হয়ত সিজন ২ পর্ব ২

#ছায়া_হয়ে_মিশে_রব_কল্পনাতে
পর্ব:- ২(হয়ত ২)
.
-” সীমা তাপৌষির সব সার্টিফিকেট নিয়ে এসেছ তো?”
-” জি ভাইয়া। কিন্তু আমার মনে হয়না তাপৌষি এখানে থাকতে পারে। ফ্ল্যাট তো বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।”
বর্ষণ সীমার কথা শুনে কোন প্রতিক্রিয়া দেখাল না। অদিতিয়া এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে ঢুকার সময় আজ দারোয়ানের দেখা পায়নি ওরা। হয়ত আশেপাশে কোথাও গেছে।
ওরা এখন দাঁড়িয়ে আছে ফ্ল্যাট বি-৩ এর সামনে।
-” ভাইয়া গেট নক করেন।”
বর্ষণ গেট নক করার সাথে সাথে একজন ভদ্র লোক এসে গেট খুলেন।
-” কাকে চাই?”
-” ফরিদ আহমেদ আছেন?”
-” জি না। এখানে ফরিদ নামের কেউ থাকে না।”
রৌদ অতি বিনয়ের সাথে বলল,
-” এই ফ্ল্যাট মনে হয় আপনারা নতুন কিনেছেন। যার কাছ থেকে কিনেছেন তিনি ফরিদ আহমেদ। উনার এড্রেসটা পাওয়া যাবে? অথবা ফোন নাম্বার? ”
-” ফরিদ আহমেদ নামের কারও থেকে তো ফ্ল্যাট কেনা হয়নি। এই ফ্ল্যাটের পূর্ববর্তী মালিক শুভ্রা খন্দকার।”
-” জি উনি ফরিদ আহমেদের স্ত্রী। উনার নাম্বারটা একটু দেওয়া যাবে? খুব বিপদে পড়ে এসেছি।”
-” দাঁড়ান। ”
ভদ্রলোক ঘরে থেকে একটা কাগজে ফোন নাম্বার লিখে নিয়ে এসে তা বর্ষণের হাতে দিল।
___________________________________________
-” কী বদমাইশ মহিলা রে। এই ফ্ল্যাট তাপৌষির বাবা-মা কষ্ট করে কিনেছে। অথচ বজ্জাত মহিলা নিজের নামে লিখে নিয়েছে।” বলে সীমা সজোরে রাস্তায় বাম পা দিয়ে আঘাত করল। ও নিজের চোখে তাপৌষির বাবা-মার স্ট্রাগেল দেখেছিল। কী কষ্টটাই না করেছিলেন উনারা একটা ফ্ল্যাট কিনার জন্য!
রৌদ, বর্ষণ চুপ করে আছে। এই মুহূর্তে বর্ষণের নিজের উপর রাগ হচ্ছে। না ও তাপৌষিকে রাজশাহী আসতে দিত, না তাপৌষি এভাবে গায়েব হত।
-” ভাইয়া ফোন দিয়ে লাভ হবে না এই নাম্বারে। আগেই তো বলেছি উনারা সিংগাপুরে। আর এটা বাংলাদেশি নাম্বার।”
-” একবার চেষ্টা করতে ক্ষতি কী?”
রৌদের কথায় বর্ষণ ফোন বের করে ডায়েলে নাম্বার তোলে।
-” যদি ধরে তাহলে ভাইয়া নিজের পরিচয় দিবা না। বলবা খালু টাকা পায় সেই টাকা দিতে ফোন দিয়েছ।”
বর্ষণ বড় করে দম নিয়ে কল করল। লাউড স্পীকার অন করে মুখের সামনে ধরল।
রিং হচ্ছে…
-” হ্যালো।”
-” আসসালামু আলাইকুম। শুভ্রা খন্দকার বলছেন?”
-” জি বলুন।”
সীমার চোখ যেন অক্ষিকোটর থেকে বের হয়ে আসতে চাইল। সিঙ্গাপুরে তাহলে কে গেল? ওদের তো বলা হয়েছিল ফ্ল্যাট বিক্রি করে সবাই সিংগাপুর চলে গেছে। বর্ষণ, রৌদও কম অবাক হয়নি। গলা খাঁকারি দিয়ে বর্ষণ বলল,
-” আসলে আমি ফরিদ আহমেদ স্যারের কাছে থেকে কিছু টাকা ধার নিয়েছিলাম। এখন ফেরত দিতে চাই। আপনাদের ফ্ল্যাটে গেছিলাম। ওখান থেকে এই নাম্বার পেয়েছি। আপনি আপনাদের বর্তমান ঠিকানা দিলে আমি টাকা পৌঁছিয়ে দিতে পারতাম।”
শুভ্রার ঠিকানা পেয়ে বর্ষণ ফোন রাখল। সীমা ক্ষ্যাপা গলায় বলল,
-” এই মহিলার মাথার চুল থেকে পা’য়ের নখ পুরোটাই মিথ্যা।”
___________________________________________
দরজার সামনে দাঁড়ানো তিনজন অল্পবয়সী ছেলে-মেয়ে দেখে শুভ্রা সরু চোখে তাকাল।
-” আপনারাই ফোন দিয়েছিলেন?”
বর্ষণের আগে রৌদ উত্তর দিল,
-” জি ম্যাডাম। ফরিদ সাহেব আমাদের অনেক করেছেন। আমাদের বিপদে টাকা ধার দিয়েছেন। উনার টাকা ফেরত দিতে এসেছি।”
-” ওহ আপনারা বাইরে কেন দাঁড়িয়ে আছেন? ভিতরে আসুন।”
শুভ্রা গেট থেকে সরে বর্ষণদের ঘরের ভেতরে ঢুকতে ইশারা করল।
কী বিচ্ছিরি গন্ধ! সীমা নাক চেপে ধরে আছে। এই রকম জায়গায় শুভ্রা খন্দকার থাকতে পারে ও ভাবতেই পারছে না।
হঠাৎ ঘরে প্রবেশ করতে যেয়ে সীমার পা থমকে দাঁড়াল। বিছানায় নীলাভ্র সুয়ে আছে। হতদরিদ্র ঘরের ছেলে-মেয়েদের মতো ছেঁড়া কাথা তার গায়ে।
সীমা আস্তে করে জিজ্ঞেস করল,
-” উনার কী হয়েছে?”
শুভ্রা ছেলের দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
-” ও চলতে পারেনা। হাতে ও পায়ে ফ্রাকচার।”
সীমা এক ঢোক গিলে কোন রকমে বলল,
-” ওহ।”
.
তেরোখাদিয়া পশ্চিম পাড়ার এক রুমের ঘর ভাড়া নিয়ে থাকছে শুভ্রা ও তার ছেলে নীলাভ্র খন্দকার। সাত-আটটা পরিবারের সাথে বাথরুম শেয়ার করে থাকতে হয়। এই রকম কষ্ট শুভ্রা ওর জীবনে কখনো করেনি। কত আশা ছিল! কত শখ ছিল! সব শেষ।
ফরিদকে তো ভালোবেসেই বিয়ে করেছিল। ফরিদের হার্ড ওয়ার্ক দেখে কখনো মনে হয়নি যে ভবিষ্যতে এমন ভিক্ষুকের মতো অবস্থা হবে ওর।
-” ফরিদ আহমেদ?”
-” আজ বিশদিন হলো উনি মারা গেছেন।”
এবার মনে হয় সবচেয়ে বড় শক পেল সীমা, রৌদ, বর্ষণ। এ কী করে সম্ভব?
-” কী হয়েছিল?”
শুভ্রা গায়ে জড়ানো ময়লা ওড়না দিয়ে চোখের পানি মুছে বলল,
-” মেজর হার্ট এট্যাক।”
-” সরি।”
সীমার এই মহিলার কথাবার্তা শুনতে ভালো লাগছে না। মুখ দেখে মনে হয় কত ভোলাভালা। কে বলবে এর অন্তর বিষে ভর্তি?
সীমা ভারী গলায় জিজ্ঞেস করল,
-” এর আগে একবার আপনাদের ওই ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম। পাশের ফ্ল্যাটের এক ভদ্রলোক বলেছেন আপনারা সিংগাপুর চলে গেছেন।”
শুভ্রা মাথায় ওড়না ভালো মতো টেনে বলল,
-” দেখতেই তো পারছেন। খুবই খারাপ অবস্থা।”
সীমা বুঝতে পারছে এই মহিলার কথা বলার ধরণ। হঠাৎ হওয়া এই গড়িবি উনি উনার হাই সোসাইটির কাউকে দেখাতে চাননা। সীমার বলতে ইচ্ছা করল, ” কেন? এমন করে আছেন? যান তাপৌষিদের মতো অন্য কারও ঘর ভাঙার খেলায় মেতে উঠেন।” তবে ও এমন কিছুই বলল না। সরাসরি শুভ্রার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে বসল,
-” তাপৌষি কোথায়?”
-” কে তোমরা?”
-” তাপৌষি কোথায় বলুন নইলে পুলিশ ডাকব।”
-” সে কোথায় আমি কীভাবে জানব?”
সীমার রাগ বেড়েই চলেছে। বর্ষণ আর রৌদেরও রাগ লাগছে।
-” আপনি জানেন না?”
-” না।”
তিনজনের মুখের দিকে একবার করে তাকিয়ে শুভ্রা জিজ্ঞেস করল,
-“তোমরা টাকা দিতে এখানে আসোনি, তাইনা?”
-” কীসের টাকা? তাপৌষি কোথায়? কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন ওকে? কিডন্যাপ করেছেন? কত টাকার জন্য?”
শুভ্রা সীমার কথায় হেসে ফেলল। কোন মতে হাসি থামিয়ে বলল,
-” তোমার মনে হয় এই অবস্থায় আমি ওকে কিডন্যাপ করব? ওকে কিডন্যাপ করলে টাকা চাইব কার থেকে? দেখি সর তো আমার কাজে যেতে হবে।”
-” কীসের কাজ?”
-” তোমাকে কেন বলব? যাও বিদায় হও।”
-” যদি তাপৌষির নিখোঁজ হওয়ার পেছনে আপনার হাত থাকে তো দেখে নিব আপনাকে, বলে গেলাম।”
.
শুভ্রা গেট লাগিয়ে ছেলের পাশে এসে বসল। নীলাভ্র ঘুমাচ্ছে। কত সুন্দর হাঁটা চলা করতে পারা ছেলেটা সেই বাজারের ঘটনার পর বিছানাগত। টাকার অভাবে চিকিৎসাও করাতে পারল না। কে জানত কোম্পানি এভাবে ডুববে। এক কোটি দুই কোটি নয় মোট পঁচিশ কোটি টাকার লোকশান। বাবা ডুবে যাওয়া কোম্পানি মেয়ে আর মেয়ে জামাতার নামে লিখে দিবে এটা তো ভাবাই যায় না। কত সুখে ছিল ওরা। সুখের সংসারে এরূপ গ্রহণ লাগবে কে জানত? শুভ্রা বিড়বিড় করে বলল,
“ফরিদ তো ঠিকই লোকশানের কথা শুনে হার্ট এট্যাক করে মৃত্যুর রাস্তা বেছে নিল। কঠিন নরকের জ্বালা ভোগ করতে হচ্ছে এই আমাকে। পাওনাদারেরা এখনও কত টাকা পায়!”
আচমকা ওর মনেও প্রশ্ন খেলা করে উঠলো, তাপৌষি কোথায় গেল? এরাই বা কারা?
___________________________________________
-” কোথায় যাবা ভাইয়া?”
-” একবার থানায় চল। দেখি কত দূর এগোল পুলিশ। সীমা তুমি বরং হোস্টেলে চলে যাও। ”
-” আচ্ছা। ফোনে জানিয়েন ভাইয়া কী হলো না হলো।”
-” ঠিক আছে।”
রৌদ একটা রিকশা ডেকে সীমাকে উঠিয়ে দিল। নিজেরা একটা অটো নিল রিজার্ভে।
-“ওই মহিলার কথা তোমার বিশ্বাস হয় ভাইয়া?”
-” অবিশ্বাস করার মতো কিছু তো দেখলাম না। আচ্ছা রৌদ, তাপৌষিকে আমি খুঁজে পাবো তো?”
-” অবশ্যই ভাইয়া।”
বর্ষণ রৌদের কথার পিঠে কিছু বলল না। চোখ বুঝে অটোর সীটে হেলান দিল ও।
” তোমার শহরের রাস্তাগুলো
আমার বড্ড অচেনা।
এই শহরের প্রাণোচ্ছল বাতাসে
শুধু তুমি আমার খুব চেনা।”
“কোথায় তুমি তাপৌষি।”
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here