হয়ত পর্ব ২৬+২৭

#হয়ত
পর্ব:- ২৬ ও ২৭
.
-‘কী করছো তাপৌষি?’

তাপৌষি বসে আছে দিশার ঘরের বারান্দায়। খুব বড় না আবার খুব ছোটও না, মোটামুটি ধাচের বারান্দা বলা চলে একে। এই ফ্ল্যাটে এই বারান্দাটাই সবচেয়ে বেশি সুন্দর। পরিষ্কার, খোলামেলা বারান্দার একপাশে কিছু গাছ সাজানো রয়েছে, আর একপাশে তিনটি বেতের চেয়ার রাখা আছে। ফ্ল্যাটের বাকী বারান্দাগুলো কে বারান্দা কম স্টোর রুম বেশি বলা চলে। এতো জিনিসপত্র ঠেসে ঢুকানো যে দাঁড়ানোর জায়গা অবধি নেই।

-‘ অথৈ আপু, এই তো বসে আছি। বারান্দাটা খুব সুন্দর, তাইনা? ব্যস্ত ঢাকা শহরের দৃশ্য খুব সহজেই দেখা যায়। এই গাছ গুলো কে লাগিয়েছে বলতে পারবে?’
-‘ দিশা লাগিয়েছে।’
-‘ বাহ! খুব সুন্দর হয়েছে।’
-‘ একা বসে আছো যে?’
-‘ এমনি। কিছুটা সময় একান্তে নিজের সাথে কাটাচ্ছি। ‘
-‘ আমি কি তোমাকে ডিস্টার্ব করে ফেললাম?’
-‘ এমা না, না। চা খাবে?’
-‘ নাহ।’
অথৈ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাপৌষিকে পর্যবেক্ষণ করছে। ওর পাশে বসা মেয়েটা সত্যি খুব রূপবতী। মেয়েটা যদি কম সুন্দর হতো অথবা চালিয়ে নেওয়ার মতো হতো তাহলে আজ অথৈ এতো টা মিইয়ে যেত না। অন্তর থেকে দীর্ঘ নিশ্বাস বের হয়ে আসলো অথৈর।
তাপৌষি একবার অথৈকে বাঁকা চোখে দেখল। আজ কী হয়েছে অথৈর? এভাবে তাকাচ্ছে কেন?
-‘ কী হয়েছে আপু?’
-‘ তাপৌষি একটা ধ্রুব সত্যি জানো? ভালোবাসা অন্যায় নয় তবে ভুল মানুষকে ভালোবাসা অন্যায়।’
-‘ বুঝলাম না আমি।’
-‘ আমি বর্ষণের কথা বলছি।’
তাপৌষি এবার একটু নড়েচড়ে বসলো।
-‘ এবারও ঠিক বুঝলাম না।’
-‘ ওহ কাম ওন তাপৌষি। আই এম নট এ কিড। তুমি কি করছো তা আমি খুব ভালোমতোই দেখতে পাচ্ছি। বয়স অনেক কম তোমার। এই যে বর্ষণকে নিয়ে তোমার মনের মাঝে যে অনুভূতির জন্ম হয়েছে তা নিতান্ত বাচ্চা বয়সের আবেগ।’
-‘ এভাবে কেন বলছো আপু?’
-‘ তো কীভাবে বলবো?’ বলো বর্ষণকে নিয়ে তোমার মনে কোন অনুভূতি জাগ্রত হয়নি?… হয়নি? এন্সার মি ড্যামিট।’
অথৈর গলা চড়ে গেছে। ও জোরে জোরে কথা বলতে শুরু করেছে। বেতের চেয়ার থেকে তাপৌষির সম্মুখে উঠে দাঁড়িয়েছে।
তাপৌষির কান্না পাচ্ছে। অথৈ রীতিমত ওকে ধমকাচ্ছে। তাপৌষি কখনো মিথ্যা বলেনি। মিথ্যা বলার প্রয়োজনই পড়ে নি কখনো। আর আজ অথৈ যে প্রশ্ন করেছে সে প্রশ্নের উত্তর তাপৌষির জন্য খুব বিশুদ্ধ।
-‘ হ্যাঁ হয়েছে।’
-‘ জানতাম আমি। ঠিক ধরেছি। শুনো তাপৌষি তুমি বাচ্চা মানুষ। তোমার সাথে আমার লড়াই সাজে না। বর্ষণ আমার হবু স্বামী।’
বাঁ হাতের অনামিকা আঙুলে চকচক করা একটি উজ্জ্বল আংটি তাপৌষির মুখের সামনে তুলে ধরে অথৈ আবার বলল,
-‘ এই যে এটা দেখছো? এই আংটি বর্ষণের মা আমাকে পড়িয়ে দিয়েছেন। আমি উনার হবু পুত্রবধূ। দুই বছর পরই বর্ষণ আর আমার বিয়ে। আমাদের মাঝে কেন আসছ?’
তাপৌষির চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। ও এরকম একটা ভুল কী করে করতে পারলো? ও তো কখনো শুভ্রা হতে চায়নি। বরং শুভ্রা নামের মানুষটিকে ও মনে প্রাণে ঘৃণা করে এসেছে তার কৃতকর্মের জন্য। আজ তাপৌষির মনে হচ্ছে ও দ্বিতীয় শুভ্রা হয়ে উঠেছে।
.
-‘ তুমি জানতে না?’
তাপৌষির কণ্ঠস্বর আজ বাজেয়াপ্ত। মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। ঠোঁট কাঁপছে তিরতির করে। হাত-পা অবশ লাগছে। ও ডানেবামে মাথা নাড়ায়।
-‘ আমারও তাই মনে হয়েছিল। জানলে কখনোই নিজের আবেগকে প্রশ্রয় দিতে না। তুমি ভালো মেয়ে তাপৌষি। কেন অযথা আমাদের মাঝে নিজেকে জড়াচ্ছ? ঢাকায় ঘুরতে এসেছ। ঘুরা শেষ হলে চলে যাবা।’

মধ্যাহ্নের অবসরে আকাশে আবার একদল কালো মেঘের বিস্তৃতি ঘটেছে। হয়ত আর একটু পরেই শহরের বুকে ঝুম বৃষ্টি নামবে।
অথৈ পুনরায় তাপৌষির পাশে বসলো। আকাশ পানে চেয়ে বলল,
-‘ ভালোবাসি শব্দটি যেদিন থেকে বুঝতে শিখেছিলাম সেদিন থেকে বর্ষণকে ভালোবাসি। আমার জীবনের সবটা জুড়ে ওই একটা নামই খেলা করে সব সময়। সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিতে চাই এই মানুষটির সাথে। বর্ষণ হাসলে আমি হাসি, বর্ষণ কাঁদলে আমি কাঁদি। আমার অক্সিজেন ও। বড্ড বেশি ভালোবাসি তাপৌষি। এই মানুষটি একান্তই আমার। যখন ওকে কেউ কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে তখন খুব কষ্ট হয়। নিজেকে সামলাতে পারিনা। বলো তুমি ওকে আমার থেকে কেড়ে নিবে না। প্রমিস করো তাপৌষি। প্রমিস মি।’
অথৈ তাপৌষির দুই হাত নিজের হাতের মধ্যে ধরে আছে। বলতে গেলে এক প্রকার অনুনয় করছে ও তাপৌষির কাছে।

গতকাল বর্ষণের চোখে তাপৌষি নিজের জন্য একটা বিশেষ জায়গা দেখেছে। সেই জায়গা কী ভালোবাসা নয়? মাথা ঝিমঝিম করছে তাপৌষির। সব কষ্ট কেন ওর একার ভাগ্যে লিখা?

চোখ জোড়া একবার বন্ধ করে পুনরায় মেলে ধরলো অথৈর সামনে।
-‘ যেই মানুষটির ভালোবাসার জন্য আমাকে সরে যেতে বলছ, তাকে কখনো জিজ্ঞেস করেছ সে তোমাকে ভালোবাসে কী না?’

কোথাও দূরে হয়ত একটা বিকট আওয়াজে বাজ পড়েছে। অথৈ তাপৌষির প্রশ্ন শুনে ওর হাত ছেড়ে দিয়েছে। তাপৌষি নিজ প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছে। অথৈর ওই রক্তশুণ্য চেহারা ওকে ওর প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছে।
-‘ ভালোবাসা ছাড়া বিয়েতে সুখ পাবে অথৈ আপু?’
-‘ বর্ষণও আমাকে ভালোবাসে। ওর সম্মতিতে আন্টি নিজে আমাকে পরিবারের সকলের সামনে আংটি পড়িয়ে দিয়েছেন।’
-‘ কখনো তোমাকে ভালোবাসি কথাটি বলেছে? জোর করছো না তো?’
অথৈর মন কু-গাইছে। আজ প্রচণ্ড ভয় হচ্ছে ওর। তাপৌষি ওকে বিভ্রান্ত করে তুলেছে। চুপচাপ তাপৌষির পাশে থেকে উঠে দাঁড়ায় ও। পা বাড়ায় ঘরের দিকে। হঠাৎ পা থামিয়ে পিছিনে ফিরে তাপৌষির দিকে তাকায়।
-‘ কাল সকালের ট্রেনে তুমি রাজশাহী রওনা দিবে তাপৌষি। আমি তোমাকে আর এখানে সহ্য করতে পারছিনা। আমি আমার ড্রাইভারকে বলে দিব। সে এসে তোমাকে স্টেশন অবধি ছেড়ে দিবে। বাপি তোমার টিকেট কেটে দিবে। চিন্তা করো না আমি এসি কেবিনের টিকিট বুক করে দিতে বলবো।’
অথৈ যথাযথ ভাবে তাপৌষির সামনে নিজের প্রতিপত্তি দেখিয়ে গিয়েছে তা বুঝতে তাপৌষির দ্বিধা হয়নি। বুক চিড়ে এক গভীর নিশ্বাস বের হয়ে আসলো ওর।
.
রৌদ আজ সকাল সকাল তাড়াহুড়ো করে বের হয়েছিল। ছাতা নেয়নি বিধায় বাসায় আসার সময় বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছে। ওর এমনিতেই নিউমোনিয়ার সমস্যা আছে। ঠাণ্ডা একেবারেই সহ্য করতে পারেনা। এটা আবার শীতের বৃষ্টি। যদিও নভেম্বর মাসে ঢাকা শহরে শীত, গ্রীষ্ম সব একই মনে হয়। তবুও এই অসময়ে বৃষ্টি শরীরের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
কোন রকমে জামা কাপড় ছেড়ে গায়ে পানি ঢালে ও। বৃষ্টির পানিতে ঠাণ্ডা লাগতে পারে। নিজের ধোয়া কাপড় গুলো হাতে করে বারান্দায় মেলে দিতে যায়। ওরা তিন ভাইবোন সব সময় নিজের কাজ নিজে করে। ছোটবেলা থেকে তনয়া বেগম ওদের এই শিক্ষাই দিয়ে এসেছেন।

অন্যান্য দিনগুলিতে ছাদে কাপড় মেলা হলেও আজ বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। কাপড় মেলার মতো একমাত্র জায়গা দিশার ঘরের বারান্দা। তবে এ বারান্দা দিশার বড় সাধের বারান্দা। ও কখনো এই বারান্দায় কাপড় মেলেনা, কাউকে মেলতেও দেয়না। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, বাসায় আসার পরই রৌদ জানতে পেরেছে দিশা কোন এক বান্ধবীর বাসায় আছে। বৃষ্টির কারণে আসতে পারছে না। সন্ধ্যা হয়ে আসছে দেখে বর্ষণ ওকে আনতে গিয়েছে।
.
-‘ কে ওখানে? ওহ তাপৌষি?’
রৌদ অন্ধকারে তাপৌষিকে বসে থাকতে দেখে ওর দিকে এগিয়ে এসেছে। ও অবাক হয়েছে এই অন্ধকারে তাপৌষি একা কীভাবে বসে আছে এ ভেবে। কে জানে গায়ে ভূতটুত আছে কীনা। থাকতেও পারে। নইলে এই অন্ধকারে বসে থাকে?
-‘ একা অন্ধকারে বসে আছো কেন?’
তাপৌষি সেই দুপুর থেকে থেমে থেমে কান্না করছে। মুখ চোখ লাল হয়ে গেছে। তনয়া বেগম একবার এসে দেখে গেছেন। কিন্তু তখন তাপৌষি “একা থাকতে চাই কিছুক্ষণ” বলে তনয়া বেগমকে চলে যেতে বলে। ওর মাথা ব্যথা করছে এখন।
ও চিকন গলায় রৌদকে উত্তর দিল,
-‘ এমনি ভাইয়া।’
-‘ কাঁদছিলে? কেউ কিছু বলেছে?’
-‘ নাহ।’

রৌদের মনে হচ্ছে কোথাও একটা গণ্ডগোল হয়েছে। ও বারান্দা থেকে বের হয়ে আসে। তাপৌষি এখন ওর সাথে কথা বলবে না কোন বিষয়ে তা রৌদ তাপৌষির কথা বলার ধরণ দেখে বুঝতে পেরেছে।

ডাইনিং রুমে টেবিলে বসে অথৈ আপেল, কলা, আঙুর কাটছিল। ও আজ বর্ষণের প্রিয় কাস্টার্ড করেছে। ফ্রিজে রেখে এসেছে এইমাত্র। চকলেট সিরাপ বাসায় আছে ভেবেছিল। তবে লাস্ট মিনিটে দেখে চকলেট সিরাপ মিসিং। বাধ্য হয়েই ওকে আইসিং স্যুগার আর কোকো পাউডার মিক্স করে চকলেট সিরাপ করতে হয়েছে। সেই সাথে ছোট ছোট চকলেট চিপসও নিজ হাতে বানিয়েছে। চিপস সেট হওয়ার জন্য ডিপফ্রিজে রেখেছে প্রায় পনেরো মিনিট আগে। বর্ষণ আসলে সুন্দর ভাবে পরিবেশন করে খেতে দিবে।
-‘ মা কোথায়?’
-‘ ঘরে, শুয়ে আছে।’
রৌদ অথৈ এর সামনের চেয়ারটা টেনে বসলো। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করলো,
-‘ তাপৌষিকে কী বলেছ?’
অথৈ হাতের চাকু রেখে রৌদের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। কাটা এক টুকরো আপেল মুখে তুলে নিয়ে চাবাতে চাবাতে উত্তর দিল,
-‘ যা বলতে বলেছিলে তাই বলেছি।’
-‘ আমি সত্যিটা জানাতে বলেছি তোমাকে।’
-‘ আমি সত্যিটাই জানিয়েছি।’
-‘ আর কিছু বলনি? ‘
রৌদের মনে খটকা লাগছে। ওর মনে হচ্ছে অথৈ ওর থেকে কিছু লুকাচ্ছে। সম্পূর্ণ কথোপকথন ওকে বলতে চাচ্ছে না। তাপৌষি আর বর্ষণের বিষয়টা অথৈ কে জানিয়ে ও কোন ভুল করলো না তো?
কয়েকদিন আগেই তাপৌষির বর্ষণের প্রতি জাগ্রত হওয়া অনুভূতি রৌদ টের পেয়েছিল। রৌদের বিশ্বাস দিশাও এই বিষয়টা ধরতে পেরেছে। তবে ও তাপৌষির জন্য বর্ষণের অস্বাভাবিক চাহনি দেখে থতমত খেয়ে গেছিল। বর্ষণের পার্সোনালিটিটাই এমন যে মেয়েরা ওকে খুব করে চায়। ওর কথাবার্তা, চাল-চলন মেয়েদের রাতের ঘুম কাড়তে যথেষ্ট। আর সেই বর্ষণ তাপৌষির দিকে তাকায় প্রেমময় চাহনিতে। রৌদের মনে হচ্ছিল অথৈ ঠকছে এভাবে। বাধ্য হয়েই অথৈ কে ও জানিয়েছিল ঘটনাটা। তারপর অথৈ আর এইখান থেকে সরেনি। নিজের বাড়িতে অবধি যায় নি।
-‘ কি লুকাচ্ছো অথৈ? ‘
-‘ ভাবি বলছো না যে? কী ব্যাপার দেবর জি?’
-‘ ফাজলামি না করে প্রশ্নের সঠিক উত্তর দাও।’
-‘কেন কী হয়েছে?’
-‘ বারান্দায় যেয়ে মেয়েটার অবস্থা একবার দেখে আসো। মুখ চোখ ফুলে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে গলা বসে গেছে।’
-‘ সত্য তিতা হবেই। সেই তিতা ওকে সহ্য করতেই হবে।’
-‘ কেন সহ্য করবে ও? কী দোষ ওর? ও ভাইয়াকে বলেছে আসো আমার প্রেমে পড়ো? ব্যর্থতা তোমার। কেন ভাইয়া এতো বছরেও তোমাকে ভালোবাসতে পারেনি? ‘
-‘ রৌদদ..’
-‘চিল্লাবা না খবরদার। বাচ্চা মেয়েটাকে আর কী বলেছ বলো অথৈ।’
অথৈ টেবিল থেকে কাটা ফলের প্লেট আর চাকু তুলে নিতে নিতে নিতান্ত অনিচ্ছায় বলল,
-‘ বলেছি ও যেন ব্যাগ পত্র সব গুছিয়ে রাখে। বাপি টিকিট বুক করে দিবে ওর রাজশাহী যাওয়ার। চাইলে আমার গাড়ি নিয়ে যেতে পারে স্টেশন অবধি। আর হ্যাঁ এও বলেছি এসি কেবিনের টিকিট বুক করে দিব।’
-‘ ওকে তুমি টাকার অহংকার দেখিয়ে এসেছ?’
-‘ হোয়াটএভার। সাইড দাও রান্নাঘরে যাব। ‘
-‘ ঘৃণা লাগছে না নিজের উপর?’
-‘ না লাগছে না। আমি আমার নৌকার ছেঁড়া পাল জোড়াতালি দিয়ে জোড়া লাগাতে চাচ্ছি। অন্যায় করিনি কিছু। তাপৌষির মতো বাচ্চা মেয়েকে আমি কখনো জিততে দিবো না।’
-‘ ভাইয়াকে কী তোমার কোন ট্রফি মনে হয়। যেটা তোমাকে জিততে হবে? ভালোবাসায় হার- জিত কই পেলে তুমি? আর কী নৌকা নৌকা করছো? ভাইয়া নৌকা? হাসালে অথৈ। তাহলে তো বলতেই হয়, নৌকাটাকে কী তুমি নিজের সম্পদ ভাবছ? কোন দিন কিন্তু সেই নৌকা তোমাকে নিজের মনে করেনি। তুমি ছেড়া পাল ঠিক করো। সেলাই করে জোড়া লাগাও যাও। তবে মন তো ছিঁড়ে গেছে। সেটা জোড়া লাগাবে কী করে?’
রৌদ অথৈর হাতে থাকা প্লেট থেকে এক টুকরো আপেল তুলে নিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। অথৈ এর রাগ লাগছে রৌদের উপর। এরা ওকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না কেন? টেবিলে থাকা ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে ও ডায়েল লিস্টের প্রথমে থাকা মানুষটাকে ফোন দিল।
-‘ হ্যালো বাপি, আই নিড আ হ্যাল্প।’
.
রৌদ ওর এ্যাকোস্টিক গীটারটা নিয়ে তাপৌষির পাশে রাখা একটা বেতের চেয়ারে বসলো। মানুষের অনেক রকম শখ থাকতে পারে। যেমন:- কারো বিভিন্ন দেশের মুদ্রা, ডাকটিকিট সংগ্রহের শখ থাকে তো আবার কারব থাকে বিভিন্ন ডিজাইনের ড্রেসের শখ। রৌদের তেমন বিভিন্ন গীটার সংগ্রহের শখ। ওর মনে আছে যখন প্রথম গীটার শিখার আবদার করেছিল, বর্ষণ তখন নিজের জমানো টাকা দিয়ে ওকে Yamaha F310P কিনে দিয়েছিল। তবে রৌদ সেটা প্রথমে ব্যবহার করেনি। ওর কাছে মনে হয়েছিল প্রথমবার এ্যাকোস্টিক গীটারের চেয়ে নাইলন তারের ক্ল্যাসিক্যাল গীটার বেশি ভালো হবে। তাই নিজের কাছে কিছু জমানো টাকা ও তনয়া বেগমের থেকে কিছু টাকা নিয়ে রৌদ পছন্দমত গীটার কিনে নিয়ে আসে। Yamaha F310P তখন রৌদের ঘরের এক পাশে পড়ে ছিল। বর্ষণ হয়ত খুব কষ্ট পেয়েছিল। রৌদ কিন্তু গীটাএ শেখার পর থেকে বর্ষণের দেওয়া গীটারটাই ব্যবহার করে। ওর হাতেও এখন বর্ষণের দেওয়া সেই গীটারটা। রৌদের সংগ্রহের লিস্টে আছে এক্সে, টিগম, দ্যা রোজ, ড্রিম মেকার, ডেভিসার, হার্জ, ফেন্ডার, গিভেসন, গুলসন, সিগনেচার সহ আরও অনেক কয়টা গীটার।
.
তাপৌষির কানে ভেসে আসছে গিটারে টুংটুং শব্দ। কিন্তু মেয়েটার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই এতে। ও নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। রৌদ অনেকক্ষণ ধরেই তাপৌষির সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে। তাপৌষি কথা বলার প্রতি কোনরূপ ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছেনা। এটাই ভাবাচ্ছে রৌদকে। কথায় আছে “অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর”। তাপৌষি অধিক শোকে আছে। তাপৌষির কেন যেন মনে হচ্ছে একটু আগে অথৈর সাথে হওয়া ওর কথোপকথন পুরোটাই দুঃস্বপ্ন। ঘুম ভাঙলে স্বপ্ন কেটে যাবে।

-‘ কথা বলবে না তাপৌষি? তুমি তো খুব ভালো গান পারো। আমাকে শোনাবে?’
তাপৌষি রৌদের কোন কথার জবাব দিচ্ছেনা, চুপচাপ বসে আছে।
হঠাৎ তাপৌষি রৌদের হাতের গিটারটা নিজ হাতে তুলে নিল। ওর কণ্ঠে ভেসে উঠলো রিচার্ড মার্ক্সের কালজয়ী “Right Here Waiting For You” গানটি।

Oceans apart day after day
And I slowly go insane
I hear your voice on the line
But it doesn’t stop the pain
If I see you next to never
How can we say forever
Wherever you go
Whatever you do
I will be right here waiting for you
Whatever it takes
Or how my heart breaks
I will be right here waiting for you
.
এই মেয়েটা গীটার বাজাতে পারে! গুণী কন্যা। কত সুন্দর করে গান গাচ্ছে। গলাটা একটু বসা বসা। তবে এই বসা গলা আর কষ্ট মিশ্রিত অশ্রুর কারণে গানটা শ্রুতিমধুর লাগছে।

I took for granted, all the times
That I thought would last somehow
I hear the laughter, I taste the tears
But I can’t get near you now
Oh, can’t you see it baby
You’ve got me going crazy
Wherever you go
Whatever you do
I will be right here waiting for you

রৌদ বুঝতে পারছে তাপৌষি সত্যি বর্ষণকে খুব ভালোবাসে। এই যে এই কষ্টের অবকাশে ওর হৃদয় থেকে যে সুর বের হয়ে আসছে তা শুধুমাত্র বর্ষণের জন্য। গানের সাথে সাথে চোখ দিয়ে অনবরত বর্ষিত হওয়া পানি গুলোর একমাত্র কারণ বর্ষণের ভালোবাসা। তবে কিছু কিছু সময় ভালোবাসা প্রধান হয়ে উঠে না। বর্ষণ কখনোই তাপৌষির প্রতি নিজের অনুভূতি গুলো সকলের সামনে ব্যক্ত করবে না। রৌদ নিজের ভাইকে চিনে। বর্ষণ কখনোই অথৈকে ছেড়ে তাপৌষিকে গ্রহণ করবে না। বাচ্চা মেয়েটা শুধু শুধু কষ্ট পাচ্ছে।

Whatever it takes
Or how my heart breaks
I will be right here waiting for you
I wonder how we can survive
This romance
But in the end if I’m with you
I’ll take the chance
Oh, can’t you see it baby
You’ve got me going crazy
Wherever you go
Whatever you do
I will be right here waiting for you
Whatever it takes
Or how my heart breaks
I will be right here waiting for you
Waiting for you…..
.
-‘ভালো গান গাও তুমি।’
-‘ ধন্যবাদ।’
তাপৌষি নিজের হাতে থাকা ফোনটা রৌদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
-‘ ভাইয়া ওয়াইফাই এর পাসওয়ার্ড কী চেঞ্জ করা হয়েছে? আমি আসলে কানেক্ট করতে পারছি না।’
-‘ সেটা তো জানিনা। জরুরি কোন দরকার। কিছু ই-মেইল করবা?’
-‘ নাহ। অনলাইন টিকেট কাটবো। খুব জরুরি দরকারে কাল রাজশাহী যেতে হবে আমাকে।’
-‘ কী দরকার।’
-‘ ব্যক্তিগত বিষয়।’
রৌদ তাপৌষির কথার পিঠে আর কোন কথা বললো না। তাপৌষি বর্ষণের মতোই। প্রচণ্ড আত্মমর্যাদা সম্পন্ন একজন মানুষ। অথৈ এর গাড়ি আর এসি কেবিন ও কখনোই নিবে না। রৌদের মনে হচ্ছে ও অন্যায় করলো তাপৌষির সাথে, অন্যায় করলো বর্ষণের সাথে। অথৈ কে বলা হয়ত উচিত হয়নি। ভালোবাসা তো কখনো সময় মেপে হয়না। আজ অথৈ এর ব্যবহার সত্যি খুব ত্রুটিপূর্ণ ছিল ।
রৌদ বিড়বিড় করে বলল,” বর্ষণকে পেয়েও হেরে গেলে অথৈ”।
.
.
চলবে…

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here