আমার আকাশে তারা নেই পর্ব -০১

-“আমায় একটু ভালবাসবেন ইহান?”

কথাটা শোনা মাত্রই চোখ মেলে তাকালো ইহান। কেবলই চোখ দুটো লেগে আসছিল তখনই ইচ্ছের এমন কথায় চোখ মেলে তাকালো। বিরক্তি নিয়েই পাশ ফিরে তাকায় সে। ইচ্ছে তখনও উত্তরের আশায় ইহানের পানে চেয়ে আছে।

-“এই মাঝরাতে কি শুরু করলে বলতো? এখন কি এসব কথা বলার সময়? ঘুম পাচ্ছে আমার খুব। বিরক্ত করো না।”

কথাটা বলে ইহান আবার পাশ ফিরে শুয়ে পরলো। ইচ্ছের এমন ব্যাকুল আবদারটি ইহানের হৃদয় স্পর্শ করল না। ইচ্ছের চোখের কর্নিশ বেয়ে এক ফোটা জল গড়িয়ে পরলো। স্বামী নামক ব্যক্তিটি তার পাশে থেকেও যেন অনেক দূরে। একই বিছানায় একই ছাদের নিচে থেকেও তারা দুজন দুজনের থেকে বহুদূরে। ইচ্ছের খুব ইচ্ছে হয় অন্য পাঁচটা সংসারের মত স্বামীর সাথে হাসিখুশিতে সংসার করতে। কিন্তু সে কপাল বুঝি তার নেই। স্বামীতো তার দিকে ফিরেও তাকায় না। রূপে গুণে কোন দিক থেকে কমতি আছে তার? তবুও স্বামী নামক এই ব্যক্তির থেকে দিনের পর দিন অবহেলা পেয়ে আসছে ইচ্ছে।

পুরো নাম তার আনিসা তাবাচ্ছুম ইচ্ছে। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। শ্যামপুর গ্রামের জমিদারের মেয়ে ইচ্ছে। জমিদারকন্যা হওয়ায় আদর ভালোবাসা থেকে শুরু করে কোন কিছুই অভাব হয়নি কখনো তার। পড়াশোনায় খুব একটা ভালো ছিলনা সে কখনোই। পড়াশোনার ব্যাপারে সে ছিল বরাবরই উদাসীন। পরীক্ষার খাতায় ৩৩ পেয়ে পাস করলেও রূপে খাতায় তার নম্বর ছিল সর্বদা ১০০। এককথায় গ্রামের সব থেকে সুন্দরী সেই ছিল। তার বয়স যখন ষোলো, তখন থেকেই তার জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করে। কিন্তু মেয়ে ছোট এবং সুপাত্র না পাওয়ায় তার বাবা মোশাররফ মোড়ল মেয়েকে বিয়ে দেয়নি। দেখতে দেখতে সে এইচএসসি পরীক্ষা সমাপ্ত করে। পরীক্ষা শেষে ইচ্ছে তার বাবাকে সরাসরি জানিয়ে দেয় সে আর পড়াশোনা করতে চায় না। তখন মোশারফ মোড়ল ভাবেন মেয়েকে শুধু শুধু বসিয়ে রেখে কি লাভ তার থেকে সুপাত্র দেখে মেয়েকে তার হাতে তুলে দেওয়াই ভালো। তাছাড়া গ্রামাঞ্চলে এইচএসসি পাস করা মেয়ে মানেই অনেক শিক্ষিত।

ইহান মোশাররফ মোড়লের অতি কাছের বন্ধু জামাল সাহেবের ছেলে। দু পরিবারের পছন্দের ভিত্তিতেই তাদের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। বিয়ে নিয়ে ইচ্ছের খুব একটা অমত ছিলনা। বাবা তাকে একবার বলাতেই সে রাজি হয়ে যায়। বিয়ের আগে সরাসরি কখনো দেখা হয়নি তার ইহানের সাথে। অবশেষে বেশ জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের বিয়ের সম্পন্ন হয়। বিয়ের দিনই ইচ্ছে প্রথমবারের মতো ইহানকে দেখে। বাইরে থেকে উচ্চ ডিগ্রিধারী সুউচ্চ সুপুরুষ ব্যক্তিটিকে প্রথম দেখাতেই ভালো লেগেছিলো ইচ্ছের। সে মুহুর্তেই সে ভেবে নিয়েছিল এই মানুষটাকে সে অনেক ভালবাসবে। মন প্রাণ উজাড় করে দিয়ে ভালবাসবে।
বর্তমানে তাদের বিয়ের বয়স ছয় মাস পেরিয়েছে। বিয়ের প্রথম দু-তিন মাস সবকিছু ঠিক থাকলেও তারপর থেকেই শুরু হয় ইচ্ছের প্রতি ইহানের অবহেলাটা। ইচ্ছ ভেবে পায়না ঠিক কি কারণে ইহান তার থেকে এতটা দূরে সরে থাকে। শ্বশুর-শ্বাশুরি আর এক ননদ নিয়ে ছোট্ট সংসার তার। শশুর, শাশুড়ি, ননদ সকলের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক ইচ্ছের। কিন্তু সম্পর্কের মূল যে ব্যক্তিটি তার সাথেই মনের কোনো মিল নেই। মাত্র এ কয়দিনেই সে ইহানকে প্রচন্ড রকম ভালোবেসে ফেলেছে। ইহানের একটু ভালবাসা পাওয়ার জন্য তার ছোট্ট হৃদয় টুকু হাহাকার করতে থাকে সর্বক্ষণ। কিন্তু ইহান সেদিকে ফিরেও তাকায় না।

আরো একটি রাত নির্ঘুম নিভৃতে কেটে যায় ইচ্ছের। চোখ মুখ ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। এই তিন চার মাস ধরে এমন কোন রাত নেই যে রাতে সে কাঁদেনি। স্বামী নামক প্রিয় ব্যক্তির থেকে অবহেলা সহ্য করার ক্ষমতা হয়ত কোন স্ত্রীরই নেই।
দূর থেকে আজানের মিষ্টি আওয়াজ ভেসে আসতেই বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় ইচ্ছে। ধীর পায়ে হেঁটে যেয়ে জানালা থেকে পর্দা সরিয়ে দেয়। বাইরে থেকে আসা অল্প আলোতে স্বামীর মুখ পানে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে। এই মানুষটাকে সে ভীষণ ভালোবাসে। আবারো চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। চোখের পানি টুকু মুছে যায় নামাজের উদ্দেশ্যে। সে তার মোনাজাতে আল্লাহর কাছে চাইবে তার স্বামীকে। সে তো শুধু পৃথিবীতে না মৃত্যুর পরের জীবন ইহানকে নিজের করে চায়। তার প্রত্যেক মোনাজাতে সে তার স্বামীকে চায়।
_______________

আটটা বাজতেই শারমিন বেগমের ঘুম ভাঙ্গে। রুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে আসতেই দেখে সকালের নাস্তা প্রায় বানানো শেষ। নাজমুল সাহেব এখনো বাড়িতে ফেরেন নি। ফজরের নামাজের পর হাঁটাহাঁটি করার অভ্যাস তার। শারমিন বেগম হাসি মুখে রান্নাঘরে ঢোকেন।

-‘আজ এত তাড়াতাড়ি নাস্তা বানালে যে?’

ইচ্ছে শারমিন বেগমকে দেখেই ঠোঁট এলিয়ে হাসল।

-‘শুভ সকাল মা। আব্বু ফিরেছেন কি?’

শারমিন বেগম কাঁপে চা ঢালতে ঢালতে প্রতিউত্তর করলেন

-‘শুভ সকাল। না তোমার আব্বু এখনো ফেরেনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে যাবে। তোমার শরীরের কি অবস্থা এখন? মাথা ব্যথা কমেছে? কাল রাতে তো মাথা ব্যথার জন্য কিছু না খেয়েই রুমে চলে গেলে।’

-‘হ্যা মা এখন সুস্থ।’

-‘ইহান কোথায়? আজ এখনো উঠলনা যে?’

-‘আজ তো শনিবার মা। উনার অফিস আজ বন্ধ। এজন্যই হয়তো বেশি সময় ধরে ঘুমাচ্ছে।’

কথার মাঝেই ইরা চলে আসে। ইরা হচ্ছে ইহানের একমাত্র বোন।

-‘শুভ সকাল মা। শুভ সকাল ভাবি।’

-‘আপনাকেও শুভ সকাল আপু।’

ইরা বয়সে ইচ্ছের থেকে বড়। তবে সম্পর্কে সে ছোট ননদ। তবুও ইচ্ছে ইরাকে আপু বলেই সম্বোধন করে।

দশটা বাজতে সকালে নাস্তার টেবিলে চলে আসে। ইহানও ইতিমধ্যে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে। নাস্তার টেবিলে নাস্তা খেতে খেতে নাজমুল সাহেব ইহানকে বলে উঠেন,

-‘বলছিলাম বিয়ের তো বেশ কিছুদিন হল। তোমরা তো এখনো কোথাও ঘুরতে গেলে না। অফিস থেকে কিছুদিন ছুটি নিয়ে না হয় ইচ্ছে কে নিয়ে ঘুরে আসো। এ বাড়িতে আসার পর থেকেতো মেয়েটি এখন পর্যন্ত বাড়ীর বাইরে পা রাখেনি।’

ঘুরতে যাওয়ার কথা শুনেই ইচ্ছের ভিষণ খুশি লাগল। ঘুরতে তার অনেক ভালো লাগে। তাছাড়া ঘুরতে গেলে নিশ্চই ইহান তাকে সময় দিবে। তখন তো আর তার অফিস থাকবেনা আর না কাজ। ভাবতেই ইচ্ছের মোনটা ভালো হয়ে গেল।

-‘আমি এখন কোথাও যেতে পারবো না বাবা। অনেক কাজ জমে আছে।’

মুহূর্তেই ইচ্ছের হাসিটা মিলিয়ে গেল। কিশোরী মনে জমা হল একরাশ অভিমান। কি হতো একটু ঘুরতে নিয়ে গেলে? কাজ তো সে সবসময়ই করে। ইচ্ছে মনে মনে চাইছে যে করে হোক তার শ্বশুর আব্বু যেন ইহানকে রাজি করে ঘুরতে যেতে।

-‘কাজ তো সবসময়ই করছ। সামনেও করবে। তাই বলে এমন না যে সব ফেলে শুধু কাজের পেছনে ছুটবে। নিজের পরিবার নিজের স্ত্রীকেও সময় দেওয়া উচিত তোমার। আমি আর কোন কথা শুনতে চাই না ইহান। আমি চাই তুমি ইচ্ছেকে নিয়ে দূরে কোথাও ঘুরে আস।’

ইহান এবার আর কোনো প্রতি উত্তর করলো না। চুপচাপ নিজের খাবার শেষ করে রুমে চলে গেল। নাজমুল সাহেবও নিজের খাবারের দিকে মনোনিবেশ করলেন।

-‘বৌমা তুমিও এবার খেয়ে নাও।’

-‘হ্যাঁ মা আপনিও বসুন।’

সবার খাওয়া শেষ হলে দুই শাশুড়ি বৌমা গল্প করতে করতে তাদের খাওয়া শেষ করে সবকিছু গুছিয়ে রাখে।

হাতের কাজ শেষ করে ইচ্ছে নিজের রুমের দিকে গেল। রুমে ঢুকতেই দেখল ইহান কোথাও বের হবার জন্য রেডি হচ্ছে।

-‘আপনি কোথাও যাচ্ছেন?’

কিছুটা জড়তা নিয়েই প্রশ্ন করে ইচ্ছে। ইহিন তার স্বভাবসুলভ গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দেয়

-‘হুহ।’

শুধুই হুহ? ইচ্ছের মন চাইছে ইহানকে জিজ্ঞেস করতেছে সে কোথায় যাচ্ছে কিন্তু সাহস পেল না। যদি ইহান রেগে যায়? কিন্তু তার কেন জানি খুব জানতে মন চাইছে। অবশেষে সকল জড়তা কাটিয়ে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে প্রশ্নটি করেই ফেলল।

-‘আপনি কোথায় যাচ্ছেন? না মানে আজতো আপনার অফিস নেই তাই আর কি।’

ইহান কিছুক্ষণ ইচ্ছের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কোন কথা ছাড়াই রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ইচ্ছে আবারো আহত হয়। কি হত একটু বলে গেলে?

চলবে…….

#আমার_আকাশে_তারা_নেই
#লাবিবা
সূচনা পর্ব

(গল্পটা কেমন হয়েছে বিস্তারিত জানিয়ে মন্তব্য করবেন। ধন্যবাদ ❤️)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here