার করতে হয়। তনয়া বেগম অবশ্য তাপৌষিকে বলেছিলেন দিশার সাথে দিশার ঘরে থাকতে। তবে তাপৌষি দিশার প্রাইভেসি নষ্ট করতে চায়নি।
.
আজকে তাপৌষি শাড়ি পড়বে না। ব্যাগ থেকে গোল ঘের ওয়ালা একটা লং জামা বের করলো। জামার রং টা লাল। চোখে হালকা কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক আর কপালে সাদা পাথরের একটা ছোট টিপ ;কানে দুপুরে কিনা একজোড়া দুল আর মাথায় দিশার কিনে দেওয়া টিকলি। তাপৌষির সাজ কমপ্লিট। একবার আয়নার সামনে নিজেকে দেখে নিলো সে। গায়ে জড়ানো জামাটার খুব সিম্পল কাজ। লাল জরজেট কাপড়ের উপর লাল সুতোর বুনোন।
মা’য়ের সবচেয়ে পছন্দের জামা ছিলো এটা। জামাটা পড়লেই মা বলতো,
-‘ তাপৌষি লালে তোকে খুব মানায়। দেখ জামাটার ডিজাইন কিন্তু একেবারেই অল্প। অথচ তোর গায়ে উঠতেই জামাটা যেন নিজ পরিচয় খুঁজে পেয়েছে। কী সুন্দর লাগছে তোকে! আয় নজর টিকা দিয়ে দেই। এখন কেউ আমার মেয়ের দিকে নজর দিতে পারবে না।’
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললো তাপৌষি। আজ নজর টিকা দিয়ে দেওয়ার মতো কেউ নেই।
.
.
চলবে…