#আমার_আকাশে_তারা_নেই
#লাবিবা
পর্ব: 2
রাত বাড়তে শুরু করেছে। এটা বর্ষার সিজন না হলেও মাঝেমধ্যে টুপটাপ বৃষ্টি আকাশের বুক চিরে ধরণীর বুকে নেমে আসে। সিক্ত করে তুলছে পরিবেশকে। ইচ্ছে ইহানের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ডাইনিং টেবিলেই মাথা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ইহান সেই সকালে বেরিয়েছে আর সারাদিনেও তার খোঁজ নেই। দুপুরে খেতে অবদি আসেনি। ইচ্ছে বার কয়েক ইহানকে কল করেছিল কিন্তু প্রতিবারই ইহান তার কল কেটে দিয়েছে। এতে ইচ্ছে খুব একটা অবাক হলোনা। ইহানের মন চাইলে তার কল ধরে কখনোবা ধরেনা। তবে খুব কম সময় সে ইচ্ছের কল ধরে। ধরলেও তার স্থায়ীত্বকাল এক মিনিটের বেশি হয় না কখনো।
ইহান যখন বাড়িতে ফেরে তখন ঘড়ির কাটা প্রায় রাত ১টা ছুঁই ছুঁই। বেল বাজতেই ইচ্ছের ঘুম ভেঙে যায়। দ্রুত উঠে দরজা খুলে দিল। দরজা খুলতেই ওপাশে ইহানকে আধ ভেজা অবস্থায় দেখতে পেল। ইহান কোনরূপ কথা ছাড়াই ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। ইচ্ছে আড়চোখে একবার ঘড়িতে সময় টি দেখে নিল। দরজা আটকে সেও ইহানের পিছুপিছু রুমে চলে আসে। তোয়ালে সহ প্রয়োজনীয় সকল জিনিস ইহানের হাতের সামনে এগিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে অবশেষে বলে ফেলে,
-‘এত দেরি হল কেন আপনার?’
ইচ্ছের প্রশ্নে ইহানের কোন ভাবান্তর হলো না। সে মনোযোগ সহকারে নিজের চুল মুছতে ব্যস্ত।
-‘না খেয়ে আপনার জন্য ভাত নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম আমি।’
-‘খেয়ে নাও। আমি খেয়ে এসেছি।’
কথাটি বলে বড় বড় পদ ফেলে বারান্দায় যেয়ে তোয়ালেটা নেড়ে দিল। বারান্দা থেকে ফিরে এসে বিছানায় ঘুমানোর জন্য শুয়ে পরলো। আর একটি বাক্য ও উচ্চারণ করলো না ইহান। ইচ্ছের খুব কান্না পাচ্ছে। কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে গলার কাছে আটকে আছে। মুখ দিয়ে সে আর একটি কথাও বলতে পারল না। তার ইচ্ছা হচ্ছে ইহানকে বলতে,
“আপনার জন্য রোজ রাতে আমি অপেক্ষা করি ইহান। না খেয়ে বসে থাকি আপনার সাথে একত্রে খাব বলে। আপনার পানের চেয়ে বসে থাকি দুটো কথা বলবো বলে। কি হয় আমার সাথে দুটো কথা বললে? খুব কি ক্ষতি হয় আমার সাথে একদিন রাতের খাবারটা খেলে? কি ক্ষতি হয় যদি একটু বুঝেন আমায়?”
কিন্তু ইচ্ছে একটি কথাও মুখ থেকে বাইরে বের করতে পারলো না। সে রুম থেকে বেরিয়ে সকল খাবার ফ্রিজে তুলে রাখে। আজও তার খাওয়া হয়ে ওঠে না। এ নিয়ে কত রাত সে উপসে কটিয়েছে তার কোন হিসেব নেই। ক্ষুধার যন্ত্রণা তাকে ছুঁতে পারে না এখন আর। মনের যন্ত্রণার কাছে এ যন্ত্রণা তো কিছুই না!
_______________
ইহান ঘুম থেকে উঠে রুমের বাইরে বের হতেই দেখতে পায় তার শ্বশুর মোশাররফ মোড়ল এসেছেন। হঠাৎ করে এভাবে আশায় ইহান অবাক হয়ে তবে মুখে কিছুই বললেন না। ইহানকে দেখে মোশারফ মোড়ল হাসিমুখে তাকে কাছে ডাকেন।
-‘ তা কেমন আছ বাবা?’
–‘জ্বি বাবা আলহামদুলিল্লাহ। আপনারা সবাই ভালো তো?”
–‘এইতো আছি। তা বাবা মেয়েটাকে নিয়ে যেতে এলাম। কতদিন ও বাড়িতে যায় না। ওর মাতো রোজ রোজ কান্নাকাটি করে। নিজের ও খারাপ লাগে। তাই চলেই এলাম মেয়েকে নিয়ে যেতে। বলি বাবা তুমিও চলো আমাদের সাথে। কিছুদিন না হয় বেরিয়ে এলে।’
-‘না বাবা আসলে অফিসে কাজের চাপ অনেক। এ সময় বেড়াতে যাওয়া টা বেমানান। কাজের চাপটা কমলে যেয়ে ঘুরে আসবো। আপনি বরং ইচ্ছে কে নিয়ে যান।’
আরো কিছুক্ষণ দুজন কথা বলে একসাথে নাস্তা করে। তাদের সাথে নাজমুল সাহেবও যোগ দেয়। হাসি মজার মাধ্যেই নাস্তাটা শেষ হয়ে যায়। কিছুক্ষণের মাধ্যেই ইহান অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। ইচ্ছে ভেবেছিলো তার যাওয়ার কথা শুনলেই ইহান তাকে যেতে মানা করবে। তার কোমল হাত দুটো ধরে বলবে,
“তুমি যেওনা ইচ্ছে। তোমাকে ছাড়া একটি দিনও আমি থাকতে পারবো না। আমার ব্যস্ততা কমলে তোমায় নিয়ে আমি একদিন ঘুরে আসবো নি। এখন প্লিজ তুমি যেওনা।”
কিন্তু তেমনটা হয়নি। ইহান তাকে যেতে মানা করাটা তো দূরে থাক সকাল থেকে তার সাথে একবার কথাও বলেনি। ইচ্ছের কিশোরী মনটা আরো একবার ভেঙে যায়। দুচোখের পানি উপচে পড়তে থাকে। সে মনে মনে ভেবে নেয় এবার গেলে সে এক মাসেও ফিরবে না। তখন ইহান ঠিকই বুঝবে। ইহান তাকে ফিরে আসার কথা যতদিন না বলবে সে ততদিন ফিরে আসবে না। বেশি করে জামা কাপড় গুছিয়ে নিল সে। এবার সে কিছুতেই ফিরবেনা। না মানে না! কিছুতেই না!
________________
ইচ্ছে শ্যামপুরে এসেছে আজ দুদিন হল। এই দুদিনে ইহান একবার ও কল দিয়ে তার খোঁজ নেয়নি। ইচ্ছে ও রাগ করে ইহানকে কল করেনি। সে ভেবেছিল সে রাগ করে কল না করলে হয়তো ইহান তাকে কল করবে। কিন্তু ইহান তো ইহান! সে ভুলেও একবার কল করেনি। ইচ্ছে বার কয়েক ফোন চেক করেও যখন কাঙ্খিত মানুষটির কল পেল না তখন কেঁদে ফেলল। ইচ্ছের ছোট মোনটাকে ইহান বারবার ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে।
বিকেল হতেই পারুলের সাথে নদীর পাড়ে ঘুরতে বেরিয়েছে ইচ্ছে। নদীর পাড় টা ইচ্ছের খুবই পছন্দ। আগে যখন এখানে থাকতো তখন প্রতিদিন বিকেলে সে এখানে বসে প্রকৃতি উপভোগ করত। কি সুন্দর ঠাণ্ডা বাতাস। নিমিষেই মন ভালো হয়ে গেলো ইচ্ছের।
-‘কেমন আছিস ইচু?’
অনেকদিন বাদে পরিচিত সেই কণ্ঠস্বর শুনতে পেরে পেছনে তাকাল ইচ্ছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি কে চিনতে একটুও সময় লাগলো না তার।
-‘হাসান ভাই!’
হাসান নামের লোকটি ঠোঁটট কামড়ে হাসলো। ইচ্ছের ঠোঁটের কোনেও হাসির ঝলক দেখা দিল।
-‘কবে এসেছ ভাইয়া তুমি! আল্লাহ আমিতো কিছুই জানিনা।’
-‘সপ্তাহের মত হয়েছে আমি এসেছি। এসেই শুনলাম ইচু পিচ্চিটার নাকি বিয়ে হয়ে গেছে!’
বিয়ের কথা শুনতে ইচ্ছের মুখ লাল আভায় ছেয়ে গেল। হাসান বুঝল ইচ্ছে লজ্জা পাচ্ছে। তাই সে কথা ঘুরিয়ে নিল।
-‘চাচিকে আমি মানা করেছিলাম তোকে জানাতে। ভেবেছিলাম তোকে একটা সারপ্রাইজ দেবো। এই দেখ তোকে সারপ্রাইজ দিয়ে দিলাম।’
ইচ্ছে এবার হাসি হাসি মুখে বলে উঠলো,
-‘হুহ বুঝলাম। এবার বলো বিয়ে করছ কবে?’
বিয়ের কথা শুনতে হাসানের মুখে আঁধার নেমে এলো। সে বিদেশে যেয়ে ইচ্ছের সাথে যোগাযোগ রাখেনি। ভেবেছিল বিদেশ থেকে ফিরে ইচ্ছে কে নিজের মনের কথা জানাবে। কিন্তু ফিরে এসে জানতে পারলো ইচ্ছের বিয়ে হয়ে গেছে। কথাটা শুনেই যেন তার পুরো পৃথিবী থমকে গিয়েছিল। ইচ্ছে যখন সেদিন গ্রামে এসেছিলো তখন সে ইচ্ছেকে দেখেও সামনে আসেনি। তখন সামনে আসলে হয়তো নিজেকে সামলে রাখতে পারতো না। এ জন্যই নিজেকে সামলে আজ দুদিন পর তার সাথে দেখা করল।
হাসান সম্পর্কে ইচ্ছের দূরসম্পর্কের চাচাতো ভাই। তবে তাদের সাথে ইচ্ছেদের পারিবারিক সম্পর্ক খুবই ভালো।
-‘নারে পিচ্চি বিয়ে নিয়ে এখনও ভাবি নি কিচ্ছু। তবে বিয়ের চিন্তা ভাবনা মাথায় আসলে সবার আগে তোকেই জানাবো।’
-‘ভাবতে ভাবতে তো বুড়ো হয়ে গেলে। আর কত ভাববে শুনি? নিজের বয়স দেখেছ! দুদিন পর চুল পিকতে শুরু করবে! এবার ভাবাভাবি বাদ দিয়ে সুন্দর দেখে একটা মেয়ে বিয়ে করে নাওতো।’
তাদের কথার মাঝেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। চারদিক থেকে সন্ধার আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে। ইচ্ছে বাড়ির পথে পা বাড়ালো।
-‘আজ আসি হাসান ভাই। এ ব্যাপারে অন্য একদিন কথা হবে।’
ইচ্ছে চোখের আড়াল হতেই হাসানের দুচোখে পানি এসে জমা হল। ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই! কিন্তু অতি কষ্টে সেই ছেলেরাও কাঁদে। যে মানুষটাকে পাওয়ার জন্য তার এত কষ্ট করা, ফিরে এসে সেই মানুষটাকে অন্য কারো অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে দেখতে হবে এটা সে কখনো ভাবেনি। তবে এখন সে দোয়া করে ইচ্ছে যেন সুখে থাকে। পৃথিবীর সকল সুখ যেন ইচ্ছের দুহাতে ধরা দেয়! ইচ্ছের সুখ দেখেই না হয় সে তার বাকি জীবন কাটিয়ে দিবে। সে সিদ্ধান্ত নিল এদেশে আর থাকবে না। সে আবারও বিদেশে চলে যাবে। এখানে থাকলে ইচ্ছের স্মৃতিগুলো তাকে ধাওয়া করবে। যেটা তার জন্য খুবই কষ্টকর হবে। তবে যাওয়ার আগে ইচ্ছের হাজবেন্ডের সাথে একবার দেখা করে যাবে। তার পিচ্চিটার কেমন ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছে তা একবার দেখে নেওয়া দরকার। তবে ইচ্ছে হয়তো বেশ সুখেই আছে। সে ইচ্ছের মুখে কোন বেদনার ছাপ খুঁজে পয়নি। ইচ্ছে সুখে থাকলেই হলো। এতেই তার তৃপ্তি।
ইচ্ছে জানতেও পারলো না কেউ একজন তাকে ভালোবাসে! পচন্ড রকম ভালোবাসে। আর কখনো হয়তো তার জানাও হবেনা। সময়যে তাকে অন্য কারো সাথে বেঁধে ফেলেছে! তা না হলে তার জীবন গল্পটা হয়তো অন্যরকম হতো!
চলবে…….
(