#হয়ত
পর্ব:- ১৯
.
পাশের কোথাও হয়তো চুড়ুই পাখিদের মেলা বসেছে, কিচিরমিচির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। দলবেঁধে বাড়ি ফিরছে কৃষাণেরা, ক্ষেতের কাজ শেষ আজকের মতো। এসময় এদিকে সরিষাসহ অনেক রকম মৌসুমি সবজি চাষ হয়। এই পড়ন্ত সন্ধ্যাবেলায় কৃষাণদের মাথায় মাথল। তবে এদিককার লোকজন বিশেষ ধরনের এই বাঁশের টুপিকে কী বলে তা তাপৌষির অজানা। কৃষাণদের হাতে দা ও কাস্তে। কাঁধের একপাশে কাপড়ের পুটলি ঝোলানো। গায়ে বস্ত্র বলতে লুঙ্গী আর গেঞ্জি। তাপৌষি ভাবছে এই শীতের সন্ধ্যায় মানুষগুলোর ঠাণ্ডা লাগে না? ওর নিজেরই তো এখন ঠাণ্ডা লাগছে।
-‘ কী ভাবছ তাপৌষি?’
-‘ আমার জন্য তোমাদের আজ ঢাকা যাওয়া হলো না তাইনা?’
-‘ তুমি এই কারনে মনঃকষ্টে ভুগছ কী? আমরা কাল সকালে রওনা দিব। এখন বলো তো জ্বর কেমন?’
-‘ জ্বর নেই দিশা আপু। তবে মাথা ঘুরায় মাঝে মাঝে।’
-‘ গতকালকে তো ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে। মা সারারাত জেগে তোমার কপালে জল পট্টি দিয়েছে। রৌদ ভাইয়া ডাক্তার ডেকে এনেছিল। পাওয়ারফুল এন্টিবায়োটিক তোমার পেটে যাওয়ার পর সুস্থ হয়েছ। রাতে কী কষ্টে যে খাওয়ানো হয়েছে তোমাকে। খাওয়াতে যাই আর তুমি দাঁত দিয়ে চেপে চামচ ধরে রাখো। রৌদ ভাইয়া আর আমি প্রায় এক ঘণ্টার পরিশ্রমে তোমাকে খাওয়াতে পেরেছি।’
দিশা মিটমিট হাসছে। তাপৌষির খারাপ লাগছে। এই মানুষগুলোকে গতকাল অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে।
-‘ সরি আপু। এরপর থেকে প্রমিস নিজের খেয়াল রাখবো।’
-‘ হুম। প্রমিস যেন মাথায় থাকে। আগে চলো কিছু খেয়ে নিবে। তারপর এই ঔষধ খাবে।’
-‘ এই ভরা সন্ধ্যায় খাবো?’
-‘ হালকা পাতলা নাস্তা করো। আর সন্ধ্যা হতে বেশ খানিকক্ষণ।’
তাপৌষি হাতের ঔষধটা নাড়াচাড়া করে দেখলো। ” ডুমাফ্লক্স ৫০০ মি. গ্রা.”।
-‘ আপু এটা তো..’
-‘ এন্টিবায়োটিক। পাঁচদিন খেতে হবে। দুইবেলা করে। যেহেতু সকালে তোমাকে খাওয়াতে পারিনি আর দুপুরে ঔষধ খাওয়ানোর আগেই তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে তাই এখন খেয়ে নাও। রাতে আর ঔষধ খেতে হবে না। কাল সকালে খেও একদম। আর শুনো জামা কাপড় সব গুছিয়ে নেও। কালকে তুমি আমাদের সাথে ঢাকা যাবে।’
তাপৌষির বলতে ইচ্ছে করছে আমি যাবো না দিশা আপু। তবে বলতে পারলো না। অসুস্থ হয়ে পড়েছে ও। তাই এখন এরা ওকে না সুস্থ করা পর্যন্ত থামবে না।
.
খুব সকাল সকাল তাপৌষিরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। রিমির বিয়ের রিসেপশন অনুষ্ঠানে ওরা ঢাকা থেকেই অংশগ্রহণ করবে। বাসে উঠার পর তাপৌষি এক দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে। বামপাশের দ্বিতীয় সাড়িতে তাপৌষি আর দিশা বসে আছে। সকাল সকাল হওয়ায় বাসে যাত্রী কম। রৌদ বসেছে ওদের কোণাকুণি। তাপৌষি ঠাণ্ডা লাগছে। দিশা আগেই জানালা লাগিয়ে দিয়েছে। তবে কিছু যাত্রী এই ঠাণ্ডার মধ্যেও জানালা খোলা রেখেছে। নাড়িশ্যা আসার সময় শীতের জামাকাপড় বলতে ওর মা’য়ের একটা চাদর নিয়ে এসেছিল। এখন ওই চাদরটাই গায়ে চাপানো। সোয়েটার না নিয়ে এসে কত বোকামি করেছে আজ বুঝতে পারছে ও।
-‘ ঠাণ্ডা লাগছে তাপৌষি?’
-‘ একটু একটু আপু।’
-‘ লাগবেই তো। এই পাতলা চাদরে কী শীত নিবারণ হয়? দেখি পা একটু জানালার পাশে চাপাও তো।’
তাপৌষি পা চাপালো। দিশা তাপৌষির সিটের নিচ থেকে ছোট ট্রেভেল ব্যাগটা তুলে নিল। ব্যাগ খুলে একটা চাদর বের করে তাপৌষির গায়ে চাপিয়ে দিল।
-‘ বাতাস কত দেখছো? এটা হলো নদীর বাতাস। ঠাণ্ডা লেগে যাবে। জ্বর কমেছে তোমার?’
-‘ জি আপু।’
-‘ কিছু খাবে?’
বাসে উঠার আগে রৌদ কিছু চিপস, ডালভাজা আর ম্যাংগো জুস কিনে নিয়েছিল। দিশা নিজের হ্যান্ডব্যাগ থেকে চিপসের একটা প্যাকেট বের করে তা তাপৌষির সামনে দিল।
-‘ এটা খাও তাপৌষি। ভালো লাগবে।’
তাপৌষি একটা চিপস মুখে তুলে নিল। তারপর ডানেবামে তাকাল। কোনাকুনির সিটটাতে একজন বয়স্কা মহিলা বসে আছে।
-‘ আপু রৌদ ভাইয়া?’
-‘ ভাইয়া পিছেই আছে। চিন্তা করো না।’
আজ রাস্তায় তেমন জ্যাম নেই। গাড়ি ফাকা রাস্তাতেই আপন গতিতে ছুটেছে। প্রায় আড়াই ঘণ্টা লেগেছে দিশাদের বাবুবাজার ব্রিজ পর্যন্ত আসতে। অন্য সময় তিনঘণ্টা পাড় হয়ে যায়। তবে সমস্যা বেধেছে ব্রিজ পাড় হওয়ার পর। গাড়ি মনে হচ্ছে অনেক ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। তাপৌষির চোখ মুখ ফুলে গেছে। গরমে দম নিতে পারছে না ও। গায়ে চাপানো দুটি শাল খুলে ফেলে পাতলা সুতির ওড়না পড়েছে। বিশ্রী উটকো গন্ধ নাকে এসে লাগছে। বমি বমি পাচ্ছে। দিশা একবার তাপৌষির দিক তাকাল। মেয়েটা এমনিতেই অসুস্থ। তার উপর এই ভ্যাপসা গরমে মাঝে ট্রাফিকজ্যামে আটকা পড়েছে। মায়া লাগছে দিশার।
.
বর্ষণ গুলিস্তানের গোলাপ শাহ্ মাজারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দোহার থেকে আগত বাস গুলো এখানে এসেই থামে। তনয়া বেগম ওকে বারবার ফোন দিয়ে বলে দিয়েছে তাপৌষির অসুস্থতার কথা। বাস জার্নি করে আবার কোন অসুখে পড়ে এই চিন্তায় তনয়া বেগম সুস্থির হয়ে বসতে পারছেন না।
বর্ষণ আগেই বুঝতে পেরেছিল এই মেয়ে অসুখ বাঁধাবে। সেদিন বকেছিল বলে কী রাগটাই না দেখিয়েছিল!
এখন কী হলো? জ্বর আনিয়ে বসে আছে।
পকেট থেকে ফোন বের করে রৌদকে ফোন দিল।
-‘ হ্যাঁ ভাইয়া বলো।’
-‘ আর কতক্ষণ?’
-‘ বাস চলে এসেছে। নামছি এখন।’
-‘ কই আছিস তোরা?’
-‘ দেখতে পেয়েছি তোমাকে। এই যে হাত নাড়ছি দেখো।’
বর্ষণ সামনে তাকিয়ে রৌদকে দেখতে পেল। ফোন পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে ওদের দিকে এগিয়ে গেল।
.
তাপৌষি বমি করছে। দিশা পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রৌদ ব্যাগপত্র সব ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ও আসলে বুঝতে পারছে হঠাৎ করে তাপৌষির বমি পেলো কেন? বর্ষণ পানি কিনতে গেছে।
আসলে ওরা চারজন দাঁড়িয়ে ছিল গোলাপ শাহ্ মাজারের পাশে। বর্ষণ রিকশা ঠিক করছিল। ধুপ আর আগরবাতির গন্ধ তাপৌষির নাকে এসে লাগে। কোন মতে রাস্তার ওপর পাশে এক দোকানের সামনে এনে দাঁড় করানো হয় ওকে। তারপর পাশের ডাস্টবিনে গড়বড় করে বমি করে দেয় তাপৌষি।
বর্ষণ দিশার হাতে পানির বোতল দিলে দিশা তাপৌষির মুখে পানির ছিটা দেয়। অল্প পানি মুখে নিয়ে কুলকুচি করে তাপৌষি।
এরপর চারজন গুলিস্তানের একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেস্টুরেন্টে এসে বসে। ভিতরটা ঠাণ্ডা হওয়াতে তাপৌষির খারাপ লাগছে না আর। বমি বমিও পাচ্ছেনা। খাবারের মেন্যু উল্টেপাল্টে দেখে বর্ষণ তাপৌষিকে জিজ্ঞেস করলো
-‘ তো তাপৌষি কী খাবে বলো? ঠাণ্ডা কিছু খাবে? আইসক্রিম? ‘
তাপৌষির হয়ে দিশা জবাব দিল,
-‘ না ভাইয়া খালি পেটে দুধের জিনিস খাওয়া ঠিক হবে না। এমনিতেই বমি করেছে। তাপৌষি এক কাজ করো এই ডেক্সল্যান ট্যাবলেটটা এখন খেয়ে নাও। তারপর কিছু খেও। জ্বর আসছে কী? দেখি।’
তাপৌষির শরীরে জ্বর নেই। তবে এন্টিবায়োটিকের কারনে শরীর দুর্বল।
.
অনেকক্ষণ ধরে খাবারের মেন্যু রৌদ নাড়াচাড়া করছে। মাঝে মাঝে অদ্ভুত মুখ বানাচ্ছে তো মাঝে মাঝে মিটির মিটির হাসছে। দিশা খেয়াল করছে রৌদের এই অদ্ভুত কাজ।
-‘ ছোট ভাইয়া কী হয়েছে তোর? পাগল হয়ে গেলি নাকি?’
-‘ ভাগ, পাগল হবো কেন? এদের মেন্যু পড়ে দেখ। দাঁত ভাঙা আইটেমের নাম সব। খাবারের নাম পড়তে পড়তে এক যুগ চলে যাবে। খাবো কখন?’
-‘ মানে?’
-‘ মানে… কেমনে বুঝাই? আচ্ছা এই আইটেমটা দেখ। এর নাম কী দেখ।’
-‘ তুমি বলনা।’
-‘ আইলসা মেয়ে মানুষ। এটা হলো একটা সেট মেন্যু। এতে আছে, থাই ফ্রাইড রাইস, সুইট এন্ড সোর চিকেন, ব্যাংকক চিকেন, মিক্সড ভেজিটেবল, কোলস্ল সালাদ, পটেটো ওয়েডজ।
বাঙালি না আমরা? আমাদের মেন্যু বাংলায় হওয়া উচিত। সুইট এন্ড সোর চিকেন না লিখে টক মিষ্টি মুরগি ভুনা লিখতে পারতো না? আর এই ব্যাংকক চিকেন আবার কী? ব্যাংকক থেকে মুরগিরে বাইধা আইনা এখানে পরিবেশন করা হয় নাকি? এরা তো খুনি। সব চেয়ে বড় কথা এরা পাচারকারী। মানুষ পাচারের সাথে সাথে মুরগিও দেখি পাচার হয়ে যায়। ও বাবা গো বাবা। তাপৌষি দ্রুত পুলিশে ফোন দাও। আমাদের দেশের মুরগিদের নিয়ে আমরা আন্দোলন করবো।’
-‘ ভাইয়া থামবে?’
-‘ কী থামবো? এই সালাদ দেখেছিস? এরে সহজ বাংলায় লিখা যেত না “বাঁধা কপির সালাদ”? ভাব যারা না বুঝে এই ঘুরানো প্যাঁচানো নাম দেখে এগুলা অর্ডার দেয়, তারা কী লসটাই না খায়? দাম দেখেছিস? সব মিলায়ে সাতশো ছুঁইছুঁই। সাথে শেষ পাতে একটু আইসক্রিম আর সাত ইঞ্চির গ্লাসে এক গ্লাস কোল্ড ড্রিংকস ধরায়ে দিবে।’
-‘ উফ ভাইয়া ওরা ইন্টারন্যাশনাল ওয়ে ফলো করে রেস্টুরেন্ট চালায়।’
-‘ তাতে কী? আমরা তো ন্যাশনাল মানুষ। ইন্টারন্যাশনাল দিয়ে কী করবো? এমন হলে দুটো মেন্যু বানাবে। একটা আমাদের জন্য শুদ্ধ ভাষায় আরেকটা ওই ইন্টারন্যাশনাল ভাষায়।’
তাপৌষি খুব মজা পাচ্ছে দিশা আর রৌদের তর্ক দেখে। ওর হাসিও পাচ্ছে। রৌদকে দেখে প্রথমে ও ভেবেছিল শান্তশিষ্ট স্বভাবের। চোখের চশমা আর মুখের হাবভাব দেখে মনে হয়েছিল সব সময় বই নিয়ে ব্যস্ত থেকে এই ছেলে। অথচ আজ বুঝতে পারছে উপরে যা বোঝা যায় ভিতরে তার উল্টো হয়।
বর্ষণ চুপ করেই ছিল। এদের তর্ক বিতর্ক ঝগড়া পর্যায়ে চলে যাচ্ছে দেখে ও দুজনকে ধমকে থামাল।
.
চলবে….