#ছায়া_হয়ে_মিশে_রব_কল্পনাতে …(হয়ত-২)
পর্ব:- ১
.
আজকের সকালটা অন্যরকম। ভীষণ অগোছালো। সূর্য মামা উঠেছে সেই কাক ভোরে। ঘড়িতে এখন বাজে নয়টা। প্রিয়তা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ব্রাশে পেস্ট নিয়ে বসার ঘরের দিকে এগোল।
-” কয়টায় এসেছিস গতকাল রাতে?”
-” সরি মা দেরি হয়ে গেছে।”
-” হুম।”
-” সরি তো।”
-” কাল কোথাও যাবি না। বাসায় থাকবি। অতিথি আসবে।”
কোন অতিথি ফতিথি না; আসলে বিয়ের জন্য দেখতে আসবে প্রিয়তা তা ভালো মতোই জানে।
-” আমি বিয়ে করব না।”
আতিয়া খাতুন জবাবে কিছুই বললেন না। দুটো ঠাণ্ডা রুটি আর ডিমভাজা মেয়ের প্লেটে তুলে দিয়ে তিনি চললেন ছেলেকে ডাকতে। আগে মর্নিং শিফট ছিল, ভালোই ছিল। প্রান্ত জলদি উঠত ঘুম থেকে। এখন ডে শিফট হওয়ায় ছেলের ঘুম অত্যধিক বেড়েছে। এই ছেলে মেয়ে নিয়ে উনি কী করবেন? একজন রাত জেগে পড়ে, আরেকজন রাত করে বাড়ি ফিরে। স্বামীর মৃত্যুর পর বাড়ির পরিবেশে কেমন যেন পরিবর্তন এসেছে। আগে তো সব নিয়ম মাফিক হত।
এই যে অভ্যাস মতো উনি সেই ভোরে রুটি বানান। অথচ তার ছেলে মেয়ে ঘুম থেকে উঠে ন’টা দশটায়।
.
হাত-মুখ ধুয়ে প্রিয়তা বাড়ির সদর দরজায় এসে দাঁড়াল। এখন ওর খেতে একদম ইচ্ছা করছে না। ঘুম থেকে উঠে এই খাওয়া-দাওয়ার কোন মানেই হয়না। খাবার দেখলে মনে হয় পাকস্থলী মোচর দেয় খালি।
“রাজশাহী’ র আলো” (কাল্পনিক) খবরের কাগজ হাতে তুলে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে এসে বসলো ও। জগ থেকে বেলের শরবত গ্লাসে ঢেলে নিয়ে এক চুমুক দিল। পেপার খুলে প্রতিটি হেডলাইনে চোখ বুলিয়ে নিল। না ওর দেওয়া আর্টিকেল ছাপানো হয়নি। ঘর থেকে ফোন নিয়ে এসে ও ডায়েল করল “রাজশাহী’র আলো” পত্রিকার সম্পাদক মাসুদ আল হক এর ফোনে।
-” হ্যালো মাসুদ ভাই, প্রিয়তা বলছিলাম।”
-” হ্যাঁ প্রিয়তা বল।”
-” আপনি এখন ব্যস্ত?”
-“না না।”
-” আজকে সকালের পত্রিকা পড়েছেন?”
প্রিয়তার গলার স্বরে রাগ স্পষ্ট।
-” এমা পড়ব না কেন? পড়েছি তো।”
দাঁতে দাঁত চেপে প্রিয়তা জিজ্ঞেস করল,
-” তাহলে এটাও দেখেছেন আমার লিখা আর্টিকেল ছাপানো হয়নি। আমি কি জানতে পারি কেন আমার লিখা আর্টিকেল ছাপানো হলো না?”
-” উফ প্রিয়তা তুমিও না। এই মৃত বিজ্ঞানী নিয়ে কে জানতে চাইবে বল? আজকাল পাবলিক দেশ বিদেশের খবরে বেশি ঝুঁকছে। আর তাছাড়াও তোমার ওই বিজ্ঞানী সম্পর্কে জেনে কী থ্রিল পাওয়া যাবে?”
-” ওই বিজ্ঞানী ওই বিজ্ঞানী করছেন কেন? উনার নাম আছে। প্রফেসর ‘জামাল নজরুল ইসলাম ‘।”
-” হ্যাঁ উনিই। শোন প্রিয়তা বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ ইনাকে চিনে না। পত্রিকায় লেখা ছাপালে কেউ পড়বেও না। তুমি এর বদলে স্টিফেন হকিং কে নিয়ে লিখতে পারতে।”
-” আমরা চিনালেই তো মানুষ চিনবে। আমরা মিডিয়া। জানা অজানা তথ্য তুলে ধরাই তো আমাদের কাজ। আর কী বললেন স্টিফেন হকিং কে নিয়ে লিখবো?
স্টিফেন হকিং নিজে জামাল নজরুল ইসলাম সম্পর্কে বলেছেন, “সে সেরা। আমি তার কাছে কিছুই না।”
এই অসাধারণ লোকটির বই ক্যামব্রিজ ও হার্ভার্ডসহ বেশ কয়েকটি নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। অথচ আমাদের দেশে কোথাও উনার লিখা কোন বই খুঁজে পাওয়া যায় না। মাসুদ ভাই এই একটা রির্পোটের পিছনে আমি একটা মাস খুব খেটেছি। চট্টগ্রাম গিয়েছে। উনাকে চেনেন এমন সবার ইন্টার্ভিউ নিয়েছি। প্লিজ রিপোর্ট টা কাল ছাপিয়েন। ”
-” উফ প্রিয়তা তুমি এই ভাষণ বলা কবে বন্ধ করবে? ফর গড সেক আমাকে এই ভাষণ আর কখনো শুনিয়ো না। ফেমাস হতে হলে আনকমন স্টোরে নিয়ে এসো। দেখবে পাবলিক গিলে খাবে তোমার লিখা আর্টিকেল। যাই হোক, শুন আমি তোমাকে ফোন দিতেই যাচ্ছিলাম। বোয়ালিয়া থানায় এক প্রতাপী পীর গ্রেফতার হয়েছেন। উনার নাম “শাক বাবা”; উনার বাগানে হওয়া বিভিন্ন জাতের শাক খেয়ে যেকোনো রোগী সুস্থ হয়ে যাচ্ছে। তুমি যেয়ে উনার ইন্টার্ভিউ নিবা।”
প্রিয়তা একটা গভীর নিশ্বাস ফেলে বলল,
-” ঠিক আছে। কিন্তু এই শাক বাবাকে গ্রেফতার করা হয়েছে কেন?”
-” স্থানীয় মানুষ কমপ্লেইন করেছিল নাকি। পাড়া প্রতিবেশীদের ডিস্টার্ব হয় উনার শত শত ভক্তদের কারণে। বাকীটা জানতেই তো তোমাকে যেতে বলছি।”
-” নাম শুনেই তো ভণ্ড লাগছে।”
-” প্রিয়তা..”
-” ওকে ওকে যাব। ”
-” উনার জামিন হয়ে গেছে। আমি অনুরোধ করেছি উনি যেন তোমার জন্য অপেক্ষা করেন।”
-” থানাতে?”
-” না থানার বাইরে। চায়ের দোকান টোকানে বসবে।”
-” ঠিক আছে।”
___________________________________________
-” আপনার বাগানে কবে থেকে এমন অলৌকিক শাকের জন্ম হচ্ছে?”
-” সবই স্রষ্টার কৃপা। আমি যে পীর! এই অলৌকিক ক্ষমতা আমি শাকে ট্রান্সফার করেছি।”
প্রিয়তার মনে হলো হাতে থাকা টেপ রেকর্ডার দিয়ে এই লোকের টাক মাথা ফাটিয়ে দিতে। তাও নিজে কে শান্ত রেখে ও আবার প্রশ্ন করলো,
-” আপনার প্রতিবেশীরা আপনাকে বিশ্বাস করেনা। তারাই পুলিশে খবর দিয়েছে। এর কারণ কী?”
-” মানুষ মানুষের উন্নতি দেখতে পারে না। ওরা মানতে পারছে না আমি পীর। হিংষা প্রকাশ করেছে মাত্র। তবে সেই মূর্খ মানুষের উপর আমার কোন আক্রোশ নেই।”
-” নিজের প্রচারে আপনি শিলিন্দার পিছনের গ্রাম সাইডটা বেছে নিলেন কেন?”
-” আমি বেছে নেই নি। খোদাই আমাকে বেছে নিয়েছেন। আমার যে ওখানে ডাক পড়েছিল।”
প্রিয়তা একবার সরু চোখে শাক বাবার দিকে তাকাল। মাথায় টাক, দাড়িমোচ সাদা, গায়ে একটা জুব্বা পড়ে বসে আছে ওর সামনে। মাঝে মাঝে মাথায় টুপে পড়ছেন আবার মাঝে মাঝে তা খুলে ফেলে টাক মাথায় হাত বুলিয়ে নিচ্ছেন।
-” আপনি ছাড়া পেয়েও এতক্ষণে চলে যাননি কেন?”
-” আমি অন্তর দিয়ে জানতে পেরেছি আজ আমার সাথে সাক্ষাতে এক সাংবাদিক আসবে। তাই অপেক্ষায় ছিলাম। দেখুন আপনি চলে এলেন।”
প্রিয়তা মনে মনে বলল,
“ব্যাটা ভণ্ড, তোরে যে মাসুদ ভাই জানিয়েছে তা বলতে পারিস না? এরে আগে এক্সপোস করব। তারপর দেখে ছাড়ব। প্রমাণ ছাড়া তো কিছু করাই যায় না।”
___________________________________________
-” আপনি কমপ্লেইন লিখবেন কী লিখবেন না?”
-” মিসিং এর চব্বিশঘণ্টা তো এখনো হয়নি।”
-” খুঁজতে বের হতে তো পারবেন?”
বর্ষণের গলা ব্যথা করছে চিল্লাতে চিল্লাতে। গতকাল থেকে তাপৌষির কোন খবর নেই। রাত অবধি অপেক্ষা করে বর্ষণ রৌদকে ফোন দিয়েছিল। সব শুনে রৌদ রাতেই রওনা দেয়।
তাপৌষির ফোন রাত অবধি খোলা থাকলেও শেষ রাত থেকে বন্ধ দেখাচ্ছে।
একদিন রৌদ তিন চারবার তাপৌষিকে কল করে। কী জানি একটা দরকার ছিল। তাপৌষির ফোনে ব্যালেন্স না থাকায় ও ওর এক বান্ধবীর ফোন থেকে কল ব্যাক করে।
রৌদ ট্রেনে থাকা অবস্থায়ই ডায়েল লিস্ট খুঁজে খুঁজে সেই নাম্বার বের করে। ভোর রাত থেকেই সেই বান্ধবীর ফোন ব্যস্ত দেখাচ্ছিল। সকালের দিকে মেয়েটা ফোন ধরে। মেয়েটার নাম সীমা। সীমা সব শুনে পনেরো মিনিট পর আবার ফোন দেয়। সীমার থেকেই জানতে পারে তাপৌষি হোস্টেল থেকেও মিসিং। ওর জিনিসপত্র সব আছে শুধু ও নাই। সবাই দ্রুত পুলিশে ইনর্ফম করতে ছুটে আসে।
-” আপনারা খুঁজা শুরু করবেন না তাহলে?”
সীমার চিৎকারে সামনে বসা পুলিশ একটু নড়ে উঠে। কিন্তু পরক্ষণে হাতের কলম নামিয়ে রেখে চেয়ারে হেলান দেয়।
-” মেয়েটার নাম ঠিকানা ছবি দিন। একটা লিখিত অভিযোগ দায়ের করুন। আমরা খুঁজে দেখবো। মেয়ে তো আর বাচ্চা না। দেখেন কারও সাথে পালিয়েছে নাকি। মাথার উপর আবার বাপ-মা নাই।”
-” এই কী বললেন আপনি কী বললেন? পালালে আপনার কাছে অভিযোগ দিতে আসতাম?”
বর্ষণ তেড়ে এসআই এর দিকে যেতে গেলে রৌদ ওকে পিছন থেকে চেপে ধরে।
-” কী করছ ভাইয়া? রেগে যেও না। স্যার আমাদের কী করতে হবে?”
-” লিখিত অভিযোগ দায়ের করুন। আমরা এমনি খুঁজবো। তবে চব্বিশঘণ্টার আগে কিছুই করতে পারব না। মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক।”
রৌদ ৭৮৫/২০ ( কাল্পনিক) একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করে।
___________________________________________
চিল্লাচিল্লির আওয়াজ শুনে প্রিয়তা ইন্টার্ভিউ ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। কী হচ্ছে দেখতে এগিয়ে আসে।
-” আরে কই চললেন? আমার ইন্টার্ভিউ পেপারে ছাপাবেন না?”
-” না। শাক বেঁচে বড়লোক হলে আমাকে ফোন দিয়েন। কষ্টের টাকায় ইনকাম করলে ইন্টার্ভিউ নিতাম। ভণ্ড শাক বাবা কোথাকার।”
শাক বাবা যেন প্রিয়তার কথার কিছুই বুঝলেন না। মাথা নেড়ে “অবুঝ, ভারী অবুঝ বালিকা” বলতে লাগলেন।
.
বাইরে পুলিশ জিপের কাছে একটা ছেলের সাথে পুলিশের এসআই এর কথা কাটাকাটি চলছে। ছেলেটা উল্টো ঘুরে আছে বলে প্রিয়তা দেখতে পাচ্ছে না। একটু সামনে আগোতেই ছেলেটা পিছনে ঘুরল। প্রিয়তা বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
“জাহাঙ্গির নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিবেট কিং আফজাল সিদ্দিকী বর্ষণ? এখানে? ও মাই গড।”
-” বর্ষণ ভাই?”
বর্ষণ পিছনে ঘুরে তাকাল। ওর চোখ মুখ ফুলে আছে। সারারাত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে। মুখ কুচকে প্রিয়তাকে দেখল ও।
-” চিনতে পারলেন না? আরে আমি প্রিয়তা। প্রিয়তা রায়হান। আপনাদের দুই ব্যাচ জুনিয়র। র্যাগ নিয়েছিলেন আপনি আমার। আমি তো ডিবেট ক্লাবের সস্ক্রিয় সদস্য ছিলা….”
বর্ষণের কাছে নিজের পরিচয় দিতে দিতে হঠাৎ প্রিয়তার চোখ বর্ষণের অগোছালো চুল আর ফ্যাকাশে মুখের উপর পড়ে।
-” কী হয়েছে?”
রৌদ ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে প্রিয়তার দিকে তাকায়। জিন্সের প্যান্ট, লং টিশার্ট পড়া মেয়েটা হয়ত নিজের ঘাড় অবধি আসা চুল গুলো ঝুটি করে রেখেছে। মেয়েটা বেশ লম্বা ও চিকন স্বাস্থ্যের অধিকারী। ফর্সা শিশু শুলভ চেহারা।
-” আপনি লোকাল সাংবাদিক?”
প্রিয়তা রৌদের দৃষ্টি অনুসরণ করে গলায় ঝোলান আইডি কার্ডটার দিকে তাকাল। কার্ডের ফিতায় প্রেস লিখা।
-” জি। রাজশাহী’র আলো পত্রিকায় আছি।”
-” একটা হেল্প করতে পারবেন?”
-” জি বলুন।”
-” আমরা একটা নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি দিতে চাই।”
.
চলবে…
[#হয়ত ৩৫ পর্বের পর থেকে শুরু]
[ভেবেছিলাম এক সপ্তাহ সময় নিব। কিন্তু লিখতে ইচ্ছে করছে খুব। বর্ষণ আমার খুব প্রিয় একটি চরিত্র। ওকে লিখার জন্য মস্তিষ্ক বারবার তাড়া দিচ্ছিল। তাই সকলের অপেক্ষার পালা দীর্ঘ করতে চাইলাম না। ]