#হয়ত
পর্ব:- ২১
.
খুব ছিমছাম সাজানো গোছানো একটা ফ্ল্যাট। তিনটা বেডরুম, দুটো এটাচ বাথরুম, একটা ড্রয়িংরুম, একটা সিংগেল বাথরুম, মাঝারি সাইজের কিচেন আর মিডিলে বড় ডাইনিং। বর্ষণরা ডাইনিং রুমের অর্ধেককে ড্রয়িংরুম বানিয়ে আলাদা ড্রয়িং রুমকে বেডরুম বানিয়েছে। সেই রুমটায় বর্ষণ থাকে। সেপারেট বাথরুম বর্ষণের সাথে রৌদ শেয়ার করে। রৌদের ঘরেও এটাচ বাথরুম নাই। এটাচ বাথরুম ওয়ালা দুটা রুমের একটা দিশার আর আরেকটা দেওয়া হয়েছে ওদের দেখভাল করা আত্মীয় পরিবারটিকে।
দুঃসম্পর্কের এক চাচা হন উনি। বউ আর পাঁচ বছরের ছেলেকে নিয়ে বর্ষণদের সাথে থাকে। উনার বউ রান্না করেন আর উনি বাজার করেন। বর্ষণরা যখন থাকে না ফ্ল্যাট দেখে শুনে রাখেন তখন।
ফ্ল্যাটের পরিবেশ খুব শান্ত আজ। দিশা চারপাশে তাকিয়ে দেখে নিল। চকচক করছে সব। এরপর বর্ষণের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
-‘ চাচারা কবে ফিরবেন?’
-‘ বলে যায় নি কিছু। শুধু যাওয়ার সময় ফ্ল্যাটের চাবি আমার হাতে দিয়ে বলল চাচির আব্বা মারা গেছে। খাবার ফ্রিজে রাখা আছে। গরম করে খেয়ে নেই যাতে। ‘
-‘ হাতে কিছু টাকা দিয়েছ?’
-‘ হ্যাঁ দিয়েছি। ‘
-‘ এখন কে রান্না করবে? আমার রান্না তো তোমাদের মুখে রোচে না।’
রৌদ দিশাকে ভেঙিয়ে বলল,
-‘ কেন ঢাকায় রেস্টুরেন্টের অভাব পড়েছে? যেকোনো রেস্টুরেন্টে ঢুকলেই ব্যাংকক থেকে ধরে আনা মুরগি খাওয়া যাবে।’
রৌদের কথায় বর্ষন তাপৌষি হেসে উঠে। দিশা প্রথমে রাগ হলেও পরে ওইও হেসে দেয়।
.
তাপৌষি থাকবে দিশার ঘরে দিশার সাথে। ওর বারবার মনে হচ্ছে ও দিশার প্রাইভেসি নষ্ট করছে।
-‘ কী হলো তাপৌষি? এত চিন্তিত কেন?’
-‘ আমি তোমার সাথে থাকলে তোমার কষ্ট হবে তো। স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে পারবে না, মনের মত কাজ করতে পারবে না।’
-‘ এই টুকু মাথায় এত ভুলভাল চিন্তা না করলেও চলবে। যাও হাতমুখ ধুয়ে আসো। কিছু খাবে? জ্বর কেমন দেখি।’
তাপৌষির শরীরে জ্বর নেই। তবে দিশা শত বলেও ওকে কিছু খাওয়াতে পারলো না। হাতমুখ ধুয়ে এসেই তাপৌষি ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছে।
.
ঘরের পর্দাটা ভালো মতো টেনে দিল তাপৌষি। দিশা ঘুমাচ্ছে। শেষ দুপুরের রোদ তীর্যকভাবে সাড়া ঘরে আলো ছড়াচ্ছে। সেই আলো পর্দার ফাঁক দিয়ে দিশার মুখে যখন পড়ছে, দিশা তখন “ইশ! ইশ!” করছে। তাপৌষি ফোন অন করলো। গতকাল থেকে ও ফোন অফ করে রেখেছিল। তবে ফোন অন করতেই বিপত্তি ঘটলো। ওর বাবার নাম্বার থেকে ফোন আসছে। স্কিনে সেভ করা “BABA” শব্দটা একবার জ্বলে উঠছে তো আবার অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। তাপৌষি ফোন ধরে সালাম দেওয়ার সাথে সাথে ওপাশ থেকে কথা ভেসে আসলো,
-‘ ইরেসপন্সিবল মেয়ে একটা। ফোন বন্ধ কেন তোমার? ফোন চালাইতে পারো না? মায়ের মতো অশিক্ষিত হয়ে থাকার ইচ্ছা খালি। এমন হলে স্মার্টনেস এর ‘স’ ও চিনবানা কোন দিন।’
-‘ আমি তোমাকে সালাম দিয়েছিলাম বাবা।’
ফরিদ সাহেব এবার একটু থমকালেন। তাও গলার স্বরে একটু তেজ নিয়ে আবার কথা বলা শুরু করলেন।
-‘ তোমার সালাম আমি শুনেছি। বড়রা কিছু জিজ্ঞেস করলে তার উত্তর দিতে হয় জানোনা? ফোন কই ছিল তোমার। ফোন দিলে পাওয়া যায় না কেন?’
-‘ তুমি সালামের উত্তর দাও নি।’
ফরিদ সাহেবের কথা আবার আটকে আসলো। আজ কী হলো এই মেয়ের? কথার মারপ্যাঁচে ফেলছে বারংবার।
-‘ ওয়ালাইকুম আসসালাম। এবার বল ফোন কোথায় ছিল তোমার?’
-‘ আমার ফোনতো সঠিক জায়গাতেই ছিল। কোন কারনে ফোন দিয়েছিলে বুঝি? আমি তো ভেবে ছিলাম বিয়ে উপলক্ষে তোমাকে ফ্রি পাওয়া যাবেনা।’
-‘ এই ভাবে কথা বলছো তুমি আমার সাথে? হাও ডেয়ার ইউ? আই উইল সি ইউ রিমেম্বার। বাবা হই তোমার। ভদ্রতাপূর্ণ কথাবার্তা তোমার থেকে আশা করি। তোমার মা এগুলো শিখিয়ে দিয়ে গেছে তোমাকে? অমানুষ বানিয়েছে একটা। মা যেমন মেয়ে তো তেমন হবেই।’
তাপৌষি একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল,
-‘ আমি তোমারও মেয়ে বাবা। এটা ভুলিয়ো না কখনো।’
অপরপাশের মানুষটির উত্তরের অপেক্ষা না করেই ফোন কান থেকে নামিয়ে ফেলল। তারপর ইন্ড কল টাচ করে আলাপচারিতার সমাপ্তি টানলো। ফরিদ সাহেব এখন আর ফোন দিবে না তা তাপৌষি জানে। হয়তো হাতের কাছে কোন কাঁচের গ্লাস থাকলে তা মেঝেতে এক আছাড় মারবে। তবে ফোন করে তাপৌষির উপর এখন সে রাগ ঝাড়বে না।
.
-‘ ফোনের অপর প্রান্তের মানুষটি খালু ছিল?’
তাপৌষি হালকা হাসলো। ফোনে কথা বলতে বলতে ডাইনিং এর বড় জানালার পাশের এসে দাঁড়িয়েছে ও।
-‘ সরি, উইথ আউট পারমিশন তোমার কথোপকথন শুনে ফেলেছি।’
-‘ ইট’স ওকে।’
-‘ কফি খাবে?’
-‘ না আমি কফি, চা এগুলা খাই না।’
-‘ তাহলে হরলিক্স খাবে? চকলেট হরলিক্স আছে ঘরে।’
বলে বর্ষণ মিটিমিটি হাসা শুরু করলো। তাপৌষি চা খায় না। কফিও খায় না। তাই নিছক মজা করে বর্ষণ হরলিক্সের কথা তুলেছে। ওর ধারণা এখন তাপৌষি ওর উপর রাগ দেখিয়ে ঘরে চলে যাবে। অথৈও অনেকটা তাপৌষির মতো। ওর সাথেও বর্ষণ এই একই মজা করেছিল। সে কী রাগ মেয়ের। দিশার কাছে বিচার দিয়েছিল।
তবে বর্ষণকে অবাক করে দিয়ে তাপৌষি বলল,
-‘ জি খাবো। বেশি করে দুধ দিবেন। আর হ্যাঁ গরম না আমি আইস দেওয়াটা খাবো।’
তাপৌষিও উল্টো মজা করছে কীনা বুঝতে বর্ষণ ওর মুখের দিকে তাকালো। তবে তাতে মজা করার কোন আলামত দেখতে পাওয়া গেলনা।
-‘ জ্বরের মানুষকে আইস দেওয়া হরলিক্স খাইয়ে মেরে ফেলার ইচ্ছা আমার নেই। গরম দুধ চিনি মেশানো হরলিক্স পেতে পারো।’
-‘ চলবে। তবে চকলেট হরলিক্সে চিনি দেওয়াই থাকে। আলাদাভাবে চিনি মেশাতে যেয়েন না।’
বর্ষণ চোখ দুটো ছোটছোট করে তাপৌষির দিকে তাকালো। এই দুই রত্তি মেয়ে ওকে অর্ডার করছে নাকি?
-‘ কী দেখছেন? হরলিক্স বানাতে যাবেন না?’
-‘ যাচ্ছি। ‘
দুই দিন আগে বর্ষণ তাপৌষির উপর অনেক রাগ দেখিয়েছিল। আজ সেই রাগের প্রতিশোধ নিয়ে তাপৌষি মনে মনে খুব আনন্দিত। একটু আগে ওর বাবার সাথেকার কথোপকথন ও ভুলেই গেছে।
.
-‘ তোমার হরলিক্স।’
-‘ ধন্যবাদ।’
বর্ষণ নিজের জন্য চা এনেছে। বেশি করে দুধ দিয়ে চিনি দিয়ে চা খেতে ও বেশ পছন্দ করে।
-‘ এখান থেকে মেঘ ছোঁয়া যাবেনা?’
-‘না।’
-‘ কী বলেন? এটা তো কত উঁচু বিল্ডিং, তাও মেঘ ছোঁয়া যায় না?’
-‘ না তাপৌষি। মেঘ ছোঁয়ার খুব শখ?’
-‘ হ্যাঁ।’
-‘ তাহলে তো সাজেক ভ্যালি যেতে হবে।’
-‘ ওহ। আর কোন উপায় নেই?’
-‘ স্বপ্নে ছুঁয়ো। এখন বলো জ্বর কেমন? আমার বকাতে তো সেদিন রাগ দেখালে। দেখলে কেন বকে ছিলাম?’
তাপৌষি এই ভয়টাই পাচ্ছিল। এই লোক যে জ্বরের কথা এত তাড়াতাড়ি উঠাবে তা তাপৌষি ভাবতেও পারেনি। কথার ট্রাক পরিবর্তন করা দরকার এখন।
-‘ আপনাদের ভালো লাগে এই ব্যস্ত নগরী তে থাকতে?’
-‘ অভ্যাস হয়ে গেছে। মানুষ অভ্যাসের দাস। তোমার তো রাজশাহী ভালো লাগে বেশি।’
-‘ হ্যাঁ, আপনি কী করে জানলেন?’
-‘ ওই যে বললাম মানুষ অভ্যাসের দাস। তোমার ওখানে থেকে অভ্যাস হয়ে গেছে।’
-‘ মোটেও না। রাজশাহী এমন একটা জায়গা, যা যে কারোর পছন্দ হতে বাধ্য। পরিষ্কার ফুটপাত, পিচঢালা পরিষ্কার রাস্তা, রাস্তার দুই পাশে গাছ। রাজশাহীর তুলনাই হয়না।’
ডায়নিং রুমের জানলা দিয়ে তাপৌষি নিচের ব্যস্ত নগরীর চাঞ্চল্যতা লক্ষ করছে। সেই সাথে নিজ শহরের সুনাম গেয়ে চলেছে। বর্ষন একধ্যানে তাপৌষিকে দেখছে। টিয়া রঙের একটা প্লাজু, কমলা কলার ওয়ালা হাফ হাতা জামা আর টিয়া কালারের সুতির ওড়না গায়ে। মেয়েটাকে ভারী মিষ্টি লাগছে। চেহারায় কেমন যেন পবিত্রতার ছাপ। নিজ আবাসভূমির ব্যাখ্যা দেওয়ার সময় ওর চোখে মুখে একরাশ খুশি ঝিলিক দিচ্ছে।
-‘ আপনি কখনো রাজশাহী গিয়েছেন?’
-‘ হুম গিয়েছিলাম তো। সত্যি খুব সুন্দর শহর। ঠিক তোমার মতো।’
তাপৌষি বর্ষণের দিকে ঘুরে তাকালো। ও কী ভুল শুনলো। বর্ষণ ওকে এইমাত্র সুন্দর বলল তাইনা?
-‘ জি কী বললেন?’
বর্ষণ বুঝতে পেরেছে ও ভুল কিছু বলে ফেলেছে। তাপৌষির থেকে দূরে না থেকে ও আরও এখানে দাঁড়িয়ে তাপৌষির রূপের প্রশংসা করছে। পালাতে হবে দ্রুত।
-‘ কী বলেছি? কিছুই বলিনি। তুমি এক ডিগ্রী বেশি শুনো।খাওয়া তো শেষ। এবার খালি কাপ নিয়ে বসে থাকবা নাকি? দাও কাপ দাও।’ বলে বর্ষন তাপৌষির হাতের কাপটা নিয়ে নিল।
তাপৌষি অবাকের চূড়ান্ত সীমানায়। লোকটার মাঝে মাঝে কী হয়। এইতো ভালো মতো কথা বলছিল। এখন আবার কী হল?
.
.
চলবে…