‘রাহাত ভাই বিয়েটা আপনাকে করতেই হবে? বিয়েটা ভেঙে দেন রাহাত ভাই।আমি যে আপনাকে বড্ড ভালোবাসি।সেই আমি কীভাবে আপনাকে আমার আপুর সাথে সহ্য করবো?’-নীলার কথায় ফিরে তাকাল রাহাত।হাতের সিগারেটায় শেষ টান দিয়ে নিচে ফেলে পা দিয়ে পিষলো।তারপর দু’হাত বুকে গুঁজে তাচ্ছিল্য হেসে বলল
-‘তুই আমাকে ভালোবাসিস সেটা একান্তই তোর সমস্যা আমি তাতে কী করবো?’
-‘আপনাকে কিছুই করতে হবে না। আপনি শুধু বাসার মানুষকে বলবেন আপনি বিয়েটা করবেন না।’
রাহাত এবার শব্দ করে হেসে উঠলো। জেনো সে বেশ মজার কথা শুনে ফেলেছে।হাসতে হাসতেই বলল
-‘ছিঃ নীলা তুই যে এত স্বার্থপর আমি ভাবতেও পারি নি।দেখছিস বিয়েটার জন্য বাসার মানুষ কি খুশি আর তুই সেই বিয়ে ভেঙে দিতে বলছিস।নিজের স্বার্থ টাই দেখলি খালি?’
নীলা এবার হাঁটু গেঁড়ে বসে কেঁদে দিলো।তার নিজেকে দিশাহারা লাগছে।রাহাত তার চাচাতো ভাই। যাকে সে ছোটবেলা থেকে ভালোবেসে আসছে।কিন্তু রাহাত কখনোই নীলাকে ভালোবাসো নি।সবসময়ই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে কারণ একটাই, নীলা কালো।
নীলাকে কাঁদতে দেখে রাহাতের বেশ মজাই লাগছে।সে কোনো এক অদৃশ্য কারণে নীলাকে পছন্দ করে না।কারণটা ঠিক অদৃশ্য বললে ভুল হবে আসলে নীলার গায়ের রংটার জন্যই সে নীলাকে পছন্দ করে না।যেখানে সে ধবধবে ফর্সা সেখানে নীলা কালো।একবারে কালো অবশ্য নয় তবে রাহাতের তুলনায় কালো।তবে নীলার চেহারা আলাদা সুন্দর সেটা রাহাতও মানে। হাসলে বা’পাশের গালে দুইটা টোল পড়ে।মুখটা গোলগাল।তবুও রাহাতের এই মেয়েটাকে পছন্দ না।আর হয়তো নীলা তাকে অতিরিক্ত ভালোবাসে বলেই এত অবহেলা পায়।কথায় আছে না “কোনো মানুষকে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ভালোবাসলে তার বিপরীতে অবহেলা পেতেই হয়” নীলাও নিয়মের বিপরীতে নয়।তাই হয়তো অবহেলা পাচ্ছে।
নীলার কান্না রাহাতকে স্পর্শ করতে পারে নি।সে সুন্দর চুলে হাত বুলাতে বুলাতে ছাদ থেকে নেমে গেলো। নীলার জেনো কষ্ট আকাশ ছুঁয়েছে। ছোট বেলা থেকে যে মানুষটাকে এত ভালোবেসে এসেছে সেই মানুষটা আজ অন্য কারো হবে।আর সেই অন্য কেউ হলো তারই আপন বোন।এখানে তার পরিবার বা বোনের কোনো দোষ নেই কারণ নীলার ভালোবাসার কথাটা নীলা,রাহাত আর তার বন্ধু বান্ধব বাদে কেউ ই জানেনা।
রঙহীন বিবর্ণ রাত্রি আর বিবর্ণ নীলাম্বরীর কান্না মিশে গেছে বাতাসের সাথে। একটা অসহায় মেয়ে যে ভালোবাসার কাঙালি,একটু প্রিয় মানুষটার ভালোবাসার জন্য কি হাহাকার তার বুকে। কেউ দেখছে না সেই হাহাকার।শুধু সাক্ষী সে নিজে আর এই কালরাত।
__________
‘কিরে নীলা তোর চোখ মুখ এমন ফুলে আছে কেনো?’- নিজের মায়ের কথায় বুকটা ছ্যাত করে উঠে নীলার।তবে কি কাল সারা রাত সে কান্না করেছে এটা সবাই বুঝে যাবে।খাবার টেবিলের সবাই এবার নীলার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। নীলা সবার দিকে তাকিয়ে আমতাআমতা করে বলল
-‘আসলে আম্মু রাতে ঠিক মতন ঘুম হয় নি তো তাই হয়তো ফুলে গেছে।’
আজিজুর রহমান মানে নীলার বাবা বা’হাতে নীলার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
-‘কেনো ঘুম হয় নি মা?তুমি কি কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তত?’
বাবার আদুরে কথায় জেনো নীলার কান্না আহ্লাদ পেয়ে বসলো।বাঁধ ভেঙে চলে আসবে মনে হয়। নীলা দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে কোনো মতে মাথা নাড়িয়ে “না” জানালো।কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না।চোখের জল কি আর সময় বুঝে,তার যখন ঝরার ইচ্ছে হয় সে তখনই ঝরে যায়। নীলার চোখের জলও নীলার শাসন শুনে নি।বাঁধ ভেঙে ঝরে পড়ল।
নীলাকে কাঁদতে দেখে উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে গেলো। নীলার বাবা তাড়াতাড়ি খাবার পাত থেকে উঠে নীলাকে জড়িয়ে ধরল।আর ব্যতিব্যস্ত সুরে বলল
-‘আম্মা কি হয়েছে কান্না কেনো করছো? কেউ কিছু বলেছে তোমাকে? কে কী বলেছে আমায় বল আম্মা। তুমি কান্না করো না তুমি কান্না করলে আমার খারাপ লাগে জানো না।’
নীলা জেনো এবার চেয়েও নিজেকে চুপ করাতে পারছে না।নীলার চাচা মানে রাহাতের আব্বুও নীলার মাথা বুলিয়ে দিচ্ছে।নীলার আম্মু পানি এনে দিছে।রাহাতের মা মানে নীলার চাচীও নীলার চোখের পানি মুছিয়ে দিচ্ছে।একমাত্র রাহাত নির্জীব। তার কোনো হেলদোল নেই।নীলার কান্নার কারণ জানারও ইচ্ছে নেই। কারণ সে জানে নীলা কেনো কান্না করছে।
বেশ কিছু সময় পর নীলা নিজেকে শান্ত করলো।হেঁচকি থামিয়ে বলল
-“বাবা আসলে আজ আমাকে চলে যেতে হবে। কাল থেকে প্রেক্টিক্যাল পরীক্ষা। তোমাদের ছেড়ে যেতে কষ্ট লাগছে।’
এতক্ষণে নীলার কান্নার কারণ জেনে সবাই শান্ত হলো।নীলার বাবা মেয়ের মাথায় বিলি কেটে বলল
-‘এজন্য আমার বোকা মেয়েটা কান্না করছে? আরে সমস্যা নেই।তুমি আবার পরীক্ষার পর আসবে।তোমার খালামনির বাসায় তো তোমাকে বেশ আদরযত্ন করে তখন তো আমাদেরই ভুলে যাও।এখন বোকার মতন কান্না করছো।’
নীলার ততক্ষণে কান্না থেমে গেছে।নীলার মা শান্ত কন্ঠে বলল
-‘তোর না সেমিস্টার শেষ হলো ক’দিন আগে।আবার কিসের প্রেক্টিক্যাল।’
নীলা জেনো এবার অথৈ সাগরে পড়লো।কোনো মতে মিথ্যা কথা তো বলে ফেলল এখন কী বলবে।নীলার ভাবনার মাঝে নীলার বাবা আজিজুর রহমান গম্ভীর কন্ঠে তার স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলল
-‘সেমিস্টার আর প্র্যাক্টিক্যালের সম্পর্ক কি?সেমিস্টার হয়ে গেছে শেষ।এজন্য কি প্র্যাক্টিক্যাল হতে পারবে না? অদ্ভুত কথা বার্তা।’
নীলা জেনো বাবার কথায় স্বস্তি পেলো।নীলার বাবা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল
-‘আজ বিকেলে আম্মু তোমাকে গাড়িতে উঠাই দিবো কেমন? এখন খাও।’
নীলা চোখের জল মুছে মাথা নাড়িয়ে খাবারে মনোযোগ দেয় কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে।কাকে ভালোবাসলো সে! মানুষটা এত পাষাণ। তার কান্না সবাইকে টলাতে পারলেও ঐ মানুষটাকে টলাতে পারলো না।কোনো মতে খাবার শেষ করে নীলা ঘরে চলে গেলো।নীলার বড় বোন নিরুপমা মানে নিরু সবটাই খেয়াল করেছে।
__________
‘নীলা ভিতরে আসলাম’-কথাটা বলেই রুমের ভিতরে ঢুকে গেলো রাহাত।
নীলা তখন রেডি হচ্ছে চলে যাওয়ার জন্য। নীলা ঢাকা থাকে ওর খালামনির বাসায়।সেখানে থেকেই পড়াশোনা করে।আর ওদের বাড়ি হলো খুলনা।ওর জন্মস্থান।
রাহাত নীলার খাটে এসে গলা পরিষ্কার করে খোঁচা মেরে বলল
-‘বাহ্ ভালোই হয়েছে চলে যাচ্ছিস।তোর এই অন্ধকার রং দেখলে আমার সারাদিন আঁধার কাটে।’
নীলার মনে হচ্ছে তার শরীরে কেউ ছুঁড়ির আঘাত করছে।টিকে থাকা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবুও সে শক্ত হয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে ওড়না ঠিক করছে। নীলার নীরবতা রাহাতের ভালো লাগছে না।সে নীলাকে কান্না করাতে চাচ্ছে।নীলাকে কষ্ট দিতে তার বেশ লাগে।
নীলার কোনো উত্তর না পেয়ে রাহাত আবার বলল
-‘তুই খাবার টেবিলে নাটক টা কেনো করলি নীলা?’
নীলা এবার আর চুপ থাকতে পারে নি।কষ্টটা চাপা দিয়ে বলল
-‘রাহাত ভাই ওটা আপনার কাছে নাটক ই মনে হবে কারণ আপনি আজও অনুভূতির মূল্য দিতে শিখেন নি।তবে মনে রাখবেন রাহাত ভাই যেদিন মূল্য দিতে শিখবেন সেদিন জেনো খুব দেড়ি না হয়ে যায়।’
নীলার কথার ধরন রাহাতের কাছে কেমন জেনো লাগল।রাহাত ভেবেছিলো নীলা আবারও কতক্ষণ ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদবে তার কাছে ভালোবাসা ভিক্ষা চাইবে কিন্তু এমন কিছুই হলো না।রাহাতের রাগ উঠে গেলো।সে বসা থেকে উঠে রাগী স্বরে বলল
-‘এই এই তুই আমাকে কি অভিশাপ দিচ্ছিস নাকি?’
নীলা তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে বলল
-‘অভিশাপ দিলাম না সাবধান করলাম।’
রাহত নীলার কথা গুলো সহ্য করতে পারছে না।তেড়ে গিয়ে কিছু বলবে তার আগেই নিরুপমা হাজির হয়। এসেই খাটে বসে হেসে বলল
-‘কি কথা হচ্ছে দুজনের মাঝে হুম? আমাকেও বল।’
রাহাত “কিছু না” বলে চলে গেলো।
নীলা চুপ হয়ে যায়। কেন জানি অকারণেই তার বোনের উপর রাগ উঠছে সেই রাগ থেকেই বলে ফেলল
-‘কেনো আপু রাহাত ভাইয়া তো আমার চাচাতো ভাই তাকে কি আমি কিছু বলতেও পারবো না আলাদা।তোমার হবু হাসবেন্ড বলে কি সব তোমাকেও বলতে হবে?’
নীলার উত্তর টা ভালো লাগে নি নিরুপমার।তবুও সে যথেষ্ট হাসি হাসি মুখ করে বলল
-‘না নীলা তেমন কিছুই না।আমি তো এমনেই জিজ্ঞেস করেছি।তুই কি আমার উপর রাগ কোনো কারণে?’
নীলা বুঝে ফেলে সে রাগের মাথায় ভুল বলে ফেলেছে।তাই চুপ হয়ে যায়। বাহির থেকে আজিজুর রহমান নীলাকে তাড়াতাড়ি বের হওয়ার জন্য ডাকছে।নীলা ব্যাগ নিয়ে দরজা অব্দি গিয়ে ফিরে তাকালো বোনের দিকে তারপর বলল
-‘আপু তুমি জীবনে কিছু না পেলেও তুমি ভাগ্যবতী কারণ জানো? কারণ সব থেকে বড় প্রাপ্তি শরীর ফর্সা রঙ যেটা তোমার আছে।তাই তুমি না চাইতেও অনেক পেয়ে ফেলেছো।’
নিরুপমা বোনের কথা বুঝে উঠার আগেই নীলা প্রস্থান নিলো।তাকে তো অনেকটা পথ যেতে হবে একা একা।
উত্তপ্ত সূর্যের তেজ এখন নরম।নীলা আর তার বাবা দাঁড়িয়ে আছে ট্রেণ স্টেশন। নীলাকে ট্রেনে তুলে দিতে এসেছে তার বাবা।নীলার ঠেলে কান্না আসছে কিন্তু সে কাঁদবে না।বাবার সামনে আর কিছুই প্রকাশ করবে না কারণ তার বাবা অনেক চতুর।বুঝে যাবে।
নীলার ট্রেনের সময় হয়েছে।নীলার বাবা নীলাকে ট্রেনে বসিয়ে দিলো।নামার সময় নীলার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
-‘আম্মু ভালো ভাবে থেকো।নিজের খেয়াল রেখো।যাই হোক মন খারাপ করবে না।আর কখনো সমস্যা থেকে পালাবে না বরং সমাধান করবে।আর শুনো যে যাওয়ার সে যাবে তাকে আকড়ে ধরেও লাভ নেই তাই যে আছে তাকে আঁকড়ে ধরো জেনো দিন শেষে জয়ের হাসি হাসতে পারো।’
নীলা হঠাৎ বাবার এই কথার মানে বুঝতে পারে নি।তবে সে বাবার কথায় কিছুটা মনোবল পেয়েছে। নীলার বাবা নেমে যাওয়ার সময় বলল
-‘তোমার খালু তোমাকে নিতে আসবে।সাবধানে যেও।’
নীলা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানাল।আজিজুর রহমান নেমে গেলো আর নীলা ডুকরে কেঁদে উঠলো।ট্রেণ ছোটা শুরু করলো।নীলা খেয়াল করে নি তার বাবা তার কান্না করার দৃশ্যটি দেখেছে আর মনে মনে বলেছে
-‘আমি জানি তোমার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষা নেই আম্মু কিন্তু জীবন অনেক বড় পরীক্ষা নিচ্ছে,কী পরীক্ষা সেটা জানিনা তবে সবসময়ই তুমি জয়ী হও সেই দোয়া করি।ছেলেমেয়ে যতই বড় হোক বাবা মায়ের কাছে তারা বাচ্চাটিই থাকে।তাদের উপর কিংবা ভিতর সব যন্ত্রণা বাবা মা বুঝে সেটা যতই লুকানোর চেষ্টা করো না কেনো।ট্রেন এগিয়ে যাচ্ছে সাথে তুমিও এগিয়ে যাও মা।পিছুটান তোমার জন্য নয়।’
বিবর্ণ নীলাম্বরী এগিয়ে যাচ্ছে একটু শান্তির টানে।কি মোড় নিবে তার জীবনে?
চলবে,,,
#সূচনা_পর্ব
#বিবর্ণ_নীলাম্বরী
#মম_সাহা