#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-১১
#রূবাইবা_মেহউইশ
___________________
গৌধূলি কমলারঙে রঙিন হয়ে পশ্চিমে পাড়ি জমিয়েছিলো অনেক আগেই। পথে অন্ধকার সড়কবাতির আলো তো কখনো আসা যাওয়া করা গাড়ির হেড লাইটে সাঁই করে পেছনে চলে যাচ্ছে। থালার মত এক মস্ত চাঁদ খোলা আকাশে ঝলমলিয়ে হাসছে। হাত দুটো ব্যাথায় অবশ হয়ে আসছে মেহউইশের। সারাটাদিন একটা তিন মাসের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বসে থাকা তার জীবনে এটাই প্রথম। হাসপাতালে বাচ্চাদের ওয়ার্ডে সে কাজ করেনি কখনও তবুও একটু আধটু নিয়েছিলো কোলে৷ কিন্তু এভাবে সারাদিন! আত্মীয়-স্বজনও তেমন ছিলো না তাই অভিজ্ঞতার ছিটেফোঁটাও নেই তার। যে পথ আট ঘন্টায় শেষ করা যেত তা দশ ঘন্টার বেশি লাগছে তাদের । পথিমধ্যে গাড়ি থামিয়ে থামিয়ে নির্জনকে খাওয়ানো আবার সে টয়লেট করায় ডায়াপার চেঞ্জ করা নির্জনকে সাফ করার কাজটাও রিশাদ নিজ হাতেই করেছে৷ মেহউইশ অবাক হয়ে শুধুই তাকিয়েছিলো। একটা ছেলে এতোটা দক্ষ হাতে সন্তানের যত্ন করতে পারে! সেও কিনা প্রথম সন্তান৷ মেহউইশ মেয়ে হয়েও এতখানি যত্ন কি করতে পারবে? ‘কক্ষনোই না’ নিজের ভেতর থেকেই সে জবাব পায়। রিশাদ মানুষ হিসেবে কেমন তা প্রথম দিনের আচরণে লেগেছিলো দানবের মতন। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ দিনেও অথচ আজকের এই রুপে সে এতোটাও মন্দ নয় ।কোথাও একটা লেখা পড়েছিলো মেহউইশ, হুমায়ূন আহমেদ স্যার তার মেয়ে শিলাকে বলেছিলো পৃথিবীতে খারাপ পুরুষ অনেক আছে কিন্তু খারাপ বাবা একটাও নেই।’ সন্তানের ভালো প্রতিটা বাবাই চায়। মায়েরা কি চায় না! অবশ্যই চায় নইলে নীলিমা এতোটা রিস্ক নিয়ে রিশাদের মত লোকের পেছনে লোক লাগানোর সাহস করতো না। আমার খোঁজও সে জানতো না আর আমাকেও এসে অনুরোধ করতো না নির্জনকে দিয়ে দিতে। নীলিমা সেদিন যা করেছিলো সবটাই সন্তানকে ফিরে পাওয়ার জন্য কিন্তু সে যে ভুল করেছে তা হয়তো কখনোই আর সন্তানকে ফিরে পাওয়ার পথ করে দিবে না। অন্তত এই চারদিনে মেহউইশ যেই রিশাদকে দেখেছে নীলিমার জন্য ছেলেকে নিজের করে পাওয়া অসম্ভব । বুকের ভেতর থেকে এক দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে মেহউইশের। জীবন বড় বিচিত্র। যেই লোকটা সন্তানের জীবনে পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো পিতা সেই মানুষটাই আবার একটা মেয়ের জীবনে সবচেয়ে খারাপ লোক।
রাতের আঁধার ঘন থেকে ঘনতর হচ্ছে ।সমতল ভূমি ছেড়ে গাড়ি পাহাড়ি রাস্তায় উঠছে ধীরে ধীরে৷ মেহউইশ গাড়ির ভেতরে বসে অন্ধকারে যতটুকু ঠাওর করলো তারা পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা বেয়ে মোটামুটি উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। গায়ে পশম কাঁটা দিচ্ছে ভয়ে। এ পথে ঢাকা শহরের মত যেখানে সেখানে ল্যাম্পপোস্ট নেই। গা কাঁপিয়ে কান্না চলে আসবে আসবে অবস্থা।দু চোখ বন্ধ রেখে বিড়বিড় করে দোয়া পড়তে শুরু করলো মেহউইশ আর দু হাতে নির্জনকে জাপটে ধরে রেখেছে বুকের মাঝে। পাশ থেকে মেহউইশের বিড়বিড় করা আওয়াজ কানে আসতেই এক পলক তাকিয়ে রিশাদ গাড়ির চলার গতি কমিয়ে দিলো। এই পাহাড়ি রাস্তায় নিজে ড্রাইভ করার অভিজ্ঞতা তার অনেক পুরনো৷ এ পথ এতোটাও উঁচু কিংবা আঁকাবাঁকা নয় যতোটা বান্দরবান,রাঙামাটির পথ৷ গাড়ি এসে থামলো সমতল থেকে কিছুটা উঁচুতে। জায়গাটা পাহাড়ের ওপর তা এখন আর বোঝা যাচ্ছে না। গাড়ি থেকে রিশাদ আগে নামলো৷ ফোনের ফ্ল্যাশ অন করতেই একটা শব্দ হলো। শব্দটা ঠিক কাঠের ঠক ঠক শব্দের মত। গা ছমছমে অন্ধকার সামনে দাঁড়ানো রিশাদকেও চোখে পড়ছে না এখন ঠিকঠাক । গাড়ির জানালা খোলা বলেই হয়তো ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লাগছে। পরনে থাকা ওড়নাটা সুতির মধ্যে হওয়ায় ভালো হলো। নির্জনের দিকে তাকিয়ে মনে হলো বাচ্চাটারও শীত লাগছে কিন্তু কাঁচ উঠানোটাই জানে না মেহউইশ। বলতে গেলে এইরকম গাড়িতে সে রিশাদের সাথে বিয়ে হওয়ার পরই প্রথম উঠেছে। তার আগে সবসময় বাস,মাইক্রো কিংবা হাসপাতালের এ্যাম্বুলেন্সে চড়েছে অনেক। সি এনজিতে ভাড়া বেশি হয় বলে কখনো সিএনজিতেও চড়ে না সে। বাইরের শীতল হাওয়া পশম ভেদ করে যেন মাংসে খোঁচাচ্ছে এবার। দ্রুত নিজের গায়ের ওড়নাটা দিয়ে নির্জনকে ঢেকে নিলো। তাকে সে এতোটাই ঢেকেছে এবং এমন করে ঢেকেছে যা দেখে যে কারে ভ্রম হবে সে নির্জনকে দুধ পান করাচ্ছে; এমনকি হয়েছেও রিশাদের। সে গাড়ির কাছে আসতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিলো মেহউইশের দিকে তাকিয়ে। পরক্ষণেই তার ভুল ভেঙে গেছে মেহউইশকে মাথার ওপর কাপড় টেনে ঠিক করতে দেখে। এক মুহূর্তের জন্য রিশাদের মনে হয়েছে মেহউইশ বুঝি তার সন্তানের সত্যিকারের মা হয়ে গেল এবার৷ তবুও শান্তি মা না হোক সৎমায়ের আচরণও করছে না সে নির্জনের সাথে এই তো ঢের। রিশাদের সারাদিনের ক্লান্তি যেন এই এক টুকরো ভালোলাগায় দূর হয়ে গেল হাওয়ার বেগে। কানে আসছে সমুদ্রের গর্জন। এই পাহাড় থেকে পথ ডিঙিয়ে সমুদ্রে যেতে আধ ঘন্টা লেগে যায় অথচ পাহাড়ে দাঁড়িয়ে ওই দূরের সমুদ্রের গর্জন কতো স্পষ্ট আর কতোটা কাছে মনে হয়৷ আচ্ছা, মেবিশ কি শুনেছে সমুদ্রের গর্জন! কথাটা মনে আসতেই রিশাদ গাড়ির সামনে এসে গাড়ির দরজা খুলে ডাকলো, মেবিশ!
মেহউইশ তাকালো রিশাদের দিকে৷ ফোনের ফ্ল্যাশের আবছা আলোয় রিশাদের মুখে এক ঝলক হাসি চোখে পড়লো তার।
-গাড়ি থেকে নামো। আমরা চলে এসেছি।
মেহউইশ চুপচাপ নেমে এলো গাড়ি থেকে ততক্ষণে আবারও কাঠের ঠক ঠক শব্দ৷ এখানে এই পাহাড়ের মাটিতে এমন শব্দ কি করে আসে! কয়েক সেকেন্ড পরই সে রহস্যের জাল ভাঙতে সক্ষম হলো। একজন বৃদ্ধা হাতে একটা লাঠি যেটাতে ভর দিয়ে সে এগিয়ে আসছে। রিশাদ গাড়ি থেকে নির্জনের ব্যাগটা আগে বের করলো এবং সেটা নিয়েই মেহউইশকে বলল, ‘চলো।’
বৃদ্ধা মহিলা রিশাদকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এই মেয়ে কে?’
‘আপনার বউমা।’
‘নীলিমা?’ বৃদ্ধা প্রশ্ন করলেন। মেহউইশ এবার ঘাড় বাঁকিয়ে পাশে দাঁড়ানো রিশাদকে দেখলো। অন্ধকারে যতটুকু বোঝা গেল রিশাদের মুখ,চোখের ভাব কঠিন। কিন্তু সে জবাব দিলো না বৃদ্ধার প্রশ্নের। ধীরে ধীরে রিশাদ আর বৃদ্ধাকে অনুসরণ করে মেহউইশ হাটতে থাকলো। পায়ের তলায় মাটি নেই টাইলেসের মত মনে হচ্ছে পথটা। পথেও কি টাইলস বসানো হয়! জানা নেই মেহউইশের । তবে তারা একটা কাঠের গেইট দিয়ে যতখানি সরু পথ পেরুলো পুরোটাই এমন টাইলসওয়ালা মনে হলো। এবার বুঝতে পারলো বৃদ্ধার হাতের লাঠির এই ঠকঠক শব্দ তখন এ পথে হেটে যাওয়ার কারণেই হয়েছিলো যেমনটা এখনও হচ্ছে।
সন্ধ্যের পর থেকে মাইমুনা রিশাদের নম্বরে কল করছে। দুয়েকবার মেহউইশের নম্বরেও করেছে। একটিবারের জন্যও কারো নম্বরে কল কানেক্ট হয়নি। চিন্তায় অস্থির মাইমুনার এবার কান্না আটকানো দ্বায় হয়ে পড়ছে। না চাইতেও মাথায় নানারকম দুশ্চিন্তা ভর করছে তার। সকালে ওরকম রেগে গেল রিশাদ মেহউইশও কেমন মুখের ওপর বলল সে পালিয়ে যাবে। রিশাদের মত ছেলে পারে না এমন কোন কাজ নেই তা ধারণা হয়ে গেছে মাইমুনার। যে ছেলে নিজ স্বার্থে মানুষকে কিডন্যাপ করে বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারে। এই ছেলের মানসিক সুস্থতা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে মাইমুনার। তার মেয়েটাকে এই ভয়ংকর লোকের হাত থেকে ছাড়াবে সে ভেবে পায় না। রাতের খাবার বেড়েছে তবুও মিহাদ খাচ্ছে না। তারও বোনের চিন্তায় গলা দিয়ে খাবার নামবে না। মা, ছেলে বড় আতংকে আছে সারাটাদিন মেহউইশের কোন খোঁজ না পেয়ে। মনে মনে আল্লাহকে ডাকা ছাড়া তাদের আর কোন পথও নেই। আত্মীয়-স্বজন বলতে মেহউইশের এক মামা ছাড়া কেউ নেই। তার কাছেও সাহায্য চাওয়ার মুখ মাইমুনার নেই।
শীতল আবহাওয়ায় যে শীত ছাড়াও কতোটা শীতল হয় তা এই পাহাড়ে না আসলে মেহউইশের জানা হতো না। দিনভর গরমে অতীষ্ঠ হয়ে বমি বমি ক্লান্তি নিয়েও গাড়িতে পার করেছিলো ভালোই। কিন্তু রিশাদের এই পাহাড়ি বাড়িতে এসে শীতে এখন কাঁপা কাঁপা অবস্থা। আঁধার ঘেরা পাহাড়ের ওপর এই বাড়িটা বাহিরে থেকে কেমন তা দেখা হয় নি। কিন্তু বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই বেশ অবাক হলো সে। কি সুন্দর ঘর কত সুন্দর পরিপাটি। ইশ, টাকা থাকলেই বুঝি এত কিছু করা যায়! রিশাদরা বুঝি টাকা খরচ করার পথ না পেয়ে এত গুলো বাড়ি বানিয়েছিলো! রিশাদ মেহউইশকে একটা ঘরে রেখে আবার বাইরে বেরিয়ে গেল। কানে এলো গাড়ির আওয়াজ। সে হয়তো আবার গেল কোথাও। কিন্তু এই বাড়িটা এতোই নির্জনে যে এখানে সমুদ্রের ঢেউয়ের আওয়াজও কানে লাগছে। গাছে ভরা এলাকা তাই হয়তো ঝিঁঝি পোকার ডাকও শোনা যাচ্ছে। মেহউইশ যে ঘরটায় আছে সে ঘরটাতে খাট অনেক বড়। আবার দেয়ালে একটা আয়নাও আছে। দূরে দাঁড়িয়েই আয়নায় তাকালো। দারুণ লাগছে মেহউইশ তোকে! স্বগোতক্তি করে উঠলো সে। বিয়ে হয়েছে, বাচ্চা আছে,স্বামী আছে, অর্তবিত্ত আরো কত কি। শুধু ইভান হারিয়ে গেছে। তাচ্ছিল্যের হাসি উঠে এলো ঠোঁটের ভাঁজে। কোল থেকে নির্জনকে বিছানায় রেখে নিজেও পাশে আধশোয়া হয়ে রইলো। ক্লান্তিতে শরীর আর চলতে চাইছে না একটুও। দু চোখে ক্লান্তি ঘুম হয়ে নামতে চাইছে তার৷ জীবনে এই প্রথম লংজার্নি করলো৷ জীবনটাও একটা জার্নি কখনও একটানা চলছে কখনো আবার বিরতি দিয়ে। এ জীবনে ক্লান্তি এসে সূর্যের মতোই আবার অস্তমিত প্রায় প্রতিটা দিন। আবার ভোরের মতোই উদীয়মান৷ এ জার্নি কবে শেষ হবে? মন থেকে আওয়াজ এলো, ‘এ তো সবে শুরু এই জার্নির শেষ মৃত্যুর পর!’
#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-১২
#রূবাইবা_মেহউইশ
_________________
পাখির পালকের মতোই পালকে তৈরি এক মোলায়েম কম্বলে পা হতে মাথা অব্ধি ঢাকা। উষ্ণতা দেহের প্রতিটি পশমের গোড়ায় গোড়ায় উপস্থিত। রাতটা ভীষণ ছোট কেটেছে কি আজ! নাকি মাত্রাতিরিক্ত আরামদায়ক বিছানা পেয়ে ঘুমের সময়টা কম মনে হচ্ছে? কে জানে! কাল রাতে পাহাড়ে এসে প্রথমেই যে ভয়টা কাজ করেছিলো তা হলো এখানকার নিস্তব্ধতা৷ যা ভোরের আলো ফুটতেই ক্রমশ বদলে গিয়ে হৈ হল্লা শোনা যাচ্ছে। ঘড়িতে সময় কয়টা দেখার উপায় নেই। রাতেই রিশাদ নিজের পকেট থেকে ফোনটা বের করে মেহউইশকে দিয়েছিলো। মেহউইশ ছুঁয়েও দেখেনি সেটাকে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভুল হয়েছে৷ এই লোকের কাছ থেকে পালানোর পথ নেই তার চেয়ে ভালো তার বাচ্চার আয়া হয়েই না হয় জীবন কাটিয়ে দেবে। এর বিনিময়ে মা,ভাই দুজনেই যদি দারুণ একটা জীবন পায় তবে এই জীবনই কবুল শুধু রয়ে যাবে দিন শেষে প্রিয় আরেকটি মানুষের জন্য হাহাকার। থাক, কত মেয়েই তো এই হাহাকার বুকে চেপে বেঁচে আছে দীর্ঘকাল ধরে। আমিও না হয় তাদেরই একজন হবো।
ভাবনায় ঘুরে বেড়ানো আজকাল অভ্যাসে পরিণত হয়েছে মেহউইশের। কাল রাতেও দেয়ালে টাঙানো আয়নায় নিজেকে দেখে কত কি ভেবেছিলো। সেই ভাবনাকে চুটকি মেরে উড়িয়ে দিয়ে রিশাদ চমৎকারভাবে তাকে নতুন বাড়িতে স্বাগতম জানিয়েছিলো। এক গুচ্ছ ফুল কোথা থেকে এনে ওই রাত্তিরেই বলেছিলো, ‘ওয়েলকাম টু ইউর নিউ হোম মিসেস. রিশাদ রায়হান। হোপ ইউ লাইক ইউর বিউটিফুল প্যালেস।’ ধরণটা এমন ছিলো বলার যেন সত্যিই কোন আলিশান মহলে নিয়ে এসেছে সে৷ আর আন্তরিকতার ছাপ এত গভীর যেন মেহউইশের সাথে তার সম্পর্ক জোরজবরদস্তির নয়। ঠিক যেন দীর্ঘজীবনের প্রেমমাখা কোন সম্পর্ক। মানুষ এতো অভিনয় করে কি করে ভেবে পায় না মেহউইশ৷ রাতের খাবারে দারুণ এক তরকারি ছিলো শুঁটকি দিয়ে যা এর আগে মেহউইশ খায়নি কখনো৷ অবাক করা বিষয় কালই খেয়াল করলো সে রিশাদ বাঙালি খাবার কত তৃপ্তি নিয়ে খায়। কোটিপতি বাবার ছেলেও যে কখন শুঁটকি আর গরম ভাতের স্বাদ চেটেপুটে নিতে পারে তা কালই প্রথম জানা হলো তার । আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছাড়তেই খেয়াল হলো বিছানায় নির্জন নেই। নিজের অজান্তেই বুকের ভেতর ভয়ের অনুভূতি জেগে উঠেছে। বাচ্চাটা কোথায় আর রিশাদ কোথায়! খাটের কিনারায় ওড়না পেল সেটাকে গায়ে জড়িয়ে দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বের হলো। দরজা পেরিয়ে লম্বা প্যাসেজের মত জায়গাটাতে আসতেই কানে আওয়াজ এলো নির্জনের। সে মুখ বাঁকিয়ে একটু একটু আওয়াজ করে, খিদে পেলে নরম সুরে কান্না করে। নামের মতোই বাচ্চাটা নির্জনতা বজায় রেখেই তার উপস্থিতি,খিদে,মায়ের কমতি সবটাই জানান দেয় সবাইকে। মেহউইশ গত কয়েকদিনেই অনেকটা জেনে গেছে বাচ্চাটাকে। নির্জনের আওয়াজকে অনুসরণ করে প্যাসেজের ডান দিকে এগুতেই ভীষণরকম চমক পেল মেহউইশ। রাতে দেখা মহিলাটি যাকে সে রাতের বেলায় বৃদ্ধা ভেবেছিলো সে কেন বৃদ্ধা মহিলা নন৷ পায়ে হয়তো সমস্যা থাকায় লাঠিতে ভর করে চলেন। মহিলাটি বড়জোর পঁয়ত্রিশ, ছত্রিশ বছর বয়সী হবেন। দেখতেও সুশ্রী, শক্ত সামর্থ্য লাগছে। ধোঁকা! রাতের আঁধার কতোই না ধোঁকা দেয়। এই আঁধার শুধু তাকেই ধোঁকা দিতে দেয়নি বিয়ের রাতে। ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি টেনে মেহউইশ মহিলার উদ্দেশ্যে বলল, ‘ওকে এভাবে তেল দিচ্ছেন কেন? ওর বাবা যেই রাগী আপনাকে বকে দিবে দেখলেই।’
ফ্লোরে মাদুর পেতে তাতে পাতলা কাঁথা বিঁছিয়ে তাতে নির্জনকে শুইয়ে রেখেছেন ভদ্রমহিলা। হাতে তার তিলের তেল যা নির্জনকে খুব যত্নে মাখিয়ে দিচ্ছেন। মেহউইশের কথা শুনে মহিলা একটুখানি হেসে জবাব দিলেন, ‘ রিশাদ দেখে গেছে আমি তেল নিয়ে বসেছি। সে এও জানে এই তেল আমি তার ছেলেকে মাখবো।’
-সত্যি! চমকে যাওয়া গলায় বলল মেহউইশ। তার বিশ্বাস হচ্ছে না এমন টিপটপ হয়ে সারাক্ষণ চলাফেরা করা লোক তার ছেলেকে তেল মালিশ করতে দিচ্ছে! সত্যিই আশ্চর্যজনক ঘটনা এটা। গত পাঁচ দিনে আজকেই এত উচ্ছল এক সকাল হলো বুঝি তার। এতোটা আনন্দ কিসে লাগলো? রিশাদের সন্তানকে তেল মালিশ করাটাই কি আনন্দকর ব্যাপার? মেহউইশ নিজেই জানে না সে কখন কি নিয়ে আনন্দ পাচ্ছে আর কখন বুকে চাপা কষ্ট অনুভব করছে।
-এই মেয়ে তুমি মাত্রই ঘুম থেকে উঠেছো তাই না!
জ্বী
‘যাও মুখ হাত ধুয়ে এসো। বেসিন তো দেখেছোই নিশ্চয়ই ওপাশে।’ মেহউইশ যে দিক থেকে এসেছিলো সে দিকে ইশারা করে বললেন।
-জ্বী
‘কথায় কথায় এমন জ্বী জ্বী করবে না। ফুপি বলে ডাকবে আমায়। আমি রাশেদ ভাইয়ের আপন চাচাতো বোন। বলতে গেলে বংশের একমাত্র মেয়েও ছিলাম। যাই হোক যাও রিশাদ আসার আগে মুখ হাত ধুয়ে এসো একসাথে খাবো সবাই ।’ শেষের দিকে কথাগুলো বলতে গিয়ে মহিলার গলাটা বোধহয় একটু কেঁপে উঠলো। মেহউইশের কেমন রহস্যময়ী মনে হলো মহিলাকে। এই বয়সে কেউ লাঠি ভর করে চলে না। এই মহিলার চলা দেখে জন্মগত বিকলাঙ্গও মনে হয় না। হয়তো কোন এক্সিডেন্টে এমন পঙ্গু হয়েছে। লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে মাদুরে শুয়ে থাকা নির্জনের গালে আলতো করে হাত বুলিয়ে চলে গেল সে। মুখ হাত ধুয়ে ঘরে এসে খাটের কার্নিশে থাকা ফোনটা দেখে তা তুলে নিলো হাতে। কন্টাক্টস চেক করে দুটো নাম্বার পাওয়া গেল। একটা মা অন্যটা রিশাদ লিখে সেভ করা। তার মানে লোকটা নিজেই এ দুটো নাম্বার সেভ করে দিয়েছে। সিম নাম দেখে একাউন্ট চেক করতেই আবারও অবাক হলো। পাঁচশো টাকার ব্যালেন্স! এত টাকা দিয়ে কি করে মানুষ? সে তে পুরো মাসে একশো টাকাও খরচ করে না। প্রয়োজনে এক দু মিনিটের কথা বলতে মানুষ একশো, দেড়শো টাকাতেই মাস পার করতে পারে। আবারও মনে হলে এই লোক অপচয়কারী৷ আর অপচয়কারী মানেই তো শয়তানের ভাই। বাহ্ মেহউইশ দারুণ বলেছিস তো এই বেডা নিজে দানব আবার সম্পর্কে শয়তানের ভাই৷ নিজেই নিজেকে এপ্রিসিয়েট করতে লাগলো মেহউইশ। তারপর অভ্যস্ত হাতে ইভানের ফোন নাম্বারটা উঠিয়ে ডায়াল করলো। প্রথমবার নেটওয়ার্ক প্রবলেম এবং দ্বিতীয়বার সংযোগ বন্ধ শোনা গেল ওপাশ থেকে। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা আর সেই ব্যথাটা চোখের মণিতে ছলছল করতে লাগলো। দু চোখের পাতা বুঁজে পানিটুকুকে লুকানোর চেষ্টা চালাতেই পেছন থেকে ডাক শোনা গেল, ‘নাস্তা দিয়েছে ফুপু। খিদে থাকলে আসা হোক।’ হাতের ফোন বিছানায় ফেলে পেছনে তাকিয়ে আবারও অবাক হতে হলো৷ এ কোন মানুষের কন্ঠ শুনলো সে? গত পাঁচ দিনে সে এমন কণ্ঠ একটিবারও শোনেনি এবং অমন কোমল চোখ মুখও এর আগে দেখেনি। রক্ত শীতল করা চাহনি; সে ভুল দেখছে নাতো!
ফুরফুরে পাহাড়ি হাওয়া আর ঝলমলে কাঁচরঙা রোদ্দুরের হালকা উষ্ণতা। মন প্রাণ জুড়িয়ে যাওয়া এই আবহাওয়ায় কোলা বারান্দায় বসে সকালের নাস্তা। আর কি চাই সুখী মানুষের জীবনে৷ সবুজ গাছপালা ঘেরা পাহাড়ের উপর এক টুকরো জমিতে ছোট্ট একটা বাড়ি। বাড়ির পেছন দিকে ভয়ংকর খাঁদ। সে বাড়ির সামনেটা টুকরো টুকরো ফুলের বাগান , পাথুরে রঙা খাঁজকাটা মোজাইক ঘরের দরজা থেকে সদর দরজা অব্ধি। কাঠের তৈরি দেয়াল বাড়ির চারপাশে৷ শিকলটানা কাঠের গেইট। কি চমৎকার শুভ্ররঙা বাড়ি এক বাড়ি ঠিক যেন স্বপ্নে দেখা প্রাসাদ। নাস্তার টেবিলে তিনজন মানুষ অথচ টু শব্দটি নেই কারো৷ বাড়ির ভেতর এই তিনজন ছাড়াও আরো দুজন লোক আছে দুজনই পাহাড়ী এখানকার স্থানীয়। আনতুং আর উকাচুং দু ভাই বোন। উকাচুং বাংলা বোঝে না তেমন কিন্তু কাজে পটু হওয়ায় বাঙালি দাড়োয়ান তাকে ঠিক করেছে। উকাচুং এর বয়স বিশ কি বাইশ হবে কিন্তু খুব কাজের ছেলে। বাজার করা থেকে সবরকম কাজই ও একা করতে পারে। এদিকে তার বড়বোন আনতুং নিজেও এ বাড়িতে আসা যাওয়া করে। প্রয়োজনীয় অনেক কাজই করে দেয় রিশাদের ফুপুর৷ আর রাতে এ বাড়িতেই থাকে। বাড়িটা ছোট বলতে এতোটাও ছোট নয়। সব মিলিয়ে তিনটা বেডরুম আছে আবার একটা স্টোররুম৷ একটা রান্নাঘর সাথে একটা বাথরুম।
সকালের নাস্তার পর রিশাদ ফুপুকে কিছু বলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়তেই রিশাদের ফুপু এসে নির্জনকে দিয়ে গেছে মেহউইশের কোলে। বারবার বলছিলো বাচ্চাটা সেই ভোরে ঘুম থেকে উঠেছে ওকে একটু খাইয়ে সাথে নিয়ে শোও। খুব আরাম পাবে। এত ছোট বাচ্চাকে এখনই কেন বাজারজাত দুধ দিতে হয়! ছ’মাসের আগে এসব কি জরুরি নাকি? মেহউইশ বুঝতে পারছিলো না তার জবাব কি দেওয়া উচিত। রিশাদ কি বলেনি নির্জনের মা নীলিমা সে নয়৷ সে তো রিশাদের জোর করে বিয়ে করা নতুন বউ৷ কিন্তু নাহ, কোন জবাব সে দেয় নি চুপচাপ নির্জনকে কোলে নিয়ে ঘরের দরজা এঁটে দিয়েছে । ফ্লাক্সে রাখা গরম পানিতে এক কাপ পরিমাণ দুধ বানিয়ে নির্জনকে খাইয়ে তার কাপড় বদলাতে নিতেই হাতের কাছে ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রীণে ‘মা’ লেখা দেখে রিসিভ করলো।
-কেমন আছো মা?
-তুই কেমন আছিস?
-আমি আগে জিজ্ঞেস করেছি।
‘ভালো আছি আমরা। তুই কেমন আছিস?’ ধরে আসা গলায় প্রশ্নটা করলেন মাইমুনা।
-ইভান কেমন আছে, তার হাত ঠিক হয়েছে মা?
-কাল রাতে ইভানের বিয়ে ছিলো মেহউইশ।
-‘কিহ!’ বজ্রের ন্যায় আচমকা বাজ পড়ার মত শোনালো মেহউইশের কণ্ঠস্বর। হাতে থাকা মোবাইলটা কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানেই নিচে পরে ভেঙে গেল স্ক্রীণের কাঁচ।
চলবে
(