বিবর্ণ নীলাম্বরী পর্ব -০৪+৫

#বিবর্ণ_নীলাম্বরী
#মম_সাহা

পর্বঃ চতুর্থ

পরিবেশ উৎসব মুখোর।আজ শুভ্রমদের বাড়িতে অনুষ্ঠান। নীলা এই বাড়িতে এতদিন ছিলো ঠিকই কিন্তু কোনো খবরা খবরই রাখে নি।সারা দিন রুমের ভিতরই বন্দি ছিলো।আর ভার্সিটিতে যেতো এই ই যা।কোনো খোঁজ খবর রাখে নি।আজ যখন নিজের বাবাকে মাথার কাছে বসে থাকতে দেখলো তখন অবাক হয়ে যায়। আর শুধু বাবা না তার পরিবারের সবাই এমনকি রাহাতকে দেখেও অবাক হয়ে যায় নীলা।

তাদের এখানে আসার কারণ জিজ্ঞেস করলে নীলার মা অদ্ভুত কন্ঠে বলে
-‘তুই কি পাগল হয়েছিস নীলা?তুই জানিস না আমি বা আমরা কেনো এসেছি?’

নীলা দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে না জানায়।আজিজুর রহমান যখন দেখলেন ঘটনা হাতের বাহিরে চলে যাচ্ছে তখন সেই গম্ভীর কন্ঠে স্ত্রীকে বলল
-‘আরে ও মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে।ঘুমের ঘোরে কি না কি বলছে।যাও তোমরা বাহিরে যাও আমি আমার মেয়েটার সাথে কথা বলে আসছি।’

নীলার মা কতক্ষণ ধারালো দৃষ্টিতে নিজের মেয়েকে পর্যবেক্ষণ করে বাহিরে চলে গেলেন।ওনার পিছে পিছে সবাই চলে যায়। আজিজুর রহমান মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন
-‘আম্মা তুমি সত্যিই জানোনা না কিসের অনুষ্ঠান আজ?’

নীলা দু’পাশে মাখা নাড়িয়ে না জানাল।আজিজুর রহমানের চিন্তায় কপালে ভাজ পড়ল।

তারপর হতাশার শ্বাস ফেলে বলল
-‘আজ শুভ্রমের বাগদান।’

নীলা জেনো আকাশ থেকে পরল।তাকে কেউ কিছু বলে নি ভেবে অবাক হলো।পরক্ষণেই মনে পড়ল সে তো কারো সাথে এ কয়দিন কথাও বলে নি কীভাবে জানাবে।

শুভ্রমের কথা ভেবে হাসি আসে নীলার।শুভ্রম আর নীলা এ কয়দিন এক সাথেই ভার্সিটিতে গিয়েছিল। শুভ্রম সেই ভার্সিটির একজন প্রফেসর।সেই সূত্রেই আর খালামনির জোড়াজুড়িতে এক সাথে যেতে হয়েছিলো।শুভ্রমও একটা বার বলে নি।অবশ্য বলবে কীভাবে। সে মুখ কি তার আছে নাকি।

আজিজুর রহমান মেয়েকে চুপ থাকতে দেখে বললেন
-‘আমি এটা দেখে আশ্চর্য হলাম যে, তুমি একটা বাড়িতে আছো সেই বাড়িতে কী হচ্ছে সেই খোঁজ খবর অব্দি রাখছো না।’

নীলা বেশ লজ্জিত বোধ করে। আসলেই সে বোধহয় বেশিই করে ফেলছে।নীলা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল
-‘আসলে বাবা একটু পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত আমি তাই খোঁজ খবর রাখা হয় নি।’

আজিজুর রহমান মাথা নাড়িয়ে উঠে গেলো। নীলার মনে হলো না এবার একটু স্বাভাবিক হতে হবে।তাছাড়া রাহাতও এসেছে তাকে দেখাতে হবে নীলার রাহাতকে ছাড়াও চলবে।যেমন ভাবনা তেমন কাজ।নীলা উঠে ঝটপট ফ্রেশ হয়ে নিচে চলে গেলো।সবার সাথে বেশ আড্ডাও দিলো।খালামনির বাসার সবাই খুশি নীলাকে স্বাভাবিক দেখে।সবাই ভাবছে নীলা তার পরিবারকে দেখে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। কিন্তু নীলার মনের খবর তো নীলাই জানে।

___________

বিকেল নেমেছে আকাশে।শীতকাল চলছে যত বেলা গরাচ্ছে তত শীত বাড়ছে।অনুষ্ঠান রাতে।সারাদিন সবাই বেশ খাটাখাটুনি করেছে। এখন ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আড্ডা দিচ্ছে।

নীলা দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির ছাদে।শুভ্রমের বিয়ে ঠিক হয়েছে তার বোন সোহার ননদের সাথে। সোহা এখনো আসে নি।সন্ধ্যাবেলা শ্বশুর বাড়ির লোকেদের সাথে একবারেই আসবে।

এ কয়দিন শুভ্রম বেশ খেয়াল রেখেছে নীলার।কোনো খারাপ ব্যবহার করে নি। নাহয় শুভ্রমও আগে রাহাতের মতন নীলাকে উঠতে বসতে খোঁচা মেরে কথা বলতো।কিন্তু কখনও রূপ নিয়ে কিছু বলে নি।শুভ্রমের হঠাৎ বিয়ের কারণটাও জানে নীলা।

‘নীলা মনে হয়ে বেশ হট, তাই তো এত ঠান্ডার মাঝে তার সোয়েটার প্রয়োজন হচ্ছে না।’

চেনা ছেলে কন্ঠে একটুও নড়চড় হলো না নীলার।ছেলেটা নীলার সামনে দাঁড়ায়। এসেই হাতটা টান দিয়ে ঘুরিয়ে বলল
-‘কিরে আমি কথা বলছি তোর সাথে ,কানে যায় না?’

নীলা আকাশের থেকে চোখ ফিরিয়ে রাহাতের দিকে তাকায়। আলগোছে রাহাতে হাতটা নিজের বাহু থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দাঁড়ায়। তারপর একটু চুপ থেকে উত্তর দেয়
-‘কোন কথাটা কানে নিবো ভাইয়া? ঐ যে আমি হট সেটা? আপনার হয়তো কিছু বলতে মুখে বাঁধে না তাই বলে কী আমরাও সব কথা কানে নিবো নাকি! কখনো কখনো কিছু কথা উড়িয়ে দেওয়াও ভালো এতে কষ্ট কমে।যদি মাসখানেক আগে আরেকবার আমি আপনার কথাটা না শুনে উড়িয়ে দিতাম তবে আজও হয়তো কম কষ্ট পেতাম।’

নীলার শান্ত কিন্তু শক্ত কন্ঠে ভরকে যায় রাহাত।এতটা কাঠিন্য তো ছিলো না রিয়ার।রাহাতের ভাবনার মাঝেই নীলা খিলখিল করে হেসে বলল
-‘আরে লেবু বেশি চটকালে যেমন তেতো হয়ে যায় তেমনই মানুষকে অতিরিক্ত আঘাত করলে তারা পাথর হয়ে যায়। নীলাও তার ব্যাতিক্রম নয় রাহাত ভাই।’

রাহাতের রাগ উঠে যায়। ঠাস করে চড় মারে নীলার গালে।এটা নতুন কিছু না। অনেক চড় এই হাতের খাওয়া হয়ে গেছে নীলার।অন্য সময় কেঁদে ভাসালেও আজ নীলা কাঁদে নি।বরং চোখ রাঙিয়ে ধমকের স্বরে বলল
-‘আজ যেটা করছেন সেটা ভবিষ্যতে ভুলেও করার চেষ্টা করবেন না।এর ফল কিন্তু খারাপ হবে।’

নীলার এতটুকু কথা রাহাতের কাছে আগুনে ঘি ঢালার মতন মনে হলো।সে আবারও চড় দেওয়ার জন্য হাত উঠাতেই নীলা রাহাতের হাত ধরে ফেলে। রাহাতের চোখে এখন রাগের জায়গায় অবাক ভর করে। নীলা রাহাতের শক্ত হাতটাকে বেঁকিয়ে ধরে।রাহাত ব্যথায় আঁতকে উঠে আ আ শব্দ করলো।নীলা হাতটা বেঁকিয়ে ধরেই বলল
-‘এতদিন অনেক করেছেন।আজ আর না। এবার থামার পালা এসে গেছে।আপনি মাসখানিক আগে কী করেছেন সেটা আমি ভুলি নি।আমার সাথে গেইম খেলেছেন আপনি। আপনাকে ভালোবাসি বলে সেটাও মাফ করেছি। কিন্তু আপনার আচারণ আমাকে আপনার উপর ঘৃণা আনতে বাধ্য করছে।আর একবার ঘৃণা যেহেতু এসে পড়ছে সেহেতু আপনার হাতটা দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে দিতোও আমি দু’বার ভাববো না।আফ্টার-অল ক্যারাটে শিখেছি।আমার বাবা হয়তো জানতো কখনো আপন মানুষ নামক জানোয়ারদের সাথেও আমার লড়তে হবে তাই আগেই ক্যারাটে শিখিয়েছে।তাই সাবধান।’

রাহাতের ব্যাথায় মুখ নীল বর্ণ ধারণ করেছে। নীলা রাহাতের হাত টা ঝাটকা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।রাহাত নিজের হাতটাকে ঝাড়তে ঝাড়তে চলে যেতে যেতে বলল

-‘নীলা তোকে আমি পরে দেখে নিবো।এইটা তোর জন্য খুব ভারী পরবে।’

রাস্তা থেকে এক আগন্তুক পুরোটাই খেয়াল করেছে।আর সবটা কল করে কোনো একজনকে জানিয়েছে।ফোনের ওপাশের মানুষটা
ফোন কেটে হাসতে হাসতে নিজে নিজেই বলে
-‘এটা ঘটনা তো আমি নিজেই দেখেছি সবটা।এই তো আমাদের নীলা শক্ত হচ্ছে।যে যে নীলার সাথে যা যা করেছে তার সবটা হিসেব দিতেই হবে।সবে না শুরু।আমি তবে নীলাকে শক্ত করতে পারছি।’

নীলা রাহাতের কথা কানে না নিয়ে আবার আকাশ দেখায় মনযোগী হলো।চারপাশে আজান দিচ্ছে।বেশ খানিক সময় না যেতে ছাদে অন্য কারো উপস্থিতি টের পায় নীলা।ঘুরে তাকিয়ে দেখে শুভ্রম।এগুলোর চিন্তায় শুভ্রমের কথা মাথা থেকে বেরই হয়ে গেছিলো ওর।

শুভ্রম আজ শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি পরেছে।পাঞ্জাবির উপরে একটা সোয়েটার খারাপ লাগছে না ছেলেটাকে।আর সে দেখতেও সুন্দর।আজ বেশ লাগছে তাকে।মনে হচ্ছে সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। সবাই বলে বিয়ের জল শরীরে লাগলে নাকি মানুষ অতিরিক্ত সুন্দর হয়ে যায়। শুভ্রমের ক্ষেত্রেও হয়তো তা ই হয়েছে।

শুভ্রম এসে নীলার পাশে দাঁড়ায়। নীলা বেশ হাসি হাসি মুখ করে তাকায় তার দিকে।শুভ্রম কতক্ষণ নীলার দিকে পর্যবেক্ষণ করে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠল
-‘তুমি এই শীতে সোয়েটার ছাড়া দাঁড়িয়ে আছো যে?আর গালে কী হয়েছে তোমার ফুলে গেছে?’

নীলা ভয় পেয়ে যায়। শেষমেশ ধরা খেয়ে যাবে না তো।আমতাআমতা করে বলল
-‘আসলে এলার্জির সমস্যা হয়েছে এজন্য ফুলে গেছে।আর আমার তেমন শীত লাগে না তাই সোয়েটার পরি নি।’

শুভ্রম আর কিছুক্ষণ নীলার দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তারপর অন্য দিকে তাকিয়ে বলে

-‘নীলাম্বরী তোমাকে সত্যিই আমি ভালোবেসে ছিলাম। তুমি আমাকে রিফিউজড না করলেই পারতে।’

নীলা তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে বলে
-‘এতই ভালোবাসা বুঝি ছিলো আপনার? তবে রিফিউজ করতে না করতে বিয়ের আসরে বসে যাচ্ছেন যে?’

শুভ্রমের বেশ অপমানে লাগল। সে মাথা নিচু করে বলল
-‘তুমি রিফিউজড করায় আমার রাগ উঠে গিয়েছিলো তাই আমি মাকে বিয়েতে হ্যাঁ করে দেই।এমনেতেও ওরা সোহার ননদকে আগেই পছন্দ করে রেখে ছিলো। আর তোমার মতন একটা মেয়ের এমন রিফিউজড আমি মানতে পারে নি।’

নীলা ভ্রু কুঁচকে বলে
-‘ওয়েট ওয়েট আমার মতন মেয়ে মানে কি বুঝাতে চাইলেন?’

শুভ্রম বিভ্রান্তিতে পরে যায়। আমতা-আমতা করে বলল
-‘আসলে আমি অন্য কিছু মিন করে নি।আসলে

নীলা হাত দিয়ে থামিয়ে দেয় শুভ্রকে।তারপর বড় করে শ্বাস নিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বলল
-‘আপনি কি মিন করে বলেছেন আমি বুজেছি।এমনেতেই আমাদের সম্পর্কে তিক্ততা বেশি।সেটা আর না বাড়ালেই বোধহয় ভালো হবে।আর ভালোবাসার সংজ্ঞা টা আপনি আজও জানেন নি তাই আমার মতন মেয়ের রিজেকশন আপনার ইগো হার্ট করেছে।যাই হোক আপনি নতুুন জীবনে এগিয়ে যান সেটাই আমি চাই।আমার মতন মেয়ে আপনার জীবনে যায় নি সেটাই ভালো। আমার থেকে হাজার সুন্দরী বউ পাবেন।দোয়া করি কোনো দিন সুন্দর বউ পেয়ে আফসোস না করেন।আর জীবনের চলার জন্য মুভ অন করা দরকার।তাই আপনার সিদ্ধান্তে আমি খুশি।’

শুভ্রমের অপমানে লাগল কথা গুলো।সেও বেশ উচ্চস্বরে বলল
-‘আমিও দেখি তুমি কোন রাজপুত্র পাও।ঐ তো রূপের শ্রী আবার এত দেমাক।’

নীলা কোনো জবাব দিলো না।শুভ্র গটগট পায়ে বেরিয়ে গেলো। এর দু’মিনিট পর নীলার শরীরে কেউ চাদর জড়িয়ে দিচ্ছে।নীলা আৎকে পিছে তাকিয়ে দেখে তার বাবা এবং আপু নীলার শরীরে চাদর জড়িয়ে দিচ্ছে।বাবাকে দেখে ভালো লাগলেও আপুকে দেখে খারাপ লাগা কাজ করল।আজ সারাটা দিন আপু এসেছে কিন্তু সে একটা কথাও বলেনি।আর সেই আপু তাকে চাদর জড়িয়ে দিচ্ছে।

নীলাকে ভাবতে দেখে নিরুপমা হেসে বলল
-‘কিরে বুড়ি শীত পরেছে কি দেখেছিস?তাও চাদর পরিস নি কেনো?’

নীলা মুচকে হেসে বলে
-‘আমি চাদর পরে ফেললে কীভাবে জানতাম যে আমার জন্য কার ভালোবাসা কতটুকু।’

নিরুপমা বোনকে জাপটে ধরে।নীলাও কিছুটা ধরে।আজিজুর রহমান দু মেয়েকে নিজের বুকে চেপে ধরে বলে
-‘শীতে থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যেমন শীতের পোশাক প্রয়োজন তেমন জীবনে সুন্দর মতন বেঁচে থাকার জন্য সঠিক মানুষ চেনা প্রয়োজন। মাঝে মাঝে ধরো সোয়েটার কেনার সময় আমরা স্টাইলিশ সোয়েটার কিনি।কিন্তু দেখা যায় ঐ সোয়েটার আমাদের শীত থেকে বাঁচাতে পারে না।ওর খালি বাহিরের চাকচিক্য টাই আছে।তেমনই জীবনেও এমন কিছু মানুষ আসবে যাদের বাহিরের চাকচিক্য টাই সুন্দর কিন্তু অন্তর ভীষন নোংরা। আমাদের সময় নিয়ে সে মানুষ গুলোকে চিনতে হবে।স্টাইলিশ সোয়েটার যেমন তোমাকে শীতের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে না তেমন চাকচিক্য মানুষ বলতেই ভালো হয় না।তাই যতই তোমার সেগুলো পছন্দ হোক না কেনো সেগুলো বর্জন করতে হবে।তাই না মা?’

বাবার কথায় মাথা নাড়ায় দুই মেয়ে।নীলা শক্তি পায় এগিয়ে যাওয়ার তবে এগিয়ে যাওয়া কি আর এতই সোজা?

চলবে,,,#বিবর্ণ_নীলাম্বরী
#মম_সাহা

পর্বঃ পঞ্চম

মেহমানে গমগম করছে হল রুম।মেয়ের বাড়ির মানুষ চলে এসেছে।সাথে মেয়েও এসেছে।এখানেই দুজন দুজনকে আংটি পড়াবে।

সবাই একসাথে আড্ডা দিচ্ছে কেউ বা মেহমান আপ্যায়ন করছে। এখানে অনুপস্থিত কেবল নীলা।আজিজুর রহমান বড় মেয়েকে পাঠিয়েছেন নীলাকে তৈরী করার জন্য।

এখন আংটি পড়ানোর সময়। সবাই অপেক্ষা করছে নীলার আসার জন্য। শুভ্রমের মা ই সবাইকে অপেক্ষা করতে বলেছে।এ নিয়ে সোহা বেশ রাগারাগি করেছে।তার ভাইয়ের অনুষ্ঠানে ঐ মেয়েকে এত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে।

সবার অপেক্ষার প্রহর শেষ করে নীলা সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে।তার পড়নে নীল রঙের একটা জামদানি শাড়ি। খারাপ লাগছে না।তার কালো শরীরে,গোলগাল মুখে শাড়িটা বেশ মানিয়েছে।নিরুপমাও একই রকম সেজেছে।দুজনকেই সুন্দর লাগছে।

নীলা নেমে আসার সাথে সাথেই শুভ্রমের মা ছুটে এসে নিজের চোখের নিচ থেকে কাজল নিয়ে নীলার ঘাড়ে লাগিয়ে দিলো।আর কপালে চুমু দিয়ে বলল
-‘মাশাল্লাহ আমার মেয়ের জেনো নজর না লাগে।’

নীলা মিষ্টি হাসি উপহার দেয়। কিন্তু ওদের মাঝেই সোহা মুখ বাঁকিয়ে ঠাট্টার স্বরে বলল
-‘ওরে কাজল দেওয়ার কি দরকার আম্মু, ওর পুরো রঙই তো কাজলময়।’

সোহার কথা থামতেই ড্রয়িং রুমে ছোটখাটো হাসির রোল পরে গেলো।ড্রয়িং রুমের ই উপস্থিত এক মহিলা হাসতে হাসতে বলল
-‘কাজলকে আর কাজল মাখানোর দরকার নেই।আপনি বরং ওর সাথের ফর্সা মেয়েটার কানের নিচে কাজল লাগিয়ে দেন।নজর লাগলে ওরই লাগবে।’

নীলার অপমানে গাঁ রি রি করে উঠে।টলমলে চোখে তাকায় বাবার দিকে।আজিজুর রহমান সবসময়ই বিচক্ষণ মানুষ।সে দু’কদম এগিয়ে এসে নীলার থুঁতনিতে ধরে মুখ উঠিয়ে মাথাটা নিজের বুকের সাথে লাগিয়ে বলল
-‘আসলে কাজলের মূল্য জানেন না বলেই হাসছেন।অথচ কি সুন্দর এই কাজলই নিজের চোখের নিচে লাগাচ্ছেন নিজের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য। যার জন্য উপকার হচ্ছে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করুন।আর ভালো জিনিস তো সবাই চেনে না এটা তাদের দৃষ্টিভঙ্গির দোষ।আমার মেয়েদের রূপের দোষ না।আমার কাছে দুজনই তো সমান সুন্দর।’

দিয়া নাক ছিটকে আজিজুর রহমানকে বলল
-‘সরি টু স্য আঙ্কেল আসলে আপনার এত বড় বড় কথা বলা উচিত না।আফ্টার-অল আপনার মেয়ের গায়ের রঙের দিকেও তাকানো উচিৎ আপনার।কে নিবে তাকে?’

দিয়ার কথায় সাঁই জানালো সোহাও।

আজিজুর রহমান দিয়ার কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
-‘আমার মেয়েকে কে নিবে সেটা পরে চিন্তা করো।আগে চিন্তা করো তুমি কই যাবে?তোমার তো মনে হয় কোনো জায়গায় দু’দিন টিকে থাকার ও যোগ্যতা নেই।আর সোহা তুমি, আমার আফসোস হচ্ছে ভাইসাহেব তার সন্তানদের মানুষ করতে পারলো না।’

শুভ্রমের পরিবার মানে বাবা-মা, চাচা চাচী লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলেন।আজিজুর রহমান গলা পরিষ্কার করে বললেন

-‘আমার মনে হয় অনুষ্ঠান শুরু করা উচিত কাল বিলম্ব না করে।’

শুভ্রমের বাবাও মত দিলো। দুজন দুজনকে আংটি পড়ালো।আংটি পড়ানোর সময়ও শুভ্রম তাকিয়ে ছিলো একবার নীলার দিকে।নীলা চুপচাপ বাবার বুকে মাথা এলিয়ে শুয়ে আছে।

আংটি পড়ানো শেষ কতক্ষণ আগেই।নীলা হল রুম থেকে দূরে বারান্দায় বসে আছে।নিরুপমা নীলার পাশে গিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসে। নীলা তখনও অন্য দিকে তাকিয়ে আছে।নিরুপমা বোনের মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে কান্নামাখা কন্ঠে বলল
-‘মন খারাপ কেনো করে আছিস নীলু?আমার উপর রাগ করেছিস?’

নীলার খারাপ লাগে। না চাইতেও রাগ হয় নিজের আপুর উপর।রাগে দুঃখে বলে ফেলে
-‘আমি ভাবতেও পারি নি আমার সুখের পথে কাটা হয়ে দাঁড়াবে আমারই আপুর সৌন্দর্য। আমি ভাবতে পারি নি এত গুলো লোকের সামনে আমার আপুর রঙের সাথে আমার রঙের তুলনা করে আমাকে হাসি ঠাট্টার খোরাক বানাবে মানুষ।’

কথা থামতেই চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরলো নীলার।নিরুপমার কষ্ট হচ্ছে।সে নিজের দু’হাতের মাঝে বোনের মুখটা আকড়ে ধরলো।অশ্রুভেজা কন্ঠে বলল
-‘আমাকে ক্ষমা করে দে না বোন।তুই খুব কষ্ট পেয়েছিস না?আমি জানি খুব খারাপ লেগেছে তোর।আমি সাজ গোজ সব মুছে আসছি দাঁড়া।’

নিরুপমা এটা বলেই উঠঁতে নিলে নীলা ওর হাতটা চেঁপে ধরে।নিজের বোনের হাতটা তার মুখে চেঁপে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে।আর কাঁদতে কাঁদতেই বলে
-‘আপু গো ও আপু, আমার গাঁয়ের রঙ এভাবে আমার কাল হয়ে দাঁড়াবে আমি জানতামই না।আমার আল্লাহ যে এমন দুঃখ আমার কপালে লিখে রেখেছে আমি জানতাম না।বুকের ভিতর রক্তক্ষরণ কি হচ্ছে সেটা বুঝাতে যদি পারতাম তাহলে তুমি বুঝতে আপু।অপমানে মরে যেতে ইচ্ছে করে।’

নিরুপমা বোনকে বুকে জড়িয়ে নেয়।বোনকে স্বান্তনা দেওয়ার ভাষা তার জানা নেই।

দু’বোনের কথাবার্তার মাঝেই রাহাত হাজির হয়।এসেই নিরুপমার হাতটা ধরে বলে
-‘চলো না নিরু অনেক তো বোনের সাথে আড্ডা দিলে এবার আমাকেও সময় দেও।’

রাহাতের হঠাৎ আগমনে বিভ্রান্তে পড়ে যায় দুজনেই।নীলা নিরুপমার বুক থেকে মাথা উঠিয়ে অন্য দিকে ঘুরে চোখের জল মুছে নিরুপমার দিকে তাকিয়ে বলে
-‘যাও না আপু।ভাইয়া এত বার করে বলছে যাও ঘুরে আসো।’

নিরুপমা না চাইতেও উঠে দাঁড়ায়। সামনে পা বাড়ানোর সময় ভুল বশত সে পিছলে যায় আর রাহাতের বা’হাতটা আকড়ে ধরে।রাহাত জোড়ে চিল্লিয়ে উঠে ব্যাথায়।নিরুপমা রাহাতের বা’হাতটা শক্ত করে মুঠ করে ধরে ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বলল
-‘কি হলো তোমার?কি লাগলো?চিল্লিয়ে উঠলেন কেনো?’

রাহাতের ব্যাথায় দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম।কেনো মতে নিরুপমার ধরে রাখা হাতটা ছাড়িয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলল
-‘আমার বা’হাতে প্রচুর ব্যাথা। তুমি ধরাতে সেটা আরও বেশি হয়ে গিয়েছিল।’

নিরুপমা তড়িঘড়ি করে বলল
-‘সরি সরি আমি বুঝি নি।কীভাবে ব্যাথা পেলে?’

রাহাত এখন চিন্তায় পড়ে গেলো কি বলবে ভেবে।কোনো মতে আমতা-আমতা করে বলল
-‘আজ বিকেলে পড়ে গিয়েছিলাম পিছলা খেয়ে। তখনই মচকে গেছে।’

নিরুপমা আতকে উঠে।তাড়াতাড়ি রাহাতকে তার পিছে আসতে বলে বকতে বকতে ফাস্ট-এইড বক্সের খোঁজে চলে যায়। রাহাত চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেই নীলা পিছু ডেকে উঠে।রাহাত কটমট দৃষ্টিতে তাকালে নীলা হাসি হাসি মুখ করে বলল
-‘নীলার সাথে কাহিনী করার ফল পেয়েছেন তো দুলাভাইই?’

রাহাত কতক্ষণ ফোস ফোস করে চলে যায়। নীলা হেসে ফেলে।হাসতে হাসতে চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পরে।মুখ ঢেকে ফেলে নীলা।শরীর কাঁপিয়ে কেঁদে উঠে।

আজিজুর রহমান দরজায় দাঁড়িয়ে সবটাই দেখেন।সে আসে না থামাতে মেয়েকে।তার মেয়ে যে কোনো কারণে ভিতরে ভিতরে ভেঙে যাচ্ছে সে জানে।কাঁদুক,কান্না করলে ভিতরের ভারী ভারী ভাবটা কমবে।কষ্ট টা বের হয়ে যাবে।

______
রাত এগারোটা। সবাই খাওয়া দাওয়া করেছে শুধু নীলার পরিবার আর শুভ্রমের পরিবার বাদে।মেয়ে পক্ষ চলে গেছে কিন্তু সোহা থেকে গেছে।

শুভ্রমের মা আজিজুর রহমানের সামনে এসে বলল
-‘তখনকার ঘটনার জন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি ভাই সাহেব।আসলেই আমি আমার সন্তানদের মানুষ করতে পারি নি।ওদের রাগ খাবারের উপর দেখাবেন না।খেয়ে নেন না ভাই।’

আজিজুর রহমান শক্ত ও প্রখর ব্যাক্তিত্বের মানুষ। সে গম্ভীর কন্ঠে বলল
-‘দেখেন রেহানা আপা আমি ঐ কথা আর তুলতে পারবো না।আর আমার সত্যিই এ বাড়ির ভাত গলা দিয়ে নামবে না।আমি এখনই চলে যাবো।’

সবাই আজিজুর রহমানকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলো।কিন্তু সে তার কথায় অনড়।নীলা এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো।আজিজুর রহমান মেয়ের কাছে গিয়ে বলল
-‘আম্মা চলো বাহিরে গাড়ি দাঁড় করানো আছে।’

নীলার সাথে সাথে উপস্থিত সবাই অবাক হলো।শুভ্রম উঠে এসে বলল
-‘খালু নীলাকে কোথায় নিবেন?ওর ভার্সিটির ক্লাশ চলছে এখন।আর ক’দিন আগে তো বেড়িয়ে আসল।আবার কেনো যাবে।’

রেহানা বেগমও শুভ্রমের কথায় সাঁই জানিয়ে বলল
-‘হ্যাঁ ভাই সাহেব নীলু যাবে কেনো? এমন করবেন না ভাই সাহেব।’

আজিজুর রহমান শক্ত কন্ঠে বলল
-‘প্রথমত আমার মেয়ে কোনো ফেলনা না যে এসব কথা শুনেও তাকে এবাড়িতে পরে থাকতে হবে।আমার মেয়ের আত্মসম্মান এত ঠুনকো না যে তা ধূলিসাৎ করে কারো বাড়িতে পরে থাকতে হবে।’

সবার খারাপ লাগছে।শুধু সোহা,দিয়া ও রাজ খুশি হয়েছে।তারা এমনেতেও নীলাকে পছন্দ করে না।

মৌ আজিজুর রহমানের সামনে এসে বলল
-‘হ্যাঁ আঙ্কেল নিয়ে যান ওরে।কখনো শুনেছেন খারাপ জায়গাতে ভালো কিছুর কদর দেওয়া হয়?আমাদের বাড়িটাও এমন।এরা এত উশৃংখল হয়ে গেছে যে বলার বাহিরে।ভালো থাকিস নীলু।’

রেহানা বেগম বোনের জামাইয়ের কাছে সুযোগ না পেয়ে বোনের কাছে যায়। নীলার মাকে বলে নীলাকে রেখে যেতে।নীলার মা কতক্ষণ নীলার দিকে তাকিয়ে তারপর নিজের বোনের দিকে তাকিয়ে বলে
-‘আপা তুমি তো আমাদের ভরসা রাখলে না।তাহলে কীভাবে ভাবছো আমার মেয়েকে আবারও আমি এখানে রেখে যাবো।যেখানে ভরা বাড়িতে আমার মেয়ে এমন হেনস্তা হয় সেখানে খালি বাড়িতে ওরে আরও কি কি শুনতে হয় আল্লাহ মালুম।আমার সত্যিই লজ্জা লাগছে আমার বোনের ছেলেমেয়েদের জন্য। আসি আপা ভালো থেকো।’

নীলা নিজের মায়ের এমন কথা শুনে অবাক হয়ে গেলো। মা বরাবরই একটু আলাদা বাবার থেকে। কিন্তু আজ মায়ের লুকায়িত ভালোবাসা দেখে কার নিজেকে সব থেকে ভাগ্যবতী মনে হলো।

নীলাম্বরী বেড়িয়ে আসলো আত্মসম্মান বাঁচাতে আরও একটা মায়া কাটিয়ে। শুভ্রমের খারাপ লাগছে।শূণ্য লাগছে বুকের বা’পাশ।কিন্তু রমনীর ফিরে দেখার সময় নেই।

#চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here