বিবর্ণ নীলাম্বরী পর্ব -০২

#বিবর্ণ_নীলাম্বরী
#মম_সাহা

পর্বঃ দ্বিতীয়

আধাঁর রজনী। ট্রেন কমলাপুর স্টেশন এসে পৌঁছেছে আরো আধাঘন্টা আগে।নীলা বসে আছে একটা বেঞ্চিতে।আধাঘন্টা হলো সে এক ধ্যানে বসে আছে।এখনো খালামনির বাসার কেউ স্টেশন এসে পৌঁছায় নি।বাবা তো বলে ছিলো খালু নিতে আসবে কিন্তু এখনো কারো দেখা নেই।তার ফোনেও চার্জ নেই যে যোগাযোগ করবে।আর সত্যি বলতে তার এই নিরিবিলি প্লান্ট ফর্মে বসে থাকতে খারাপ লাগছে না বরং ভালো লাগছে। অবশ্য যার ভিতরটা শূণ্যতায় ভরে গেছে তার তো শূণ্যতাই পছন্দ হবে।

‘তোমার কি সামান্য কমন সেন্স নেই নীলাম্বরী?এখানে এক কোণে চুপ করে বসে আছো আর তোমাকে আমি আধাঘন্টা যাবত পুরো স্টেশন খুঁজেছি। ড্যাম ইট।’-একটা রাগী পুরুষ নালী কণ্ঠে ফিরে তাকায় নীলা।ঠিক তার পিছে দাঁড়িয়ে আছে তার খালাতো ভাই শুভ্রম।

নীলা শুভ্রমকে দেখে তেমন প্রতিক্রিয়া জানালো না।সে ধীরে উঠে লাগেজ টা হাতে নিয়ে শান্ত স্বরে বলল
-‘আমার ফোনে চার্জ ছিলো না।’

নীলার শান্ত স্বরের কথাটাই থামিয়ে দিলো শুভ্রমকে।কারণ নীলা কখনোই তার সাথে এত শান্ত স্বরে কথা বলে না।নিশ্চয়ই নীলার সাথে এমন কিছু হয়েছে যেটা নীলা মানতে পারে নি।যখন নীলার বাবা ফোন করে কাল কোনো পরীক্ষা আছে কি না জানতে চেয়েছে তখনই শুভ্রমের সন্দেহ হয়েছিলো।তাই তো নিজে এসেছে নীলাকে নিতে।শুভ্রম আর কিছু না বলে লাগেজ টা নিজের হাতে নিয়ে গাড়ির দিকে হাঁটা দেয়।

গাড়ি চলছে আপন গতিতে।নীলা নিশ্চুপ,নির্বাক।আশেপাশের কিছুই তার মাথায় আসছে না।আসলে সে ধাক্কাটা মানতে পারে নি।সেমিস্টার শেষ হয়েছে কয়েকদিন হলো।তারপর ভার্সিটি বন্ধ করে দিলো।ভেবেছিলো নিজের বাড়ি থেকে ঘুরে আসবে।কিন্তু বাড়ি গিয়ে এমন কিছু শুনতে হবে সে ভাবতেও পারে নি।তারই ভালোবাসার মানুষটার সাথে তার আপন বোনের বিয়ে। এই ধাক্কাটাই জেনো নীলাকে চুপ করিয়ে দিতে যথেষ্ট ছিলো। মানুষটার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কি না করেছে।কত পা ধরে ভিক্ষা চাইলো কিন্তু তবুও মানুষটার মন গললো না।

শুভ্রম গাড়ি চালাচ্ছে আর নিরব চোখে নীলাকে দেখছে।আর ভাবছে বাড়িতে গেলো কি নীলা আর ফিরে আসলো কি নীলা।

দুজনেরই ভাবনার মাঝে শুভ্রমের ফোনটা বেজে উঠলো। নীলা আড়চোখে তাকিয়ে আবার নিজের মতন চুপ করে বসে রইল।শুভ্রম ফোনটা রিসিভ করে নীলার দিকে এগিয়ে দিলো।নীলা প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকালে শুভ্রম চোখ দিয়ে বুঝিয়ে দেয় নীলার বাবা।নীলা দ্রুত ফোনটা কানে ধরেই বলল
-‘সরি বাবা আমার ফোনে চার্জ শেষ তাই তোমাকে জানাতে পারি নি আমার পৌঁছানোর খবর।’

আজিজুর রহমান মুচকি হাসে মেয়ের কথা শুনে। এ হাসি নীলা অব্দি পৌঁছায় নি।নীলা বাবার প্রতিউত্তর না পেয়ে আবার বলল
-‘বাবা আ’ম রিয়েলি সরি।আমার ফোনে চার্জ থাকলে আমি সত্যিই জানাতাম তোমায়।’

আজিজুর রহমান শান্ত স্বরে বলল
-‘তুমি স্টেশনে পৌঁছে গেছো সাড়ে দশটা বাজে।তোমাকে আধাঘন্টা শুভ্রম খোঁজার পর ঠিক এগারোটায় খুঁজে পেয়েছে।আর এখন বাজে এগারোটা আটচল্লিশ। মানে শুভ্রমের সাথে তোমার দেখা হয়েছে ঠিক আটচল্লিশ মিনিট হয়েছে, তোমার ফোনের চার্জ ছিলো না আম্মু আমি মানলাম কিন্তু শুভ্রমের ফোনের চার্জের খবরটা তো নিতে পারতে মা।’

বাবার কথায় বেশ লজ্জিত বোধ করল নীলা।শুভ্রমের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল শুভ্রম কিছু শুনেছে কি না।শুভ্রম আপন মনে গাড়ি চালাচ্ছে।নীলা ফোনটা আবার কানে দিয়ে বলল
-‘আসলে বাবা সরি আমি এতটা খেয়াল করি নি।’

আজিজুর রজমান এবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।তারপর আদুরে কন্ঠে বললেন
-‘মা এই ছন্নছাড়া জীবন তোমার জন্য না।এই নিস্তব্ধতা, নিরবতা,নিষ্প্রাণতা তোমার জন্য না আম্মু।এই নিস্তব্ধতা রাতকে মানায়, নিরবতা গাছকে মানায়,নিষ্প্রাণতা মানায় মরা নদীকে।তোমার জন্য তো চঞ্চলতা, তোমার জন্য হলো খিলখিল হাসি।তোমার জন্য যেগুলো সেগুলোর মাঝেই তুমি থাকো আম্মু কারণ আমরা তোমায় ওভাবেই দেখে সন্তুষ্ট।আমি জানিনা আম্মু তোমার কি হয়েছে।আমি জানতে চাইও না।কারণ হয়তো এমন কিছুই হয়েছে যা তুমি আমাদের বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছো না।আর ছেলেমেয়ে যখন বড় হয় তখন তাদেরও কিছু ব্যাক্তিগত জিনিস থাকে।ওটা বাবা মায়ের জানাও দরকার না।বাবা মা এতটুকু জানে তার সন্তান জেনো সবসময় খুশি থাকে।তুমি কি বাবা মায়ের সেই ইচ্ছে টা রাখবে না আম্মু।’

বাবার এমন আহ্লাদী কন্ঠে নীলা নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না।আবারও বোকার মতন কেঁদে দিলো।কাঁদতে কাঁদতেই বলল
-‘আমি অনেক ভালোবাসি তোমাদের বাবা।আর কখনোই কষ্ট দিবো না তোমাদের।’

নীলার কান্না আজিজুর রহমানকে ভেঙে দিচ্ছে।তবুও সে শান্ত কন্ঠে বলল
-‘আবারও কান্না করছো কেনো আম্মু? জল শুধু মেঘের থেকে ঝরলেই মানায়। তোমার চোখে তো মানায় মায়া। চুপ করো আম্মা।আর শুভ্রমকে মোবাইলটা দেও।’

নীলা হ্যাঁ বলে শুভ্রমের দিকে মোবাইলটা বাড়িয়ে দিলো।নীলার কান্না দেখে শুভ্রম অনেক আগেই গাড়ি থামিয়ে দিয়েছিলো।সে কতক্ষণ আজিজুর রহমানের সাথে কথা বলে ফোনটা কেটে দিলো।

নীলা ততক্ষণে কান্না থামিয়ে দিয়েছে।শুভ্রম ফোন কেটেই নীলার দিকে তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলল
-‘এমন ছিঁচ কাঁদুনে স্বভাব কবে থেকে হলো তোমার নীলাম্বরী?’

নীলা শুভ্রমের ঠেস মারা কথাতেও রাগে না।শান্ত স্বরে উত্তর দেয়
-‘আমার চোখের জল কেবল নাটক আর ঠাট্টা হয়েই রয়ে গেলো।মূল্য আর পেলো না।’

নীলার ঠান্ডা এবং তীক্ষ্ণ কথায় চুপ করে যায় শুভ্রম। সে বুঝে যায় নীলার সাথে এখন এগুলো বলে লাভ নেই।

________

‘কিরে এতক্ষণ লাগলো যে বাড়ি আসতে?’-শুভ্রম আর নীলাকে বাড়িতে ঢুকতে দেখেই শুভ্রমের মা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।শুভ্রম সোফায় বসতে বসতে উত্তর দেয়
-‘তোমার বোনের মেয়েকে খুঁজতে আমার ঠিক আধাঘন্টার মতন সময় লেগেছে।দেড়ি হবে না!’

শুভ্রমের মা রেহানা নীলার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওর ব্যাগটা নিজের হাতে নিয়ে বলল
-‘কিরে মা আধাঘন্টা লেগেছে কেনো?’

নীলা জোড় করে হাসি হাসি মুখ করে বলল
-‘আসলে খালামনি আমি যেখানে ছিলাম সেখানে উনি আসেন নি।তাই আমাকে খুঁজতে খুঁজতে তার আধাঘন্টা লেগে গেছে।

নীলার কথা তার খালামণি বুঝতে পেরে বলল
-‘আচ্ছা যাক ভালো ভালোই তুই চলে এসেছিস সেটাই অনেক।তোরে ছাড়া বাড়িটাও কেমন নিষ্প্রাণ লাগে।মৌ তো জানিসই সারাদিন পড়াশোনা করে আর দিয়া ও রাজ তো সারাদিন ভার্সিটি আর আড্ডা।আমি আর তোর চাচী একা বাসায় পরে যাই।এখন যা তো মা ফ্রেশ হয়ে আয়।তোদের খেতে দেই।’

নীলার খাবারের প্রতি একদম রুচি নেই।সে ক্লান্ত কন্ঠে বলল
-‘না খালামনি আমার খিদে নেই।আমি ট্রেনে খেয়েছি।আমার এখন ঘুম দরকার।আমি ঘুমাবো।’

এতক্ষণ শুভ্রম চুপ করে থাকলেও এখন আর চুপ করে থাকতে পারে নি।এমন নীলাকে কেউ আশা করে নি।নীলার সাথে মানায় চঞ্চলতা আর সে কিনা চুপচাপ থাকার শপথ নিয়েছে।

শুভ্রম উঠে দাঁড়িয়ে নিজের মায়ের কাছে এসে দু’জনেরই খাবার বাড়তে বলল আর নীলার কাছে এসে ফিসফিস কন্ঠে বলল
-‘এখন চুপচাপ খাবে তুমি আর যদি না খাও তবে সারা রাস্তা যে ট্রেন দিয়ে আসার সময় কান্না করতে করতে ভাসিয়েছো, চোখমুখ ফুলিয়েছো সেটা তোমার বাসার মানুষকে বলবো।তোমার বাবাকে এও বলবো যে তোমার কোনো প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষা নেই।’

নীলা অবাকে হতবাক।তার প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষা আর কান্নার কথা শুভ্রম কীভাবে জানলো। নীলাকে ভাবতে দেখে শুভ্রম বলল
-‘অত ভেবে কাজ নেই নীলাম্বরী। তুমি কোনো উত্তর পাবে না।তবে যতটুকু করতে বললাম ততটুকুই করো।আমি ফ্রেশ হয়ে এসে জেনো তোমাকে টেবিলে পাই।’

এই সময়ে এমন কাহিনী নীলার সহ্য হচ্ছে না।তবুও সে নিরুপায়। গটগট পায়ে চলে যায় রুমের দিকে। শুভ্রম হেসে ফেলে।পরক্ষণেই আবার এটা ভেবে অবাক হয় যে এই মেয়েটার জন্য সে এত কেনো ভাবছে।

_______
রাত পুরোটা কেটেছে নীলার নির্ঘুম।এই তিনদিনে সে বেশ শুকিয়ে গেছে।চোখের নিচে কালি পড়েছে।নিজেকে আয়নায় দেখে নীলা নিজেই তাচ্ছিল্য হাসে।নিজেই নিজের মনে মনে বলে ‘এমন একটা রূপহীন মেয়েকে কোনো ছেলেই চাইবে না সেটাই স্বাভাবিক। তবে আমার কষ্ট কেনো হচ্ছে।’

পরক্ষণেই তার মন বিদ্রোহী ঘোষণা করে বলে ‘উপরওয়ালার সৃষ্টি প্রত্যেক টা মানুষই সুন্দর।সেই সূত্রে আমিও সুন্দর। কারো কোনো অধিকার নেই আমার রূপ নিয়ে মজা করার।’

নিজের মনে দুই রকমের দ্বন্দে কেঁদে দেয় নীলা।ঐ মানুষটাকে ভালোবাসার পর থেকে নীলা কেঁদেই আসলো।কিন্তু সবসময়ই সবার সামনে নিজেকে খুশি দেখানোর চেষ্টা করতো।নীলা জানতো তার ভালোবাসা এক পাক্ষিক যার পরিণাম শুভ না।তবে আজ সেটা মানতে পারছে না।

চারদিকে আধাঁর ছেয়ে আলো এসেছে।ভোর হয়ে গেছে যে।আজানের শব্দে মুখোরিত সকাল।নীলার শরীর বড্ড ক্লান্ত।তার একটু স্নিগ্ধতা দরকার।সে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসলো।এসেই নামাজে দাঁড়ালো।উপরওয়ালার দরজায় তুলে দিলো সকল অভিযোগ। সাথে প্রার্থণা করলো তার প্রিয়জন জেনো সুখী হোক।

নীলার কান্না উপরওয়ালাকে কতটুকু টলিয়েছে জানা নেই।তবে রুমের বাহিরে থাকা মানুষ টাকে বেশ অবাক করেছে নীলার করুণ আকুতি।

এই ভোরে নীলার সাথে জড়িত আরও দুটি প্রাণও আল্লাহর দরজায় কড়া নেড়েছে। একজন চেয়েছে তার সন্তানের সুখ, আরেকজন চেয়েছে,,,,থাক ওটা নাহয় আড়ালেই রইল।

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here