বিবর্ণ নীলাম্বরী পর্ব -০৩

#বিবর্ণ_নীলাম্বরী
#মম_সাহা
#পর্ব: তৃতীয়

নীলা ঢাকা এসেছে আজ চারদিন হতে চলল।সে ঘর থেকে তেমন বের হয় না,কারো সাথে মিশে না কেমন নির্জীব হয়ে থাকে।নীলার নিরবতা চোখ এড়ায় না করো।তার খালামনি এসে মাঝে মাঝে কথা বলে যায়। খালামনির জা মানে শুভ্রমের চাচীও কথাবার্তা বলে যায়। নীলা শুধু পুতুলের ন্যায় সব কথা শুনে যায়। মাঝে মধ্যে হু হা উত্তর দেয়।

নিরবতা নীলার বৈশিষ্ট্য না।তাই তার খালামনির বাড়ির সবাই বেশ চিন্তিত।দিনের বেশিরভাগ সময় নীলা রুমের দরজা বন্ধ করে রাখে। ভার্সিটিতে ও যায় নি এ কয়দিন।শুভ্রমের বোন মৌ সারাদিন পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকে কারো সাথে কথা বলে না।তবে সে নীলাকে বেশ পছন্দ করতো নীলার বকবক ছটপটে রূপটার জন্য। সেই ছটপট নীলাকে চুপচাপ দেখতে তারও ভালো লাগে না তাই মাঝে মাঝে সেও এখন নীলার ঘরে এসে নিজে থেকে কথা বলে।

নীলাকে খালামনির বাড়ির তিনজন পছন্দ করে না।তারা হলো শুভ্রমের আপন মেজো বোন সোহা যার বিয়ে হয়েছে বছর খানিক হলো আর শুভ্রমের চাচাতো ভাই বোন দিয়া আর রাজ।

নীলা দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। এখন ধরণীতে আধাঁর করে সন্ধ্যা নেমেছে।সন্ধ্যা নেমেছে নীলার মনেও।সারাটা দিন কোনো মতে কাটালেও সন্ধ্যার পর তার একাকিত্ব টা বেড়ে যায়। এত বড় পৃথিবীতে এত কোটি মানুষ থাকা স্বত্তেও সে একা হয়ে যায়। একা তো হওয়ারই কথা। আমরা যাকে নিজের সবটা ভাবি সে আমাদের না হলে সবটা তো খালি হয়ে যায়। আর প্রিয় মানুষের শূণ্য স্থানটা প্রিয় মানুষ ব্যাতিত কেউ ই তো পূর্ণ করতে পারে না সে যতই কোটি কোটি মানুষ আশেপাশে থাক না কেনো।

নীলার মনে পরে অতীত। সে রাহাতকে ভালোবাসে সেই ছোট বেলা থেকে কিন্তু কখনোই রাহাতের সামনে সেটা প্রকাশ করে নি বা প্রকাশ করতে চায়ও নি।কারণ সে জানতো রাহাত কখনোই তাকে মানবে না।সে ভেবেছিলো তার একপাক্ষিক ভালোবাসা নিজের মধ্যে লুকায়িত থাকবে।কারণ যদি একপাক্ষিক ভালোবাসা একবার প্রকাশ করা হয়ে যায় তাহলে না চাইতেও বিপরীত পক্ষের মানুষটা অবহেলা করবেই।কিন্তু একদিন রাহাত যা কান্ড করলো তাকে বাধ্য হয়েই প্রকাশ করতে হলো।রাহাত যে তার সাথে এমন খেলা খেলবে ভাবতে পারে নি সে।

‘নীলাম্বরী আসবো?’ একটা ছেলে কন্ঠে ফিরে তাকালো নীলা।অতীতের গভীরে আর যেতে পারলো না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে অতি গোপনে চোখের জল টা মুছে নিলো।সে জানে কে এসেছে। কারণ এই নাম ধরে শুধু একজনই ডাকে।

নীলা বারান্দা থেকে রুমে আসলো।এসে দেখে এখনও শুভ্রম দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে।মনে মনে হাসে নীলা।লোকটা বড্ড ডিসেন্ট। এখনো অনুমতি দেয় নি বলে রুমের ভিতর অব্ধি আসে নি।

নীলা শুভ্রমকে ভিতরে আসতে বলে ওয়াশরুমে চলে গেলো।

অন্যদিকে কেউ একজন রাস্তায় দাঁড়িয়ে নীলার অন্যমনস্ক হয়ে চোখের জল ঝড়ানোর দৃষ্টিটি দেখেছে।তার খারাপ লাগছে এই বিবর্ণ নীলাম্বরীর জন্য। মেয়েটা তো একটু ভালোবাসাই চেয়েছিলো।আগন্তুক এবার একটা বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে কাউকে কল দেয়।অপর পাশে ফোন রিসিভ করতেই আগন্তুক বলে উঠে

-‘নীলাকে এত কষ্ট কেনো দিচ্ছো?মেয়েটা ভেঙ্গে পড়েছে অনেক।’

অপরপাশ থেকে কেউ দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিলো
-‘এই ভালোবাসা নীলাকে আজীবন কষ্টই দিয়ে যেতো।আজীবন কষ্ট পাওয়ার থেকে একবার বেশিই কষ্ট পাক তবুও ওর ভিত্তি মজবুত হোক।শক্ত ভাবে বেড়ে উঠুক ওর শিকড়।’

আগন্তুক নিরাশার শ্বাস ফেলে বলল
-‘এই কাজটার জন্য নীলা তোমাকে অপছন্দ করবে।ধীরে ধীরে ওর রাগ হবে তোমার উপর।তাও এমন করবে?’

অপরপাশের মানুষটা মুচকি হেসে বলল
-‘এখন খারাপ হবো কিন্তু যখন সে বুঝবে আমার একাজ ওরে একটা নতুন জীবন দিচ্ছে তখন সব থেকে বেশি ভালোবাসবেও আমায়।’

আগন্তুক ফোনটা কেটে রুমে চলে যায়।

নীলা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো শুভ্রম কারো সাথে কথা বলছে।নীলাকে দেখে ফোনটা কেটে দিলো।

শুভ্রম নীলাকে দেখে গলা পরিষ্কার করে বলল
-‘তুমি ভার্সিটিতে যাচ্ছো না কেনো?’

নীলা জেনো জানতো তার সামনে থাকা গম্ভীর লোকটা এই প্রশ্নই করবে।নীলা একটু সময় নিয়ে উত্তর দিলো
-‘আমি কয়েকদিন বাসায় থাকতে চাচ্ছি।’

নীলার উত্তর শুভ্রমের পছন্দ হয় নি।এমনেতেই নীলার এমন চুপচাপ দশা কারোই ভালো লাগছে না। যদি সে মিশে সবার সাথে একটু বাহিরে যায় তাহলে তো ওর মন টাও ভালো লাগবে।

শুভ্রম বেশ গম্ভীর কন্ঠে বলল
-‘দেখো নীলাম্বরী আমি যা বলি সোজাসাপ্টা বলি।তোমার এমন আচরণ আমাদের পরিবারের কেউ মানতে পারছে না।এমন হতো তুমি আগে থেকেই চুপচাপ তাহলে একটা কথা ছিলো কিন্তু তোমার হঠাৎ করে চুপচাপ হওয়া টা কারোই বোধগম্য হচ্ছে না।তোমার কি হয়েছে না হয়েছে সেটা একান্তই তোমার ব্যাক্তিগত ব্যাপার।আমি শুধু একটা কথাই বলতে চাই তুমি যদি এমন দিশাহারা চলাচল করো তাহলে আমি তোমার বাবাকে জানাতে বাধ্য হবো।পড়াশোনার জন্য তোমাকে এখানে পাঠিয়েছে যদি তুমি সেটা না ই করো তাহলে চলে যাবে নিজের বাড়ি।থেকে তো লাভ নেই।আর ভার্সিটির একটা নিয়ম আছে।তুমি ক্লাশ মিস দিলে তোমার উপস্থিতি নাম্বার কম দিবে টিচাররা।আর কে কি করবে আমি জানিনা না তবে আমার সাবজেক্টে তুমি কম পাবে এটা সিউর।’

শুভ্রমের কথায় খারাপ লাগলো নীলার।সে শুভ্রমের কথার অন্য মানে বের করে ভুল বুঝে বলল
-‘আপনাদের বাড়ি থাকছি বলে এত চিন্তা তাই না? এত গুলো কথা বলে ফেললেন।’

শুভ্রম আশ্চর্য হলো নীলার কথা শুনে।নীলা এমন একটা মেয়ে যাকে হাজার কথা বললেও কিছু মনে করে না।আর সে কিনা এই শাসন টা বুঝলো না।শুভ্রম কিছু বলার আগে রাতের খাবারের ডাক এলো।নীলা শুভ্রমকে কিছু বলতে না দিয়েই চলে গেলো।

________

খাবার টেবিলে শুনশান নীরবতা।যে যার মতন খাবার খাচ্ছে।এখানে কথার আসর জমাতো একমাত্র নীলা কিন্তু সে এখন স্বাভাবিক কথাবার্তাই বলে না হাসি ঠাট্টা করবে তো দূরের কথা।

নীরবতা ভেঙে নীলার খালামনিই বললো
-‘নীলা মা ভার্সিটিতে যাস না কতদিন হলো।কবে যাবি ভার্সিটি?’

নীলা খাবার থামিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল
-‘আগামীকাল থেকেই যাবো খালামনি।’

নীলার কথা থামতেই দিয়া মুখটা বাঁকিয়ে বলে উঠল
-‘আরো কয় একদিন বাসায় থাকো আপু।তোমাকে ভার্সিটিতে না দেখে সবারই দিন ভালো যাচ্ছে।কেউ আর ভয়ে জ্ঞান হারাচ্ছে না।’

কথা শেষ করে হা হা করে হেসে উঠলো দিয়া সাথে রাজও।জেনো কোনো একটা জোক্স শুনে ফেলেছে তারা।শুভ্রমের বাবা চাচা টেবিলো নেই।তারা ব্যবসায়িক কাজে শহরের বাহিরে গেছে।সে জন্যই দিয়া এত বড় কথা বলার সুযোগ পেলো।

শুভ্রমের চাচী মানে দিয়ার মা বেশ জোড়ে একটা ধমক দিলো।কিন্তু দিয়া আর রাজের তাতে কোনো হেলদোল নেই। তারা হেসেই যাচ্ছে।

নীলা এতক্ষণ মাথা নিচু করে ছিলো।শেষমেশ টিকতে না পেরে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল

-‘আমার রঙটা এতই অপছন্দ তোমাদের? কালো রঙ এতটা অপছন্দ তো তোমাদের না।সারা জীবন দেখে আসলাম তোমাদের ড্রেসের রঙ বেশিরভাগই কালো।তোমার কালো ড্রেস পছন্দ।তবে মানুষের বেলায় সেটা না কেনো?রঙটাকে যদি শুধুই রঙ হিসাবে রাখতে তবে তোমরা মন নামক মন্দিরটাকে ভাঙতে পারতে না কখনোই।’

নীলা খাবার না খেয়েই উঠে গেলো হাত ধুয়ে।সবাই আহম্মক হয়ে তাকিয়ে রইল।কারণ নীলা কখনোই এত গম্ভীর ভাবে জবাব দেয় না।এসব কথা শরীরে মাখে না বললেই চলে।আজ তার প্রতিবাদ দেখে বিস্ময় সবাই।খালামনি, চাচী বেশ পিছু ডাকলেও শুনে না নীলা।কারণ পিছুটান নীলার জন্য না।

দিয়া একবারে চুপ মেরে যায়। তাকে যে এভাবে নীলা কথা শুনাবে ভাবতেও পারে নি।মনে মনে নীলার প্রতি রাগ জন্মে তার।

দিয়ার মা অবাক কন্ঠেই বলল
-‘নীলা তো কখনোই এভাবে কথা বলে না। আজ কি হলো ওর?’

অন্য কেউ কিছু বলার আগে মৌ বলে উঠে
-‘চাচীআম্মু এখানে নীলা কিভাবে কথা বলেছে সেটা ম্যাটার করে না।এখানে ম্যাটার করে তোমার ছেলে মেয়ে কতটা অভদ্র হয়েছে যে তাদের বড় একটা মানুষকে তারা এত নোংরা বিষয় নিয়ে ঠাট্টা করছে।’

মৌয়ের কথায় চুপ হয়ে যায় তার চাচী।দিয়া জ্বলে উঠে বলে
-‘বাহ্ বাহ্ আজ কাল দেখি কালো রে কালো বলা যাবে না।আবার মুখচোরা দের মুখে কথাও ফুটেছে।’

মৌ চিল্লিয়ে উঠে বলে
-‘শাট আপ দিয়া।আমি চাচ্ছি না ব্যাপারটা সিরিয়াস কিছু হোক।তবে শুধু কথা ফুটে নি হাত চলাও শুরু করেছে।আমি নীলা না।আমার সাথে অভদ্রতা করলে চড়িয়ে সোজা করে দেবো।’

দিয়া রেগে যায় আরও।খাবার ছেড়ে উঠতে নিলেই মুখ খুলে শুভ্রম।গম্ভীর কন্ঠে বলে
-‘এখন থেকে এক পা উঠবি তো খবর আছে তোর।একে তো বেয়াদবি করেছিস আবার তেজ দেখাচ্ছিস? আর কলেজে কে কি করে সব খবর আমার কাছে আসে।’

শুভ্রমের ঠান্ডা কন্ঠে থেমে যায় দিয়া।দিয়া আর রাজ বাদে সবার মনেই নীলার জন্য খারাপ লাগা কাজ করে।

নীলা ঘরে আসে।কান্না পায় তার খুব।সে নিজের গায়ের রঙটাকে কখনোই এত গুরুত্ব দিতো না।আর এখন এটা অভিশাপ মনে হয়। তার কান্না পাচ্ছে কিন্তু সে কাঁদবে না।তার শান্তির প্রয়োজন। কল লাগায় বাবাকে।আজিজুর রহমান কল ধরেই আদুরে কন্ঠে জিজ্ঞেস করে
-‘কেমন আছে আমার আম্মা টা?’

নীলা উত্তর দেয়

-‘ভালো বাবা। তুমি কেমন আছো?

আজিজুর রহমান হেসে বলে
-‘মা বাবার ভালো থাকাটা সন্তানদের ভালো থাকার উপর নির্ভর করে।তোমরা ভালো আছো মানেই বাবা মা ভালো।’

নীলার শান্তি লাগে বাবার কথায়।আজকাল তার শান্তির স্থান বাবা।নীলাকে চুপ থাকতে দেখে আজিজুর রহমান বলল

-‘আম্মা তোমার মন ভালো আছে তো?’

নীলার কান্না পায় খুব।আজকাল তার মনের খবর জিজ্ঞেস করলেই তার কান্না আসে।নীলা কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করে কিন্তু লাভ হয় না।

আজিজুর রহমান বুঝে তার মেয়ে কাঁদছে। তাই সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল

-‘একটা বাবার অসহায়ত্ব কি জানো মা?তার সন্তান কাঁদছে জেনেও তার কষ্ট দূর করতে না পারা।যে বাবা মা ছোট বেলায় সন্তানকে দামি খেলনা কিনে দেওয়ার জন্য নিজের দরকারী জিনিস কেনা বাদ দিয়ে দেয়,নিজের সন্তানকে খাবার খাওয়ানোর জন্য নিজে না খেয়ে থাকে সে বাবা মা ই এক সময় সন্তানদের কষ্ট দূর করতে ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতা যে বাবা মার কাছে কেমন লাগে তোমরা বুঝবে না মা। তোমার কান্না এত কিসের জন্য মা? যেই জিনিসটা তোমার জন্য নয় তুমি সেই জিনিসটার জন্যই কান্না করছো।কারণ যেটা তোমার ভাগ্যে লেখা আছে সেটাই হবে।তুমি কেঁদেও তা বদলাতে পারবে না।তোমার দরকার একটা ফুল কিন্তু তোমার উপরওয়ালা হয়তো তোমার জন্য পুরো একটা ফুল গাছই রেখেছে।তাই যা হচ্ছে হতে দেও।মা জীবনে কষ্টের অভাব নেই।সে কষ্টকে আকঁড়ে ধরেই যদি বাঁচতে চাও তাহলে এটা তোমার ব্যর্থতা হবে।আর তুমি যদি এই দুঃখকে ছাপিয়ে সুখটাকে কেড়ে নেও তবে তুমিই সফল।আমি কি বলি বুজেছো মা?’

বাবার কথায় জেনো কলিজা ঠান্ডা হলো নীলার।নতুন করে বাঁচার ইচ্ছে জাগল।
______

মাঝে কেটে গেছে এক সপ্তাহ।নীলা ভার্সিটি যাওয়া শুরু করেছে।তবে কথাবার্তা বলা একবারেই কম করে দিয়েছে।

আজ শুক্রবার।নীলা ঘুম থেকে উঠে তার সামনে বসে থাকা মানুষটাকে দেখে বিষ্ময়ে হতবাক। তার সামনে বসে আছে তার বাবা।শুধু বাবা না সবাই এসেছে।আর সবার এখানে আসার কারণ শুনে অবাক নীলা কারণ,,

চলবে,,

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here