তোলপাড়
ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৩৮
_______________
সারা রাত না ঘুমানোর ফলে চোখ দুটো ফুলে লাল হয়ে আছে অরূণীর।মাথা প্রচণ্ড রকমের ব্যথা। গায়ে জ্বর এসে গেছে।শরীর’টা নিস্তেজ হয়ে বিছানার সাথে মিশে আছে যেন।সকালের আলো ফোটার সাথে সাথে সূর্য অরূণীর রুমে আসে।অরূণী একবার সেদিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে রাখে।সূর্য এসেই বলল, “আমি তোকে ভার্সিটিতে পৌঁছে দিবো।ফোন চালানোর দরকার নেই আর।”
সূর্যের কথায় অরূণীর তেমন ভাবান্তর পরিলক্ষিত হলো না।অরূণীর মুখের অভিব্যক্তি আগের ন্যায় ই রইলো। সূর্য আবার বলল, “অরূণী আমি তোকে কিছু বলছি।আমি যদি পরবর্তী সময়ে এসব নিয়ে আর কিছু শুনি বা দেখি তাহলে কি হবে সেটা তুই বুঝতেই পারছিস। তুই কখন কি করছিস,না করছিস সব খবর আমার কাছে আসবে।”
সূর্য চলে গেল।অরূণী গুমোট ভাব’টা এখনো বিদ্যমান। কোনো উত্তর দিলো না সূর্যর কথায়। কিছুক্ষণ পর সেলিনা আহমেদ আর সাহেদ আহমেদ দুইজন ই আসলো। সবার ই একই কথা।অরূণীর অসহ্য লাগছে সব। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে।বাসার প্রতিটা মানুষ’কে বিরক্ত লাগছে।বুকের ভিতর কষ্টের তোলপাড় বয়ে যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে।
দুর্বল শরীর নিয়েও ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো অরূণী।সূর্য গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। ভার্সিটিতে গেলে অন্তত কারো ফোন দিয়ে কথা বলা যাবে রুদ্রর সাথে। বিধ্বস্ত অবস্থা অরূণীর! মনে হচ্ছে মুমূর্ষু রোগী। রুদ্র’কে বিষয়টা জানানো প্রয়োজন,অতি প্রয়োজন।
সূর্য অরূণী’কে ভার্সিটি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেল। ভার্সিটিতে পৌঁছে অরূণী তাইতির ফোন দিয়ে রুদ্র’কে কল দিলো।রুদ্র বেশ ভালো করেই বুঝতে পেরেছে অরূণীর কোনো সমস্যা হয়েছে।নয়ত এমন কখনো হয় নি।অরূণীর ফোন পেয়ে রুদ্র ব্যগ্র হয়ে বলল, “কী হয়েছে তোমার?কাল থেকে ফোন বন্ধ।আরে মেয়ে তুমি বোঝো না আমার চিন্তা হয়। সমস্যা কী তোমার?”
অরূণীর উত্তর দিচ্ছে না।কান্নার বেগে ভিতর থেকে কথা বের হচ্ছে না।শেষ পর্যন্ত আর কান্না আটকে রাখতে পারলো না।অবাধ্য কান্না গুলো বেরিয়ে আসলো। রুদ্র হতভম্ব হয়ে বলল, “অরূণী কি হয়েছে?কাঁদছো কেন?”
অরূণীর কান্না শুনে রুদ্র সন্দিহান হয়ে পড়লো।অরূণীর বাসায় কি জেনে গেল?শেষ পর্যন্ত অরূণী বলল, “বাসায় সব জেনে গেছে।চিঠিতে কি লেখা ছিলো?আমার ফোনও নিয়ে গেছে।”
রুদ্র হতবিহ্বল হয়ে কিছুক্ষণ চুপ থাকলো।মিনিট তিনেক পরে বলল, “চিঠি পেলো কীভাবে? একটু সাবধানে রাখতে পারো নি?কোথায় তুমি এখন?”
রুদ্রর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো।চোখে-মুখে অস্থিরতা।অরূণী বলল, “আমি ভার্সিটিতে।”
– “আমি আসছি।”
– “না। ভুলেও আসবেন না। সূর্য দাদা জেনে যাবে।”
সেদিনের মত আর দেখা করা হলো না। রুদ্র এখন ঝামেলা টা বাড়াতে চাচ্ছে না।প্রথমত কারণ হলো রুদ্রর লেখাপড়া এখনো কমপ্লিট হয় নি।এসব ঝামেলার রেশ ধরে যদি অরূণীর ফ্যামিলি অরূণী’কে বিয়ে দিতে চায়?এমন ই একটা চিন্তা রুদ্রর মাথায় জেঁকে বসেছে। রুদ্রর অনার্স ফাইনাল বর্ষের পরীক্ষারও খুব বেশি দিন বাকি নেই। রুদ্র অরূণী’কে বলল, “তুমি তোমার বাসায় বলো যে আমাদের মাঝে এখন কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের এখন যোগাযোগ করা,কথা বলা সব রিস্কি। সবকিছু ভেবে আমাদের উচিত কয়েক মাস যোগাযোগ বন্ধ করে রাখা।”
অরূণী মানতে নারাজ। রুদ্র নিজেকে সামলে নিতে পারবে অতি সহজে।ভিতরে ভিতরে কষ্টে দগ্ধ হলেও মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাখতে পারবে। কিন্তু রুদ্র জানে অরূণী’কে দিয়ে এটা কখনো সম্ভব না।অরূণীর ফোন এখনো সূর্যর কাছে। শামীমার ফোন দিয়ে অতি গোপনে রুদ্রর সাথে কথা বলে। তীব্র আতঙ্কের ভিতর কথা বলতে হয় অরূণীর। না ঘুমোতে ঘুমোতে চোখের নিচ’টা কালো হয়ে গেছে। অরূণীর এই বেহাল দশা দেখে রুদ্রর বুকের মাঝে চিনচিনে ব্যথা হয়।
_____________
দিন গুলো এভাবেই কাটছে। হঠাৎ অরূণী অসুস্থ হয়ে পড়লো। শামীমাও তাঁর দেশের বাড়ি গিয়েছে বেড়াতে। রুদ্রর সাথে কথা বলার সুযোগ নেই। বাসার সবাই শ্যেন দৃষ্টিতে অরূণীর খেয়াল রাখছে।দিনে দিনে এসবে তিক্ত হয়ে ওঠছে অরূণী। জীবন’টা বিষাদময় লাগছে। রুদ্র’কে দেখে না বেশ কয়েকদিন। লাস্ট যেদিন দেখেছে সেদিন সাথে সাহেদ আহমেদ ছিলো।দূর থেকে দেখেছিলো। রুদ্রও দূর থেকে তাকিয়ে ছিলো অরূণীর দিকে।বিষদময় চাহনি ছিলো রুদ্রর।অরূণীর কান্না পাচ্ছিলো।বার বার সন্তপর্ণে চোখের পানি মুছে ছিলো।অরূণীর কান্না রুদ্রর দৃষ্টি এড়ায় নি। রুদ্রর বুকের মাঝে তীক্ষ্ণ এক যন্ত্রণা হয়েছে।
অরূণীর শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয় যা হওয়ার হবে, রুদ্রর মেসে যাবে। রুদ্র’কে না জানিয়ে হুট করেই রুদ্রর মেসে গিয়ে হাজির হয়।রুদ্রর বিছানায় শুয়ে শুয়ে সিগারেট ফুঁকছিলো। আচমকা অরূণী’কে দেখে ভুত দেখার মত চমকে যায়।তড়াক করে ওঠে বসে। রুদ্রর মেসের অন্য দুইজন তখন ছিলো না। রুদ্র হতবিহ্বল হয়ে বলে, “অরূণী!তুমি?তুমি এখানে?”
অরূণী কোনো উত্তর না দিয়ে আচমকা রুদ্র’কে জড়িয়ে ধরে।চোখ দুটো বর্ষণমুখর হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। রুদ্র আর প্রশ্ন না করে অরূণী’কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো। আশ্চর্য! রুদ্রর চোখ দুটোও ভিজে ওঠছে। রুদ্র নিজেকে সামলায়।অরূণীর কপালে চুমু খায়। আশ্বস্ত গলায় রুদ্র বলে, “আবেগী রাণী কেঁদো না।সব ঠিক হয়ে যাবে। বলছি তো আমি সব ঠিক হয়ে যাবে।”
অরূণীর কান্না আরো বাড়ে।অরূণী জানে এই সমস্যা ঠিক হওয়া সহজ বিষয় না। কাঁদতে কাঁদতে অরূণী বলে, “আমি এভাবে আর পারছি না।আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।”
রুদ্র বিষণ্ণ গলায় বলল, “সব ঠিক হয়ে যাবে অরূণী। সব সম্পর্কেই এমন কিছু বাঁধা বিপত্তি আসে। ধৈর্য ধরো ঠিক হয়ে যাবে।তুমি এত পাগলামি করলে সমস্যা আরো বাড়বে তো?”
রুদ্রর কথার উত্তরে অরূণী কেবল মাথা নাড়ালো।অরূণী মুখ’টা পাণ্ডুর,ফ্যাকাশে হয়ে আছে। চেহারায় তীব্র ক্লান্তি। রুদ্র কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো অরূণীর দিকে। রুদ্র আদুরে গলায় অরূণী’কে জিজ্ঞেস করে, “খেয়েছো? চেহারার এই হাল কেন?”
রুদ্র খাট থেকে ওঠে প্লেটে ভাত নিলো।অরূণী’কে খাইয়ে দিতে দিতে শাসিয়ে বলল, “এত পাগলামি করার কি আছে বলো তো? ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করবে এখন থেকে।”
বেশ কিছুক্ষণ থেকে বেরিয়ে পড়ে অরূণী বাসার উদ্দেশ্যে। রুদ্র কয়েক’টা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল।বুকের ভিতর চাপা একটা কষ্ট বিচরণ করছে।
______________
রুদ্রর ওখান থেকে বাসায় ফেরার সাথে সাথে সেলিনা আহমেদ অরূণী’কে ডেকে তাঁর রুমে নিলো।অরূণীর বুকের ভিতর ধ্বক ধ্বক করছে।জেনে গেল বাসায়? সেলিনা আহমেদ দরজা বন্ধ করে অরূণীর গালে ক্রমাগত চড় মারতে লাগলো। চেঁচিয়ে ওঠে বলল, “এত বেহায়া হয়েছিস? রুদ্রর বাসায় গিয়েছিলি?”
অরূণী চোখ তুলে তাকালো সেলিনা আহমেদের দিকে।হাত-পা কাঁপছে অরূণীর। কিছু ভাবতে পারছে না। সেলিনা আহমেদ রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “সূর্য এসে তোকে মেরে ফেলবে।খুব বেশি বেড়েছিস?এত নির্লজ্জ হয়েছিস?”
সেলিনা আহমেদ চলে যাওয়ার পর অরূণী রুমে বসে ভয়ে কাঁপছিলো। সূর্য হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকলো। সূর্যের চড়ে আঘাতে অরূণীর গালে কালশিরা পড়ে গেল। ঠোঁটের কাছ’টা ফেটে রক্ত পড়তে লাগলো।অরূণী কাঁদছে না,স্তম্ভিত হয়ে বসে আছে। অরূণীর রাত গুলো কাটতে লাগলো তীব্র কষ্ট নিয়ে। রাতে ঘুম হয় না,ঠিক মত খাওয়া-দাওয়া করে না। কয়েকদিন ধরে অরূণী’কে রুম থেকে বের হতে দিচ্ছে না। রুদ্রর সাথে কোনো রকম যোগাযোগ করতে পারছে না।অরূণীর পাগলামি দিন দিন বেড়েই চলেছে।সাহেদ আহমেদ সিদ্ধান্ত নেয় অরূণী’কে বিয়ে দিয়ে দিবে। সূর্যও সায় দেয়।মান-সম্মান অক্ষুণ্ন থাকতেই বিয়ে দিয়ে উচিত সেলিনা আহমেদের মতে।এর ভিতর রুদ্ররও ফাইনাল এক্সাম শেষ হয়ে যায়। মাস্টার্সের জন্য সুযোগ পায় কানাডার University of Saskatchewan এ। রুদ্র শত চেষ্টা করেও অরূণীর সাথে দেখা করতে পারছে না। শুধু শুনেছে অরূণীর বিয়ের কথা চলছে। রুদ্রর পাগল প্রায় অবস্থা। অন্যদিকে মুকুল আকন আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
(চলবে)