#বিবর্ণ_নীলাম্বরী
#মম_সাহা
পর্বঃ উনবিংশ
নীলার পরিবারের সবাই চলে গেছে আজ পুরো একদিন হলো।সবাই বের হয়ে যাওয়ার পর নীলা তৈরী হয়ে রঙদের সাথে ভার্সিটিতে যায়। সেখানে প্রতিদিনের মতন স্বাভাবিক কাটে। শুধু মাঝে শুভ্রম একবার কথা বলতে এসেছিলো নীলা এড়িয়ে গিয়েছে। নীলা বুঝতে পারে অহনের সাথে রঙের বেশ ভাব হয়েছে।এমনে সর্বক্ষণ অহন রঙের পিছু লেগে থাকলেও দুজন দুজনের বেশ খেয়াল রাখে।
নিজের আনমনেই হালকা হাসে নীলা।এর মাঝেই কলিং বেলের আওয়াজে ধ্যান ভাঙে। পড়ার টেবিল থেকে উঠে দরজা খুলে দেয়।
দরজার উপাশে বর্ণকে দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে দেখে ভ্রু কুঁচকায় নীলা।নীলাকে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বর্ণ মুচকি হাসি দিয়ে বলল
-‘এত শীতে এই অসহায় ছেলেটাকে বাহিরে দাঁড় না করিয়ে ভিতরেও তো আসতে বলতে পারেন ম্যাডাম।’
নীলা নিজের বোকামি বুঝতে পেরে দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়। বর্ণ রুমে ঢুকে তার হাতে রাখা বক্স টা টেবিলের উপর রাখে।
বর্ণকে টেবিলের উপর বক্স রাখতে দেখে এগিয়ে আসে নীলা।অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে
-‘আরে আন্টিরা না বাড়িতে নেই।বিকেলে কোন অনুষ্ঠানে গেলো তাহলে খাবার পেলেন কই?’
বর্ণ হাত ধুয়ে সোফায় বসতে বসতে বলল
-‘হ্যাঁ মা রান্না করে ফ্রীজে রেখে গেছিলো।এখন তো শীতকাল ঠান্ডা তরকারি খাওয়া অসম্ভব তাই মা আমাকে কল করে বলেছিলো বাসায় এসে খাবার গরম করে জেনো আপনাকে দেই।’
নীলা বর্ণ ও তার পরিবারের এত সুন্দর আচরণ দেখে মুগ্ধ হয়।নিজের মুগ্ধতা চেপে রেখে বলল
-‘আমি আরও ভাবছিলাম রান্না করবো আপনাদের জন্যও।’
বর্ণ হেসে বলল
-‘আপনার আর রান্না করার প্রয়োজন নেই তবে যদি এক কাপ কফি খেতে বলেন তাহলে আমি না করবো না।’
নীলা তড়িঘড়ি করে বলল
-‘আমি এখনই আনছি।’
নীলা কফি বানাতে চলে গেলো।বর্ণ পুরো ড্রয়িং রুম ঘুরে দেখতে লাগল।বেশ গুছানো দেখে ভালো লাগে বর্ণের।মেয়েটা এত গুছানো কখনই ছিলো না।আজিজুর রহমান বলেছিলো।সারা দিন দস্যিপনা করে কাটাতো।বাড়ি মাথায় উঠিয়ে রাখতো।বছর কয়েক যাবত হাজারো ঘটনা মেয়েটাকে নিস্তব্ধ করে দিয়েছে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বর্ণ।সে চঞ্চল নীলাম্বরীকে দেখেনি।তবে সেই নীলাম্বরীর প্রেমেই সে পড়েছে।আজিজুর রহমান যখন তার ছোট মেয়েটার বর্ণনা দিচ্ছিলো তখনই সে কল্পনায় ঐ মেয়েটাকে নিজের মনের মণিকোঠায় ঠাঁই দিয়েছিলো।শেষে না পেরে সেই মানবীকে দেখতে চলে যায় তার বাড়িতে।কিন্তু দেখা আর হয় না।মানবীর পরিবর্তে বুক পকেটে লুকিয়ে মানবীর ছবি নিয়ে আসে।
এসব ভাবনার মাঝেই বর্ণের জন্য কফি নিয়ে হাজির হয় নীলা।বর্ণ হাসি দিয়ে নীলার হাত থেকে কফির মগটা নিয়ে আয়েশ করে বসলো।এখন শীতকালের মাঝামাঝি সময় তাই বেশ শীত পড়ে আর অবাক করা ব্যাপার হলো বৃষ্টিও হয় মাঝেমধ্যে। যেমন আজ হচ্ছে।
নীলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বর্ণ বলল
-‘দাঁড়িয়ে আছেন যে,বসুন।কফি খেতে খেতে আপনার সাথে কিছু কথা বলে নেই।’
নীলা বর্ণের কথা শুনে বর্ণের সামনের সোফায় গিয়ে বসলো।বর্ণ কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল
-‘বাহ্ বেশ কফি বানান তো আপনি।বেশ খেতে হয়েছে।বৃষ্টির মধ্যে এমন একটা কফিরই অভাব বোধ করছিলাম।ধন্যবাদ।’
নীলা শুধু বর্ণের কথার পিঠে হাসি দিলো।আজও সে বাসায় একা আর তার সামনে একজন পরপুরুষ বসে আছে কিন্তু তার ভয় করছে না।যেখানে তার আপন মানুষ রাহাতকে এত ভয় পায় সে।পরক্ষণেই মনে পড়লো আপন বললেই কি সব আপন হয়ে যায়?
নীলাকে গভীর ভাবনায় মগ্ন থাকতে দেখে বর্ণ গলা পরিষ্কার করে বলল
-‘আচ্ছা নীলা রাহাতকে আপনি ভালোবাসতেন বা ভালোলাগতো মানলাম রাহাত তো আপনাকে তেমন নজরে দেখে না তাই না? তাহলে আপনার প্রতি ওনার এমন আচরণের কারণ কি?’
নীলা চুপ হয়ে থাকে।সে জানে বর্ণের কৌতূহল না মিটলে বর্ণ প্রশ্ন করবে।তাই সে ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল
-‘আসলে রাহাত ভাইয়া আমাকে ভীষণ অপছন্দ করেন তাই এমন করে।’
বর্ণ কফির কাপটা টেবিলে রাখে।তারপর পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
-‘ঠিক আছে, একজন মানুষের আরেকজন মানুষকে অপছন্দ হতেই পারে তাই বলে এমন আচরণ করবে? সে যদি সামান্য কারণে আপনার সাথে এমন আচরণ করতে পারে তাহলে আপনার বোন বিয়ের পর সুখী থাকতে পারবে?’
নীলা চুপ করে থাকে।কি বা আর বলার আছে।তার হাত পা বাঁধা।অনেক কিছু করার থাকলেও সে কিছুই করতে পারবে না।
বর্ণ নীলাকে চুপ থাকতে দেখে আবার বলল
-‘নীলা ভেবে দেখুন সবটা।আমার মনে হয় আপনার পুরো ব্যাপার টা পরিবারের মানুষকে জানানো উচিৎ।রাহাতের এসব ব্যবহারের কথা জানানো উচিৎ সবাইকে।’
নীলা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল
-‘এবার বিয়ে নিয়ে আবার এমন কিছু হলে আমার বোনটা যে মরে যাবে।’
বর্ণ নীলার কথায় অবাক হয়ে তাকায়। তারপর বিষ্ময়মিশ্রিত কন্ঠে বলল
-‘আবার এমন কিছু হলে মানে? আমি ঠিক বুঝি নি আপনার কথা।’
নীলা মাথা নিচু করে বলল
-‘আপুর এর আগেও একটা বিয়ে ভেঙে ছিলো।’
বর্ণ অবাক হয়ে বলে
-‘কেনো?’
নীলা বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বলল
-‘আমার কারণে।’
বর্ণ ভ্রু কুঁচকে বলল
-‘আপনার কারণে মানে বুঝি নি।একটু পরিষ্কার করে বলেন।’
নীলা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল
-‘আজ থেকে প্রায় তিন বছর আগের কথা। আপু একটা ছেলেকে প্রচন্ড রকমের ভালোবাসতো।আর ছেলেটাও নাকি আপুকে বেশ ভালোবাসতো।তারপর আপু তাদের ভালোবাসার কথা আমাদের পরিবারের সবাইকে জানায়।তখন আমি সবে ঢাকা এসেছি অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে।বাবা জানালো বাড়ি যেতে হবে আপুর বিয়ের কথাবার্তার জন্য।
আমি বাড়ি গেলাম।সেদিন আপুকে ঐ ছেলের পরিবার দেখতে এলো।আমিও ঐ ছেলেকে প্রথম দেখলাম।আপুকে ওনারা পছন্দ করলেন।বিয়ের কথা পাঁকা হলো একমাস পর।এর দুদিন পরে আপু আমাকে নিয়ে গেলো ঘুরতে ওনার সাথে তার হবু স্বামীও ছিলেন।বেশ মজা করলাম।
এরকম আরও দু একবার ঘুরেছিলাম ওদের সাথে। তারপর সে ছেলে আমাকে প্রায়ই কল দিতো।প্রথম প্রথম নরমালি কথা বললেও পরে তার কথাবার্তা কেমন জেনো হতে লাগল।এরপর যত পারি তত তাকে ইগ্নোর করছিলাম।’
এত টুকু বলে থামল নীলা।বর্ণের জেনো পরের টুকু শোনার জন্য তড় সইছিলো না।সে সঙ্গে সঙ্গে বলল
-‘তারপর? তারপর কি হয়েছিলো?’
নীলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
-‘তারপর আমি আমার আপুর সুখের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম নিজের অজান্তেই।
বিয়ের দু’দিন আগে ছেলে আমার বাড়ির লোককে জানালো সে আপুকে না আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে।আপু তার কেবল মাত্র মোহ ছিলো।আপুকে বিয়ে করবে না।বিয়ে যদি করতেই হয় তাহলে আমাকে করবে।
বিয়ের আর মাত্র দুদিন।আত্মীয় স্বজনে বাড়ি ভরপুর ছিলো।এমন ঘটনায় পুরো বাড়িতে ছিঃ ছিঃ পড়ে গিয়েছিলো।আমি থমকে গিয়ে ছিলাম।আপু এটা শোনার পর জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।আপুর যখন জ্ঞান ফিরে ততক্ষণে সে মানসিক ভারসাম্যহীনে পরিণত হয়।সবটা আমার জন্য। আমি জানতামও না আমার অজান্তেই আমার আপুর এত বড় ক্ষতি আমি করে ফেলেছি।’
নীলা কান্নায় ভেঙে পড়ে।বর্ণ কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।বেশ কিছুক্ষণ পর নীলাকে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল
-‘নিরুপমাকে দেখে তো এমন মনে হয় না।তাহলে?’
নীলা হেঁচকি থামিয়ে বলে
-‘সে ঘটনার পর দীর্ঘ পাঁচমাস আপুর চিকিৎসা চলে।তাই আপু এখন ঠিক আছে।আসলে সে ঘটনা টা মানতে পারে নি।এত বড় বেঈমানীর স্বীকার হবে সে ভাবতে পারে নি। এরপর আত্মীয় স্বজন সবাই আমার গায়ে অলক্ষীর ট্যাগ লাগিয়ে দেয়।ছিঃ ছিঃ করে সবাই। আমি নাকি অপয়া।
কিন্তু তখন আমার সাপোর্ট হয়ে দাঁড়ায় আমার পরিবার।আমার বাবা-মা আমার বড় বাবা।এমনকি আমার মানসিক ভারসাম্যহীন আপুও।আপু তো ঠিক হয়ে যায়। সব স্বাভাবিক হয়ে যায়। স্বাভাবিক হতে পারি নি আমি।খেয়াল করলাম ধীরে ধীরে চুপ হয়ে গেছি আমি।এরপর থেকে গুটিয়ে নিলাম নিজেকে।পরিবারের কেউ আমায় এ নিয়ে দোষ দেয় নি কিন্তু আমার দোষীর কাঠগাড়ায় আমি নিজেকে রেখেছি।আজও আমি দোষী।
যেখানে আপুর একটা বিয়ে ভাঙার দোষ আমার ঘাড়ে নিয়ে ঘুরছি সেখানে আবারও আপুর আরেকটা বিয়ে আমি কীভাবে ভাঙতে দেই।আর এই বিয়েটা ভাঙার চেষ্টা করলে আরও বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে আমার আপুর।এত ধাক্কা নেওয়ার ক্ষমতাও আমার পরিবারের নেই।’
বর্ণ নির্বাক হয়ে যায়। তাহলে মেয়েটা এভাবেই তার চঞ্চলতা হারিয়ে ফেলেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে।উঠে চলে যায় নিজের ফ্লাটে।
নীলার পুরোনো ক্ষত আবার তাজা হয়ে উঠে।নিজেকে পাগল মনে হয়। কীভাবে আপুর আবার ক্ষতি সে করবে।বিয়ে ভাঙলেও ক্ষতি বিয়েটা হলেও ক্ষতি। কি করবে সে?
#বিবর্ণ_নীলাম্বরী
#মম_সাহা
পর্বঃ বিংশ
মাঝে কেটে গেছে দু’দিন। নীলার সময় যাচ্ছে বেশ দ্রুত।সকালে উঠে ভার্সিটি সেখান থেকে আসতে আসতে বিকেল তারপর বর্ণদের রুমে গিয়ে কথাবার্তা বলে নাহয় রঙের সাথে ছাদে যায়। রাত নামে আকাশের বুকে ক্লান্ত পাখির মতন নীড়ে ফিরে শান্তির ঘুম দেয় সে।
একয়েকদিনে বর্ণের সাথে বেশ ভাব হয়েছে নীলার।আজকাল নীলা বর্ণের সান্নিধ্য পছন্দ করে। বর্ণ আশেপাশে থাকলে তার ভালো লাগে।
প্রতিদিনের ন্যায় আজও সকালে ঘুম থেকে উঠেছে নীলা।কিন্তু আজ তার শরীর চলছে না। ইদানীং অতিরিক্ত শীত পড়েছে আর নীলার গরম কাপড়ের প্রতি অনীহা তাই ঠান্ডা টা লেগেছে বেশ জোরদার ভাবে।
তবুও কোনো মতে তৈরী হলো নীলা।ঠান্ডায় শরীর ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।আজ ক্লাশ গুলো গুরুত্বপূর্ণ তাই যেতেই হবে।বেশ আঁটসাঁট করে গরম কাপড় পড়ে নিলো সে।এই কয়েকদিন প্রতিদিনই বের হওয়ার পর বর্ণ শীতের কাপড়ের জন্য জোড় করতো তারপর সে শীতের কাপড় পড়তো।
আজ নীলা সকালে কোনো খাবার তৈরী করে নি।তার শরীর ধীরে ধীরে বেশ অসুস্থ হচ্ছে।সে বাহিরে বের হয়ে ফ্লাটে তালা দিতেই বর্ণ আর রঙ বের হয়েছে।
নীলা তার ফ্লাটের চাবি বর্ণের মায়ের হাতে দিতেই বর্ণ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। নীলার চালচলন কেমন ধীর।শরীরে বল পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।বর্ণ সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করল
-‘নীলা আপনি ঠিক আছেন তো? কেমন অসুস্থ লাগছে আপনাকে?’
নীলা চমকে উঠে। এই ছেলেটা সব বুঝে যায় কীভাবে ভেবে অবাক হয় সে।বর্ণকে বুঝতে দিতে চায় না সে যে অসুস্থ। তাই কোনো মতে মাথা নাড়িয়ে “না” জানালো।
বর্ণ আর রঙ ওরা আসছি বলে লিফটের কাছে দাঁড়ালো। ওদের পিছে পিছে নীলাও আসলো।লিফটের দরজা খুলতেই রঙ ভিতরে চলে গেলো।বর্ণ নীলার পিছে দাঁড়িয়ে নীলাকে ঢুকতে বলল।নীলা ভিতরে যেতেই বর্ণ ওর পিছে পিছে গেলো।
রঙ প্রতিদিনের ন্যায় বকবক করছে।নীলা কেবল মাথা নাড়াচ্ছে।কোনো কথা বলছে না।কারণ তার কন্ঠস্বরের অবস্থা খুবই বাজে হয়ে গেছে ঠান্ডায়। কথা বললেই বুঝে যাবে ওরা।তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে মাথা নাড়াচ্ছে।
বর্ণ ফোনে অফিসের কিছু ফাইলের কাজ দেখছিলো।অনবরত রঙের কথা শুনে সে পিছে তাকায়। নীলা শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে মাথা নাড়াচ্ছে।
লিফট নিচে নামতেই তিনজন গাড়িতে গিয়ে বসলো।বর্ণ এবার গলা পরিষ্কার করে বলল
-‘নীলা আপনি কথা বলছেন না কেনো?’
নীলা চোখ বড় বড় করে তাকায়।বর্ণ খেয়াল করেছে তাহলে সবটা।রঙও এবার প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
-‘হ্যাঁ আপু দাভাই ঠিকই বলছে।তুমি এতক্ষণ খালি মাথা নাড়ালে।হু হাও করলে না আজ।ব্যাপার কি?’
নীলা অনেক কষ্টে উচ্চারণ করল
-‘কিছু না।’
নীলার এতটুকু উচ্চারণে বর্ণ গাড়ি ব্রেক কষে। রঙ অবাক হয়ে বলে
-‘আপু তোমার কন্ঠ এমন মর্মান্তিক হলো কীভাবে?’
নীলা করুন দৃষ্টিতে তাকায়। শব্দ উচ্চারণ করলেই গলা ব্যাথা শুরু হয়। বর্ণ গম্ভীর কন্ঠে বলল
-‘তাহলে তখন আমি ঠিকই ধরে ছিলাম।আপনি অসুস্থ। শুধু অসুস্থ না ভীষন রকমের অসুস্থ। কথা অব্দি বলতে পারছেন না।’
নীলা মাথা নিচু করে ফেলল।বর্ণ নীলাকে চুপ থাকতে দেখে বলল
-‘এখন চুপ করে আছেন যে? নিশ্চয়ই গলা ব্যাথার জন্য কথা বলতে পারছেন না?’
নীলা উপর-নীচ মাথা নাড়ায়। বর্ণ ওর গাড়ির ড্রয়ার থেকে কত গুলো ওষুধের থেকে দুটো ওষুধ নীলার দিকে বাড়িয়ে দেয়। পানির বোতল নীলার হাতে দিয়ে ওষুধ খেতে বলে।
নীলা বর্ণের ভিতর নিজের বাবার প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়।চোখ ছলছল করে উঠে তার।বাবা তার জীবতে বট গাছের মতন।বাবা না থাকলে কি হতো ভেবেই কলিজা মোচড় দিয়ে উঠে তার।বাবার অবর্তমানে এ লোকটাও তার বেশ খেয়াল রাখছে। লোকটার এসব আচরণে সে লোকটার প্রতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।
এসব ভাবতে ভাবতে ক্যাম্পাসের সামনে চলে আসে ওরা।বর্ণ নিতে আসবে বলে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যায়। আর নীলার খেয়াল রাখতে বলেছে রঙকে।
_______
আজ ক্যাম্পাস বেশ গরম। রাজনৈতিক ঝামেলা চলছে।নীলা আর ওর বন্ধুরা ক্লাশ রুমে গিয়ে বসলো।রঙকে ওর ক্লাশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ক্যাম্পাসে ঘুরাঘুরি করাটা বেশ বিপজ্জনক এখন।সবাই বসে কথা বলছে এর মাঝেই নীলাকে এক জুনিয়র মেয়ে এসে বলল
-‘আপু আপনি নীলা না?’
নীলা অবাক হয়ে মাথা উপর নীচ করলো। মানে সে ই নীলা।মেয়েটা নীলাকে বিপরীতের বিল্ডিং এর করিডোর দেখিয়ে বলল
-‘আপনাকে ওখানে একজন ডাকছে।’
নীলা অবাক হয়ে বলল
-‘কে ডাকছে?’
মেয়েটি হেসে বলল
-‘তা তো আপনি গেলেই দেখতে পারবেন আপু।চলুন আমার সাথে।’
নীলা সবাইকে বসতে বলে মেয়েটার সাথে গেলো।অহন আসতে চেয়েছিলো কিন্তু নীলা না করে দেয়।
নীলা মেয়েটার পিছে পিছে করিডোরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।মেয়েটা নীলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে চলে গেলো। মেয়েটা চলে গেলেই পিছন থেকে একটা শক্ত পুরুষ নালী কণ্ঠ ভেসে আসলো
-‘আমি ডেকেছি তোমায় নীলা।’
পরিচিত কন্ঠ শুনে পিছে ঘুরে তাকায় নীলা।পিছে শুভ্রমকে দেখে ভ্র কুঁচকে তাকায় সে।শুভ্রম নীলার দিকে কয়েকটা শুভ্র গোলাপ এগিয়ে দিয়ে বলল
-‘এটা তোমার জন্য এনে ছিলাম।রাস্তায় হঠাৎ সাদা গোলাপে চোখ আটকিয়ে গিয়েছিলো তখনই তোমার কথা মনে পড়লো তাই নিয়ে আসলাম। সবার সামনে তো দেওয়া যাবে না তাই এখানে ডেকেছি।’
নীলা নিজের দু’হাত বুকের মাঝে গুঁজে ভ্রু উঁচু করে জিজ্ঞেস করল
-‘আচ্ছা কালো গোলাপ দেখেন নি?’
নীলার এমন প্রশ্নে অবাক হয় শুভ্রম মাথা নাড়িয়ে বলল
-‘হ্যাঁ ছিলো তো কিন্তু কালো গোলাপ টা কেনো জেনো ভালো লাগে নি।কেমন বিদঘুটে লাগে।গোলাপ তো সাদা’ই সুন্দর।’
নীলা হেসে বলল
-‘আসলে ঐ কালো গোলাপ টাই আমি ছিলাম।আপনি বরাবরেরই মতন রঙে মন ভুলালেন সৌন্দর্য চিনলেন না।শুভ্র মানেই যে সুন্দর তা তো না।হ্যাঁ জানি সব ফুল সুন্দর।আপনি কি জানেন ঐ ফুল হলো মেয়ে।যেমন সব ফুল সুন্দর তেমনই সব মেয়ে সুন্দর।কিন্তু আমরা মানে আমরা সবাই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে এটা মানি না।আমরা শুভ্র মানে সুন্দর কালো মানে বিদঘুটে ভেবেই বসে থাকি।
নীলার কথা আচ্ছা মতন লজ্জা পেলো শুভ্রম।মাথা নিচু করে বলল
-‘আমারই ভুল নীলা।তুমি কি আরেকবার আমাকে নীলা থেকে নীলাম্বরী ডাকার অধিকার দিবে?আমি সব ভুল শুধরে নিবো।’
নীলা আগের ন্যায় হাসি বজায় রেখেই বলল
-‘আমি তো কখনোই নীলাম্বরী ডাকার অধিকার আপনাকে দেই নি।আপনি নিজেই ডেকে ছিলেন। তারপর আপনি নিজেই বুজে ছিলেন আসলে আপনি এই নামটা ডাকার যোগ্য না তাই ডাকেন না।সব তো আপনিই করলেন তাহলে আবার নতুন করে জিজ্ঞেস করছেন কেন?’
শুভ্রম ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে। তারপর বলে
-‘তোমার সব কথা যুক্তিযুক্ত। তবে তুমি শুভ্র রাঙা জামা কেন পড়ো? কালো পড়লেই পারো।’
নীলা “কিছু না” বলে চলে আসতে নিলে পিছন থেকে শুভ্রম বলল
-‘আমাকে পছন্দ করো না কিন্তু আমার ইচ্ছেই রাখছো নীলা? রিফিউজের দিন আমার আকুতি তবে একটু হলেও তোমার মনে লেগে ছিলো।এতটুকুতেই ধন্য আমি।’
নীলা কথা পাত্তা না দিয়ে নিচে নেমে আসে।হ্যাঁ যেদিন শুভ্রমের প্রপোজাল রিফিউজড করে ছিলো সেদিনই শুভ্রম বলে ছিলো অন্তত তার প্রিয় রঙটা জেনো সবসময় জড়িয়ে রাখে।এটাই তার প্রাপ্তি হবে।নীলা শুভ্রমের প্রতি এক পুরোনো কৃতজ্ঞতা থেকে এই কথা টা রেখে ছিলো।
______
কলেজের ঝামেলা বেশ গুরুতর। আজ কোনো ক্লাশই হয় নি।সবাইকে আটকিয়ে রাখা হয়েছে ক্যাম্পাসে জেনো ঝামেলাতে কেউ আঘাতপ্রাপ্ত না হয়।
বর্ণকে রঙ কল দিয়ে কলেজের সামনে আসতে বলেছে।মেইন গেইট এখনি খোলা হবে তখন সব শিক্ষার্থীদের কলেজ ক্যাম্পাস ছাড়তে হবে।
সবাই গেইটের পাশে পাশে ঘুরঘুর করছে। হঠাৎ রঙের চোখ গেলো দিয়ার দিকে।সে নীলাকে খোঁচা দিয়ে দিয়াকে দেখালো।নীলা ভ্রু কুঁচকে বলল
-‘দিয়া কখন আসলো ক্যাম্পাসে? ওরে না ক্যাম্পাস বহিষ্কার করা হয়েছিলো?’
রঙ মুখ গোমড়া করে বলল
-‘রাজনৈতিক দলের সাথে ওর সম্পর্ক আছে।আজ ঝামেলা না সেই জন্য হয়তো এসেছে।’
ওদের কথার মাঝেই গেইট খুলে দেয়। গেইটের সামনে বর্ণের গাড়ি দেখে রঙ দৌড়ে চলে যায় বর্ণের কাছে।নীলা যেতে নিলেই দেখে এক ছেলে তার হাতে কাচের বোতলে কোনো একটা তরল পদার্থ নিয়ে দিয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।তরল পদার্থ টা কি সেটা নীলার বুঝতে বাকি রইল না।
নীলা দৌড়ে দিয়াকে সরাতে সরাতে তরল পদার্থ টা ছুঁড়ে মারল ছেলেটা।গগণ বিদারক আত্ম চিৎকারে ভারী হয়ে যায় জায়গা সবাই হা হয়ে তাকিয়ে রইল।বর্ণ কেবল চিৎকার দিয়ে বলল
-‘নীলাম্বরী!!’
#চলবে
#চলবে