বাসরঘরে ঢুকতেই মৃদুলের পিঠে দুম করে এক কিল বসিয়ে দিলো ওর বউ সাবা। মৃদুল রক্তচক্ষু করে কিছু সময় সাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর এগিয়ে গিয়ে সাবার চুলের খোপা টেনে সেও পিঠে একটা বসিয়ে দিলো।সাবা পিঠে হাত দিয়ে চেচিয়ে বললো,
— এই তুই আমাকে মারলি কেন?
— তুই মারলি কেন আগে?
— একদম বেশ করেছি তোকে মেরেছি।
— আমিও তাহলে বেশ করেছি।
— তুই ঠিক করিস নি।কত করে তোকে বললাম বিয়েটা ভেঙে দে। তাতো শুনলি না। ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে বিয়ে করে নিলি।
— তা তুই ভাঙতে পারলি না?
—দেখ মৃদুল, আমার রাগ উঠাস না। তাহলে কিন্তু প্রলয় ঘটে যাবে।
—কচু ঘটবে। সর সামনের থেকে।
— আমি তোর সাথে সংসার করবো না।
— আমারও বয়ে গেছে তোর সাথে সংসার করার। কি দেখে যে আব্বু-আম্মু তোকে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিলো আল্লাহ জানে? এরকম একটা পেত্নী নিয়ে আমি এক ঘরে থাকতে পারবো না।
সাবা মৃদুলের সামনে এসে দুই হাত কোমড়ে রেখে রাগী ভঙ্গিতে বললো,
— কি বললি তুই? এই তুই কাকে পেত্নী বলিস হ্যাঁ? নিজের চেহারা কখনও আয়নায় দেখছিস? তোকে দেখলে তো আয়নাও ভয় পেয়ে যাবে।
— আহা, এমন করে বলছো তুমি যেনো আগুন সুন্দরী?
সাবা ভাব নিয়ে বললো,
— জ্বি, একদম তাই।
মৃদুল ওর মাথায় ঠাস করে এক থাপ্পড় দিয়ে বললো
— সর সামনের থেকে। খালি ঢং করে।
— তুই থাপ্পড় মারলি কেন?
— বেশি কথা বললে চটকনা খাবি। বের হো আমার রুম থেকে। আমি তোকে স্ত্রী হিসেবে মানি না।
— আহা, তুমি কি ভারতীয় সিরিয়াল পাইছো সোনা?তুমি রুম থেকে বের হতে বলবে আর আমি ডেং ডেং করে বের হয়ে যাবো। একটুও না। বের হতে হলে তুই বের হো। আর শোন, আমিও তোকে স্বামী হিসেবে মানি না। তাই আমার থেকে দূরে থাক।
— তোর সাথে এক ঘরে আমি থাকতে পারবো না।
— তাহলে বারান্দায় যা।
— আমি কোথাও যাবো না। তুই বের হবি আমার রুম থেকে।
— তোর রুম কোথাও লেখা আছে?
— বেশি হচ্ছে কিন্তু সাবা?
সাবা মৃদুলের গাল দুটো জোরে টেনে দিয়ে বললো,
— একটুও বেশি হচ্ছে না।
— গাল ছাড়।
ঝাড়া মেরে গালের থেকে হাত ছাড়িয়ে নিলো মৃদুল।সাবা ভেংচি কেটে সামনের দিকে যেতে নিলেই মৃদুল ওর ঘোমটা টেনে ধরলো। তারপর আবারো এক কথায় দুই কথায় দুজনের মধ্যে তুমুল মারামারি লেগে গেলো। সাবা মৃদুলের চুল ধরে টানে, মৃদুলের সাবার চুল ধরে টানে। কেউ কাউকে ছেড়ে দেওয়ার নয়। খাটে উঠে মারামারি করতে করতে সব ফুল ছিঁড়ে নষ্ট করে ফেললো, এখানেই ক্ষান্ত হলো না। বালিশ যুদ্ধ শুরু করলো। ওরা মারামারি করতে থাক। আমি সংক্ষেপে ওদের পরিচয় দেই।
মৃদুল বিল্লাহ ও সাবরিনা সাবার বাবা সেই ছোটবেলা থেকে ভালো বন্ধু। অন্তরাত্মার বন্ধু যাকে বলে আরকি। সেই সুবাদে মৃদুল ও সাবার মধ্যেও ছোট বেলা থেকে ভালোই বন্ধুত্ব গড়ে উঠার কথা। কিন্তু তা না ঘটে ওদের দুজনের মধ্যে গড়ে উঠে টম এন্ড জেরী সম্পর্ক। দুজন দুজনের সাথে সবসময় লেগে থাকবে। টম এন্ড জেরীর মতো এদেরকে খুব কম সময় মিলে থাকতে দেখা যায়। দুজনের বাবার খুব ইচ্ছে ছিলো তারা আত্মীয় গড়বে। বাঙালি অন্তরঙ্গ বন্ধু হলে যা হয় আরকি। সেই ছোটবেলা থেকে ছেলে-মেয়েদের বিয়ে ঠিক করে রাখে। তারাও একি কাজ করে রেখেছে।কিন্তু সমস্যা হলো তাদের ছেলেমেয়েদের তো মিলেই না। বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে ভেবে এক প্রকার ধরে,বেঁধে, ব্লাকমেইল করেই ওদের দুজনের হাত এক করেছে। বেশ বড় অনুষ্ঠান করে ওদের বিয়ে হয়েছে আজ। কোন উপায় বের করেও এরা বিয়েটা ভাঙতে পারেনি।কারণ দুজনেই দুজনের বাবাকে ভীষণ ভয় পায়।
মারামারি করতে করতে দুজনেই হয়রান হয়ে ফ্লোরে হাত-পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। সারা রুম বালিশের তুলা ও ছেঁড়া ফুলে বিচ্ছিরি অবস্থা। সাবার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে উঠলো মৃদুল। কারণ সাবার চুলে তুলা, ফুল লেগে পাগলনীর মতো লাগছে। মাথার ঘোমটা ফ্লোরে ছড়িয়ে আছে। হঠাৎ দরজায় জোরে বারি পারলো। মৃদুল মাথা উঠিয়ে বললো
— কে?
অপরপাশ থেকে মৃদুলের বড় বোন মিথিলা চেচিয়ে বললো,
— দরজা খোল, কি শুরু করছিস তোরা? আবারো টম এন্ড জেরী যুদ্ধ শুরু করে দিছিস? আজকে তোদের বাসররাত সেই দিকে খেয়াল আছে?
মৃদুল উঠে দরজা খুলতে গেলে সাবা ফিক করে হেসে উঠলো। মৃদুল পিছনে ঘুরে সাবার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— হাসিস কেন?
— তোর পাঞ্জাবীর পেছন দিক ছেঁড়া 🤭।
— এটা তোর কাজ!
— কে জানে হতে পারে।
— জলদী স্বীকার কর।
—বললাম তো হতে পারে।
💞💞💞
মুখে হতে পারে বললেও সাবা জানে এটা ওরই কাজ। মারামারি করতে গিয়ে ওর ডাইনির মতো বিশাল বড় নখের আঁচড়ে মৃদুলের পাঞ্জাবীর পেছনে খামচি দিয়ে ছিঁড়ে ফেলছে। মৃদুলও ওকে মারতে বিভোর ছিলো। তাই খেয়াল করেনি। মৃদুল একটা ক্রুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দরজা খুলতে গেলেই সাবা সামনে এসে ওকে আটকে দিলো। মৃদুল চোখ, মুখে বিরক্তি নিয়ে বললো,
— কি হয়েছে?
— রুম দেখ।
সাবার কথায় মৃদুল সারারুমে চোখ বুলিয়ে চিৎকার করে উঠলো,
— কি করছিস এগুলো?
— আমি একা করিনি। সাথে তুইও করছিস।
—সব দোষ তোর।
— কানের নিচে বেশি না দুইটা দিবো।
— দেখ তো আমার রুমটার কি অবস্থা করছিস? তুই ভালো করে জানিস আমার অগোছালো একদম পছন্দ নয়।
— কিন্তু আমার পছন্দ।
অপরপাশ থেকে মিথিলা আবারো দরজা ধাক্কানো শুরু করলো। বেচারী যে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে তা এই দুজন বেমালুম ভুলে গেছে।
— এই মৃদুল, সাবা দরজা খোল। কি অকাজ করেছিস আমাকে একটু দেখতে দে।
সাবা একবার দরজার দিকে তাকিয়ে মৃদুলের এক বাহু চেপে ধরে বললো,
— কোথায় যাস?
— দরজা খুলবো হাত ছাড়।
— দরজা খুলিস না মৃদুল।
— কেন?
— দেখ তো রুমের কি অবস্থা? আপু দেখলে দুজনকে অনেক বকবে।
— বকলে বকবে। আমি একা বকুনি খাবো না। সাথে তোকেও নিয়ে নিবো।
— এমন করিস না ভাই আমার। কিছু একটা ভুজুংভাজুং বলে আপুকে পাঠিয়ে দে। আমি তোকে রুম গুছাতে সাহায্য করবো।
— সত্যি সাহায্য করবি তো?
— তিন সত্যি করবো।
মৃদুল শয়তানি হাসি দিয়ে সাবার দিকে তাকালো। সাবার সেদিকে খেয়াল নেই। মিথিলা এখনো সমান তালে দরজা ধাক্কাচ্ছে। মৃদুল জোরে চেচিয়ে বললো,
— কি শুরু করলে আপু? ছোট ভাইয়ের বাসর ঘরের দরজা কেউ এভাবে ধাক্কায়? মাথার ঘিলু কি আছে নাকি গলে পরে গেছে?
— তোরা কথা কম বল। আগে দরজা খোল।আমি তোদের হারে হারে চিনি। তোরা যে কি কাজ করছিস আমি ভালো করে জানি।
— প্লিজ আপু ডিস্টার্ব করিস না। আমাদেরকে আমাদের মতো থাকতে দে৷
মিথিলা আরো কিছু সময় দরজা ধাক্কিয়ে হয়রান হয়ে চলে গেল। মৃদুল ভ্রু কুঁচকে শয়তানি হাসি দিয়ে সাবার থেকে নিজের বাহুটা টেনে নিয়ে কোণার থেকে একটা ঝাড়ু এনে ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
— নে এবার ঘর ঝাড়ু দে। নয়তো একটা মারও নিচে পরবে না।
সাবা ছোট বাচ্চাদের মতো করে ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,
— আমার মতো ছোট বাচ্চা মেয়ের সাথে তুই এমন করতে পারিস না।
— জলদী জলদী ঝাড়ু দে। নয়তো দেখবি আমি কি করতে পারি আর কি করতে পারি না। ঝাড়ু ধর। নয়তো ঝাড়ু দিয়ে দিবো দুইটা বারি।
— তোর কপালে শনি আছে মৃদুল।
— হু দেখা যাবে। আগে কাজ কর।
সাবা মুখটাকে কালো করে ঝাড়ু নিয়ে রুম পরিষ্কার করতে লাগলো। মৃদুল বিছানার চাদর,বালিশের কভার পাল্টাতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। সাধারণত ছেলেদের একটু অগোছালো আর মেয়েদের কে গুছালো দেখা যায়। কিন্তু ওরা দুজন এর উল্টো। মৃদুল খুব গুছালো ও পরিষ্কার একটা ছেলে। নিজের রুম অগোছালো, অপরিষ্কার ওর কখনো পছন্দ না। আর সাবা ওর বিপরীত। বড্ড বেশি অগোছালো সে। কোন জিনিস গুছিয়ে রাখতে পছন্দ করে না। আলসেমি তে ডিগ্রি কমপ্লিট করেছে সে। নিয়ম,শৃঙ্খলার ধার ধারে না। যা মন চাইবে তাই করবে। বেশ কিছু সময় লাগিয়ে পুরো রুম গুছিয়ে ফেললো মৃদুল। সাবা রুম ঝাড়ু দিয়ে দরজার কোণায় ঠেস মেরে সেই যে দাঁড়িয়ে আছে তার কোন হুশ নেই।ভীষণ ঘুম পাচ্ছে তার। ঘুমে ঢুলছে সে। বাকি সব কাজ মৃদুল করেছে। পুরো রুমটায় একবার চোখ বুলালো মৃদুল। রুম দেখে বোঝার উপায় নেই যে একটু আগে এখানে বাসর ঘর সাজানো ছিলো। এখন দেখে অন্য পাঁচটা গুছানো রুমের মতো মনে হচ্ছে। ছেঁড়া ফুলের স্তুপ ঝুড়িতে তুলে পা টিপে টিপে মৃদুল রুম থেকে বের হয়ে গেলো। কেউ দেখলে ঝামেলা শুরু করবে।
বেশ কিছু সময় পর চোরের মতো রুমে ঢুকলো মৃদুল। হাতে তার বেলচা ও ঝুড়ি। দরজা আটকিয়ে বিছানার দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো সে…….
#চলবে
#মেঘের_ওপর_আকাশ_উড়ে
#Part_01
#Writer_NOVA