#হলুদ_বসন্ত
#পর্ব_০৮ (বোনাস)
#Eshika_Khanom
নুহাশ এটা বলে আর কিছুর অপেক্ষা না করে দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেল। দরজা বন্ধ করে মেঝেতেই বসে পড়ল। নিজের মাথাটা দুই হাত দিয়ে চেপে ধরল নুহাশ। মোটেও সে নিজেকে কাপুরুষের পরিচয় দিতে চায় না। অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরছে তার দুই চোখ থেকে। নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করা শুরু করেছে সে ইতিমধ্যে। ইচ্ছে করছে এ বাড়ি থেকে চলে যেতে, কিন্তু প্রিয় বন্ধুর শেষ সময়টুকুতে সে যে তার পাশে থাকতে চায়। তবে এখানে থাকলেই নিজের অব্যক্ত ভালোবাসাও তার নজরবন্দী হবে৷ নিজেকে দিশেহারা লাগছে তার। এমন একজনকেই ভালোবাসলো সে যাকে সে কখনোও পাবে না সে। প্রথমবার আয়াতকে দেখেই ভালোবেসে ফেলেছে সে। তবে এমন এক তরফা ভালোবাসা যে কখনোই পূর্ণতা পাওয়ার নয়। নিজের সুখের জন্যে কারো দুঃখের কারণ হতে পারবে না সে। আদ্রাফ হয়তো দুনিয়াতে থাকবে না, তাই বলে তার স্ত্রীকে নিজের করতে পারবে না সে। আয়াতকে কষ্ট দিতে পারবে না নুহাশ, একদমই পারবে না সে। আয়াতের চোখে ইতিমধ্যেই আদ্রাফের জন্যে ভালোবাসা দেখে ফেলেছে সে। আজ নুহাশের নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে। সহ্য করতে পারছেনা সে আদ্রাফ আর আয়াতকে একসাথে। দুইজনের মধ্যকার নীরব ভালোবাসা সেও অনুভব করছে, তবে তা মেনে নিতে পারছে না। কাঁদতে কাঁদতেই উঠে পড়লো নুহাশ। সোজা চলে গেল তার ওয়াশরুমে। শাওয়ারটা ছেড়ে তার নিচে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। বসন্তের আগমনের পূর্বে বিরাজমান শীতও আজ তাকে কাবু করতে পারলো না। নিজের অশ্রুধারাকে বিলিয়ে দিল কনকনে ঠাণ্ডা পানির মধ্যে। কষ্টগুলোকে সহ্য করা যে এখন বেশিই কঠিন হয়ে পড়ছে। তবে কি কাপুরুষেই পরিণত হবে সে?
.
.
.
“আচ্ছা শুনুন আমার না আপনার রুমটাতেও একবার ঢুকার খুব ইচ্ছে। আমি যদি একবার ঢুকি তাহলেও কি খুব সমস্যা হবে?” আদ্রাফকে প্রশ্ন করল আয়াত।
আদ্রাফ নাক মুখ কুচকে বলে, “আয়াত তুমি জানো তো আমার রোগ সম্পর্কে। আমার ব্যবহার্য কিছুই তোমার এখন স্পর্শ করা উচিত নয়। তোমাকে সাবধান থাকতে হবে।”
আয়াত বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টিয়ে বলে, ” উফচ আপনি বেশি ভয় পান। আমি শুধু দেখেই চলে আসবো।”
“কি দরকার আয়াত?”
“একটু প্লিজ, দুই মিনিট থাকব আপনার রুমে।”
আদ্রাফ ফোন চালাতে চালাতে বলল, “জেদ করো না তো!”
আয়াত জোর গলায় বলল, “আপনি না নিয়ে গেলে আমি জেদই করব। আমার অধিকার আছে আপনার রুমে যাওয়ার।”
আদ্রাফ আয়াতের কাছে একটু ঘেঁষে বসে ধীর কন্ঠে বলল,
“আমারও তো অনেককিছুর অধিকার আছে আয়াত।”
আয়াত পুনরায় কেঁপে উঠল। মানুষটা এই শীতের মধ্যেও আরও কাঁপিয়ে দেয় তাকে। বুঝেনা কি সে যে আয়াত তখন কি অনুভব করে? আয়াত কিছুটা চেপে আরও দূরে গিয়ে বসলো। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো আদ্রাফ৷ আয়াতের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,
“চলো আয়াত।”
আয়াত প্রশ্ন করল, “কোথায়?”
আদ্রাফ বলল, “যেখানে যেতে চেয়েছিলে।”
আয়াতের ঠোঁটে সুক্ষ এক হাঁসি ফুটে উঠলো। আদ্রাফের সাথে সেও চললো আদ্রাফের রুমে।
তবে রুমে গিয়ে অবাকের শেষ সীমানায় পৌছে গেল আয়াত। খুব সুন্দর করে মোহনীয়ভাবে সজ্জিত ঘরটির দেয়ালের বেশ কিছু অংশে আয়াতের ছবি টাঙানো। আয়াতের জীবনের পরিসরের ছোট ছোট কিছু মূহুর্তকে বিশেষভাবে সাজিয়ে তুলেছে আদ্রাফ। একবার আয়াত তার এক বান্ধবীর পোষা বিড়ালকে কোলে তুলেছিল। তার বান্ধবী তাকে দেখাতে নিয়ে এসেছিল বিড়ালটি। সেই বিড়ালটিকে আদর করার মুহূর্তটি আদ্রাফ ফ্রেমে বন্দী করে রেখেছে। আয়াত বিমোহিত হয়ে আদ্রাফের রুমে হেঁটে যাচ্ছে। আরেকটা ছবিতে সেই মূহুর্তকে অবলোকন করা যাচ্ছে যেখানে সে একটা বাবলগাল খেয়ে খুব বড় করে ফোলানোর চেষ্টা করছিল কিন্তু সেটা ফেটে গিয়ে আয়াতের নাকে লেপ্টে রয়েছে। বাবলটি বড় করে ফোলাতে না পারার কষ্টে আয়াত দুঃখভরা মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঠিক সেই মূহুর্তেই ছবিটি তোলা হয়েছে। আনমনেই হেসে উঠলো আয়াত। দূর থেকে সেই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হলো আদ্রাফ। আয়াত আরও এগিয়ে গিয়ে একটা ছবি স্পর্শ করতে নিলে আদ্রাফ বাঁধা দিয়ে বলল,
“ছুয়ো না এগুলো আয়াত, এগুলো মরণ পর্যন্ত আমার সম্পদ। তোমায় তো ছুয়ে দিতে পারব না আমার ভালোবাসা দিয়ে, তাই এই ছবিগুলোতেই নিজের ভালোবাসা কিছুটা উজাড় করব।”
.
.
.
মাত্র গোসল শেষে ওয়াশরুম থেকে বেরোলো আয়াত। ঘন কেশ চুয়ে চুয়ে এখনো পানি পড়ছে।সেই সাথে ভিজে যাচ্ছে তার পিঠ। এই শীতের মধ্যেও দ্বিতীয়বার গোসল করতে হলো তাকে একমাত্র আদ্রাফের কারণে। আয়াত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একা একাই বলতে লাগলো,
“লোকটা ভীষণ খারাপ, আমায় গোসল করতে বাধ্য করল।”
আবার আনমনেই হেসে উঠলো আয়াত। মাথাটা কোনোরকম মুছে নিচে নেমে এলো। সোজা গেল দাদীর রুমটিতে। সদ্য গোসল করায় যথেষ্ট আবেদনময়ী লাগছে তাকে একজন পুরুষের। তবে তাকে দূর থেকেই দেখলো সে। আবার নিজেকে সংযত করে চোখ ফিরিয়ে নিল সে। আয়াত দাদীর রুমে গিয়ে পিছন থেকে দাদীর দুই চোখ চেপে ধরল। ভয় পেয়ে গেলেন দাদী। নিজের চোখ ছাড়িয়ে পিছনে ঘুরে দেখতে পেল যেন এক সদ্য প্রস্ফুটিত ফুলকে। হাসি ফুটে উঠলো দিলারা জাহানের মুখে। আয়াতের ভেজা চুলগুলো দেখে ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করলেন,
“এই অবেলায় গোসল? কারণটা কি রে সতীন?
দাদীর মুখে ফুটে উঠেছে দুষ্টুমি ভরা হাসি। নয়নেও খেলা করছে দুষ্টুমি। আয়াত দাদীর প্রশ্ন ও চোখের ভাষা বুঝতে পারলো। মূহুর্তেই লজ্জার লালিমা ছেয়ে গেল তার কপোলদ্বয়ে। লজ্জাভরা হাসি নিয়ে বলল,
” ধুর দাদী তেমন কিছুই না।”
দাদী প্রশ্ন করলেন, “তাহলে বল এই অবেলায় কেন গোসল করলি?”
আয়াত বলল, “দাদী আদ্রাফ…”
আর কথা শেষ করতে পারলো না আয়াত। দিলারা জাহান আয়াতের কথা থামিয়ে মাঝপথে বললেন,
“হুম জানি তো কারণটা আদ্রাফ। পোলাটা দিনে দিনে বেশরম হয়ে উঠছে।”
আয়াত এবার বলল, “ধ্যাত দাদী আপনি যা বলছেন তেমন কিছুই না।”
দাদী বললেন, “হয়েছে হয়েছে এই সময়টা আমিও পার করে এসেছি বুঝলি সতীন। এই সময়ে তোর গোসলের কারণ জানি আমি।”
আয়াত মুখ ভার করে বলল, “হুম বেশি জানেন।”
দাদী ভাব নিয়ে বললেন, “হুম তা তো জানবই।”
আয়াত দাদীর হাত ধরে আহ্লাদের সুরে বলল,
“ও দাদী আজ রাতের রান্নাটা আমি করি?”
দাদী অবাক হয়ে বললেন, “তুই করবি?”
আয়াত বলল, “হুম আমিই করব। আপনার কি মনে হয় আমি রান্না পারিনা? প্লিজ দাদী না করবেব না প্লিজ।”
দাদী বললেন, “হুম না করব না, তবে শর্ত আছে।”
আয়াত জিজ্ঞেস করল, “কি শর্ত?”
দাদী কিছুটা আবদারের সুরে বললেন, “এইযে তুই আমায় আপনি করে ডাকিস না আমার নিজেকে খুব পর পর লাগে। তোর এখন থেকে তাহলে আমায় তুমি করে ডাকতে হবে।”
আয়াত ফিক করে হেসে দিল। তারপর বলল,
“ওহ আচ্ছা। ওকে সোনা দাদী, আমি এখন থেকে তোমাকে তুমি করেই ডাকবো। এখন অনুমতি দাও না?”
দাদী আয়াতের গালে আলতো করে এক চড় দিয়ে বললেন,
“যাহ বানিয়ে ফেল আজকের রাতের খাবার। আর কোনো সমস্যা হলে আমাদের সার্ভেন্টদের সাহায্য নিবি।”
আয়াত খুব খুশি হয়ে গেল অনুমতি পেয়ে। খুশি হয়ে দাদীকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আই লাভ ইউ দাদী।”
দাদী আয়াতকে ধরে বললেন,
“এটা আদ্রাফকে বল, কাজে দিবে।”
আয়াত বলল, “তুমি তো উত্তর দাও!”
দাদী বললেন, “হুম আই লাভ ইউ টু সতীন।”
এবার দুইজনেই শব্দ করে হেসে দিল।
.
.
.
রাতের খাবার বানানোর জন্যে পূর্ণ উদ্যমে রান্নাঘরে কাজ করছে আয়াত। পাক্কা গৃহিণীর মতো কাজ করছে। নিজের সম্পূর্ণ মনযোগ রান্নার মধ্যেই দিয়েছে সে। হঠাৎ করে রান্নাঘরে প্রবেশ করলো নুহাশ। ধীর পায়ে আয়াতের দিকে এগিয়ে নিল সে। তাদের মধ্যে আর কয়েক ইঞ্চি দূরত্ব হবে। নুহাশ আয়াতকে তখনই বলল….
#চলবে
[